বখতিয়ার খলজি কোনোদিন নালন্দায় যাননি; তাই বখতিয়ার কর্তৃক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের প্রশ্নই ওঠে না

 

নালন্দা মহাবিহার পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা সর্বপ্রথম আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি প্রাচীন উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের বিহারের পাটনা থেকে ৮৮ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গড়ে তোলা একটি প্রতিষ্ঠান যা পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ খ্রিষ্টীয় শতাব্দির মধ্যে নির্মিত।

এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঠিক সময়কাল নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকই একমত যে রাজা কুমারগুপ্তের সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা মগধে ৪২৭ সালে নালন্দা প্রতিষ্ঠিত হয়। নালন্দা মূলত বৌদ্ধধর্মের গবেষণা ও ধর্মচর্চার জন্য নির্মিত হলেও সেখানে হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত¡, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত¡, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অনেক বিষয় পড়ানো হতো। এ বিদ্যালয়ে বিদ্যার্জনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তথা তিব্বত, চীন, কোরিয়া, গ্রিস, পার্সিয়া, তুরস্ক থেকে বহু শিক্ষার্থীর সমাগম হতো।

শিল্পীর চোখে বখতিয়ার থলজি : kalayi.blogspot.com

২০০৬ সালে চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুরের সহায়তায় মাটিতে চাপা পড়া ধ্বংসস্ত‚প থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। নালন্দাকে উদ্ধারের পর এর ব্যাপ্তি, ভবনগুলোর কাঠামো ও স্থাপত্যশিল্প দেখে পুরো বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। ৮০০ বছর পর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আবারো চালু করা হয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রমণের মুখে পড়ে। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.) প্রচণ্ড রকমের বৌদ্ধবিদ্বেষী মিহিরাকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। তারা নির্মমভাবে বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধররা নালন্দাকে পুনর্গঠন করেন। প্রায় দেড় শতাব্দি পরে আবার এটি ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। মুর্শিদাবাদের শাসক শশাঙ্ক রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাস বিরোধে লিপ্ত হন। যার ফলে রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করেন। বুদ্ধের পদচিহ্নকে খণ্ড-বিখণ্ড করেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের সফরনামায় শশাঙ্কের সন্ত্রাসের ইতিহাস ফুটে উঠেছে।

বিভিন্ন ব্লগ, ওয়েবসাইট, খবরের কাগজ ও সোস্যাল মিডিয়ায় মুহাম্মাদ বখতিয়ারের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ আরোপ করা হয়। তাকে অত্যাচারী, আক্রমণকারী, হিন্দু-বৌদ্ধ নিধনকারী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথচ এগুলো সর্বৈব মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক, গাঁজাখুরি। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। পূর্বোক্ত ও পরবর্তী আলোচনায় ইটা স্পষ্ট। মানুষ লুণ্ঠন করে স্বর্ণ, রৌপ্য, অর্থকড়ি, টাকাপয়সা। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব মূল্যবান ও দামিও সম্পদ থাকার কথা নয়। তাই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা ওদন্তপুরি বিহার লুণ্ঠন করার প্রশ্নই আসে না।

দ্বাদশ শতকে তুর্কি বাহিনীর এক অভিযানের সময় নালন্দা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। (দৈনিক প্রথম আলো, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪, বিবিসি বাংলা পহেলা সেপ্টেম্বর ২০১৪, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া) বখতিয়ার খলজি ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথম আলো, বিবিসি, বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়ার কেন এই মিথ্যাচার? এমনকি ভারতের রাজ্যসভায়ও ২০১৪ সালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সভায় কংগ্রেস সদস্য করণ সিং ও সিপিএম সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে নালন্দা বিলুপ্তি নিয়ে বাহাস হয়। করণ সিং অধিবেশনে বখতিয়ার খলজি যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন সেটি উল্লেখ করেন। দুঃখের বিষয়, ইতিহাস এখন ঐতিহাসিক একাডেমিনিসিয়ানদের হাত থেকে রাহাজান হয়ে মতলববাজ রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও হলুদ সাংবাদিকদের দখলে চলে গেছে। এ জন্যই দুনিয়াজুড়ে এত অশান্তি, বিপর্যয়।

দুর্মুখেরা মিনহাজই সিরাজের তবাকাত-ই-নাসিরির সূত্রে নালন্দা ধ্বংসের বিভ্রান্ত তথ্যটি পেশ করে থাকেন। কিন্তু মিনহাজের বয়ানে এ রকম তথ্য নেই। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও কথাসাহিত্যিক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায় মিনহাজের বিবরণী ‘বাংলার ইতিহাস’ শীর্ষক কিতাবে তরজমা করেছেন (সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-৩-৬)। ঐতিহাসিক মিনহাজের বর্ণনায় বিহার ও নদীয়া জয়ের কাহিনী পাওয়া যায়। নালন্দা অভিযান, নালন্দা জয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কোনো ঘটনা বা তথ্য বর্ণিত হয়নি। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আবদুল করিমও সহমত। এ দুজন গবেষকই বখতিয়ার খলজির ওপর ব্যাপক গবেষণা করেছেন (আবদুল করিম : বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, পৃ-৮০-৯০), বাংলার ইতিহাস মুসলিম বিজয় থেকে সিপাহী বিপ্লব, পৃ-১৫-২২ এবং সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-৩-২৪)। তাছাড়া শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার : ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ কিতাবে (পৃ-১০২-১০৬)। মিনহাজের তাওয়ারিখ ও বখতিয়ার সংক্রান্ত তথ্যাবলির বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। এ তিন বরেণ্য মনীষী তাদের কোনো ইতিহাস গ্রন্থে বখতিয়ারের নালন্দায় অভিযানের সত্যতা স্বীকার করেননি। আর সি মজুমদার বলেছেন, বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা দেশ জয় সম্বন্ধে যত কাহিনী ও মতবাদ প্রচলিত আছে, তা মিনহাজের বিবরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ সম্বন্ধে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় নাই’ (শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার : বাংলা দেশের ইতিহাস, পৃ- ১০৪)। পরবর্তীকালের আরো দুটি তাওয়ারিখ (ইতিহাস গ্রন্থ) ইসামি রচিত ফুতুহ-উস-সালাতিন এবং হাসান নিজামি রচিত তাজ-উল-মাসিরেও নালন্দা অভিযানের কোনো ঘটনা নেই। তারপরও বখতিয়ার বিদ্বেষীরা কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তুর্কি মুজাহিদদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন।

[বখতিয়ারের নামে এ ছবিটা বেশি বেশি প্রচার করছে বাম-রাম-ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা। কিন্তু এটা্ একটি কাল্পনিক, বানোয়াট, মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছবি। কোনো শিল্পী সেখানে হাজির ছিলেন না।]

ওদন্তপুরী বিহারের বিষয়টা আলাদা। কারও কারও মতে, সেখানে শত্রুসৈন্যদের দুর্গ মনে করে ভুলবশত খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। মুয়াররিখ মিনহাজের বয়ানে জানা যায়, বখতিয়ার বিহার দুর্গে অভিযান চালান। এ জায়গার বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিল নেড়া মাথা ব্রাহ্মণ। ড. আবদুল করিম ও সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে, এটি ছিল একটি বৌদ্ধ বিহার। যার নাম উদন্তপুর (আবদুল করিম : বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল, পৃ-৮২ এবং সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-৪)। তবে ড. দীনেশচন্দ্র সরকার দেখিয়েছেন, উদন্তপুর বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। এ ছাড়া আরো অনেক গবেষক বলেছেন, উদন্তপুর ধ্বংস হয় ১১৯১-৯৩ সময়কালে। অথচ সুখময় মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, বখতিয়ার বিহার বিজয় করেন ১২০৪ সালে (সুখময় মুখোপাধ্যায় : বাংলার ইতিহাস, পৃ-২৪) তাই বখতিয়ার কর্তৃক উদন্তপুর বা ওদন্তপুর বিহার ধ্বংসের কাহিনীও নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। অন্য কেউ সেটা নিশ্চিহ্ন করতে পারে বা দৈব দুর্বিপাকেও পরিত্যক্ত হতে পারে। তাছাড়া সেটা কোনো স্বর্ণভাণ্ডার বা গুপ্তধনকেন্দ্র নয়, সেখানে লুটতরাজ চালাতে হবে। তাছাড়া বই কিতাবাদি বিনষ্টের ঘটনাও নির্ভরযোগ্য নয়। আবার কোনো কোনো গবেষক প্রমাণ করেছেন, সেন রাজাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্তচররা তুর্কি বাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওদন্তপুরীতে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে।

রূপক ছবি

এতদ্ব্যতীত মুয়াররিখ গোলাম হোসেন সলিম, চার্লস স্টুয়ার্ট, ড. এম আবদুল কাদের, ড. এম এ রহীম, ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, আবদুল জব্বার, মোহাম্মাদ হান্নান, মোহাম্মাদ আবদুল মান্নান, সরকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ড. মোহাম্মদ আবদুর রহিম, মোহর আলী, ড. মমিন চৌধুরী, ড. এ বি এম মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম, সিরাজ উদদীন আহমদ, ড. কে এম মোহসীন, ড. আসকার ইবনে শাইখ, ড. এম এ আজিজ, এম আর আখতার মুকুল, জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ গবেষক বা ঐতিহাসিকরাও কেউ বখতিয়ারের নালন্দা অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করেননি।

তারপরও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার গ্রন্থরাজি পোড়ানোর কাল্পনিক অভিযোগ কেন দাঁড় করানো হয় বখতিয়ার খলজির নামে? প্রকৃতপক্ষে এটা ব্রাহ্মণ্যবাদী কারসাজি। মুসলমানদের সন্ত্রাসী জঙ্গি বানানোর অতি প্রাচীন নীতিকে তারা আজও লালন করছে। একই সাথে তাদের প্রতারণা, শঠতা, মিথ্যাচার, বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখছে। এই কাজে কারা জড়িত বা কারা এরূপ নিধনপ্রক্রিয়ায় জড়িত নিচের আলোচনা থেকে বিষয়টি অবহিত হওয়া যাবে। ইসলাম বরাবর সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধ্বংসযজ্ঞের বিপক্ষে। নামজাদা বুদ্ধিজীবী গোপাল হালদার বলেছেন, ‘হিন্দুধর্মের পরিবেশ ভারতবর্ষ। তাই এ ধর্মকে সত্যই ‘ভারতধর্ম’ও বলা চলে। এ দেশের নদ-নদী, গিরিপর্বত, আহার্য পানীয় এবং এর ইতিহাসের উপলব্ধিই হলো সেই হিন্দুধর্মের দেহ ও প্রাণ। ইসলাম দেশগত বা জাতিগত ধর্ম নয়, তা সব মানুষের একমাত্র ধর্ম হইবার স্পর্ধা রাখে।— ইসলাম কোনো জাতির ধর্ম নয়, প্রচারশীল ধর্ম। উহা অন্যকে জয় করিয়াই ক্ষান্ত হয় না। কোলে টানিয়া লয়। তাই ইসলামের বিজাতীয় ও বিজেতা প্রচারকের দল ভারতের জনগণকে বিন্দুমাত্রও অবজ্ঞা করিল না (গোপাল হালদার : সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃ-১৮০-১৮১)। ইসলামি নীতিতে সব মানুষ সুষম অধিকার ভোগ করবে। সেখানে বেইনসাফির সুযোগ নেই।

আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন বৌদ্ধদের প্রতি হিন্দুদের অনেক অত্যাচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বৃহৎবঙ্গ প্রথম খণ্ড শীর্ষক কিতাবে লিখেছেন, হিন্দুরা শুধু বৌদ্ধদের অত্যাচার ও তাদের ধর্ম নষ্ট করে ক্ষান্ত হননি, তারা এতকালের সঞ্চিত বৌদ্ধ ভাণ্ডারের সর্বৈব লুণ্ঠন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির উপর স্বীয় নামাঙ্কের ছাপ দিয়ে সামগ্রিকভাবে সর্ববিধ নিজস্ব করে নিয়েছেন। হিন্দুদের পরবর্তী ন্যায়, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদির মধ্যে এ লুণ্ঠন পরিচয় পাওয়া যায়। এভাবে হিন্দুগণ কর্তৃক বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যময় ইতিহাস বিলোপ প্রাপ্ত হয়েছে। এর জন্য হিন্দুগণই একমাত্র দায়ী (সংগৃহীত, ভিক্ষু সুনীথানন্দ : বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, পৃ-৭৮)। হিন্দুরাই বৌদ্ধকীর্তি নিধনের নায়ক। তারপরও আজ হিন্দু-বৌদ্ধ মিলে বখতিয়ারকে দোষারোপ করছে। যিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এলেন আজ তাকেই খলনায়ক বানাচ্ছে উপকারভোগীরা!

বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করে দেন বখতিয়ার খলজি : pantip.com

বিশ্ববরেণ্য নামজাদা দার্শনিক মানবেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধ-বিপ্লব যখন পর্যুদস্ত হয়ে গেল আর তাতেই হলো ভারতের সমাজে বিশঙ্খলার উৎপত্তি; তখন অগণিত জনসসাধারণ তা থেকে স্বস্তি ও মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচার জন্য ইসলামের বার্তাকেই জানালো সাদর সম্ভাষণ (এম এন রায় : ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, পৃ-৮৬-৮৭)। ইসলাম চিরদিন জ্ঞানার্জন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকাশের পক্ষে। আল কুরআনে প্রথম আহবান ইকর বা পড়। দুনিয়ার সব মহামানবদের মধ্যে ইলম অর্জনকে বা লেখাপড়াকে সর্বাপেক্ষা বেশি উৎসাহিত করছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:। তাই তাঁর উত্তরাধিকারের পক্ষে বইপুস্তক পোড়ানো বা বিশ^বিদ্যালয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো অসম্ভব ব্যাপার। ব্রিটিশ সিভিলিয়ান এফ বি ব্রাডলি বার্ট বলেন, ‘প্রাচীন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পূর্ব বাংলার প্রাথমিক যুগও রহস্যের দুর্ভেদ্য অবগুণ্ঠনে আবৃত। মুসলিম অভিযানের পূর্ববর্তী সময়ের যা কিছু জানা যায়, তা উপখ্যান ও লোককাহিনী মাত্র। মুসলমানদের আগে এ দেশে বৌদ্ধ এবং হিন্দুরা বাস করত। তারা ইতিহাস লিখতে জানত না। বংশপঞ্জি সঙ্কলনের মধ্যেই তাদের সাহিত্য-নৈপুণ্য সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়। দেশের স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি তারা লিপিবদ্ধ করত না।— কেউ যদি তা করত (ইতিহাস রচনা), তবে নিশ্চয়ই তার লিখিত কাগজপত্রসুদ্ধ তাকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হতো (এফ বি ব্রাডলি বার্ট : প্রাচ্যের রহস্য নগরী, পৃ-১৭-১৮)। বাংলাদেশের আদিম জনসাধারণকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস-দর্শন-চিকিৎসা শিক্ষা দিয়েছেই মুসলমান উস্তাদরা। এখানে জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ বিবেচনায় আনা হয়নি। ভয়ঙ্কর উগ্র মুসলিম বিরোধী ই বি হ্যাভেল নিতান্ত অনিচ্ছা সত্তে¡ও ‘এরিয়ান রুল ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, মুসলমান রাজনৈতিক মতবাদ শুদ্রকে দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার, আর ব্রাহ্মণদের উপরেও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা। ইউরোপের পুনর্জাগরণের মতো চিন্তাজগতে এও তুলেছে তরঙ্গাভিঘাত, জন্ম দিয়েছে অগণিত দৃঢ় মানুষের আর অনেক অত্যদ্ভূত মৌলিক প্রতিভার। পুনর্জাগরণের মতোই এও ছিল আসলে এক পৌঢ় আদর্শ।— এরই ফলে গড়ে উঠল বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা (সংগৃহীত, এম এন রায় : ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, পৃ-৮৭-৮৮)। বখতিয়ারের বাংলা জয় কোনো উপনিবেশবাদী বিপ্লব ছিলো না। এটা ছিলো আমজনতার গণবিপ্লবও বটে।

হদিসঃ
১. আবুল মাল আবদুল মুহিত: বাংলাদেশ: জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, সাহিত্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০০, ৫১ পুরানা পল্টন ঢাকা-১০০০
২. আবদুল করিম: বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, জানুয়ারি ১৯৯৯
৩. সুখময় মুখোপাধ্যায়: বাংলার ইতিহাস ১২০৪-১৫৭৬, খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি, ৬৭ প্যারীদাস রোড ঢাকা-১১০০, এপ্রিল ২০০০
৪. রিচার্ড এম. ইটন: ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ (তরযমা- হাসান শরীফ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০৮
৫. আবদুল করিম: বাংলার ইতিহাস মুসলিম বিজয় থেকে সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত (১২০০-১৮৫৭), বড়াল প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০, আগস্ট ১৯৯৯
৬. বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া; সংগৃহীত: ১১ মে ২০১৭; ইন্টারনেট, ব্লগ, অনলাইন কাগজ ইত্যাদি
৭. ভিক্ষু সুনীথানন্দ: বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহার ও ভিক্ষু জীবন, বাংলা একাডেমি ঢাকা, জুন ১৯৯৫
৮. এফ বি ব্রাডলী বার্ট: জড়সধহপব ড়ভ ধহ ঊধংঃবৎহ ঈধঢ়রঃধষ, (তরযমা: রহীম উদ্দীন সিদ্দিকী, প্রাচ্যের রহস্য নগরী) নবরাগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০, ফেব্রুয়ারি ২০০৭
৯. গোলাম হোসায়ন সলীম ঃ বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতীনের বাংলা তরযমা), আকবরউদ্দীন কর্তৃক তরযমা, অবসর প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৮
১০. শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলা দেশের ইতিহাস, প্রথম খ-, প্রাচীন যুগ (বাংলা তরযমা), চতুর্থ সংস্করণ, কলকাতা
১১. মোহাম্মদ আবদুল মান্নানঃ বাংলা ও বাংগালীর মুক্তি সংগ্রামের মূলধারা, বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৪
১২. ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), অনুপম প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, তৃতীয় সংস্করণ, ডিসেম্বর ১৯৯৯
১৩. এ. এফ. এম আব্দুল জলীল: সুন্দরবনের ইতিহাস, আহমদ পাবলিশিং হাউস, বাংলাবাজার ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ জুন ২০০২
১৪. বাংলাদেশের উৎপত্তি ও বিকাশ প্রথম খ-, সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ জুন ২০০৮
১৫. ড. এস এম রফিকুল ইসলাম: প্রাচীন বাংলার সামাজিক ইতিহাস: সেনযুগ, বাংলা একাডেমি ঢাকা, প্রথম প্রকাশ মে ২০০১
১৬. প্রথম প্রভাত, বঙ্গবিজয়ের ৭৯৩ তম স্মারক, ধানমন্ডি ঢাকা, জানুয়ারি ১৯৯৭
১৭. শফীউদ্দিন সরদারঃ বখতিয়ারের তলোয়ার, মদীনা পাবলিকেশানস, বাংলাবাজার ঢাকা, সপ্তম সংস্করণ, মার্চ ২০১১
১৮. ড. আসকার ইবনে শাইখ: রাজ্য রাজা রাজধানী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ এপ্রিল ২০০৫
১৯. ড. আসকার ইবনে শাইখ: মুসলিম আমল বাংলার শাসনকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০০৪
২০. গোপাল হালদার: সংস্কৃতির রূপান্তর, পুথিঘর, ২২ নং লর্ড কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট, কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
২১. এম. এন. রায়: ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, (তরযমা- আবদুল হাই), মল্লিক ব্রাদার্স, ৫৫ কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা ৭৩, ভারত, দ্বিতীয় সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৫
২২. ড. এম. এ. রহিম: বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতি ইতিহাস প্রথম খ-, (তরযমা- মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান) বাংলা একাডেমি ঢাকা, দ্বিতীয় পুন:মুদ্রণ, জুন ২০০৮
২৩. শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন: প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান, পলাশ প্রকাশনী, ১০ কবি জসিমউদদীন রোড, ঢাকা ১২১৭, প্রথম পলাশ প্রকাশনী সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২ইং
২৪. মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান,বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা
২৫। সুরজিৎ দাশগুপ্ত: ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সাহিত্য প্রকাশ, ৮৭ পুরানা পল্টন লাইন, ঢাকা ১০০০, প্রথম বাংলাদেশ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৪

বি.দ্র.
১। ১২ মে ১২০৫ ইসায়ি সন বখতিয়ার খলজি বাঙলায় মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
২। ১২ মে ২০১৭ বখতিয়ার খলজির বাঙলা বিজয়ের ৮১৩ তম বার্ষিকী উদযাপন করুন
৩। ১২ মে বখতিয়ার দিবস পালন করুন।

ছবি ঃ  ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত; 16.01.2018

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *