মাহমুদ ইউসুফ
এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
কত আনন্দ বেদনায়, মিলন ও বিরহ সংকটে ॥
এমনি অসংখ্যা জনপ্রিয় গানের গীতিকার ও সুরকার অধ্যাপকআবু জাফর। তিনি একাধারে একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি সর্বশেষ কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ২০০০ সালে অবসর গ্রহণ করেন সরকারি চাকরি থেকে। তিনি রাজশাহী ও ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত সঙ্গীত শিল্পী এবং গীতিকার ছিলেন। তার দেশত্ববোধক গান ও আধুনিক গান বিভিন্ন মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে, নতুন রাত্রি পুরনো দিন (কাব্য), বাজারে দূর্ণাম তবু তুমিই সর্বস্ব (কাব্য), বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত কবিতা (অনুবাদ কাব্য), মহানবীর মহাজীবন, তুমি পথ প্রিয়তম নবী তুমিই পাথেয়, আল্লামা ইকবাল: কবি ও নকীব, আমি অন্ধকার থেকে বলছি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইসলাম ও আত্মঘাতী মুসলিম, ইসলামের শত্রুমিত্র, অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা তাঁর বাঁকফেরার স্মারক। এসব বইয়ে তাঁর আদর্শিক বিস্তৃতি পরিস্ফুটিত। তাঁর মানস পরিচয় জানতে এসব গ্রন্থ অবলম্বন।
বর্তমানে তিনি সুরের জগত, সঙ্গীতের জগত, সংস্কৃতির জগত ছেড়ে অহির প্রতি অনুরক্ত। অহির কিতাব কুরআনের নিগঢ়ে বন্দী তিনি। ভোগবাদী সংস্কৃতি মায়ার বাঁধন তাঁকে আটকাতে ব্যর্থ হয়। নারী ও প্রকৃতি বন্দনা ছেড়ে রবের গুণগানে বিভোর। বদলে গেছে জীবন, বদলে গেছে চরিত্র, বদলে গেছে চিন্তাচেতনা, বদলে গেছে কর্মকান্ড, বদলে গেছে কর্মক্ষেত্র। জীবন জাহানের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পড়ন্ত বেলায় বিভোর আছেন মৃত্যু পরবর্তী অনাগত দিনের ভাবনায়। যাপিত জীবনও সেভাবেই সুরভিত।
বাংলা আধুনিক সংগীত ভূবনে তাঁর আবির্ভাব ধুমকেতুর মতোই। প্রস্থানও একইভাবে। অসম্ভব সৃজনশীল এ শিল্পী বাংলা সংগীতে অভাবনীয় সব সংগীত সৃষ্টি করেছেন। লোকধারার সাথে আধুনিক সুর ও দুর্দান্ত সব শিল্পিত ভাবনার সম্মিলন এ সংগীতগুলোতে। শিল্পী ফরিদা পারভীন গানগুলো গেয়েছেন তাঁর সুর ও বাণীর সাথে আত্মার সংযোগ ঘটিয়ে। ‘অধ্যাপক আবু জাফর বাংলাদেশের সঙ্গীতের একদা বিশেষ মনোযোগের পাত্র ছিলেন। কিন্তু সেই মায়াবী কুহক থেকে এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। আবু জাফরের সকল প্রেম ও মনোযোগ, সকল চিন্তা, আনুগত্য ও অনুরাগ এখন একমাত্র দীনের প্রতি নিবদ্ধ। যদিও অনেক জাগতিক সীমাবদ্ধতা ও ক্লেশ এবং দুঃখ তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু দীনের কাছে অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণ নিয়ে তিনি এখন সুখী ও পরিতৃপ্ত। তাঁর নিজের বিশ্বাস, তথাকথিত সংস্কৃতি চর্চায় নিমগ্ন এক অন্ধকার বিবরবাসী মূষিক থেকে তিনি পরিবর্তিত হয়েছেন ইসলামের শাশ্বত নূরে স্বর্ণাভ ডানার এক সোনালী বিহঙ্গে। তাঁর এই রূপান্তর ও নবজন্ম আসলেই খাঁটি, অমোঘ ও দুর্নিবার। [দ্বিতীয় ফ্লাপ, ইসলামের শত্রু মিত্র]
বর্তমান বিশ্বের মানবাধিকার ও মানবতাবোধের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এর কারণ অনুসন্ধানে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। আবু জাফর বলেছেন, ‘শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই মুসলমানদের উপর যে নিগৃহ চলছে এবং মুসলমানরা যে একেবারে লাঞ্ছিত নিপীড়িত অবস্থায় পৌঁছে গেছে তার একটা কারণ তো নিশ্চয়ই আছে, অনেক কারণ আছে। তবে এর প্রধান দুটি কারণ হলো, আল্লাহ দুটো জিনিসকে খুব পছন্দ করেন। একটা হলো ঐক্যবদ্ধতা আর অন্যটি হলো জিহাদের তামান্না। যে মুসলিম জাতির মধ্য থেকে এই দুটো জিনিস উধাও হয়ে যায়, এই দুটো জিনিস থাকে না, ওই মুসলিম জাতির ললাটে নিগৃহ, লাঞ্ছনা এগুলো খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠে। সেজন্য, সারা পৃথিবীর মুসলমানের মধ্যে অনেক গুণাবলি আছে, কত যে ইবাদত-বন্দেগি আছে, তার কোনো শেষ নেই। কিন্তু এই দুটো গুণ ঐক্যবদ্ধতা ও শাহাদাতের কোনো তামান্না নেই। আর যদি তা না থাকে তাহলে ওই জাতি নিগৃহীত হবে, নিস্পেষিত হবে। এটাই সত্য।’ [২০০০ সালে জাতীয় নাগরিক ফোরামের উদ্বোধনী সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ] এখানেই তাঁর মানসভূমি চিত্রিত। জাতীয় জীবনের যাত্রিক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে তিনি সুপথের দিকে ফিরে আসার আহবান জানান বিপথগামীদের। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম বিশ্ব থেকে নিঃশেষ করে দিয়েছে মানবতাবোধ। এই ভয়ঙ্কর ড্রাগন সম্পর্কে আবু জাফর লিখেছেন, ‘বর্তমান সময়ে আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রত্যক্ষ করি, সে হলো আবু জেহেলদের ধর্মনিরপেক্ষতা; যার সাথে সত্য, সততা ও ইনসাফের কোন সম্পর্কই নেই; যার আপতশোভন মুখোশের আড়ালে ক্রূরহাসি নিয়ে বিরাজ করছে মুসলমানদের ঈমান ও আকীদা-বিধ্বংসী এক দানবীয় কুৎসিত মুখাবয়ব। [আবু জাফর: অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা, পৃষ্ঠা ১৭২] তিনি আরও জানান, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা হলো- Green Snake in Green Grass অর্থাৎ সবুজ ঘাসে হরিৎবর্ণ বিষধর সরিসৃপ। আর এই সরিসৃপটির কাজই হলো যেকোনো উপায়ে ইসলাম ও মুসলমানকে দংশন করা।’ [আবু জাফর: অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা, পৃষ্ঠা ১৬৯]
.
তথ্যসূত্র
১. ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান, অধ্যাপক আবু জাফর : নারী ও প্রকৃতির বন্দনার কুহক থেকে মুক্তি, দৈনিক সংগ্রাম, ১০ মার্চ ২০১৭
২. বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক আবু জাফর, দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ মার্চ ২০১৯
৩. জাতীয় নাগরিক ফোরামের উদ্বোধনী সম্মেলন স্মারক, অক্টোবর ২০০০
৪. আবু জাফর, অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা, আরআইএস পাবলিকেশন্স, কাটাবন বুক কর্নার, ঢাকা, এপ্রিল ২০০৫
৫. https://mashiurmithu.wordpress.com/2016/10/15
আল্লাহর সৃষ্ষট বস্তু এবং বাণীই বিজ্ঞান । মানব শিল্প কলার অধ্যাপক আবু জাফর শেষপর্যন্ত তাঁহাই পাথেয় করলেন ! ফিআমানিল্লাহ