জাকিরুল আহসান
বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে স্বরূপকাঠি-বরিশাল সড়কে মাধবপাশার কাছাকাছি পৌঁছালেই নজরে পড়বে উঁচু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বিশাল দিঘি। এর ভেতরে প্রবেশের জন্য দুইদিকে দুইটি গেট রয়েছে। দিঘির মাঝখানে গাছপালাপূর্ণ ছোট দ্বীপ। শীতকালে এখানে অতিথি পাখির ব্যাপক সমাগম হয়। চারপাশে বিপুল সবুজ বৃক্ষের সমাহারে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাখিকুলের কলকাকলীতে সারা বছর মুখর থাকে দুর্গাসাগর দিঘি। সারাবছর ধরেই এ দিঘিতে আসেন পর্যটক। বিশেষ করে শীত মৌসুমে বনভোজন এবং দর্শনার্থীদের ঢল নামে দুর্গাসাগর দিঘির চারপাশে। তবে দিঘি হলেও কেনই বা এর নাম ‘দুর্গাসাগর’ আর কে-ই বা খনন করলো এত বড় দিঘি? এসব প্রশ্নের জবাব নিয়ে সাজানো হলো প্রতিবেদনটি।
দুর্গাসাগ রের নামকরণ:
ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চন্দ্রদ্বীপের রাজা শিবনারায়ণ ১৭৮০ সালে মাধবপাশায় ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দিঘি খনন করেন। তার স্ত্রী দুর্গা রানীর নামানুসারে দিঘির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। দিঘি খননে এক হাজার ৮০০ শ্রমিক একাধারে ছয় মাস কাজ করেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তৎকালীন দিঘি খননে ব্যয় হয়েছিল তিন লাখ টাকা। ১৭৯৯ সালে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন দেশের। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত বর্তমান বরিশাল বিভাগের প্রাচীন নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। চন্দ্রদ্বীপের সর্বশেষ রাজধানী মাধবপাশার উপকণ্ঠে ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দিঘির অবস্থান। প্রথম খননের ১৯৪ বছর পর ১৯৭৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দিঘিটি পুনঃখনন করেন তৎকালীন মন্ত্রী শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত। তখন দিঘির মাঝখানে একটি দ্বীপ তৈরি করা হয়। একই বছর ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে দিঘি ও চার পাড়ের জমি সরকার অধিগ্রহণের আওতায় নেয়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির উদ্যোগে দুর্গাসাগর দিঘিকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘দুর্গাসাগর দিঘি উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য’ প্রকল্পের আওতায় নেওয়া হয়। তখন দুর্গাসাগর দিঘির চারপাশে নিরাপত্তা দেয়াল নির্মাণ ও অভ্যন্তরে সৌন্দর্যবর্ধনের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় জেলা প্রশাসনের অধীনে।
দুর্গা সাগর দিঘির আয়তন:
সরকারি হিসাব অনুযায়ী দিঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এর ২৭ একর ৩৮ শতাংশ জলাশয় এবং ১৮ একর চার শতাংশ পাড়। চারপাশে চারটি ৫০ ফুট বিশিষ্ট পাকা ঘাট, মাঝবরাবর একটি দ্বীপ দিঘিটিকে পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। দৈর্ঘ্য একহাজার ৯৫০ ফুট ও প্রস্থ একহাজার ৭৫০ ফুট। পশ্চিম পাড়ে ঘাট সংলগ্ন স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। ১৯৯৬ সালে এই দিঘিকে ‘দুর্গাসাগর দিঘি উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য’ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে পরিণত করা হয়েছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে। ১৯৯৬ সালে উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের পর নবরূপ পায় ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দিঘি। গত কয়েক বছরে দর্শনার্থী আয় বেড়েছে পাঁচ গুণ। দুই-তিন বছর আগেও মাস যেখানে দুর্গাসাগর দিঘি থেকে দর্শনার্থী-আয় ছিল ২৫/৩০ হাজার টাকা, এখন তা এক লাখে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ‘দুর্গাসাগর দিঘির উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য’ নামে একটি প্রকল্পের অধিনে বরিশাল জেলা প্রশাসন দিঘিটির তত্ত্বাবধান করছে।
যেসব আয়োজন করা হয়:
বরিশাল উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে দুর্গাসাগর এলাকায় পিকনিক স্পট রয়েছে যেখানে চাইলে আপনি পিকনিক করতে পারেন। এছাড়াও অনুমতি সাপেক্ষে দিঘি থেকে মাছ ধরতে পারেন এবং সেখানে অবস্থিত একটি চমৎকার পার্কে সুন্দর সময় কাটাতে পারেন। এছাড়া প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ইউরোপ এবং সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা অতিথি পাখির দল এখানে ভীড় করে। সেটি একটি উপভোগ্য এবং দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। প্রতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন দুর্গা সাগরে অষ্টমী স্নানের আয়োজন করে থাকে। তাঁরা দিঘির পাশে নানা রকম পূজা অর্চনা এবং ধর্মীয় আলোচনাও করে থাকেন।
কিভাবে যাবেন:
ঢাকার গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন বরিশালের উদ্দেশ্য বাস ছেড়ে আসে। বেশীরভাগ বাস পাটুরিয়া ঘাট অতিক্রম করে আবার কিছু বাস মাওয়া ঘাট অতিক্রম করে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে আসে। ভোর ৬.৩০ মিনিট থেকে সকালের বাসগুলো এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯ টার মধ্যে রাতের বাসগুলো বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। বাসগুলোতে পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টায় আপনি বরিশালে পৌঁছে যাবেন। বরিশাল শহর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় আপনি ৩০ মিনিটে বাস অথবা টেম্পোতে দুর্গাসাগরে আসতে পারবেন। প্রবেশ মূল্য মাত্র ২০ টাকা।
তথ্যসূত্র: মুক্তবুলি ম্যাগাজিন ১২তম সংখ্যা, দীঘি উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারণ্য প্রকল্প, বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ, উইকিপিডিয়া।