আযাদ আলাউদ্দীন ।।
বরিশাল তথা সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে শিক্ষাবিস্তারের বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছেন ভোলার লালমোহনের কৃতিসন্তান অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ। আপদমস্তক একজন শিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল ইসলামিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ছিলেন।
এছাড়াও তিনি যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সাবেক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
একইসাথে তিনি বরিশাল বিভাগে গড়ে তুলেছেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। সংগ্রামী এই শিক্ষক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
২০০৮ সালে যখন দলীয় প্রতীকে সিটি ও পৌর নির্বাচন হতোনা- তখন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নাগরিক পরিষদের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট শওকত হোসেন হিরণের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক ছিলেন অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ। শওকত হোসেন হিরণের বিজয়ের নেপথ্য নায়ক ছিলেন তিনি।
প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার ধলিগৌড়নগর ইউনিয়নের চতলা গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা- মুন্সী মকবুল আহমেদ, মা- ফাতেমা বেগম। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারেই সম্পন্ন করেন। চতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণিতে ভর্তি এবং সেখান থেকে প্রাথমিকের পাঠ শেষ করেন। লালমোহন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫০ সনের ৪ নভেম্বর ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন সরকারি ব্রজমোহন কলেজে।
বিএম কলেজ থেকে তিন তিনটি বৃত্তি নিয়ে ১৯৫২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৫৪ সালে স্নাতক কোর্স সম্পন্ন করেন। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হওয়ার কারণে প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত বৃত্তি লাভ করেন। এরপরে ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করেন। নিজের পড়াশোনার ব্যয়ভার নিজেই বহন করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী মোহাম্মদ হানিফ। তার ভেতরে বিএম কলেজের শিক্ষক হওয়ার অদম্য স্বপ্ন ছিল। অবশেষে স্বপ্নপুরণ। ১৯৫৮ সনের আগস্ট মাসে সরকারি ব্রজমোহন কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক, হিসেবে যোগদান করেন।
যেহেতু প্রান্তিক পরিবারে জন্ম, অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যেও নিজের লেখাপড়া ছাড়াও পিতা-মাতাকে সহযোগিতা করেছেন। ১৯৫৯ সনে পিএইচডি স্কলারশিপ, ১৯৬১ সনের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ, ১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডে স্কলারশিপ, ১৯৭৮ সনের কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েও যাওয়া হয়নি পরিবারের প্রেক্ষাপট, বরিশাল এবং বিএম কলেজ ও হাতেম আলী কলেজের ভালোবাসার টানে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপে না য়াওয়ার কারণে শোকজও হয়েছে।
১৯৬১-৬৩ সনে লাহোরে সিভিল সার্ভিস একাডেমির ফাইন্যান্স সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। ডেপুটেশন শেষে আবার বিএম কলেজে ফিরে এসেছেন। তৎকালীন অধ্যক্ষ মেজবাহুল বার চৌধুরীর উদ্যোগে ব্রজমোহন কলেজে চালু করা হয় অর্থনীতি বিষয়ে সম্মান কোর্স। অধ্যক্ষের অনুরোধে আবার বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স বিভাগ পুনর্গঠনের দায়িত্ব পালন করেন। প্রফেসর মােহাম্মদ হানিফ ১৯৫৮ সনে বিএম কলেজে যোগদান করে অর্থনীতি বিষয়ের প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান ও শেষে কলেজ অধ্যক্ষ হিসেবে বর্ণাঢ্য পেশাগত জীবন অতিবাহিত করেন।
বিএম কলেজের অর্থনীতি বিভাগে কর্মরত থাকাকালীন ডেপুটেশনে স্যার ৩০. ০৪. ১৯৭৩ খ্রি: থেকে ৩১. ১২. ১৯৮৪ খ্রি: পর্যন্ত তৎকালীন বেসরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ ও বরিশালের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ০৮. ১২. ১৯৮৮ থেকে ৩০. ১২. ১৯৯২ পর্যন্ত বিএম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিএম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে তিনি কলেজের শিক্ষা ও অবকাঠামোর আমূল পরিবর্তন আনেন। তিনি মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের সত্য-প্রেম-পবিত্রতার মূল আদর্শকে ধারণ ও লালন করার প্রয়াস চালান। বরিশালকে ভালোবেসে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানসহ অনেক লোভনীয় পদ ও পদবীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন হানিফ স্যার। সরকারি চাকুরি থেকে অবসরের পরে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত বরিশাল ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বরিশাল ছিলো হানিফ স্যারের স্বপ্ন ও ভালোবাসার আবাসভূমি।
প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন রোডের ‘বিমলাধাম’ নামক বাড়িতে পরিবারসহ বসবাস করতেন। তিনি ২০২১ সালের ১ লা মার্চ, (১৬ই ফাল্গুন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ) সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য জটিলতায় ঢাকাস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২ মার্চ তাঁর প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্রজমোহন কলেজের মূল ভবনের মাঠে জানাজা শেষে বরিশাল মুসলিম গোরস্তানে দাফন করা হয়। স্যারের সহধর্মিণী মিসেস রওশন আকতার জাহান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। প্রফেসর মোহাম্দ হানিফের চার ছেলে পারভেজ হানিফ- বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তা, সোহেল আহম্মেদ- ব্যবসায়ী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সাব্বির- বরিশালস্থ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এ টেলিকমিউনিকেশন বিষয়ের শিক্ষক, আবু মোহাম্মদ ফয়সাল মাসুক- মেঘনা গ্রুপের কর্মকর্তা এবং দুই মেয়ে যডথাক্রমে মিসেস হানিফ পারভীন লিনা- জীবন বিমা কর্পোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং নাহিদ ইসলাম- গৃহিনী।
মৃত্যুকালে প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ বরিশাল সাহেবেরহাট শহীদ জিয়াউর রহমান কলেজ, বাকেরগঞ্জ রাণিরহাট বেগম শামসুদ্দীন তালুকদার ডিগ্রি কলেজ, এবং বরিশাল গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট-এর ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি জন্মস্থান লালমোহন, ভোলা এবং বরিশালে নিজ হাতে পরম মমতায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎসাহী সদস্য ছিলেন।
বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় হানিফ স্যারের নিরলস নেতৃত্ব ও ভূমিকা বরিশালবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তিনি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড ও ২০১১-২০১৫ মেয়াদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। আমৃত্যু প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িকতা চর্চা, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও শিক্ষা সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন আমাদের চিন্তা, মনন ও প্রত্যয়ের বাতিঘর। প্রাকৃতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় অভিষিক্ত মেধাবী শিক্ষক প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ শিক্ষকদের শিক্ষক, অধ্যক্ষের অধ্যক্ষ- সর্বোপরি শিক্ষার বাতিঘর ছিলেন তিনি। ##
আযাদ আলাউদ্দীন
বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়া দিগন্ত
প্রকাশক ও সম্পাদক, মুক্তবুলি।
০১৭১২১৮৯৩৩৮