রুকাইয়া সুলতানা মুন ।।
.
সময় আটটা তের মিনিট। সকালের আবহাওয়াটাও বেশ চমৎকার। বরিশালের নীল আকাশে ঝকঝকে নরম রোদ। শরতের আকাশ বলেই রংটা গাঢ় নীল। নীল আকাশের মাঝে শুভ্র মেঘের বিচিত্র কারুকাজ আঁকা দেখে মনে হচ্ছে রঙের সাথে রঙের লুকোচুরি খেলা চলছে।
আমি এয়ারপোর্টের গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানলাম অফিস খুলবে সাড়ে আটটায়। স্যুটের পকেট থেকে মোবাইল বের করে আমার স্ত্রীকে ফোন করে বললাম, তোমার বাবা আমাকে ঘুম থেকে তুলে আড়াই ঘণ্টা আগে এনে এয়ারপোর্টে বসিয়ে রেখে চলে গেছে। একমাত্র আমি ছাড়া আর কোন যাত্রীতো দূরে থাক এয়ারপোর্টের কর্মচারীও আসেনি। তাদের অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু হবে সাড়ে আটটায়।
নীলা ফোনের ওপাশ থেকে খিলখিল করে হেসে উঠলো। বৃষ্টির মত স্নিগ্ধ মধুর সে হাসির ফোয়ারায় আমার বিরক্তি, ক্ষোভ, অভিমান সব ভেসে গেল। আমি ফোন কেটে কিছুদূর হেঁটে একটি চায়ের দোকানে ঢুকলাম । ধীরে ধীরে চায়ে চুমক দিয়ে সময় পার করছি যাতে অন্যেরা এসে আমাকে দেখে আঁতেল না ভাবে। আমার শ্বশুরমশাই অতি সতর্ক মানুষ, কোনভাবেই যাতে ফ্লাইট মিস না হয়ে যায় সেজন্য সবার আগেই আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
আমি নয়টার দিকে এয়ারপোর্টে ঢুকে ল্যাগেজ চেকিং করিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। আমার দুসারি পরে সামনের চেয়ারে আরও দুজন যাত্রী বসে আছে, তাদের দেখে স্বামী-স্ত্রী মনে হচ্ছে। পুরুষটির কোলে একটি ফুটফুটে সাত-আট মাসের মেয়ে শিশু।
আমি ফেসবুকে ঢুকে ঘাটাঘাটি করছিলাম ।এমন সময় স্ত্রীটি উঠে এসে গলায় পেঁচানো ওড়না সরিয়ে আমাকে বলল, ভাই দ্যাখেনতো আমার গলায় কোন দাগ আছে কিনা? আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। মেয়েটি কিছুটা ঝুকে থাকায় তার খোলা চুলগুলো সামনে এসে পড়লে সেগুলো সরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, দ্যাখেনতো এখানে রক্ত জমাট হয়ে আছে কিনা?
আমি অস্বস্তি নিয়ে একপলক তাকিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বললাম, জি আছে।কি হয়েছিল?
মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট উল্টে আসার সময় রিক্সায় এক্সিডেন্ট করছি বলে আমার পাশের সিটে বসে পড়ল। কিন্তু তার দাগ দেখে তেমন লাগছিল না। মনে হচ্ছিল ধস্তাধস্তির দাগ। আমি পুরুষ লোকটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কি আপনার সাথে? হ্যা সূচক ভেংচি কাটলো সে।
আমি বোডিংপাস সংগ্রহ করার ছুতোয় মেয়েটির পাশে থেকে চলে গেলাম। কেমন বেহায়া মেয়েরে বাবা! নিজের স্বামী পাশে থাকতে অন্য একজন অচেনা পরপুরুষকে নিজের গলার দাগ দেখাতে আসছে। মেয়েটির স্বামীই বা কি ভাবছে? ছি ছি।
এরা আবার প্রতারক চক্র কিংবা মলম পার্টি নয় তো? দেখে তো ভালো ঘরেরই মনে হচ্ছে।
মেয়েটির স্বামীও তাদের বোডিংপাস নিতে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল, ভাই কিছু মনে করবেন না প্লিজ; আমার স্ত্রীর মাথায় গন্ডগোল আছে।
আমি মুখে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে ইটস ওকে বলে বিমানের অপেক্ষায় আবার গিয়ে বসলাম। অমনি স্ত্রীটি উঠে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ও আপনাকে কি বলেছে? আমার দোষের কথা?
আমি বললাম, না না আপনার কথা কিছু বলেনি। মেয়েটি ঝড়ের বেগে স্বামীর কাছে গিয়ে বলল, তুমি ঐ লোকটির কাছে আমার কথা কি বলছিলে ফুসুর ফুসুর করে?
স্বামী বেচারা উপেক্ষার ছলে বলল, তোমার কথা কি বলব, কিছুই বলিনি। স্ত্রী স্বামীর মুখটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, কিছুই বলিনি ,সাধু। কুকুর, তোকে আমি চিনিনা?
এটা পাবলিক প্লেস, চুপ থাকো বলে পুরুষ লোকটি মুখ ঘুরিয়ে নিল।
মেয়েটি, তুই চুপ থাক টুট.টুট.টুট।
ছেলেটা, তুই চুপ টুট.টুট….।
লোকটা বাচ্চা মেয়েটিকে স্ত্রীর কোলে দিয়ে আমার পাশে এসে অসহায় কন্ঠে বলল, ভাই জীবনে বিয়ে কইরেন না।
-ভাই বিয়ে তো আগেই করে ফেলেছি।
-আপনার বৌ কি বরিশালের?
-জি, আমার বৌ বরিশালের ।
-তাহলে বুঝবেন মজা।
-আমার বৌ এবং আমি দুজনেই বরিশালের। বিয়ে করেছি পাঁচ বছর, তিন বছর বয়সী একটি মেয়েও আছে, আমাদের তো কোন সমস্যা নেই। ভাই আপনার বাড়ি কোথায়?
-আমার বাড়ি সিলেট, ঢাকায় থাকি।
-ও আচ্ছা। তা ব্রাদার আপনার বাড়ি সিলেট, বিয়ে করেছেন বরিশাল। আপনাদের দুজনের পরিচয় কিভাবে হল? ফেসবুকে নাকি?
ফেসবুকের নাম শুনেই লোকটি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বিড়বিড় করে বলল ফেসবুকের গুষ্টি কিলাই। ফেসবুকে প্রেম করেই আজ এই দশা!
তার কথা শুনে আশেপাশের যাত্রীরা মুখ টিপে হাসছে দেখে আমি আর কথা বাড়ালাম না। ঢাকা থেকে আগত ফ্লাইট কিছুক্ষণের মধ্যেই আবতারন করবে। তাই ঢাকাগামী ইউএস বাংলা ফ্লাইটের যাত্রীদের প্রস্তুত থাকার জন্য এনাউন্স করা হল।
আমি টিকেট মোবাইল মানিব্যাগ সব ঠিকঠাক আছে কিনা পকেটে চেক করে দেখলাম। কিছুক্ষণ পর বিমান আসলে নিজের সিট খুঁজে বসে পড়লাম। আজ প্যাসেঞ্জার অল্প, অনেক সিট খালি পরে আছে।
বিমান ফ্লাই করার পর মেয়েটি আমাকে ডেকে বলল, ভাই আপনার বাসায় আমাকে কয়েক দিন থাকতে দেবেন? তাদের দুজনার সিট ছিল আমার পিছনের সিট দুটোতেই। আমি তো শুনে অবাক, বলে কি! এতো সত্যিই তারছেঁড়া পাবলিক। চেনা নাই জানা নাই, আমার বাসায় থাকবে!
আমাকে চুপ থাকতে দেখে মেয়েটি আবার বলল, আপনার বাসায় না রাখতে পারলে আপাতত আমাকে একটা বাসা ঠিক করে দিলেও চলবে।
আমি বললাম দেখুন আপু, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি হতেই পারে। বাইরের মানুষের সামনে নিজেদের সম্মান নষ্ট না করে সেগুলো ঘরে বসেই মিটমাট করা উচিত।মেয়েটি বেশ ঝাঁঝ নিয়ে বলল, আর ঝগড়া করবনা। আমি ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। এবার ঢাকায় গিয়েই ওকে ডিভোর্স দিব।
আমি তাদের দুজনকে স্বামী-স্ত্রীর মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং উপর কিছু বয়ান দিলাম। তেমন কোনো উপকার হল বলে মনে হচ্ছে না। একটুপরে বিমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করল। আমি আমার ল্যাগেজ নিয়ে যখন বেড়িয়ে যাচ্ছিলাম তখন মেয়েটি এসে বলল, ভাইয়া আপনার গাড়িতে করে আমাকে একটু পান্থপথে নামিয়ে দেবেন ?
এতো ভালো যন্ত্রনায় পড়া গেল দেখছি! আমি কিছু না বলে আদরের ভঙ্গীতে তার কোলের বাচ্চাটির গাল টিপে দিলাম। মেয়েটির হাজবেন্ডের সাথে ‘বেস্ট অফ লাক’ বলে হ্যান্ডশেক করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গেলাম।
বাসায় পৌছালাম সাড়ে বারোটার দিকে। তরকারি রান্নার ঝামেলা নেই। শ্বাশুড়ি গোস্তভূনা করে বক্সে ভরে দিয়ে দিয়েছে। শুধু ভাত রান্না করতে হবে।
গোসল করে চুলোয় ভাত বসিয়ে গেলাম নামাজ পড়তে। নামাজ শেষ করে দেখি ভাতে বলক উঠেছে, হতে আরও সময় লাগবে। আমি সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ফেসবুকিংএ মগ্ন হয়ে গেলাম। কতক্ষন পর পোড়া গন্ধ পেয়ে দৌড়ে কিচেনে গিয়ে দেখি ভাত পুড়ে বার-বি-কিউ হয়ে গেছে।
ধুত্তেরি, এখন আবার পাতিল পরিস্কার করে ভাত রান্না করতে হবে। নিজে নিজের প্রতি বিরক্তিতে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘ফেসবুকের গুষ্টি কিলাই’।
.
তথ্যসূত্র:
মুক্তবুলি ম্যাগাজিন (প্রিন্ট ভার্সন)
১৪তম সংখ্যা, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০২০