দুঃখ

মো. নুর উল্লাহ আরিফ :

মিটিমিটি তারকালোকিত সন্ধ্যারাত। সারাদিনের খাটুনি শেষে শরীরটা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে। একটু খানি বিশ্রাম নিতে উঠোনে শীতল পাটিতে দেহ বিলিয়ে দিলেন । শিথানে শিমুল তুলার বালিশে মাথা রেখে আয়েশ করে আকাশপানে চেয়ে আছেন বজলে রশিদ মিয়া। ভাবছেন জীবনটা এমন কেন? যদি জোস্নাস্নাত নক্ষত্ররাজির ফুরফুরে মেজাজে বিচরণকারী স্বচ্ছ আকাশমালার মত হত !
কতকাল বাইতে হবে জীবনের এ তরি? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। উত্তর খোঁজে পায় না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। জমানো কষ্টে নিঃশ্বাসও বের হতে চায় না। ভাবনার মাঝে হঠাৎ স্মিথ হেসে ওঠে বজলে রশীদ মিয়ার দু’ ঠোট । পাশে হাত পাখার বাতাশ দেয়া স্ত্রী শাহেদার মুখশ্রীও হেসে ওঠে স্বামীর হাসিতে। ভাবনায় আসে ছেলের কথা। ক’দিন পরই ঘুছে যাবে সব দুঃখ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়া ছেলে বাবার জীবনের দুর্যোগ মুছে দিবে।

ভোর – বিহানে মেঠোপথের অলিগলি মাড়িয়ে শাকসবজির পসরা নিয়ে হাজির হতে হয় শহুরে । টংঘরে চট বিছানো দোকানে রোদবৃষ্টির নিত্য মিতালি। নিত্য ঝড়ের মত আরেক দুর্ভোগ মাথার ওপর। সুদী ব্যবসায়ীদের নিত্য আনাগোনা বাড়িতে। মেয়ের বিয়ের যৌতুকের টাকা পরিশোধ হলেও বজলে রশীদের পরিশোধ হয় না সুদের টাকা। প্রতি মাসেই বাড়তে থাকে সুদের লভ্যাংশের টাকা। সেদিকে তার খেয়াল নেই। ছেলে তালাত মাহমুদের পড়াশোনার খরচ ম্যানেজে সব ভাবনা তার। ছেলের ভাবনায় কালেভদ্রেও গোশত নামক আমিষের সাক্ষাৎ পায়না বজলে মিয়ার পরিবার। মাসের পর মাস সুদের টাকা বকেয়া থাকলেও ছেলের খরচের টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পৌছে যায় প্রতি মাসে।

তালাতের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। ক’দিন পরই প্রকাশ হবে চূড়ান্ত রেজাল্ট। চাকরির জন্য আবেদন করতে আর অপেক্ষা করতে হবেনা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় হয়ত বেশি দৌড় ঝাপ করতে হবেনা। সোনার হরিণ চাকরির বাজারে যদি লবিং করা লাগে তাহলে কেমনে কী করব । টাকা পয়সা নেই, কী দিয়ে কী করব?
বাবার এসব ভাবনার মাঝে ছেলের চাকরি হয়ে গেল সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে। দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলের পরিচালক হিসেবে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থদের উন্নয়নে কাজ করা। বেতন কাঠামো উচ্চাবিলাসী হওয়ায় পরিবারের সবার বদনে হাসি। বাবা পড়শীদের মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন আর ছেলের চাকরির গল্প বলছেন।
চাকরি হতে না হতে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে বাবার কাছে। বাবার ভাবনা তার ধারদেনাগুলো পরিশোধ হলেই ছেলেকে বিয়ে দিবেন অল্প সময়ে। সময় যেতে না যেতেই হেডকোয়ার্টারে বদলী হলো তালাত। বাবার সাথে হয় না ছেলের যোগাযোগ। ধার-দেনায় ডুবে থাকা বাবার মাথায় চিন্তার পারদ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। শুনতে পায় ছেলে বিয়ে করছে শহুরে কোন মেয়েকে।

দিন যায়, অনেক দিন , কিন্তু ছেলের কোন দেখা নেই। বয়সের ভারে শরীরে বাসা বেধেছে বালাই। ওষুধ কেনার টাকা নেই। একবেলা খেলে তিনবেলা উপোস থাকতে হয়। সুদি কারবারিদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে গেছে। মানুষিক চাপের ধকল শরীর সহ্য করতে পারছে না।বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ইচ্ছে করেও যেতে পারে না, সুদী মহাজনের বাধা আসে। কোথাও যাওয়ার আগে আমাদের টাকা দিয়ে যাও। তালাতের কাঁছে এলাকার মানুষ খবর দেয় বাবা মায়ের দুর্দশার খবর দিয়ে। কিন্তু ছেলের খবর নেওয়ার ফুসরত হয় না বাড়ির । হতাশা- রোগ শোকে শয্যাশায়ী হয় বজলে মিয়া। বিনা ঔষধে দীর্ঘদিন ধুঁকতে ধুকতে চলে যায় না ফেরার দেশে। গ্রামবাসী দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে। দালাতও আসে বাবাকে দেখতে, দুর থেকে দেখে মসজিদের পাশে কাকে যেন মাটি দিচ্ছে মুসল্লীরা, তালাত এগিয়ে আসে, দেখে, কিন্তু তৎক্ষণে বাবা মাটির দেশে।..

মো. নুর উল্লাহ আরিফ
শিক্ষক, বেগম রহিমা ইসলাম কলেজ
চরফ্যাশন, ভোলা।

One comment

Leave a Reply to Md.Solaiman Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *