পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীন স্মরণে

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীনের মৃত্যুবার্ষিকী ১৩ মার্চ । ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি । জসীমউদ্‌দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগরসভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীমউদ্‌দীনের। তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্টতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার লেখা অসংখ্য পল্লিগীতি এখনো গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। যেমন- আমার হার কালা করলাম রে, আমায় ভাসাইলি রে, বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে ইত্যাদি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত জসীমউদ্‌দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছর শিক্ষকতা করেন; ১৯৪৪ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে অবসরগ্রহণ করেন। জসীমউদ্‌দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।

জসীমউদ্‌দীন প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

পারিবারিক পরিচিতি

মোহাম্মাদ জসীম উদ্‌দীন মোল্লা তার পূর্ণ নাম হলেও তিনি জসীম উদ্‌দীন নামেই পরিচিত। তার বাবার বাড়ি ছিল একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তাঁর দুই জামাতা।

শিক্ষাজীবন

জসীমউদ্দীন ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুলে (বর্তমানে ফরিদপুর জিলা স্কুল) পড়ালেখা করেন। এখান থেকে তিনি তার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সনে উত্তীর্ণ হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিষয় থেকে বি. এ. এবং এম. এ. শেষ করেন যথাক্রমে ১৯২৯ এবং ১৯৩১ সনে।

কর্মজীবন

১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীমউদ্‌দীন কাজ করেন। তিনি পূর্ব বঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোক সংগীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলা লোক সাহিত্যের বিশদ ব্যাখ্যা এবং দর্শন খণ্ড আকারেও লিখে গেছেন।

১৯৩৩ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগ দেন। এরপর ১৯৩৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এবং তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে গেছেন। তিনি গুরু মৃত্যুন জয় সিলের কাছে গুণগ্রাহী ছিলেন। ১৯৬৯ সনে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মান সূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন।

সাহিত্যের ধারা

জসীমউদ্দীন একদম অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায়, পরিবার এবং বিয়োগান্ত দৃশ্যে, একদম সাবলীল ভাষায় তিনি বিশেষ আলোচিত কবিতা কবর লিখেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়।

গাঁয়ের লোকের দৃষ্টিতে গ্রাম্য জীবন এবং পরিবেশ-প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্য জসীম উদ্ দীন বিশেষভাবে পরিচিত। তার এই সুখ্যাতি তাকে পল্লি কবি উপাধি এনে দিয়েছে। তার কাব্যের গঠনপ্রণালী এবং বিষয়বস্তু পাঠককে বাংলা লোক সাহিত্যের প্রগাঢ় আস্বাদন এনে দেয়। তার রচিত নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থকে তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং পৃথিবীর অনেক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে।

এছাড়াও জসীম উদ্দীন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক গান রচনা করেছেন। বাংলার বিখ্যাত লোক সংগীতের গায়ক, আব্বাসউদ্দীন, তার সহযোগিতায় কিছু অবিস্মরণীয় লোকগীতি নির্মাণ করেছেন, বিশেষত ভাটিয়ালী ধারার। জসীম উদ্দীন রেডিওর জন্যেও আধুনিক গান লিখেছেন। তিনি তার প্রতিবেশী, কবি গোলাম মোস্তফার দ্বারা ইসলামিক সংগীত লিখতেও প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে, তিনি বহু দেশাত্মবোধক গান লিখেন।

মৃত্যু

তিনি ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়।[৯] গোবিন্দপুরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে তার জন্মদিনকে স্মরণ করে জসীম মেলা নামে একটি পাক্ষিক উৎসব উদ্‌যাপন করা হয়।[১০] তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।

গ্রন্থাবলি

কাব্যগ্রন্থ

  • রাখালী (১৯২৭)
  • নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯)
  • বালুচর (১৯৩০)
  • ধানখেত (১৯৩৩)
  • সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩)
  • হাসু (১৯৩৮)
  • রুপবতি (১৯৪৬)
  • মাটির কান্না (১৯৫১)
  • এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬)
  • সখিনা (১৯৫৯)
  • সুচয়নী (১৯৬১)
  • ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
  • মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)
  • হলুদ বরণী (১৯৬৬)
  • জলে লেখন (১৯৬৯)
  • পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯)
  • মাগো জ্বালায়ে রাখিস আলো (১৯৭৬)
  • কাফনের মিছিল (১৯৭৮)
  • মহরম
  • দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি (১৯৮৭)

নাটক

  • পদ্মাপার (১৯৫০)
  • বেদের মেয়ে (১৯৫১)
  • মধুমালা (১৯৫১)
  • পল্লীবধূ (১৯৫৬)
  • গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯)
  • ওগো পুস্পধনু (১৯৬৮)
  • আসমান সিংহ (১৯৮৬)

আত্মকথা

  • যাদের দেখেছি (১৯৫১)
  • ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় (১৯৬১)
  • জীবন কথা ( ১৯৬৪)
  • স্মৃতিপট (১৯৬৪)
  • স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮)

উপন্যাস

ভ্রমণ কাহিনী

  • চলে মুসাফির (১৯৫২)
  • হলদে পরির দেশে ( ১৯৬৭)
  • যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮)
  • জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)

সঙ্গীত

  • রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫)
  • গাঙের পাড় (১৯৬৪)
  • জারি গান (১৯৬৮)
  • মুর্শিদী গান (১৯৭৭)

অন্যান্য

  • বাঙালির হাসির গল্প ১ম খন্ড (১৯৬০), ২য় খন্ড (১৯৬৪)
  • ডালিমকুমার (১৯৮৬)

গানের শিরোনাম

  • “কাজল ভ্রমরা যে”
  • আমার সোনার ময়না পাখি
  • আমার গলার হার খুলে নে
  • আমার হার কালা করলাম রে
  • আমায় ভাসাইলি রে
  • আমায় এতো রাতে
  • কেমন তোমার মাতা পিতা
  • নদীর কূল নাই কিনার নাই
  • ও বন্ধু রঙিলা
  • রঙিলা নায়ের মাঝি
  • নিশ্তে যাইও ফুলবাণে, ও ভোমরা
  • ও বাজান চল যাই মাঠে লাঙল বাইতে
  • প্রানো শখি রে ঐ শুনে কদম্ব তলে
  • ও আমার দরদি আগে জানলে
  • বাঁশরি আমার হারাই গিয়াছে
  • বালু চরের মেয়া
  • বাদল বাঁশি ওরে বন্ধু
  • গাঙ্গের কূলরে গেলো ভাঙিয়া
  • ও তুই যারে আঘাত হানলিরে মনে
  • ও আমার গহীন গানের নায়া
  • আমার বন্ধু বিনুধিয়া

অনুবাদ গ্রন্থাবলি

জসীমউদ্দীনের “নকশী কাঁথার মাঠ” কাব্যটি “দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট” এবং বাঙালীর হাসির গল্প  গ্রন্থটি ‘ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।

এছাড়াও তার ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট‘ কাব্যগ্রন্থটি ইংরিজেতে জিপ্সি ওয়ার্ফ শিরোনামসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

পুরস্কার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *