আযাদ আলাউদ্দীন ।।
গবাদী প্রাণির বিকল্প খাদ্য আধুুনিক প্রযুক্তির ঘাষ ‘হে’ ব্যবহার করে লালভবান হচ্ছেন বরিশালের পশু খামারিরা। ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে, ফিড দ্যা ফিউচার বাংলাদেশ লাইস্টক অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্টিভিটি প্রকল্পের আওতায় বেসরকারি উন্নয়ণ সংস্থা এসিডিআই/ভোকা বরিশালে গবাদী প্রাণির উৎপাদনশীলতা এবং পুষ্টির মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বরিশালের তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিতায় খামারী পর্যায়ে বিভিন্ন রকমের কারিগরি সহযোগিতা প্রদানসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়, আধুনিক প্রযুক্তিতে হাতে কলমে ‘হে’ তৈরি পদ্ধতি সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে।
‘হে’ হলো সবুজ লিগুউমিনাস ঘাসকে শুকনা করে, এর পুষ্টিমান অক্ষুন্ন রেখে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ রাখার একটি পদ্ধতি। বরিশাল যেহেতু নদী বেষ্টিত এলাকা এবং বছরের কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ মাস এই এলাকার বেশিররভাগ জমিতে পানি জমে থাকে, তাই গবাদী প্রাণিকে সারা বছর ব্যাপি সবুজ ঘাসের যোগান দেয়া খামারীদের পক্ষে খুবই দুঃস্বাধ্য ব্যাপার। বরিশালের বেশিরভাগ কৃষক জমিতে বিভিন্ন ডাল (যেমন- মাস কালাই, মূগ ডাল, খেসারি ও সয়াবিন ইত্যাদি) চাষে অভ্যস্থ যা এই এলাকার মানুষের পুষ্টির একটি বড় অংশের যোগান দেয়। কৃষকেরা গাছ থেকে ডাল সংগহের পর ডালের উচ্ছিষ্ট অংশ জমিতে মিশিয়ে দেয় বা জ্বালানি হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহার করে। ডাল সংগ্রহের পরেও ডালের উচ্ছিষ্ট অংশে যে প্রোটিন থাকে এবং সেটা যে গবাদী প্রাণির জন্য উপকারী তা খামারিদের কাছে অজানা ছিল। এসিডিআই/ভোকার মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা খামারিদেরকে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানানোর পর তারা এর উপকারীতা বুঝতে পারে এবং আনুসঙ্গিক কারিগরি সহযোগিতা গ্রহণ করে ‘হে’ তৈরির দিকে ঝুঁকে পড়েন। বর্তমানে খামারী পর্যায়ে, মাসকালাই, খেশারী, মূগডাল, সোয়াবিন ও বাদাম গাছের উচ্ছিষ্ট দিয়ে এই অভিনব পদ্ধতিতে আপদকালীন সময়ের জন্য গরুর খাবার হিসেবে সংরক্ষণ করা শুরু হয়েছে।
লাইভস্টক অ্যান্ড নিউট্রিশন প্রকল্পের টিম লিডার ডা: মো: আব্দুস সালাম বলেন- লিগিউম, নন লিগিউম উভয় প্রকার ঘাস হতে ‘হে’ তৈরি করা যায়। তবে লিগিউম ঘাস যেমন- ডাল জাতীয় ঘাস দিয়ে ‘হে’ তৈরি করা উত্তম। লিগিউম ‘হে’ তে ধানের খড়ের তুলনায় প্রোটিন সহ অন্যান্য পুষ্টিমান বেশি থাকে। যখন মাঠে প্রচুর ঘাস উৎপাদন হয় তখন সেই ঘাস সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয় এবং যখন ঘাসের চরম অভাব দেখা যায় তখন খাওয়ালে খরচ কমে ও উৎপাদন বাড়ে।
এসিডিআই/ভোকা যে সকল খামারিকে এই কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করেছেন তাদের মধ্যে বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি ইউনিয়নের সটিখোল গ্রামের খামারি মো: জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নতুন টেকনোলজি হিসেবে ‘হে’ তৈরি করা খুবই ভালো পদক্ষেপ। গরু খুব ভালো খায় এবং এটি ব্যবহার করেও আমার খামারে গবাদী প্রাণির স্বাস্থ্য ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
অপরদিকে বাকেরগঞ্জ উপজেলার বলাইকাঠী গ্রামের খামারি মালেক শিকদার বলেন, ‘হে’র গুনাগুন শুনে যখন আমি ‘হে’ তৈরি করি তখন আমাকে অন্যান্য খামারিরা অনেক উপহাস করে কিন্তু আমি সেই সকল বাধা উপেক্ষা করে ৬০ বান্ডিল ‘হে’ তৈরি করি এবং বর্ষার মৌসুমে গাভীকে খাওয়াই। এর ফলস্বরূপ আমার গাভীর স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং এর পাশাপাশি খামারের দানাদার খাদ্য খরচও কমে যায়
একই ভাবে বরিশালের ডেইরি ফারমার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মো. মোনাসেফ হাওলাদার ফিরোজ (ফিরোজ ডেইরি ফার্মের সত্ত্বাধিকারী) বলেন, ‘অফ সিজনে যখন কাঁচা ঘাস থাকে না তখন আমরা এই প্রোটিন জাতীয় খাদ্য‘হে’ ব্যবহার করে দানাদার খাদ্যের খরচ কমিয়ে আনতে পারি এবং খামারকে লাভজনক করতে পারি। মোনাসেফ হাওলাদার ফিরোজ গত মৌসুমে ১.৫ একর জমিতে মাসকালাই চাষকরার পর ‘হে’ তৈরি করেও সংরক্ষণ করে রাখেন। তারপর যখন তার কাঁচা ঘাসের স্বল্পতা দেখা দেয় তখন ‘হে’ খাইয়ে গরুর স্বাস্থ্য ও দুধের উৎপাদন মাত্রা ঠিক রাখেন।
‘হে’ টেকনোলজি সম্পর্কে বরিশাল জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নুরুল আলম বলেন, বরিশালের প্রেক্ষিতে ‘হে’ টেকনোলজি একটি নতুন উদ্ভাবন। এতে খামারীদের দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভরশীলতা কমে যায় এবং খামার লাভজনক হয় বলে আমি বিশ্বাস করি। ঘাস যেহেতু সার বছর জমিতে রাখা যায় না কিন্তু এই টেকনোলজি ব্যবহার করে খামারিরা সারা বছরই গরুকে কাচা ঘাসের বিকল্প খাদ্য হিসেবে এটা যোগান দিতে পারে।
প্রকল্পের সিনিয়র মাঠ সমন্বয়কারী ডা: মো: রিদওয়ানুল হক বলেন, বর্তমান সময়ে খামার পরিচালনা করতে গেলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ টাকা খাদ্য খরচেই ব্যয় করতে হয়। খামারিরা তাদের উৎপাদিত ডালের উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে সহজেই ‘হে’ তৈরি করে খামারের ব্যয় কমাতে পারেন। ‘হে’ তৈরি করতে দামি কোন যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র একটি কাঠের তৈরি বেলিং বক্স এবং কিছু রশির প্রয়োজন হয়, যা অত্যন্ত সহজ লভ্য এবং পরিবেশ বান্ধব। বেলিং বক্স তৈরির পরিমাপ হল ২৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ১৬ ইঞ্চি প্রস্থ ১৩ ইঞ্চি উচ্চতা বা চওড়া।
এসিডিআই/ভোকা এর লাইভস্টক অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্টিভিটি প্রকল্পের মাঠ সমন্বয়কারী পলাশ কুমার জানান, বরিশাল অঞ্চলে প্রায় তিনশত পয়তাল্লিশ জন খামারিকে এখন পর্যন্ত এই ‘হে’ পদ্ধতির সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এই সকল খামারী গবাদী প্রাণির বিকল্প খাদ্য হিসাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে খাদ্য সংরক্ষণ করছেন এবং বছরব্যাপি তারা তাদের গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন। এর পাশাপাশি তারা অনান্য খামারীদেরকেও এটি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছেন যার ফলে খামারগুলো আরও লাভজনক হচ্ছে এবং টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ছে।