দক্ষিণাঞ্চলে হাজারো মানুষ গড়ার কারিগর আ.খা.মো. আবদুর রব

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

বরিশাল তথা পুরো দক্ষিণাঞ্চলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে সমধিক পরিচিত অধ্যক্ষ আ খা মো আবদুর রব। একাধারে তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, ব্যাকরণবিদ ও সুসাহিত্যিক। সব কিছুকে ছাপিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। বরিশাল অঞ্চলের হাজারো শিক্ষকেরও শিক্ষক তিনি। পরম মমতা আর আন্তরিক স্নেহ দিয়ে বরিশাল অঞ্চলে তৈরি করেছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী, যারা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বরিশাল বিভাগের ৫ সহস্রাধিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার বাংলা শিক্ষকের ৮০ ভাগই আ খা মো আবদুর রব স্যারের ছাত্র। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলে বাংলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে ‘রব স্যার’ অতি পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় নাম। ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৮ সালে বরিশাল বিভাগের শ্রেষ্ঠ কলেজ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন তিনি। বর্তমানে বাংলা ভাষা সমিতির বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি, বরিশাল মেট্রোপলিটন কলেজ ও সরকারি ব্রজমোহন কলেজ বাংলা বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আ.খা.মো আবদুর রব স্যারের ছাত্র ও বরিশাল নগরীর অমৃত লাল দে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তপংকর চক্রবর্তী বলেন, ‘রব স্যারের মতো নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক ও সাদা মনের মানুষ দ্বিতীয় কেউ আছেন বলে আমার জানা নেই; তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য শুধু বরিশাল অঞ্চলই নয়, সমগ্র বাংলাদেশেও বিরল। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, স্যার আমাদেরকে ক্লাসে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে শিক্ষা দিতেন, ক্লাসের বাইরেও আমরা দিনের অনেকটা সময় স্যারের বাসায় কাটাতাম, স্যার সযত্নে আমাদেরকে তার বাসায় খাওয়াতেন ও প্রাইভেট পড়াতেন, কিন্তু কোনো পয়সা নিতেন না। এ যুগে এমন শিক্ষক কি আর আছে?’

বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি ও নিউ এজ পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ‘সত্তরের দশকে আমি যখন বিএম কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ি, তখন থেকেই রব স্যারকে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর তার যে পাণ্ডিত্য তার সমতুল্য এখন আর কেউ নেই, তিনি একজন প্রকৃত সাদা মনের মানুষ, এ ধরনের শিক্ষকেরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নিভৃতেই কাজ করে যান দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য। এমন শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত।’

বরিশাল বিএম কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর জাহান আরা বেগম বলেন, রব স্যার আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষক। আমি ছাত্রাবস্থায় বাংলা বিভাগে তাঁর কাছে পড়েছি, তাঁর ছাত্রী থেকে পর্যায়ক্রমে একই বিভাগের চেয়ারম্যানও হয়েছি। কিন্তু তাকে অতিক্রম করার দুঃসাধ্য নেই কারো, কারণ তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চলমান ডিকশনারি।

বাদলপাড়া ডিগ্রি কলেজের বাংলা প্রভাষক আরিফুর রহমান বিশ্বাস বলেন, আপনি বরিশাল বিভাগের যেকোনো স্কুল, কলেজ বা মাদরাসায় গিয়ে বাংলার শিক্ষক খুঁজবেন, দেখবেন ওই বাংলা শিক্ষক কোনো না কোনোভাবে রব স্যারের ছাত্র বা তাঁর ছাত্রের ছাত্র। অথবা রব স্যারের লেখা ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ তিনি ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে পড়াচ্ছেন। এক কথায় বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের প্রিয় নাম ‘আবদুর রব স্যার’।

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার আবদুল জব্বার কলেজের বাংলা প্রভাষক মো. আবদুল আউয়াল বলেন, রব স্যার বরিশাল অঞ্চলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন আদর্শ শিক্ষক। আমরা ছাত্রাবস্থায় তাঁর কাছে পড়াশোনার কোনো বিষয় নিয়ে গেলে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে তা আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতেন, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ানোতেই ছিল তার আনন্দ।

২০১৩ সালের বইমেলায় রাজধানী ঢাকার জয় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আ.খা.মো আবদুর রব অনূদিত গল্পগ্রন্থ ‘প্রথম পাপ’। এই বইয়ের প্রসঙ্গ কথায় তিনি লিখেছেন, ‘অবশেষে উর্দু থেকে অনূদিত ভারত ও পাকিস্তানের প্রথিতযশা নয়জন লেখকের দশটি গল্প গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো। গ্রন্থের সাতটি গল্প ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সেই ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থেকে লেখা। গল্পগুলো সে সময়কার মাসিক সওগাত ও মাসিক পূবালী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, শেষ তিনটি গল্প বর্তমান সময়ের অনুবাদ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক ড. আহমদ শরীফের সরাসরি ছাত্র ও ড. হুমায়ুন আজাদের সহপাঠী আ খা মো আবদুর রব বর্তমানে বরিশাল নগরীর বৈদ্যপাড়ায় নিজ বাড়ি ‘রৌশনী’তে অবসর জীবনযাপন করছেন। মুক্তবুলি’র সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সারা জীবন শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে গেছি, জীবনে কী পেয়েছি সেটা ভাবিনি, এখনো ভাবছি সমাজের জন্য, জাতির জন্য কী করতে পেরেছি’। যখন দেখি আমার ছাত্ররা শিক্ষা-দীক্ষায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তখন মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : আ খা মো আবদুর রবের জন্ম ১ ডিসেম্বর ১৯৪২। গ্রাম : দক্ষিণ হোসনাবাদ, উপজেলা : বেতাগী, জিলা : বরগুনা। তাঁর বাবা এ অঞ্চলের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মরহুম আলহাজ মাওলানা মুহম্মদ হাসান। মা মোসাম্মৎ নুরুননেসা। প্রাথমিক লেখাপড়া বাবার কাছে এবং গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

দক্ষিণ বাংলার বিখ্যাত অলি-এ কামেল মরহুম আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ হাসান উদ্দিন সাহেব প্রতিষ্ঠিত করুণা মোকামিয়া আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৫৩, ১৯৫৭ ও ১৯৫৯ সালে যথাক্রমে দাখিল, আলিম ও ফাজিল পরীক্ষায় বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগ নিয়ে পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা মাদাসায়-ই-আলিয়া থেকে কামিল (হাদিস) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে ৫ম স্থান অর্জন করেন। অতঃপর বেতাগী হাইস্কুল থেকে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ ও ১৯৬৪ সালে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে ১৯৬৭ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৬৮ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় যথাক্রমে ১০ম ও ৭ম স্থানসহ দ্বিতীয় শ্রেণি অর্জন করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনান্তে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ। ১৯৬৯ সালের আগস্টে বাগেরহাট পিসি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখান থেকে জানুয়ারি ১৯৭১-এ  বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের বাংলাবিভাগে যোগদান এবং সেখানে পর্যায়ক্রমে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানসহ বিভিন্ন পদে দীর্ঘ প্রায় ৩৯ বছর শিক্ষকতা করার পর ডিসেম্বর ১৯৯৯-এ অবসর গ্রহণ করেন।

মাঝে ১৯৮৭-৮৮ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও ১৯৯২ সালে স্বল্প সময়ের জন্য চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজে উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকরির অবসরের পর জুলাই ২০০০ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত বরিশাল শহরের এ. করিম আইডিয়াল কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর অনারারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বরিশাল অমৃতলাল দে কলেজে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি যেমন সুপরিচিত, দক্ষ ও নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক হিসেবেও তেমনি সর্বজন নন্দিত। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৮ সালে বরিশাল বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ কলেজ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।

সাধারণ শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষা এই উভয় ধারার শিক্ষায় সমৃদ্ধ বিধায় তিনি একাধিক বিদেশি ভাষা শেখার সুযোগ পান। বিশেষ করে উর্দু, ইংরেজি, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষা। ছাত্রাবস্থা থেকেই তার লেখালেখি শুরু। গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি অনুবাদমূলক রচনায়ও তিনি সমান দক্ষ।

বিশেষ করে উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদে তিনি অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সম্প্রতি তিনি ‘দো ইসলাম’ নামে বিখ্যাত একটি উর্দু গ্রন্থের অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন, সেটি এখন প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। ধ্বনিবিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্ব তাঁর অধ্যয়নের দু’টি প্রিয় বিষয়। কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন ও কল্যাণ ফোরাম বরিশালের সভাপতি এবং এই সংগঠনের নিয়মিত প্রকাশনা ‘আন্ নূর’ সম্পাদনের সাথেও যুক্ত রয়েছেন তিনি। বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে বরিশাল শহরের বৈদ্যপাড়ায় বসবাস করছেন সবার প্রিয় শিক্ষক আ. খা. মো আবদুর রব।

১৪ জুলাই ২০২৩, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ বাংলাবিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিদ আ. খা. মো আবদুর রবকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।

##

আযাদ আলাউদ্দীন চেয়ারম্যান, বরিশাল মেট্রোপলিটন কলেজ, ০১৭১২১৮৯৩৩৮

৩ comments

  1. আমার বিএম কলেজের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আখাম আবদুর রব স্যারের সাথে অন্য কোন স্যারদের তুলনা হয় না। এককথায় অতুলনীয় ও একজন সাদা মনের মানুষ।
    তার জন্য মহান আল্লাহর নিকট সুস্থতা ও হায়াতে তৈয়্যবা কামনা করছি।

  2. অামি রব স্যারের গুনমুগ্ধ একজন ছাত্র।
    অামি মোঃ নুরুদ্দিন, দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর যাবত বাংলা বিভাগ এর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছি এবং বর্তমানে সিংগাইর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করছি। অামি স্যারের দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।অার, বরিশাল বিএম কলেজের সত্য সুন্দর পবিত্রতার পাদপীঠ অামাদের আচেতনায় অমলিন হয়ে থাকবে!!Md

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *