গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদের অতন্ত্র প্রহরী বিএনপি

প্রফেসর ড. মো. মামুন অর রশিদ ।।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ববাংলায় গণহত্যা শুরু করার পর সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় প্রধান নেতার কাছ থেকে কোন দিক নির্দেশনা না থাকায় পাক বাহিনীর গণহত্যা ও প্রচন্ড নির্যাতনের মুখে জাতি যখন হতাশ ও বিভ্রান্ত, ঠিক তখনই আশার আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন সেদিনের মেজর জিয়াউর রহমান।

নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুকি উপেক্ষা করে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আহবান জানিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার। তাঁর সে ঘোষণা ও আহবান জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল। হতাশ ও বিভ্রান্তি কাটিয়ে জাতি যুদ্ধে নেমে পড়েছিল। জিয়াউর রহমান নিজেও যুদ্ধে নেমেছিলেন। জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার দুর্দান্ত সাহসী ভুমিকা ইতিহাসের গৌরবোজ্জল অধ্যায় হয়ে রয়েছে।

১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান মুক্ত হন। সাতই নভেম্বরকে গণমানুষের জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে আখ্যায়িত করেন। ১৯৭১ সালে এ দেশের সর্বস্তরের জনগণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। ওই যুদ্ধে ভারত সরকার, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় জনগণ আমাদের বিপুল সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। তাই তাদের প্রতি আমাদের খানিকটা দায়বদ্বতা ছিলো এবং আছে। কিন্তু জনগণ পাকিস্তানের মুঠো থেকে বেরিয়ে ভারতের জালে আটকাতে প্রস্তুত ছিল না। তারা চেয়েছিল সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু সে সময় যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসলেন- তারা এ ব্যাপারটি সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে আমাদের প্রতিবেশীদের কাছে কারণে-অকারণে আরো বেশি করে ধরা দিতে লাগলেন।

প্রথমে হলো ভারত- বাংলা ২৫ বছর চুক্তি- যা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। এদিকে পানি বন্টনের চুক্তি না করে ফরাক্কা বাঁধ চালু করতে দেয়া হলো। সেই যে চালু হলো আর তো বন্ধ হয় না। আমরা নিজেদের জালে আটকিয়ে গেলাম। বেরুবাড়ী ভারতকে দেয়া হলো- বিনিময়ে কিছুই পেলাম না আমরা। অসম বাণিজ্য চুক্তি হলো। চোরাচলানির ফলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হতে থাকলো। সাতই নভেম্বর মানুষের যে বিদ্রোহ তা এ সবেরই প্রতিক্রিয়া।
এ বিপ্লবের মাধ্যমে তারা চাইলেন একজন ব্যক্তি, যিনি স্বধীনতার ঘোষক, সৎ, দেশপ্রেমিক ও সাহসী তার উপর আস্থা রাখতে- যাতে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সত্যিকার অর্থে রক্ষিত হয়। এ অর্থেই এটি জাতীয় বিপ্লব। সেদিন যে বিপ্লব ঘটলো তার পিছনে ছিলো সেনাবাহিনীর সাধারণ সদস্য আর আমজনতা। একটি দেশের সেনাবাহিনী সে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিক। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনী স্বাধীনতা-উত্তর শাসকদের ভ্রান্তনীতির ফলে বিভক্ত হয়ে পরে অথচ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিলো একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনী। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহকারী সেনা সদস্যরা অপরের থেকে আলাদা একটি গ্রুপ, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগতরা আর এক গোষ্ঠী। উপরে আবার ছিল রক্ষীবাহিনী। একে অপরের সাথে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছিলেন তারা। এ রকম যখন অবস্থা- তখন ঘটলো ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ক্যুর ঘটনা। যার ফলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অংশ ক্ষমতারোহন করলেন।

আড়াই মাস পরে সংগঠিত হলো আর একটি পাল্টা ক্যু। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বরের এ ক্যু নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। তাদের মনে সন্দেহ জাগে এ কারণে যে, তখন কয়েকদিন ধরে সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের সুনির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। উপরন্ত বিভিন্ন ঘটনাদৃষ্টে এমন মনে হচ্ছিল যে খালেদ মোশাররফের ক্যু-তো আমাদের প্রতিবেশীদের প্ররোচনায় সংগঠিত হয়েছিল। অন্তত জনমনে এরুপ ধারণাই দানা বাধছিল। এসব ঘটনা পরস্পরারালে সেনাবাহিনী ভেঙ্গে পরে যা দেশের জন্য খুবই অমঙ্গলের বার্তাবহ ছিলো। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহীদের সাথে যোগ হয় সাধারণ জনগণও। সেনা সদস্য এবং জনগণের সংহতি যেমন সেনাবাহিনীর মনোবল ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে তেমনি তাদের এই ঐক্য দেশের স্বাধীনতা- সার্বোভৌমত্ব সংরক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তৎকালে দেশের এই পরিস্থিতে জিয়াউর রহমান চরম অস্থিতিশীল রাজনীতিকে স্থিতিশিল করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণভোটে আস্থা লাভ করেন। কিন্তু এরপরও সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা ব্যতিরেকে আপন সামর্থ ভিত্তি দৃঢ় করার তাগিদে বেসামরিক রাজনীতিবিদদের সমম্বয়ে দল গঠনের প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করেন।
এই উপলব্ধি থেকে জিয়াউর রহমান প্রথমে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি দল গঠন করেন। জাগদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার এবং এই কমিটির ১৬ জন সদস্যের ১০ জনই জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। এরপরই জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের মে মাসে জাগদল, ন্যাপ (মশিউর রহমান), মুসলিম লীগ, ইউপিপি, লেবার পার্টি ও তফশীল জাতি ফেডারেশনের সমন্বয়ে ’জাতীয়তাবাদী’ ফ্রন্ট নামে একটি ঐক্যজোট গঠন করেন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। নির্বাচনের পর ফ্রন্ট ভেঙ্গে নিজের নেতৃত্বে ০১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের মধ্যপন্থী রাজনীতি, রাজনৈতিব দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো, সেখানে দল হিসেবে বিএনপি এবং নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমান’র সৃষ্টিশীল উত্থান ছিলো সেই শূন্যতার পরিপূরক এবং একই সঙ্গে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে আরো আধুনিক। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন এই দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাণপুরুষ। আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিপরীতে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন দল মতের ব্যক্তিদের নিয়ে মূলত জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে এই দল গড়ে তুলেছিলেন। এই দলে ডানপন্থি ও বামপন্থিদের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।

পরবর্তীতে বিএনপি ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। বিএনপি গঠনের ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান দক্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবি শীর্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয় সাধনই দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি হতে পারে। তাই এটাকে দল সংগঠনের কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। এ কৌশলে সমাজের অনেক পেশাজীবী, দক্ষ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, ডাক্তার, লেখক, কবি বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। তবে তাঁর ব্যক্তি চরিত্র, দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা, পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নেবার গুণ, উদারতা এবং আন্তরিকতা ছিল তার নেতৃত্বের সফলতার মূলকারণ। বিএনপি গঠনের প্রাক্কালে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন:
১। রাজনীতির অনিবার্য প্রয়োজনীতা আছে এবং থাকবে।
২। বাকশাল গঠন এবং তার ভয়াবহ পতন প্রমাণ করেছে, এদেশে বাকশাল চলবে না। এদেশে বিরাট রাজনৈতিক শূন্যতা রয়েছে।
৩। রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করতে পারে একটি রাজনৈতিক চিন্তাধারা- যার মধ্যে
ক) স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকবে দৃঢ়ভাবে
খ) বহুদলীয় গণতন্ত্র হবে নিশ্চিত এবং
গ) উৎপাদন বন্টন সমাজকর্ম হবে রাজনীতির সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত।

রাজনৈতিক শূন্যতা তখন ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, উৎপাদন ও সমাজকর্ম সমন্বিত রাজনীতি দিতে পারে, এমন রাজনীতির জন্য দেশ ও জাতি তাকিয়ে ছিল অনেক আশা ভরসা নিয়ে। কেননা এগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা। এই মূল্যবোধ আওয়ামীলীগ বাকশালী সরকার সম্পূর্ন ধ্বংস করে গেছে ৭২-৭৫ শাসন আমলে। জাতীয় প্রয়োজনে, দারিদ্র দূরিকরণ ও সুন্দর জীবন যাপনের প্রতিশ্রুতিসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গিকার বাস্তবায়নে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ছিলো অবশ্যম্ভাবী। জিয়াউর রহমান সেই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনে বিএনপি গঠন করতে বাধ্য হলেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। জিয়াউর রহমান জানতেন এবং বুঝতেন দল গঠনের বিষয়টি শুধু ঘোষণা বা কিছু ন্যূনতম মাপকাঠির আলোকে। তিনি যে বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় রেখেছেন তা নিম্নরূপ:
ক) দলের আদর্শ ও লক্ষ্য হলো এদেশের মানুষকে একটা শোষণমুক্ত সমাজ উপহার দেয়া।
খ) এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীককে চিরস্থায়ী রাখতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন বাস্তবায়ন করা। এই দর্শনের মাধ্যমে দেশের পাহাড়, সমতল মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের মধ্যে, সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবি ও স্তরে গণঐক্য গড়ে তোলা ।
গ) দলের লক্ষ্যে পৌছানোর মৌলিক কর্মসূচি ১৯ দফা এদেশের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করেছে ।
ঘ) দলের কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যায়ে নির্বাচিত সংগঠনের নিশ্চয়তা, সমাজে পরিচিত একটি সৎ নেতৃত্ব তৈরি করা।

জিয়াউর রহমান বলেছেন- আমরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সকল দরজা খুলে দিয়েছি। খবরের কাগজে বিরোধী দলীয় যে যা করতে চাচ্ছে করছে। আমরা একটা জিনিস বুঝে ফেলেছি- বাংলাদেশের মানুষ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি গ্রহণ করেছে। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সকলকে বলতে দিতে হবে এবং এর মাধ্যেমে আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলে রাজনীতি কতটা উদার। আমাদের যে কর্মসূচি রয়েছে তা সবচেয়ে ভালো। এটাই বাংলাদেশের জন্য উত্তরণের একমাত্র পথ। চারদিকে পরিবর্তন আসছে। আগামী বছর প্রতি গ্রামে টেলিভিশন থাকবে। জনসংযোগে আরো উন্নতি হবে। মানুষের চোখ খুলে দিতে আমরা গ্রামে গ্রামে যাচ্ছি। বলছি, ভাইসব কতদিন ঘুমিয়ে থাকবেন? বিদ্রোহ করুন শোষণের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আমরা এসব না করলে আমাদের কাজ অসম্পূর্ন থেকে যাবে।

আরো একটা কথা- রাজনীতি ঠিক রাখতে হবে। রাজনীতি কোনো সময়েই দাড়িয়ে থাকে না। আমাদের কিছু মৌলিক বিষয় রয়েছে এগুলো ঠিক রেখে রাজনীতিকে সময়োপযোগী করতে হবে। নইলে রাজনীতিতে ফাটল ধরে যাবে। আর একটা জিনিস মনে রাখবেন- জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বহির্মুখী, অন্তর্মুখী নয়। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ঝর্ণার পানির মতো ছড়িয়ে পরতে হবে। রাজনীতি হলো একটা ইন্টারেকশন। রাজনীতির সবচেয়ে বড় বাহন হচ্ছে সংগঠন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যদি দুর্বল হয় তাহলে আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। যে দেশেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতি রয়েছে সেখানেই আক্রমন হয়েছে। যেমন এখন আমাদের উপর আঘাত আসছে। চাপ খেতে খেতে এক সময় শক্ত হয়ে যাব। আঘাত খাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আপনাদের শক্ত হতে হবে।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যদের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদাতবরণ করলে তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-তে অন্তঃকলহ প্রকট হয়। এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছিল সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেতা, যিনি শহিদ জিয়ার দেখানো পথে তার প্রবর্তিত আদর্শকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলকে পরিচালিত করতে পারবেন। নিভৃতচারিণী বেগম খালেদা জিয়াই ছিলেন সেই আইকনিক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বিএনপি নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।

১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। সেই থেকে তাঁঁর বিপ্লব ও সংগ্রামের সূচনা। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন এবং এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
১৯৮৩ সাল থেকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি রাজপথে জনতার কাতারে নেমে এসে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহ এরশাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগনকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। নব্বই দশকের সেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অনেকেই সমঝে চলার নীতি গ্রহণ করলেও বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কোন আপোস করেননি। এরফলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে আপোষহীন নেত্রী উপাধিতে ভূষিত করলেন।

একাধিকবার তিনি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের রোষাণলে পড়েন। তাকে মোট চারবার আটক করা হয়- ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর। ১৯৮৭ সালে হোটেল পূর্বাণী থেকে তাকে আটক করে আরো কয়েকজন নেতাসহ মতিঝিল থানায় নেয়া হয়। তবে সে সময় পুলিশ তাকে জেলে পাঠায় নি।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে এক প্রকার গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু তিনি দমে যান নি। সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য তিনি সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বারবার দীপ্তি ছড়িয়েছেন। অতঃপর দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ৯০ এর ছাত্র-জনতার প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। জনগনের মুক্তির জন্য আপোষহীন সংগ্রামী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগনের রায়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালে ১৯ মার্চ শপথ গ্রহণ করেন তিনি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি আরও দুইবার বিজয় লাভ করে। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি তৃতীয়বারের মত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করেন।
গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রাম আজ অবধি অব্যাহত আছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের মতোই অধিপত্যবাদী ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি বারবার তার উপর খড়গহস্ত হয়েছে। ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়েও তাকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়েছে। রাজনীতি থেকে তাকে মাইনাস করে দেয়ার নীল নকশা প্রস্তুত করেছিল এক-এগারোর অবৈধ সরকার।

নানারুপ হুমকি-ধমকি, প্রলোভন দেখিয়েও তাকে দেশছাড়া সম্ভব হয়নি। এদেশের মানুষের সাথেই তার ভাগ্যকে মিলিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে বৃদ্ধঅবস্থায় এসেও অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের মুক্তির পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী থাকতে হয়েছে। কিন্তু তিনি হার মানেনি, আধিপত্যবাদী শক্তির আগুনসদৃশ লালচোখের সামনে দাড়িয়ে তিনি গণতন্ত্রের, জাতীয় ঐক্যের, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন।
২০১৭ সালের বকশিবাজারের বিশেষ আদালতে কাঠগড়ায় দাড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এদেশের গতি প্রকৃতির সাথে আমার নাম লেখা হয়ে গিয়েছে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবরণের আগের দিন তিনি এক বার্তায় বলেন- কম বয়সে স্বামী হারিয়েছি, দেশের জন্য জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আরেকটি সন্তান দূরদেশে চিকিৎসাধীন। আমার স্বজনহীন জীবনে দেশবাসীই আমার স্বজন। আমি যেমন থাকি যেখানে থাকি, যতক্ষণ বেঁচে থাকবো দেশবাসীকে ছেড়ে যাবো না।
প্রকৃত অর্থেই তিনি এদেশের দেশপ্রেমিক আপামর জনতার আস্থা ও বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। ১৯৯১ সালে আধিপত্যবাদী শক্তির দোসরদের বিপরীতে সগর্বে মাথা উঁচু করে বেগম খালেদা জিয়া উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ওদের হাতে গোলামীর জিঞ্জির; আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা। এই ভয়হীন আত্নমর্যাদাবোধই তাকে রাজনীতির উচ্চাসনে আসীন করেছে।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে রাজনীতিতে আগমন ঘটে তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের। ১৯৮৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বগুড়ার গাবতলি উপজেলায় বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শুরু করেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অগ্রযাত্রা। ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনী প্রচারে তারেক রহমান বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট। তারপর থেকে তিনি শুরু করেন রাজনৈতিক অধ্যয়ন, চর্চা এবং উপলব্ধিকরণ। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের পিছনে তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল অসামান্য। এ নির্বাচনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ‘গবেষণা ও মনিটরিং ইউনিট’ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনী পরিচালনা সেল তাঁর নেতৃত্বেই আধুনিকতার স্পর্শে উজ্জীবিত ও ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে।
২০০২ সালে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারেক রহমান দলের সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের কর্মীদের সাথে ব্যাপক গণসংযোগ, প্রতিনিধি সম্মেলন, মাঠ পর্যায়ে দলীয় কর্মকান্ড তদারকি, বিশেষ করে দল পরিচালনায় একটি ‘আধুনিক সক্ষম ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সঙ্গে গড়ে তোলেন।

রাষ্ট্রীয় পদ পদবী উপেক্ষা করে তারেক রহমান দলকে সুসংগঠিত করার কাজে অল্প সময়ের মধ্যে তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বস্তরের দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আশা ও উৎসাহ সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি হয় অভাবনীয় কর্মতৎপরতা। দল হয়ে ওঠে সুসংগঠিত। জাতীয়তাবাদী আদর্শের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় নেতা কর্মীদের অদম্য উৎসাহে তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতেই প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থায় ২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশনে গণতান্ত্রিক পন্থায় সর্বসম্মতিক্রমে হন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। বর্তমানে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ##

তথ্যসূত্র: মুক্তবুলি ম্যাগাজিন, ৩১ তম সংখ্যা (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

ড. মো. মামুন অর রশিদ
প্রফেসর, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সমন্বয়ক, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, বরিশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *