প্রথম শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন

মাহমুদ ইউসুফ

উপমহাদেশের সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক, দক্ষ অনুবাদক এবং সূক্ষ্মদর্শী, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও স্পষ্টবাদী সাহিত্য সমালোচক। অর্ধ-শতাব্দীরও অধিককাল কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য ও সমাজ-সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় সর্বদাই তিনি ছিলেন সামনের কাতারে। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করতে তিনি ছিলেন আপোষহীন। ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে যেমন ছিলেন সক্রিয়, তেমনি আজাদ সম্পাদক হিসেবে তাঁর কলম চিরদিন মানবাধিকারের পক্ষে পরিচালিত হয়। উপনিবেশবিরোধী আজাদি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখপত্র ‘দৈনিক আজাদ’ কলকাতা থেকে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর। তখনই শামসুদ্দীন এ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে তাঁকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। এই দায়িত্বে থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

File:ShamsuddinAbulKalam.jpg

লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্বে এম. কে. গান্ধীসহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ভারতবর্ষকে এক রাষ্ট্রে পরিণত এবং এক জাতীয়তায় আবদ্ধ করার জন্য হিন্দিকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে জোর প্রচেষ্টা ও তৎপরতা চালায়। দৈনিক আজাদ এ প্রসঙ্গে ১৯৩৭ সালে এক ঐতিহাসিক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। উক্ত সম্পাদকীয়তে বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বাংলাকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পেশ করা হয়।১ ঠাকুর কবি রবীন্দ্রনাথও সেদিন ভারতের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে হিন্দির পক্ষে ওকালতি করেন। ঔপনিবেশিক শাসনের পরিসমাপ্তির পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। স্বাধীনতার শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেয়ার একটি ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠায় এবং ভাষা আন্দোলনের পথ উন্মোচন করে।২ আবুল কালাম শামসুদ্দীনও বাংলাভাষার দাবিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পরেন। ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর শিল্পী জয়নুল আবেদীনকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সভায় শামসুদ্দীন বলেন, ‘মুছলমান রাজা-বাদশারাই প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধশালী করিয়াছিল। ইসলামী প্রভাবের ফলে বাংলা ভাষা ক্রমোন্নতি লাভ করে এবং ইহার প্রসার হয়। প্রত্যেক বাঙ্গালী মুছলমানের বুলি বাংলা, উর্দু ভাষা বাঙ্গালী মুছলমানের নিকট গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান প্রভৃতি ভাষারই স্বরূপ। উর্দু কখনই বাঙ্গালী মুছলমানের ভাষা নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু রাষ্ট্রভাষা হইতে পারে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হওয়া যুক্তিযুক্ত।’ ৩ এ বয়ান থেকেই তাঁর গভীর মাতৃভাষা প্রীতি লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণার দাবি জানিয়ে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে যে স্মারকপত্র পেশ করা হয়, শামসুদ্দীন ছিলেন তার অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। সমসাময়িক সময় পূর্ববঙ্গ সাংবাদিক সংঘের তরফ থেকে এক স্মারকলিপি সরকারের কাছে পেশ করা হয়। তিনি ছিলেন এর অন্যতম উদ্যেক্তা।

১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’ গঠন করেন। মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন এই কমিটির সভাপতি। শামসুদ্দীন ছিলেন কমিটির অন্যতম সদস্য। ৪ এ কমিটির বৈঠক সম্পর্কে তিনি অতীত দিনের স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরেই সাধারণ ভাষা সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বাঙলা ভাষাকে নবরূপ দেয়ার জন্য এর কোন কোন বিষয়ে সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে তা নিয়ে কমিটির সভায় তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হতো। আমি ছিলাম এর বহুল সংস্কারের পক্ষপাতী। বর্ণমালা থেকে শুরু করে ব্যাকরণ পর্যন্ত এর আদ্যন্ত সংস্কার দরকার। কমিটির অধিকাংশ সদস্যের অভিমত ছিলো এই ধরনের। আমাদের মতে, বাঙলা ব্যাকরণ নামে যা প্রচলিত রয়েছে তা সংস্কৃত ব্যাকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। … যাহোক, কয়েকটি বৈঠকে আলাপ আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পর আমরা ভাষা সংস্কার সম্পর্কে যে সুপারিশ সর্বসম্মতক্রমে প্রণয়ন করেছিলাম। তাতে বর্ণমালায় সংস্কার করা হয়েছিলো বিপুল এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের অনেক বিধি নিষেধই উড়িয়ে ব্যঞ্জনবর্ণের ঙ, ঞ, ণ, অন্তস্থ য, ষ, ক্ষ প্রভৃতি বর্ণ একদম বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিলো। ডক্টর শহীদুল্লাহ ‘য়্যা’ নাম নতুন একটি বর্ণ সংযোজনের সুপারিশ করেছিলেন। ব্যাকরণ সম্পর্কেও বিপুল সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছিলো। সংস্কৃত ব্যাকরণের খোল-নলচে বদলিয়ে বাঙলা ব্যাকরণের একটা নবরূপ দানের সুপারিশ আমরা করেছিলম।’ ৫ দুঃখজনক হলেও সত্য সেই কমিটির রিপোর্ট অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পৈশাচিক বর্বরতার এক নতুন অধ্যায় পয়দা হয় ঢাকার রাজপথে। জিঘাংসার এক ট্রাজিক কাহিনী রচিত হয় সেদিন। ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষনে নিহত হয় আবুল বরকত, সালাহউদ্দীন, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান ও নাম না জানা আরও কয়েকজন। সভ্য দুনিয়ার ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য জীবনদানের সম্ভবতঃ এটা দ্বিতীয় ঘটনা। এর পূর্বে ১৯৩৭ সালে দক্ষিণ ভারতের তামিলরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ড. এবনে গোলাম সামাদ লিখেছেন, ‘১৯৩৫ সালের ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুসারে প্রাদেশিক বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। এই নির্বাচনে তখনকার মাদ্রাজ প্রদেশে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। কংগ্রেস মাদ্রাজ প্রদেশের স্কুলে হিন্দি শেখা বাধ্যতমূলক করে। কিন্তু তামিলভাষীরা এটা মানতে রাজী হন না। করেন বিক্ষোভ মিছিল। এই মিছিলে গুলি চলে। নিহত হন একাধিক ব্যক্তি। তামিলভাষীদের হিন্দি শিখতে বাধ্য করা যায়নি। এখনো যাচ্ছে না। কেবল তাই নয়, তামিলভাষীরা বর্তমানে তাদের ভাষার প্রবিষ্ট সংস্কৃত শব্দাবলিকে বর্জন করে চাচ্ছেন বিশুদ্ধ তামিলভাষী হতে। বাংলা ভাষার সাথে তামিলভাষার অনেক সাদৃশ্য আছে। বাংলা ভাষার পদক্রম তামিল ভাষার অনুরূপ। … ’ ৬ এছাড়া আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলনে ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসাম পুলিশ ১১ জন শ্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে গুলি করে হত্যা করে।

২১ ফেব্রুয়ারির ট্রাজেডিতে আবুল কালাম শামসুদ্দীন খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। এই মর্মন্তুদ ঘটনায় তিনি সাথে সাথে পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নওবেলাল, আজাদসহ বিভিন্ন খবরের কাগজে তার পদত্যাগের খবর প্রকাশিত হয়। গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুনের কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেন, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদে আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নূরুল আমিন সরকারের আমিও একজন সমর্থক- এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।’ ৭ ছাত্র জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে তাঁর প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফাদানের ব্যাপারটা ছিলো একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ফল এবং আজাদ কর্তৃপক্ষের সেখানে কোনো তাগিদ বা ভূমিকা ছিলো না। দৈনিক আজাদের তৎকালীন সহকারী সম্পাদক মুজীবুর রহমান খাঁ স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘তিনিই প্রথম পদত্যাগ করেন প্রাদেশিক আইন পরিষদ থেকে। মিছিলে পুলিশের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই শামসুদ্দীন সাহেব পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং অত্যাধিক উত্তেজিত হয়ে পড়ার দরুন আমাকে বললেন দ্রুত একটি পদত্যাগপত্র ড্রাফট করে দিতে। আমি শামসুদ্দীন সাহেবকে বলেছিলাম, ‘আপনার পদত্যাগ, আজাদের সম্পাদকীয় লেখা, এতে জনগণকে কি উস্কিয়ে দেয়া হবে না? আর এজন্য আমাদের ক্ষতিও তো হতে পারে।’ শামসুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘সেটা হবে হয়তো, তবে আমাদের এ ঝুঁকি নিতে হবে।’ তারপরই আমি সম্পাদকীয় লিখেছিলাম, ‘‘পদত্যাগ করুন’’।’ ৮

সরকারি পেটোয়া বাহিনীর জুলুমের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি নিহতদের স্মরণে যে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন শামসুদ্দীন। ৯ অতীত দিনের স্মৃতি গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘পুলিশী গুলিবর্ষন ও আমার ব্যবস্থাপক সভার সদস্যপদ ত্যাগের খবর নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় ‘আজাদের’ এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। গুলীবর্ষনের নিন্দা করে সে সংখ্যায় অগ্নিবর্ষী ভাষায় যে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ঢাকার নাগরিক মহলে, বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিলো বলে শুনেছি। পরদিন গুলীবর্ষনে নিহতদের স্মৃতিতে যে শোকসভা আহ্বান করা হয়, তাতে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছাত্র বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন এসে আমাকে সে সভার সভাপতিত্ব করার জন্য এমন চেপে ধরেন যে, শোক-বিহ্বল চিত্ত নিয়েও আমার পক্ষে তাদের অনুরোধ রক্ষা না করে উপায় ছিলো না। মেডিকেল কলেজের পাশে, বর্তমানে যেখানে শহীদ মিনার অবস্থিত, সেখানেই পরদিন সে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। কারণ, সে স্থানেই পুলিশী গুলীবর্ষনে কয়েকজন নিহত হয়েছিলেন। আমার চিত্ত সে সময় এতোই শোক বিহ্বল ছিলো যে, সভায় দীর্ঘক্ষণ ধরে ভাষণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না, আমি সংক্ষিপ্ত ভাষণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার আমার মর্মবেদনা প্রকাশ করেছিলাম এবং যতদূর মনে পড়ে পরদিন আজাদে তা প্রকাশিত হয়েছিলো’। ১০

২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তরুণ ছাত্ররা ইট, সুরকি, সিমেন্ট দিয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্র বদিউল আলম কর্তৃক অঙ্কিত নকশা মোতাবেক শহিদ মিনার নির্মাণ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শামসুদ্দীন এই শহিদমিনার উদ্বোধন করেন। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলী সম্পর্কে আজ যাহারা দলীয় বা ব্যক্তিস্বার্থে অসত্য বক্তব্য রাখিতেছেন, তাহাদের কেহই সেই আন্দোলনে কিংবা আবেগঘন ঐতিহাসিকলগ্নে উপস্থিত ছিলেন না। … ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে যিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যপদ হইতে ইস্তফা দিয়াছিলেন, দৈনিক আজাদ সম্পাদক সেই আবুল কালাম শামসুদ্দীন ২৩শে ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করিয়া একদিকে ছাত্র যুব জনতার কৃতজ্ঞতাভাজন ও অন্যদিকে জালেম সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন। রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় প্রশ্নে তাঁহার সহিত আমাদের মৌলিক পার্থক্য সত্ত্বেও শ্রদ্বাবনতচিত্তে স্বীকার করিতেই হয় যে, তাঁহার সাহিত্যিক মন সঠিক মুহূর্তেই বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিল এবং সর্বপ্রকার আত্মস্বার্থের উর্ধ্বে উঠিয়া তিনি এই সংগ্রামী চেতনার সহিত একাত্ম হইয়া গিয়াছিলেন, সত্যাশ্রয়ী ও হৃদয়বান মানুষেরা এইভাবেই ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় নিজেদের অবদান রাখেন।’ ১১ মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহও একই বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আবুল কালাম শামসুদ্দীনের হাতেই যে প্রথম শহীদ মিনারের উদ্বোধন হয়েছিলো, এটা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি একালের বহুলোকই সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। বর্তমান লেখকের সৌভাগ্য হয়েছিলো ২৩ শে ফেব্রুয়ারির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একজন তরুণ দর্শক হিসাবে উপস্থিত থাকার। পুলিশ কর্তৃক এই শহিদমিনার ভেঙ্গে ফেলার দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই রচিত হয় আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত কবিতা ‘স্মৃতির মিনার’। একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা বর্তমান লেখকের ‘স্মৃতির মিনার’ শীর্ষক একটি কবিতা সেকালেই প্রকাশিত হয় আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায়।’ ১২

আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। জাতির ক্রান্তিকালে, যে কোনো দুর্যোগের মুহূর্তে তিনি এগিয়ে এসেছেন বীরবিক্রমে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শত্রুর হুমকি ও সরকারের রক্তচক্ষুকে পরোয়া করেন নি। ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে শক্তির শেষবিন্দু খরচ করতেও দ্বিধা করেননি এই মহান ব্যক্তিত্ব। অথচ মতলববাজ ও সুযোগ সন্ধানী ঐতিহাসিক, সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনীতিবিদরা এই বাস্তব সত্যটাকে অস্বীকার করতে চায়।

পাদটীকা :

১. দৈনিক আজাদ, ২৩ এপ্রিল, ১৯৩৭/উদ্বৃতি-মোস্তফা কামাল, ভাষা আন্দোলন: সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ২-৬
২. মোহাম্মদ তোহা, ঢাকা ডাইজেস্ট, মার্চ ১৯৭৮/স্মৃতিসরণ, একুশের সংকলন, ১৯৮১, বাংলা একাডেমী সম্পাদিত/ উদ্বৃতি-মোস্তফা কামাল, ভাষা আন্দোলন: সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৯
৩. দৈনিক আজাদ, ৮ নভেম্বর, ১৯৪৭/উদ্বৃতি – মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী ২, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৭২৪-৭২৫/ মোস্তফা কামাল, ভাষা আন্দোলন: সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১৪-১৫
৪. ভূঁইয়া ইকবাল: আবুল কালাম শামসুদ্দীন, বাংলা একাডেমী, ফেব্রুয়ারি ১৮৭, পৃ ১৩
৫. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ: আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী ২, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৪৩২-৪৩৩
৬. এবনে গোলাম সামাদ, বাংলা ভাষা, মাসিক অন্য এক দিগন্ত, ফেব্রুয়ারি ২০১২, বর্ষ ৫, সংখ্যা ১০, পৃ ৯
৭. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী ২, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৪৩০
৮. আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সত্যিকার প্রগ্রেসিভ ও মানব কল্যাণকামী সাহিত্যিক, দৈনিক আজাদ, ২৮শে ফাল্গুন, ১৩৮৪/উদ্বৃতি-মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ: আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী ২, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৭২৪
৯. ভুঁইয়া ইকবাল, প্রাগুক্ত, পৃ ১৫
১০. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ: আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী ২, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৪৩১
১১. অলি আহাদ: জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ৪র্থ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃ ১৫০
১২. মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ: আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী ২, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৭২২-৭২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *