প্রাচীন গঙ্গারিডি রাষ্ট্র : বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস

Mahmud Eusuf

ইসায়িপূর্ব তৃতীয় শতক। গাঙ্গেয় অববাহিকার এক পরাক্রমশালী রাষ্ট্র। বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল জুড়ে এ স্বাধীন রাষ্ট্রটির অবস্থান। আযাদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করত এক জাতি; যাদের ভয়ে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট সৈন্যসামন্ত গুটিয়ে পালিয়েছিলেন ভারতবর্ষ ও পূর্ব এশিয়া জয়ের নেশা থেকে। সেই ঐতিহাসিক সমৃদ্ধশালী সুপারপাওয়ার রাষ্ট্রটির নাম ছিলো গঙ্গারিডি। গঙ্গারিডিদের সুনাম সুখ্যাতি তখন তুঙ্গে। সমসাময়িক গ্রিক ও লাতিন পর্যটক, ভূগোলবিদ ও মুসাফিরদের কলমে এ জাতির শৌর্যবীর্য ও জ্ঞানগরিমার সপ্রশংস চিত্র আমাদের গৌরবান্বিত করছে। গঙ্গারিড, গঙ্গারিডই, গঙ্গারিডাই, গঙ্গারিড়ী, গঙ্গাহৃদি, গঙ্গাহৃদয়, গঙ্গাঋদ্ধি, গঙ্গারাষ্ট্র প্রভৃতি গঙ্গারিডির লিপ্যান্তর। মেগাসথিনিসের গঙ্গারিডি আর প্লিনির বঙ্গরাষ্ট্র একই ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন নাম।

[টলেমির মানচিত্রে গঙ্গাঋদ্ধি (Gangaridai)]

গঙ্গারিডির অধিবাসী
নুহ নবির আওলাদ বঙ বাংলাদেশের প্রথম মানব ছিলেন। বঙই আমাদের ওয়ালেদ। বঙ বাঙালি জাতির আদি জনক। আবহমানকাল থেকেই বঙের উত্তরসূরী বাঙ জাতি বাংলাদেশে বসবাসরত। ইসলাম ধর্মাবলম্বী এই বাঙ জাতিই এদেশের ধারক বাহক। অনাদিকাল থেকেই তাঁরা এদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির মূল নিয়ামক। তবে পরবর্তীকালে তাঁদের সাথে যোগ দেয় নুহ নবির সন্তান সামের উত্তরসূরী দ্রাবিড় জাতি। উত্তর ভারত আর্যপদানত হলে তারা বাংলাদেশে এসে আর্যবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ড. এম এ আজিজ ও ড আহমদ আনিসুর রহমান বলেন: ‘খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজাণ্ডারের উপমহাদেশে অভিযানের সময়েও বাংলার অধিবাসীরা শৌর্যবীর্য, সভ্যতা ও কৃষ্টিতে শীর্ষস্থানীয় ছিল। বহুজাতির আবাসভূমি এ উপমহাদেশে গঙ্গা-বিধৌত গঙ্গারিডি জাতিই ছিল শ্রেষ্ঠ। কার্তিয়াস, ডিওডোরাস, প্লুতার্ক প্রমুখ গ্রীক লেখকের ইতিবৃত্ত, স্ট্রাবো ও টলেমীর ভৌগোলিক বৃত্তান্ত আর ভার্জিলের মহাকাব্য থেকে এ সময়কার বাংলার অধিবাসীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রীক ও লাতিন লেখকদের গ্রন্থে বঙ্গরাষ্ট্রের নাম পাওয়া যায় না। তবে গঙ্গারিডিরা যে বঙ্গ জনপদের অধিবাসী দ্রাবিড় এবং এ ভৌগোলিক সীমায়ই যে গড়ে উঠেছিল স্বাধীন সার্বভৌম শক্তিশালী গঙ্গারিডি রাষ্ট্র তাতে কোন সন্দেহ নেই। … দ্রাবিড়রা ছিলেন ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের নর-গোষ্ঠীর লোক এবং তাঁদেরই একটি দল গঙ্গা মোহনায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করে এক উন্নততর সভ্যতা গড়ে তোলেন। প-িতগণের মতে, ‘গঙ্গারিডি’ নামটি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত নয়। এতে মনে হয়, এ রাজ্যের অবস্থিত ছিল আর্য জগতের বাইরে। গঙ্গারিডীই সম্ভবত বাংলার প্রাচীনতম স্বাধীন রাষ্ট্র।’ [বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ ২৫-২৬] তাই বলা যায় বংগ দ্রাবিড়ি বা বাঙ দ্রাবিড়ি জাতিই ছিলো গঙ্গারিডির জনবল। অতএব বাংলাদেশ চিরকালই আমাদের, ওদের নয়।
প্রথম শতকের লাতিন দার্শনিক প্লিনি পেরিপ্লাস অফ ইরিত্রিয়ান সি শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, বঙ্গরাজ মগধসহ গোটা আর্যাবর্ত জয় করে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় একচ্ছত্র স¤্রাট হয়ে বসেছেন। প্লিনির মতে, গঙ্গারিডাই রাজ্যের ভেতর দিয়ে গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হয়েছে। গঙ্গার দক্ষিণ অংশের অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ ছিলো কালো এবং রৌদ্রে পোড়া, কিন্তু তারা ইথিওপিয়ানদের মতো কালো ছিলো না। মেগাসথিনিস তাঁর ইন্ডিকা কিতাবে লিখেছেন, ‘গঙ্গার শেষ অংশের প্রস্থ ৮ মাইল, এবং যেখানে এটি সবথেকে কম প্রস্থের সেই স্থানে এর গভীরতা প্রায় ১০০ ফুট। সেই মানুষরা যারা সেই সুদুর প্রান্তে থাকেন তারা হলেন গঙ্গারিডাই। এদের রাজার ১ হাজার ঘোড়সওয়ার, ৭০০ হাতি এবং ৬ হাজার পদাতিক মুজাহিদ নিয়ে সজ্জিত প্রতিরক্ষা বাহিনী আছে।’ [উইকিপিডিয়া] গ্রিকবীর আলেকজান্ডার এসব বিবরণী শুনে বাংলাদেশ জয়ের দুরাশা ত্যাগ করেন।

গঙ্গারিডির অবস্থান
এ ভূভাগের অবস্থান নিয়ে প-িতদের মধ্যে তেমন কোনো মতপার্থক্য নেই। মেগাসথিনিস (ইসায়িপূর্ব ৩৫০-২৯০), ডিওডোরাস (ইসায়িপূর্ব ৬৯-১৬), কার্তিয়াস, প্লুতার্ক, সলিনাস, প্লিনি, ক্লডিয়াস টলেমিয়াস (ইসায়ি ৯০-১৬৮), স্ট্র্যাবো প্রভৃতি ঐতিহাসিক, পরিব্রাজক ও ধ্রুপদী লেখকদের প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলানামূলক আলোচনা করিলে বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগ গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের অবস্থান চিহ্নিত করে। এছাড়া পশ্চিমবাংলার উত্তর ২৪ পরাগনা জেলা, কলকাতার দক্ষিণাংশও গঙ্গারিডির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অর্থাৎ গঙ্গারিডির পূর্বে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা, পশ্চিমে ভাগীরথী নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে ময়মনসিংহ।

গঙ্গারিডির রাজধানী
গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের রাজধানী ছিলো গঙ্গা তীরবর্তী গঙ্গে। এই গঙ্গে নগরী ছিলো একটি প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক বন্দর। গঙ্গে বন্দরের সঙ্গে রোম, মিসর, চীন, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকার তেজারতি সম্পর্ক ছিলো। এখানে বাণিজ্য ব্যাপদেশে বিভিন্ন দেশের জাহাজ যাতায়াত করত। এখান থেকে স্বর্ণ ও মনিমুক্তা, রেশম ও কার্পাসজাত বস্ত্র, মসলা, গন্ধদ্রব্য এবং যুদ্ধোপকরণ হিসেবে হাতি প্রভৃতি বিদেশে রপ্তানি হতো। [মনসুর মুসা সম্পাদিত বাঙলাদেশ, পৃ ৩০] গ্রিক ভৌগোলিক টলেমি দ্বিতীয় শতকে জানান, গংগা মোহনার সব অঞ্চল জুড়েই গংগারিড়ীরা বাস করে। তাদের রাজধানী গংগ খ্যাতিসম্পন্ন এক আন্তর্জাতিক বন্দর। এখানকার তৈরি সূক্ষ্ম মসলিন ও প্রবাল রতœাদি পশ্চিম দেশে রপ্তানি হয়। তাদের মত পরাক্রান্ত ও সমৃদ্ধ জাতি ভারতীয় উপমহাদেশে আর নেই। [আখতার ফারুক: বাংগালীর ইতিকথা,পৃ ২-৩] কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাজধানী বা কেন্দ্রস্থল গংগ কোথায় ছিলো- তা নিয়ে ঐতিহাসিক, বিশেষজ্ঞ, আলেম উলামারা একমত হতে পারেননি। বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন। বিভিন্নজনের বিভিন্ন বয়ান আমরা তুলে ধরার কোশেশ করছি।

এক. বারোবাজার

গঙ্গারিডি বা গঙ্গা রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল বারোবাজার। তখন এই বারোবাজারের নাম ছিলো গঙ্গে বা গঙ্গারোজিয়া। পাক-ভারতের মধ্যে একটি প্রাচীন বাণিজ্য বন্দর হিসাবে এর নাম সুবিদিত ছিলো। [হোসেন উদ্দিন হোসেন: বিলুপ্ত নগরী বারোবাজার;, ঔবংংড়ৎব.ওহভড়] বিখ্যাত ঐতিহাসিক এ. এফ. এম আব্দুল জলীল বলেন, ‘মুরলী বা যশোর টলেমী বর্ণিত গঙ্গা রেজিয়া।’ [এ. এফ. এম আব্দুল জলীল: সুন্দরবনের ইতিহাস, পৃ ৫৫৭] শ্রীযুক্ত পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও এই গঙ্গারেজিয়া যশোহর জেলার অন্তর্গত বলে অনুমান করেছেন।

দুই. কোটালীপাড়া

প্রাচীন এ জনপদকে গঙ্গারিডির রাজধানী বলে অভিহিত করেছেন ঐতিহাসিকদের একাংশ। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে গ্রিক বিবরণে দেখা যায় গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্র। গঙ্গা নদীর মোহনায় কুমারতালক বা কোটালীপাড়ায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের রাজধানী। মি. ওয়াটার্স ও জেমস ওয়াইজের মতে কোটালীপাড়ায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের রাজধানী ছিলো। মেগাসথিনিসের বিবরণে দেখা যায় গঙ্গার মোহনায় মোদকলিঙ্গ নামে একটি দ্বীপ ছিলো এবং সেখানে মোলঙ্গীদের আবাস ছিলো। গৌরনদী উপজেলার মেদাকুল গ্রাম প্রাচীনকালের মোদকলিঙ্গের পরিবর্তিত নাম। ১৮৭৩ সন পর্যন্ত কোটালীপাড়া থানা বাকেরগঞ্জ জেলাধীন ছিলো। উল্লেখ্য বর্তমানে বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলা সীমানা থেকে কোটালীপাড়ার দূরত্ব মাত্র ৫-৬ মাইল। [সিরাজ উদদীন আহ্মেদ : বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, পৃ ২৫]

তিন. চন্দ্রকেতুগড়
উইকিপিডিয়ায় উক্ত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার প্রতœস্থল চন্দ্রকেতুগড় সম্ভবত প্রাচীন বন্দর-রাজ্য ‘গঙ্গারিডাই’র রাজধানী বা ‘গাঙ্গে’ বন্দর। এই প্রতœস্থলটির অবস্থান বিদ্যাধরী নদী সংলগ্ন। উইকিপিডিয়ার মতো মুক্তবিশ^কোষে এ ধরনের তথ্যের উপস্থিতিতে আমরা মর্মাহত হই। সতীশচন্দ্র মিত্রের মতে, কলিকাতার দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত সমগ্র ভূভাগ গঙ্গে বা গঙ্গরেজিয়া। [সতীশচন্দ্র মিত্র: যশোর খুলনার ইতিহাস ১ম খ-, পৃ ১৭০] প্রাচীন শিলালিপিতে বিক্রমপুর ও নাব্য- প্রাচীন বঙ্গের এ দুটি ভাগের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। বিক্রমপুর এখনও সুপরিচিত। নাব্য বরিশাল ও ফরিদপুরের জনবহুল নি¤œভূমির নাম ছিলো। কারণ এই অঞ্চলে নৌকাই যাতায়াতের প্রধান উপায়। [শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার : বাংলা দেশের ইতিহাস প্রথম খ-, পৃ ৬] অতএব বলা যায়, প্রাচীন বাংলা বা গঙ্গারিডি রাষ্ট্র আজকের বাংলাদেশ নিয়েই সৃষ্টি হয়েছিল। তাই কলকাতা বা চন্দ্রকেতুগড়ে গঙ্গে রেজিয়ার অস্তিত্ব খোঁজা অযৌক্তিক।

চার. বাঙ্গালা

পেরিপ্লাসের বিবরণে দেখা যায় গঙ্গ চট্টগ্রামের নিকট পতিত হয়েছে এবং গঙ্গা নামে মোহনায় একটি বন্দর ছিলো। বন্দরের বিপরীত দিকে ছিলো একটি দ্বীপ। এ দ্বীপ সন্দ্বীপ বলে মনে করা হয়। [সিরাজ উদদীন আহ্মেদ : বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, পৃ ২৪] যদি তাই হয় তাহলে ‘বেঙ্গল’ বা ‘বাঙ্গালা’ বন্দরও গঙ্গে রেজিয়া হতে পারে। ডক্টর এম. এ. রহিম মনে করেন, ‘বাঙ্গালা শহর হাতিয়া ও সন্দ্বীপের মাঝামাঝি স্থানে সম্মিলিত নদীগুলোর মোহনায় অবস্থিত ছিল এবং ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমদিকে সাগরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ [বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রথম খ-, পৃ ১৩]
ইতালিও সওদাগর লুই বারথেমা জাহাজযোগে টেনাসেরিম থেকে ‘বাঙ্গেলা’ শহরে আগমন করেছিলেন ১৫০৩-১৫০৮ সনের মধ্যে। তিনি মন্তব্য করেন যে, এই শহরটি ছিলো তাঁর দেখা শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং এর সুতি ও রেশমি বস্ত্রের পর্যাপ্ত রপ্তানি বাণিজ্য ছিলো। পর্তুগিজ সওদাগর বারবোসা ১৫১৮ সনের দিকে বাংলাদেশ সফর করেন। তিনিও উত্তম পোতাশ্রয় সমেত প্রসিদ্ধ সমুদ্র বন্দররূপে ‘বেঙ্গলা’ শহরের নামোল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এই শহরের অধিবাসীদের বেশির ভাগই ছিলো মুসলিম, যাঁদের অনেকেই ছিলো বড় বড় বণিক এবং বিরাট বিরাট জাহাজের মালিক। বেঙ্গলা শহরের অধিবাসীরা বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম ও সুন্দর সুতিবস্ত্র ব্যাপক পরিমাণে তৈরি করত। এগুলো তাদের সওদাগররা চিনি ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে কোরোমন্ডাল, মালাবার, কাম্বে, পেগু, টেনাসেরিম, সুমাত্রা, সিংহল ও মালাক্কায় রপ্তানি করত। ১৫৬১ সনে ভেনিসের গ্যাসতালদি কর্তৃক প্রকাশিত এশিয়ার একটি মানচিত্রেও বাঙ্গালা শহর ও সাটিগাঁয়ের [সাতগাঁও] উল্লেখ আছে। এই মানচিত্র এবং দুজন বিদেশি পরিব্রাজকের সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায় যে, বেঙ্গলা নামক একটি বড় শহর ও বন্দর বঙ্গ উপসাগরের উপকূলভাগে ষোড়শ শতকের প্রারম্ভে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। [বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রথম খ-, পৃ ১১-১৩]
এই বেঙ্গল শহরটি যদি গঙ্গে বন্দর হয় তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় ইসায়ি তৃতীয় শতক থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত এর অস্তিত্ব জানান দেয়নি কেন? জবাবে বলা যায়, এই দীর্ঘসময়ে ইহা পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। গঙ্গারিডিদের গৌরবময় অধ্যায় খতমের পর ষোড়শ শতাব্দীতে সেটি তার দীপ্তিময়তা ফিরে পায়। যেমন: মুর্শিদাবাদ, লাখনৌতি, নদিয়া, বিক্রমপুর, পু-্রনগর, বরেন্দ্র একদা দুনিয়াজুড়ে কাঁপন ধরিয়েছিল। বর্তমানে ইতিহাসের পাতায় ঘুমিয়ে আছে সেই গৌরবগাঁথা। আবার ১৬১০-১৭১৭ পর্যন্ত ঢাকা ছিলো বৃহৎ বাংলার রাজধানী। তারপর হারিয়ে যায় অতীতের গর্ভে। ১৯৪৭ সনে আবার সাবেক মর্যাদায় প্রত্যাবর্তন করে। অবশ্য ১৯০৫-১৯১২ সময়কালে সাত বছরের জন্য উজ্জ্বলতা ফিরে পেয়েছিল। বেঙ্গলা নগরের ক্ষেত্রেও একই কথন প্রযোজ্য হতে পারে।

পাঁচ. সোনারগাঁও

ইতিহাস গবেষক ও প্রখ্যাত পণ্ডিত মোাহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ‘কেউ কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে চেয়েছেন যে, টলেমী বর্ণিত ‘গংগ’ বন্দরটি সোনারগাও ও চাঁদপুরের মধ্যবর্তী কোনো এক স্থানে অবস্থিত ছিলো, যা নদীতে বিলীন হয়েছে। আবার কারো কারো মতে সোনারগাওই ছিলো টলেমী বর্ণিত গংগ বন্দর।’ [মোহাম্মদ আবদুল মান্নান : বাংলা ও বাংগালী মুক্তি সংগ্রামের মূলধারা, পৃ ৩]
সোনারগাঁও স্বর্ণগ্রাম বা সুবর্ণগ্রাম নামে অভিহিত বঙ্গের এক প্রাচীন জনপদ। ব্রহ্মপুত্রের উভয় তীরব্যাপী বিস্তৃত এই জনপদে স্বর্ণভূষিত জাতি নামে চিহ্নিত এক আদিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিলো। এরা ঐতিহ্যগতভাবেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত ছিলো। প্রাচীনকালে এই জনপদের অবস্থান ছিলো শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মধ্যবর্তী ওই ভূখ-ে যা বর্তমানে নরসিংদী জেলা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার বৃহত্তর অংশে বিস্তৃত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বহুপূর্বে সোনারগাঁও এলাকায় একটি স্বাধীন রাজ্যের রাজধানী ছিল এমন লোকশ্রুতি নির্ভর বিবরণ রয়েছে। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান: সোনারগাঁও, বাংলাপিডিয়া]
মসলিন হলো অতি কোমল ও সূক্ষ্ম কার্পাস পোশাক। প্রাচীন ব্যবিলনের মসৌলে নির্মিত সূক্ষ্ম মসৃন বস্ত্র সদৃশ ঢাকায় তৈরি বস্ত্রের নাম হয় মসলিন। [বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ ৯৬১] আদিকাল থেকেই বাংলার বয়নশিল্প পৃথিবীব্যাপী সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। ইরৎফড়িড়ফ তাঁর ওহফঁংঃৎরধষ অৎঃং ড়ভ ওহফরধ গ্রন্থে মসলিনকে সোলেমানের পর্দার মতো লাবণ্যময় ও মনুসংহিতার চাইতে প্রাচীনতর বলে অভিহিত করেন। বহু শতাব্দীকাল যাবত বাংলাদেশের মসলিন তার খ্যাতি ও জৌলুস অক্ষুণœ রাখে। এরমধ্যে নি:সন্দেহে ঢাকাই মসলিনের অবস্থান ছিলো শীর্ষদেশে। রোমান প-িত প্লিনি গঙ্গেয় মসলিন নামে পরিচিত ঢাকার মসলিনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। গঙ্গে বন্দর থেকে সুদূঢ় পশ্চিমে ঢাকার মসলিন রপ্তানি হতো। [বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ ২৭-২৮]
দ্রাবিড়রা বাবেল বা ইরাক থেকে মসলিন নাম আমদানি করে। মসলিনের কেন্দ্রভূমিই হলো ঢাকা ও সোনারগাঁও। মলমল নামক ঢাকাই মসলিন আজও কিংবদন্তী। ঐতিহাসিকদের মতে, গঙ্গে রেজিয়া থেকে উৎকৃষ্ট মসলিন বাইরের দুনিয়ায় রপ্তানি হতো। তাই গঙ্গে রেজিয়া আর সোনারগাঁও অভিন্ন বলেই মনে হয়। তাছাড়া বর্তমান বুড়িগঙ্গা নদীই ছিলো প্রাচীন গঙ্গানদীর মূলধারা। শরীয়তপুর-মুন্সীগঞ্জের ভেতের দিয়ে বর্তমানে প্রবাহিত পদ্মানদী অষ্টাদশ শতকের সৃষ্টি। এসব বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে আমরা মনে করি, সোনারগাঁওই গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী।

[৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বের এশিয়ার মানচিত্র যাতে আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য ও প্রতিবেশী রাজ্য সহ নন্দ রাজ্য ও গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্য দেখানো হয়েছে। ]

জগদ্বিখ্যাত এই জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে ইতিহাসবিদ শ্রী রমেশচন্দ্র বলেন, ‘আলেকজা-ারের অভিযানের চারি পাঁচশত বৎসর পরে লিখিত পেরিপ্লাস গ্রন্থ ও টলেমীর বিবরণ হইতে আমরা জানিতে পারি যে, খৃষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন গঙ্গরিডই রাজ্য বেশ প্রবল ছিল, এবং গঙ্গাতীরবর্তী গঙ্গে নামক নগরী ইহার রাজধানী ছিল। এই গঙ্গে নগরী একটি প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল, এবং বাংলার সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় এখান হইতে সুদূর পশ্চিম দেশে রপ্তানি হইত। এই সংবাদটুকু ছাড়া খৃস্টজন্মের পূর্বের ও পরের তিনশত -মোট ছয় শত বৎসরের বাংলার ইতিহাস নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। বিদেশীয় ঐতিহাসিকগণ যে গঙ্গরিডই জাতির সা¤্রাজ্য ও ঐশ^র্যে মুগ্ধ হইয়া তাহাদিগকে ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। মহাকবি ভার্জিল যে জাতির শৌর্যবীর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন, এবং পঞ্চশতাধিক বৎসর যাঁহারা বাংলা দেশে রাজত্ব করিয়াছেন, এ দেশীয় পুরাণ বা অন্য কোন গ্রন্থে সে জাতির কোন উল্লেখই নাই।’ [শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার : বাংলা দেশের ইতিহাস প্রথম খ-, পৃ ২০-২১]
ভারতীয়দের মনোভাব কত নীচ, হীন, কুৎসিত, কদাকার, বিশ্রী এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে স্পষ্ট। হিন্দু পৌরাণিক গ্রন্থরাজি, ধর্মীয় উপকথা ও সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে কত অপপ্রচার, হিংসা-বিদ্বেষ, উগ্র মতবাদের উপস্থিতি? অথচ পাঁচ শতাব্দীর সুপার পাওয়ার, অপরাজেয় ক্ষমতাধর গঙ্গারিডি রাষ্ট্র ও গঙ্গারিডি জাতি তাঁদের চিন্তাচেতনায় অনুপস্থিত। হিন্দুজনগোষ্ঠী চিরদিনই বাংলাদেশ ও বাঙালি বিরোধী। হিন্দুসম্প্রদায়, হিন্দুশ্রেণি, আর্যসমাজের চির বৈরী আচরণ এখনও সমভাবে সক্রিয়। সেই প্রাচীন বিরূপ মনোভাব আজও অপরিবর্তনীয়। কেবল মানুষই নয়; এই দেশ, এই ভূমি, এই মাটি পৌত্তলিক বর্ণহিন্দুদের কাছে চরম অ্যালার্জি। এদেশের আবহাওয়া, বন-বনানী, নদীনালাও তাদের অসহ্য। অস্ত্র-ফেনসিডিল পাঠিয়ে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত, আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশি তাহজিব তমদ্দুন দুষিত করা, ফরমালিন পাঠিয়ে ভোগ্যসামগ্রীর ভেজাল, ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে নদ-নদী ভরাট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে সুন্দরবন ধ্বংস সে কথারই সাক্ষ্য দেয়।

 

ছবি:  উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *