দিনগুলি মোর স্মৃতির পাতায়

বেগম শামসুন্নাহার
.

বরিশাল মহিলা মহাবিদ্যালয় এর ২৫ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে রজত জয়ন্তী উৎসব। আমন্ত্রণ পেলাম কিছু লেখার জন্য। যদিও লেখা আমার আসেনা তবুও কেন যেন এই মহতী উৎসবের অঙ্গনে কিছু দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। জীবন সমুদ্রের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আজ অতীতের ফেলে আসা আনন্দঘন কয়েকটি দিনের স্মৃতি যেন বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে।

১৯৫৭ সালের সেই ছোট্ট কিশলয়টির কথা মনে পড়ে, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাংলার অক্সফোর্ডের জনাকয়েক মালি। আর সেই ছোট্ট চারা গাছটির স্নেহছায়ায় জীবনের দুটি বছর কাটিয়ে ধন্য হয়েছি আমি, আমার মত আরো ক’একজনা। সেদিনের সেই কিশলয় আজ ফুলে ফলে ভরে ওঠা এক বিরাট মহীরূহ, দূর থেকে ডাকছে আমায়।
সাতান্ন থেকে বিরাশি, সুদীর্ঘ ২৫ বছর আগে শুভ বাসন্তী কোন লগ্ন বরিশালের নারী সমাজের কাছে বয়ে নিয়ে এসেছিল মহিলা মহাবিদ্যালয় স্থাপনের এক নতুন সওগাত। এই মহাবিদ্যালয় বিশেষ করে রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের কাছে খুলে দিয়েছিল এক নব দিগন্ত। এককালের বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে হাতে খড়ি নেবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম আমি। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে আমার জীবনের শৈশবের দিনগুলি কেটে ছিল সেখানে। আমার স্বপ্ন -সাধ ছিল মানবজীবনের তরুমূলে বসে জল ঢালার। কিন্তু তখনকার দিনের অন্য দশটি মুসলিম পরিবারের মতো আমার স্বপ্ন সাধ যখন প্রায় বিলুপ্তির পথে, তখনই আমি পেয়েছিলাম এই শুভসংবাদ, যা আমার জীবনের গতিধারাকে সুদীর্ঘ দশটি বছর পরে আবারও সচল করে দিয়েছিল। ১৯৪৯ সনে ম্যাট্রিক পাশ করার পর অন্য দশটি মুসলিম পরিবারের মতো স্বামী পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত সংসার সমুদ্রের অকূলপাথারে পাড়ি জমাবার মস্কো করে চলছিলাম আমি। আমার জীবনের এই গতানুগতিক গতিধারায় পরিবর্তন এনেছিল মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংবাদ।
বরিশাল সদর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নাতি- প্রশস্ত একটি কক্ষে মাত্র ২৫ টি মেয়ে নিয়ে আরম্ভ হলো আমাদের মহা বিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি। সেদিনটিতে আমাদের বরণ করার জন্য হয়নি কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। ছিলাম শুধু বৃহত্তর জগৎ ও জীবনের সাথে পরিচিত হওয়ার প্রত্যাশী জনাকয়েক মেয়ে। সহপাঠিনীদের কাছে আমি ‘ভাবী’। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ক্লাস করতাম আমরা। আমাদের অধ্যক্ষ ছিলেন মিসেস মনোরমা গুহ। শান্ত, সৌম্য, ধীর ,গম্ভীর প্রকৃতির মনোরমাদি আমাদের বাংলা ক্লাস করাতেন। ইংরেজি ক্লাস নিতেন ডি,এন,সি স্যার । ক্লাস করতে করতে মাঝে মাঝে নাটক করে ফেলতেন তিনি। একদিন Briefness Barrister কথাটি বোঝাতে গিয়ে যেভাবে অঙ্গভঙ্গি করলেন, তা আজও মনে পড়লেই হেসে উঠি। গভীর আত্মপ্রত্যয় সম্পন্ন এই ব্যক্তিটিকে আজও মনে হলে শ্রদ্ধায় আপনি নিয়ে পড়ি। আর D.K.B (দেবেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জি) স্যারের Diminishing Return, Economics ক্লাসের সেই Elasticity of Demand, কত রকমের কত humor -এর মধ্য দিয়ে বোঝাতেন আর বলতেন, `ছেলেরা তো রসগোল্লা দিয়ে বোঝালে ভালো বোঝে, তোমরা কি দিয়ে বোঝালে বুঝবে তাই বল’। হ্যা, তখনকার দিনে আমাদের শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি । Civics ও Economics মিলিয়ে ছিল একখানা বই। সিরাজুল হক স্যারের লেখা সেই মস্ত বড় মোটা বইটি কথা মনে হলে আজ ও ভীতির সঞ্চার করে। D.K.B (দেব কুমার বোস) স্যার দুটো বিষয়ই একা চালিয়ে যেতেন। জ্ঞানবৃদ্ধ N.K.B স্যার পড়াতেন General History। কথা খুব কমই বলতেন তিনি। দৃঢ় আত্মনির্ভরশীল, সদা হাস্যোজ্জ্বল সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি আয়ূব আলী স্যার–যিনি এখন এই মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ পদ অলংকৃত করে আছেন। তিনি ছিলেন Islamic History এর দায়িত্বে। ছিলেন K.G.K (কাজি গোলাম কাদের) স্যার। গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্হিরভাবে বোঝাতেন তর্কশাস্ত্র। Deductive, Inductive দুটো বিষয়ই দেখতে হত তাঁকে।
এঁরা সবাই ছিলেন ব্রজমোহন মহাবিদ্যালয় প্রভাষক । সকালের অবসর সময়টুকু তাঁরা কাটাতেন আমাদের নিয়ে । এজন্য তাঁরা কোন বেতন নিতেন না । কলেজ থেকে যৎসামান্য হাত খরচা বাবদ তাঁদের দেয়া হতো । এই সঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, আমরা সবাই কিন্তু ছিলাম অবৈতনিক । আমাদের একজন কারনিকও ছিলেন কচি আপা। বেলা দশটার পর সদর বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস আরম্ভ হওয়ার ঘন্টা বাজার কিছু আগেভাগেই আমাদের ছুটির ঘন্টা বাজত। যদি কোনদিন কোন বিষয়ে অনুষ্ঠান করতাম তাহলে তাই স্কুলেরড্রিল শেডেই হত । বিদ্যোৎসাহী প্রধান শিক্ষিকা শান্তি গুহের সহিষ্ণুতা ও বদান্যতায় এইভাবে আমাদের প্রায় একটি বছর কেটেছে সদর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।
পর বছর আমরা পেলাম বর্তমান মহিলা মহাবিদ্যালয় এর অফিস কক্ষের দালানটি । একান্ত আপন করে পাওয়া এই মহাবিদ্যালয়ের দোতালায় ক্লাস আরম্ভ করলাম আমরা। মিলাদ পড়ে শুকরিয়া আদায় করলাম মহান আল্লাহর দরগায় । কৃতজ্ঞতা জানালাম সেইসব মহান ব্যক্তিদের, যাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় বরিশালের বুকে প্রতিষ্ঠিত হল নারী মুক্তির প্রথম সোপানটি। ইতোমধ্যে আমাদের মহাবিদ্যালয়ের আরো অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়েছে । স্যারদের মধ্য থেকে অনেকে চলে গেছেন, পেয়েছি নতুন নতুন স্যার ও আপাদের। মনোরমা দির পরিবর্তে পেলাম নুরুন্নাহার আপাকে। D.N.Cস্যারের স্যারের স্হলে পেলাম আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয়া মরহুমা রওশন আপাকে। রওশন আপা সত্যিই রওশনছিলেন । বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পেরিয়েসদ্য আগত দৃঢ় আত্মনির্ভরশীল ছোটখাটো সদাহাস্যময়ী রওশন আপারসেই হাসিমাখা মুখ খানি আজও ভাসে আমার চোখে । আমাকে তিনি নাম ধরে ডাকেন নি কোনোদিন । ডাকতেন ‘ভাবি’ বলে । ইতিহাসের দায়িত্বে আসেন ফজলুল হক স্যার। আর Economics-এ আসলেন মিস পারভীন আপা।
মুক্ত মাঠের একপাশে মেয়েদের হোস্টেল, অন্যদিকে আমাদের ক্লাস কক্ষ। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা সেদিনের সেই মহাবিদ্যালয় আজ ফুলে ফলে সুসজ্জিতা। ভরে উঠেছে আরো প্রশস্ত দালান । সেদিনের নিরাভরণ মহাবিদ্যালয়টি আজ সালংকরা। শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে উন্মুক্ত আকাশ তলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সে । কালের ব্যবধানে দেশ আজ স্বাধীন মুক্ত। স্বাধীন দেশের নারীমুক্তির প্রধান সোপানটি আজ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। মহানুভব সরকার নিজ হাতে তুলে নিয়েছেএর গুরুদায়িত্ব। সালঙ্করা আজকের এই মহাবিদ্যালয়ের এদিকে দূর থেকে তাকিয়ে দেখি আর নিজেকে গৌরাবান্বিত মনে করি । একদিন এই নিকেতনে আমরাও ছিলাম। আজকের এই বিদ্যাপীঠ দিয়েছিল আমায় মুক্তির স্বাদ। এখানেই আমি দীক্ষা পেয়েছি আমার উচ্চতর জীবনযাত্রার। এই সেই মহাবিদ্যালয় যা আমাকে দিয়েছিল নতুন জীবন যাত্রার পথের দিশা।

(বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজ বার্ষিকী ‘দিগন্ত’এর রজত জয়ন্তী সংখ্যায় প্রকাশিত ‘দিনগুলি মোর স্মৃতির পাতায়’ এর লেখিকা বেগম শামসুন্নাহার ১৯৯২ সালে বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বরিশাল মহিলা কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী বেগম শামসুন্নাহার যখন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তখন তিনি সাত সন্তানের জননী। এ কারণেই শিক্ষক থেকে সহপাঠীরা সবাই তাঁকে `ভাবী’ বলে সম্বোধন করতেন। ২০০৬ সালের ১লা নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।)

.

বেগম শামসুন্নাহার এম এ বিএড (প্রথম শ্রেণি)
প্রাক্তন সহকারি প্রধান শিক্ষিকা
বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

২ comments

  1. রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা। বেগম শামসুন নাহারের সর্ব কনিস্ট পুত্র আমি। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি, এই ভেবে, যে, আমি তাদের সন্তান। আমার পিতা মাতা, দুজনেই আমাকে শিখাতেন মানুষ হতে। বড় হতে হলে, মানুষ হতে হবে। লেখাটা পড়ে, চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আজ আমি বড় হয়েছি, কতোটুকু মানুষ হয়েছি জানিনা। তবে প্রতিটি মুহুর্তে তোমাদের কথা মনে আসে, আর আল্লাহর কাছে দোয়া করি ” রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা”।

  2. আমার মত ভাষাজ্ঞান-হীন একজন মানুষের পক্ষে এই লেখার উপর মন্তব্য করা অসমিচিন মনে করি। এই সুন্দর লেখা যা পাঠককে নিয়ে যায় ঘটনাস্থলে । ভুলিয়ে দেয় পাঠকের অস্তিত্বকে নিমিষেই। আমি ও তেমনি এক মন্ত্রমুগ্ধ পাঠক হয়ে ভুলে গিয়েছিলাম নিজের অস্তিত্বকে । আল্লাহ এমন মহিয়ষী মানুষকে যুগে যুগে এই ধরনীতে পাঠিয়ে থাকেন তা না হলে জগত-সংসার অসাড় হয়ে যেত। মহাপ্রভুর কাছে দোয়া করছি তিঁনি যেন খালাম্মাকে জান্নাতে চির শান্তিতে রাখেন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *