আ. খা. মো. আবদুর রব
এক.
বাংলাদেশের সাথে মুসলমানদের যোগাযোগ বহু দিনের। কিন্তু ঠিক কবে কোন মুসলমান সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আগমন করেন তার সঠিক কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ, এ সম্বন্ধে সর্বপ্রাচীন প্রমাণাদি কালগ্রাসে নিপতিত হয়েছে বলে মনে হয়। হিন্দুদের ইতিহাস রচনার অভ্যাস ছিল না। কাজেই তাদের রাজনৈতিক বা অন্যবিধ কোন ইতিহাস নেই। মুসলমানগণ ইতিহাস লেখার সূচনা করলেও সে যুগে তারা মোটামুটি রাজনৈতিক ঘটনাবলির ইতিহাস লিখেই তাদের কর্তব্য সমাধা হয়ে গেল বলে মনে করতেন। সামাজিক ইতিহাস রচনার গুরুত্ব তারা তখন উপলব্ধি করেননি। এজন্যই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন বহুপূর্ব থেকে শুরু হলেও তার সঠিক প্রমাণ পাওয়া কঠিন। তবে রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে বৌদ্ধস্তূপে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশিদের আমলের (খ্রি.৭৮৬-৮০৯ অব্দ) একটি স্বর্ণমুদ্রা এবং কুমিল্লা জেলার ময়নামতীতে অনুরূপ খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত কতিপয় আরবি মুদ্রাকে আরবীয় মুসলমানদের সংযোগের প্রচীনতম ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে পন্ডিতরা মনে করেন। এর মাধ্যমে তাঁরা খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের শেষের দিকে অথবা নবম শতকের গোড়ার দিকে এই অঞ্চলের সাথে আরবীয় মুসলমানদের প্রথম সংযোগ ঘটে বলে অনুমান করেন। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত মুদ্রাটিতে ১৭২ হিজরি সনের (খ্রি.৭৮৮ অব্দ) তারিখ দেওয়া রয়েছে। পাহাড়পুরের স্তূপটি গৌড়ের পাল বংশীয় রাজা ধর্মপাল (আনু. খ্রি. ৭৭০-৮১০অব্দ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ময়নামতীর শালবন বিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেব বংশীয় রাজা ভবদেব। খলিফা হারুন-অর-রশিদ ছিলেন রাজা ধর্মপাল ও রাজা ভবদেবের সমসাময়িক নৃপতি। সুতরাং খলিফার মুদ্রা তাঁর শাসনামলেই কিংবা তার অব্যবহিত কিছুকালের মধ্যেই ধর্মপালের রাজ্যে এবং আরবীয় মুদ্রাগুলি তার প্রায় সমসময়েই বৌদ্ধ রাজা ভবদেবের রাজ্যে এসে পৌঁছায় বলে ধরে নেয়া যায়। সম্ভবত ইসলামের কোন এক বা একাধিক ধর্মপ্রচারকের মাধ্যমেই মুদ্রাগুলি এদেশে আনীত হয়েছিল। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত মুদ্রাটি সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হক এর অভিমত এখানে প্রধানযোগ্য। তিনি বলেন,
‘হিন্দু সভ্যতার কোন কোন প্রাচীন কেন্দ্রে এই যুগের আরব-পারস্যের মুসলিম সাধক ও ধর্ম প্রচারকদের আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। আমাদের বিশ্বাস এইরূপ কোন ইসলাম প্রচারকের দ্বারা পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারে খলিফার এই মুদ্রাটি নীত হয়। সম্ভবত যিনি এই মুদ্রাটি সঙ্গে লইয়া তথায় ইসলাম প্রচার করিতে ভ্রমণ করেন, তিনি বৌদ্ধদের হাতে প্রাণ হারাইয়া ছিলেন এবং তাঁহার মুদ্রাটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হস্তগত হইয়াছিল। যে রূপেই হউক, পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত খলিফার এই মুদ্রাটি অন্তত খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে উত্তর বঙ্গের সহিত ইসলামের সমন্ধ সূচনা করিতেছে’।
এই ধর্ম প্রচারক জ্ঞানের অনুসন্ধানে খলিফা কর্তৃক প্রেরিত কোন দূতও হতে পারেন। ইতিহাস বলে, কতিপয় সিন্ধু দেশীয় পন্ডিতকে সে সময় বগদাদে নিয়ে গিয়ে তাঁদেরই সহায়তায় প্রাচীণ ভারতের বিশিষ্ট পন্ডিত ব্রহ্মগুপ্তের জ্যোতিবিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রন্থ ‘ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত’ এর আরবি অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। অনুরূপভাবে সে সময় মুসলিম মনীষীদেরও বিভিন্ন্ দেশে জ্ঞানের অনুসন্ধানে পাঠানো হয়েছিল। সুতরাং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আহরণের জন্য সে সময় কোন মুসলিম মনীষী খলিফা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে এদেশে আগমন করেছিলেন বলে অনুমান করা চলে। গৌড় ও সমতট ছিল দুটি পাশাপাশি রাজ্য, আর সমতটের তৎকালীন রাজা ভবদেবও ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। রাজা ধর্ম পালের রাজধানীতে আগত খলিফার দূত উক্ত মুসলিম ধর্ম প্রচারক রাজা ভবদেবের রাজধানী ময়নামতীও পরিদর্শন করেছিলেন-এরূপ অনুমানকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। মোটকথা, পাহাড়পুর ও ময়নামতী বৌদ্ধ বিহারে প্রাপ্ত আরবীয় মুদ্রা থেকে একথা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, খলিফা হারুন-অর-রশিদের সমসময়ে কিংবা তাঁর শাসনামলের অব্যবহিত কিছুকালের মধ্যেই সম্ভবত তৎকালীন গৌড়, সমতট ও বঙ্গ অঞ্চলের সাথে ইসলাম ও মুসলিম মনীষার প্রথম সংযোগ ঘটে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম ও নিবঙ্গের সমুদ্রোপকূলবর্তী স্থান সমূহের সাথে অনেক আগে থেকেই আরবীয় বণিকদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে কতিপয় আরব পর্যটকের ভৌগোলিক বিবরণ থেকে জানা যায়। একটি সাহসী নাবিক ও বণিক জাতি হিসেবে আরবরা প্রাচীনকাল থেকেই প্রসিদ্ধ। সে যুগে তারাই ছিল সাতসাগরের মালিক। নৌ বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সাধনে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন এবং নৌযান পরিচালনার জন্য তাঁরাই মানচিত্র তৈরি করেন ও ‘কুতুবনামা’ বা কম্পাস অবিষ্কার করেন।
এই আরব পর্যটকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মুসলমান পর্যটক তাঁদের গ্রন্থে আরব বণিকদের বাণিজ্যপথ বা বাণিজ্য সংক্রান্ত নানা বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। এদের মধ্যে সুলায়মান তাজেরের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘সিলসিলাত-উত্-তাওয়ারিখ’ নামের বিখ্যাত গ্রন্থটি ৮৫১ খিস্টাব্দ বা তার কাছাকাছি সময়ে রচিত হয়। অন্যান্য মুসলমান ভূগোলবিদ পর্যটকেরা হচ্ছেন: ইবনে খুরদাদবিহ (মৃত্যু ৯২২ খ্রি.), আল ইদ্রিসী (জন্ম খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের শেষাব্দে), আল মাসুদী (মৃত্যু ৯৫৬ খ্রি.) প্রমুখ মণীষীবৃন্দ। ইবনে খুরদাদবিহ তাঁর ‘কিতাব উল মাসালিক ওয়াল মামালিক’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম আরব দেশ হতে চীন দেশ পর্যন্ত মুসলমান বণিকদের বাণিজ্য পথ বর্ণনা করেন। ঐ সময়ে আরবের মুসলমান বণিকদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ, বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর উৎপত্তিস্থল, মূল্যমান ও আমদানি-রপ্তানি বিষয়ক খুঁটিনাটি বিষয় আরবদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল। এ কারণেই আরব ভূগোলবিদ পর্যটকদের মধ্যে এই প্রচেষ্টা দেখা দেয়।
এই আরব ভূগোলবিদ পর্যটকদের বিবরণে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমত- তাঁরা তাতে এমন এক দেশের বিবরণ দিয়েছেন, যাকে আধুনিক গবেষকরা বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেছেন। দ্বিতীয়ত- তাঁরা এমন কতকগুলি বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী বাংলাদেশের বাণিজ্যকেন্দ্র সমূহের সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয় ।
আরাকান রাজবংশীয় উপাখ্যান ‘রাদজা-তুয়ে’-তে একটি কথা লিপিবদ্ধ আছে, ‘এই সময়ের শেষভাগে কান-রা – দজা-গী এর বংশধর মত্যইঙ্গত চন্দয়ত সিংহাসন অরোহণ করেন। এই রাজা ২২ বছর রাজত্ব করিবার পর মারা যান। কথিত আছে যে, তাঁহার সময়ে (খ্রি. ৭৮৮-৮১০ অব্দ) কয়েকটি কুল অর্থাৎ বিদেশী জাহাজ রণবী দ্বীপের সঙ্গে সংঘর্ষে ভাঙ্গিয়া যায় এবং জাহাজের মুসলমান আরোহীদিগকে আরাকানে নিয়া যাওয়া হয়। সেখানে তাহারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস শুরু করে।’
আরব বণিকেরা যে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ব্যবসা চালান এটা তার বড় প্রমাণ। উল্লেখিত মুসলমান বণিকেরা সম্ভবত আরব দেশীয় ছিলেন এবং চাটগাঁ থেকে উপকূল বেয়ে দক্ষিণ মুখে যাবার পথে, কিংবা দক্ষিণ উপকূল হয়ে উত্তরে চাঁটগার দিকে এগোবার সময়ই সম্ভবত ঝঞ্ঝা তাড়িত হয়ে তারা ‘রণবী’ দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বস্তুত চাটগাঁয়ের সাথে আরবের সম্পর্ক এত প্রাচীন যে ‘চাটগাঁও নামটাও সম্ভবত তাদের দেওয়া। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতেও আরবদের যোগাযোগের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন- চট্টগ্রামী ভাষায় প্রচুর আরবি শব্দ ব্যবহৃত হয়, চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে ‘না’ সূচক শব্দের ব্যবহারও আরবি ভাষার প্রভাবের ফল।
এসব আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, চট্টগ্রাম ও নিম্মবঙ্গের বদ্বীপ অঞ্চলের সাথে ইসলামের সংযোগ বহু প্রাচীন কাল থেকেই শুরু হয়েছিল এবং এই সময়টাকে অন্তত অষ্টম শতক বলে নিঃসন্দেহে ধারণা করা যেতে পারে।
‘ফতহুল বুলদান’, ‘তোহফাতুল মুজাহেদিন’ ও অন্যান্য কিংবদন্তি জাতীয় আরব ইতিহাসে দেখা যায় যে, আরব মুসলমানগণ ইসলামের মহানবী (স.) এর জীবদ্দশাতেই বাণিজ্য ব্যপদেশে ভারত উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলের কালিকট ও মাশাবার এলাকা, মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ এবং সিংহল বা সরন্দ্বীপ প্রভৃতি স্থান হয়ে ব্রহ্মদেশ, মালয়, যাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও, শ্যাম, ইন্দোচীন এবং সুদূর চীন দেশের ক্যন্টন প্রভৃতি স্থানে গমন করতেন। ক্যন্টনে একটি প্রাচীন মসজিদ এখনও বিদ্যমান আছে । বলা হয়ে থাকে যে, রসূলুল্লাহ (স.) এর একজন সাহাবি কর্তৃক তা প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত সাহাবি সম্ভবত বৈদেশিক বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং বাণিজ্য ব্যপদেশেই চীন দেশে গিয়ে তিনি উক্ত মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করে থাকবেন।
এ শ্রেণির কোন কোন আরব বণিক সুদূর প্রচ্যের যাত্রাপথে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ নোঙর করে যাত্রা বিরতি করতেন এবং এভাবেই চাটগাঁ ও নিম্মবঙ্গের কোন কোন স্থানের সাথে তাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় বলে মনে করা হয়। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সাথে আরব মুসলমানদের সংযোগের ইতিহাস খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত, এমন কি, ‘Peripus of Erythrean sea’ এর বর্ণনার আলোকে বাংলাদেশের সাথে আরব বণিকদের এ সম্পর্ক খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব। সুতরাং দেখা যায়, ইসলামের জন্মভূমি আরব দেশের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বহু বহু প্রাচীন। এসব বিবেচনার বাংলাদেশে মুসলমান আগমনের সূচনা কালটা খ্রিস্টীয় সপ্তম কিবাং নিদেনপক্ষে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে বলে অতি সহজেই ধরে নেওয়া যায়।
ভারত উপমহাদেশে আরব মুসলমানদের আগমনের দুইটি পথের কথা ইতিহাস পাঠে জানা যায়। একটি জলপথ আর অপরটি স্থলপথ। এই দুই পথ ধরেই আরবীয় মুসলমানেরা বাংলাদেশে আগমন করেছেন। পূর্ব ও নিম্মবঙ্গে প্রধানত জলপথেই বাণিজ্য ব্যপদেশ তাদের আগমন ঘটে। আর সম্ভবত ধর্ম প্রচার ব্যপদেশে স্থুলপথে উত্তর বঙ্গের সাথে তাঁদের যোগাযোগ ঘটে। এখন বাংলাদেশে স্থলপথে বা সড়ক পথে যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত ছিল বলে প্রাচীন চৈনিক পরিব্রাজক ফাহিয়েন ( আনু খ্রি. ৫ম শতক) হিউয়েন সাঙ ( আনু খ্রি. ৭ম শতক ), ইৎসিঙ ( খ্রি. ৭ম শতক ) প্রমুখের বিবরণী থেকে জানা যায়।
তাদের বিবরণীতে এই সকল পথের আংশিক বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। এই সমস্ত পথ কেবল অন্তর্বঙ্গ পথ নয়, এ সকল পথই বাংলাদেশের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংযোগ রক্ষা করত। মধ্যযুগেও এই পথগুলি বিদ্যমান ছিল। কথিত আছে যে, পাল সেনাবাহিনী বাংলাদেশের রাজধানী থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাব পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করেছিল। তাই পরবর্তী কালে পাঠান সম্রাট শের শাহ কর্তৃক পুনর্নিমিত হয়েছিল এবং তাই বর্তমানে ‘গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ’এ পরিণত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত আরব মুসলমানেরা এই পথে বাংলাদেশে আসেন এবং উত্তর বঙ্গের সাথে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেন।
ব্যবসা বাণিজ্যই মুসলমান আরব বণিকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্দেহ নেই। তবে বাণিজ্যিক পণ্যের সাথে তারা ইসলামের মঙ্গল বাণীও বাংলাদেশে বহন করে নিয়ে আসেন- প্রাচ্যদেশসমূহে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পাঠে তা বোঝা যায়। এসব বণিক প্রায়ই দল বেঁধে বিদেশে সফর করতেন। এসব দলের মধ্যে থাকতেন মুসলমান ব্যবসায়ী সুফি দরবেশ, মুসলমান পর্যটক, সাধারণ মুসলমান নাগরিক প্রভৃতি বিভিন্ন্ ধরনের মানুষ। সর্বশক্তিমান এক আল্লাহ তায়লার সার্বভৌমত্বকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাঁর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ উপকরণ মানবসমাজকে তাঁরই নামে এক অবিচ্ছিন্ন্ ভ্রাতৃসমাজে পরিণত করা- ইসলামের এই মহান আদর্শের প্রেরণায় আত্মহারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন এইসব আরব মুসলমান আপনাপন কার্যোপলক্ষ্যে এই দেশে আগমন করেছিলেন। কেউ এসেছিলেন জ্ঞানের অনুসন্ধানে বিপুলা এই পৃথিবীর অজানাকে জানতে। কেননা, একটি বিখ্যাত আরবীয় প্রবাদে বলা হয়েছে ‘উত্লুবুল ইলমা অলাও কানা বিস্সিন’ অর্থাৎ সুদূর চীন দেশে হলেও জ্ঞানের সন্ধানে সেখানে গমন কর।
কাউকে আকর্ষণ করেছিল অপরিমেয় ঐশ্বর্যেভরা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশের পণ্য ও প্রাকৃতিক শোভা। কারণ, তেজারত তাঁদের মহানবী (স.) এরও অন্যতম জীবিকা ছিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়লা বলেন : সিরু ফিল আরদি অবতাগুমামিন্ ফাদলিল্লাহ্- ‘দুনিয়া পরিভ্রমণ কর এবং আল্লাহর তায়ালার অনুগ্রহসমূহ সন্ধান করে নাও।
বাংলাদেশের জড়বাদ, পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার কারো কারো প্রাণে ইসলামের মঙ্গলবাণী প্রচারের তীব্র আকাঙক্ষা জাগ্রত করেছিল, কেননা ইসলামের মহানবী (স) বলেছেন : ‘বাল্লিগু আন্নি অলাও কানা আইয়াহ’- অন্তত একটা বাক্য হলেও আমার বাণী সকলের নিকট পৌঁছিয়ে দাও। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে : ‘কুনতুম্খাইরা উম্মাতিন উখ্রেজাত্ লিন্নাস, তা’মুরুূনা বিল মা’রুফে অতানহাওনা অনিল মুন্কারি-তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ দল, মানুষের কল্যাণের নিমিত্ত তোমাদের উদ্ভব, মানুষকে তোমরা কল্যাণের পথ নির্দেশ কর এবং মন্দ কাজ থেকে তাদের বিরত কর। উপরন্ত ভারত উপমাহাদেশে ইসলামের অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে হযরত মুহম্মদ (স.) এর স্পষ্ট উৎসাহ প্রদান ও নির্দেশ থাকায় এবং খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের গোড়ার দিকে ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চল আরব শক্তির পদানত হওয়ায় এই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অভিযানের পূর্ব প্রস্ততির প্রচ্ছন্ন আকাঙক্ষা কাউকে কাউকে এদেশে আগমনে উদ্বুদ্ধ করেছিল হয়ত।
এভাবে ইসলামের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ বেসামরিক আরব মুসলমানেরা আপনাপন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবং আল্লাহ তায়লার বাণী ও মহানবী (স.) এর নির্দেশে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রমাগত বাংলাদেশে আগমন করতে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এই শ্রেণির প্রচারকদের দ্বারাই মালয়, সুমাত্রা, যাভা, বোর্নিও এবং চীনদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচ্যদেশের বিভিন্ন এলাকার ন্যায় বাংলাদেশে এসে এসব আরব মুসলমান মুখে মুখে ইসলামের তৌহিদী মতবাদ যেমন প্রচার করতেন, তেমনি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের উন্নত আদর্শ দ্বারা পরোক্ষভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করারও যথেষ্ট সুযোগ তারা পেয়েছিলেন। এভাবে চাটগাঁ ও নিম্মবঙ্গের সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থানগুলোতে এদেশে মুসলিম রাজশক্তির অভ্যুদয়ের অনেক আগেই কিছু কিছু লোক নবাগত আরব মুসলমানদের প্রভাবে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
বাণিজ্য ব্যপদেশে এই মুসলমান আরব বণিকেরা সিন্ধু, মালাবার, চীনের ক্যাণ্টনের ন্যায় বাংলাদেশেও ছোটখাট উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলেন সমম্ভবত। কেননা, বাংলাদেশে কেবল বাণিজ্যপযোগী সুন্দর সমুদ্র বন্দরই ছিল না, বাংলাদেশ ও আসামের অন্তরদেশে পদ্মা, মেঘনা, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের ধারা বেয়ে পণ্যের বাজার অনুসন্ধানেরও যথেষ্ট সুযোগ ছিল। এই সূত্রে বন্দর এলাকায় তারা এসব উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলেন এবং স্থানীয় রমনীদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে থাকবেন হয়ত। পরবর্তীকালের পর্তুগীজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকদের জীবন যাপন পদ্ধতির কথা স্মরণে রাখলে স্বভাবতই এ ধরনের অনুমান করা চলে। ইংরেজ আমলে দেখা যায়, বাঙ্গালি মুসলমানেরা বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমারে) বর্মী স্ত্রী গ্রহণ করতেন আর তাদের সন্তানেরা ‘জেরবাদী’ নামে পরিচিত হতো। মালা বারে মুসলিম আরব ঔপনিবেশিক ‘মোপলাদের’ ব্যাপারে অনুরূপ অবস্থাই লক্ষনীয়। সুতরাং চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বন্দর এলাকার এমনি সংকর মুসলমান হয়ত কিছু ছিল। চাটগাঁয় অঞ্চলের অধিবাসীদের দৈহিক গঠন, বিশেষত তাদের মুখাবয়বের আকৃতি, তাদের কথ্যভাষা, চাল চলন ও আচার ব্যবহারের মধ্যে আরবীয় প্রভাব এত বেশি নযরে পড়ে যে, স্বভাবতই ধারণা হয়- অনেক আগে থেকেই সম্ভবত এই অঞ্চলে আরবীয় রক্তের যথেষ্ট সংমিশ্রণ ঘটেছিল। রক্তের এহেন মিশ্রণ এই এলাকায় ইসলাম বিস্তৃতির অন্যতম কারণ মনে হয়। সম্ভবত এভাবেই চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বন্দর এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে ক্রমে বদ্ধি পায় এবং তারই ফলে বিখ্যাত মুর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৩৪৬ খ্রি.) এবং ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগীজ পরিব্রাজক বার্বোসা ‘সাদকাওয়ান’ (চাটগাঁও) ও নিম্ম বঙ্গের বন্দরগুলোতে গড়ে ওঠা বেশকিছু মুসলিম অধ্যুধিত উপনিবেশ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ।
বাণিজ্য ব্যপদেশে চট্টগ্রাম ও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বন্দর এলাকায় নবাগত এই সব মুসলমানের কারবার ছিল শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বণিক থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষের সাথে পর্যন্ত। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্রবহীন ছিলেন বলে জনসাধারণের সাথে মেলামেশা করতে তাদের কোনই অসুবিধা হতো না। তাছাড়া এদেশে মুসলমানদের প্রথম আবির্ভাবকালে এদেশের জনসাধারণ-আর্য, অনার্য, কোল, ভিল, দ্রাবিড়, মোঙ্গ, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, বৌদ্ধ প্রভৃতি বংশ ও ধর্মগত পার্থক্যে ও অনৈক্যে শতধা বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনরূপ জাতি বিদ্বেষ ছিল না। উত্তর ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভবিষ্যত বিপদাশঙ্কায় সন্ত্রস্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাজা মহারাজারা মুসলমান নরপতিদের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হলেও গোটা মুসলমান জাতিকে সম্ভবত শত্রুজাতি হিসেবে গণ্য করতেন না। আর জনসাধারণ-তারাতো করতোই না। লক্ষণ সেনের রাজসভা কবি হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’ গ্রন্থে দেখা যায়, মুসলমান আক্রমণের ভয় শঙ্কিত রাজা লক্ষণ সেন তাঁর রাজসভায় আগত শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজি (র.)-কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে সংবর্ধনা করছেন। এটা একটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয় বলেই মনে হয়। শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজি (র.) সুদূরের পথ পাড়ি দিয়ে এই অজ্ঞাত দেশে নিশ্চয়ই একা আসেননি; তাঁর সাথে আরো কিছু লোক এসে থকবেন হয়ত। হয়ত রাজ দরবারে আসেননি বলে তারা কোথাও উল্লেখিত হননি। কিন্তু জনসাধারণ তাদেরকে সাদরেই গ্রহণ করেছিল। অতএব সে যুগে যখনই কোন মুসলমান এদেশে এসেছেন, তিনি অনায়াসে নিসঃঙ্কোচে এদেশের জনসাধারণের সঙ্গে মিশেছেন, ভাবের বিনিময় করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের মঙ্গলবাণীও তাদের মাঝে ছড়িয়েছেন। নবাগত মুসলমানগণ স্বভাবতই ছিলেন ধর্মপ্রাণ, সত্যনিষ্ঠ, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, মনুষ্যত্বের মহিমায় উজ্জ্বল নিখুঁত চরিত্র সম্পন্ন মানুষ। কাজেই এদেশের জনসাধারণ সহজেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হতো। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের শেষ দিকের কবি রামাই পন্ডিতের ‘শূন্যপূরাণ’ কাব্যের অন্তর্গত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ অংশে মুসলমানদের পীর, পয়গম্বরগণকে হিন্দুর দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতির সঙ্গে অভিন্ন কল্পনা করা হয়েছে সম্ভবত এজন্যেই। এর ফলে শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, একেবারে দল বা সম্প্রদায়গতভাবে জনসাধারণ ইসলাম ধর্মগ্রহণ করতে থাকে । বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাঙালি জনগণের বিশেষ মনোভঙ্গি, সমকালীন রাজনৈতিক অন্তর্বিরোধ এবং সামাজিক অবস্থা ইসলামের দ্রুত বিস্তৃতিতে অনেকখানি সহায়ক হয়েছিল বলে মনে হয়। বাংলাদেশ নদী বিধৌত একটি বদ্বীপ এলাকা। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলি, মধুমিতা, পায়রা, বিশখালি, বলেশ্বর প্রভৃতি।
নদী ও তাদের অসংখ্য শাখা-উপশাখা দ্বারা এ অঞ্চল নিবিড়ভাবে পরিবেষ্টিত। বর্ষাকালীন প্লাবনে এবং বর্ষা শেষে পলিমাটির পুরু আস্তরণে এর ভূমি হয়ে উঠে উর্বর ও সরস। সমগ্র উপমহাদেশের মধ্যে এ অঞ্চলেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বাধিক। প্রায় সবটা অঞ্চলই সমতল। চট্টগ্রাম ও সিলেট পাহাড়ি এলাকায় এবং দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে সুন্দরবন এলাকায় রয়েছে ঘন বনাঞ্চল। সকল দিক দিয়েই এই দেশ অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে। আদিকাল থেকেই এই অনুপম প্রাকৃতিক পরিবেশ এই অঞ্চলে বিরাজমান। তারই জন্য এখানকার অধিবাসিদের মধ্যে ‘এক করুণাময় আধিভৌতিক শক্তির অনুভূতি প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজিত ছিল- এরূপ অনুমান অসংগত নয়। কারণ, বলতে গেলে বিনা আয়াসে অথবা স্বল্প পরিশ্রমে যেখানকার জমি সোনালি ফসলে ভরে ওঠে, না চাইতেই যেখানে বৃষ্টি ধারার অজস্র বর্ষণ জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা পূর্ণ করে এবং নদীনালার অফুরন্ত সম্পদ নিয়ত স্থানীয় অধিবাসীদের প্রয়োজন মেটায়- সেখানকার মানুষের মনে অজ্ঞাত এক মহাশক্তির করুণার অনুভূতি বিরাজিত থাকা কিন্তু একান্ত স্বাভাবিক। সম্ভবত অন্তর্নিহিত এরূপ একটা অনুভূতির জন্যই ইসলামের সংস্পর্শে এসে এখানকার মানুষ পরম করুণাময় এক আল্লহতায়ালার প্রভুত্বের স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশেই শুধু নয়, সেকালের সমাজ ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক পটভূমিও এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসারে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে, সন্দেহ নেই। প্রাগৈতিহাসিক যুগে এ অঞ্চলের অবস্থা কীরূপ ছিল, সে সর্ম্পকে সঠিক কিছু জানা যায় না। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের গোড়া থেকে প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলের প্রকৃত ঐতিহাসিক যুগের শুরু হয়েছে বলা যায়। খ্রিস্টীয় ৩২০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত গুপ্তরা গৌড় পর্যন্ত ক্ষমতা বিস্তার করেছিল। গুপ্ত সম্রাজ্যের শাসকগণ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং স্বভাবতই তাঁদের শাসনামলে দেশের এই পূবাঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃতি ঘটে। গুপ্ত সম্রাট হর্ষবর্ধনের শাসনামলে শশাঙ্ক নরেন্দ্র গুপ্ত নামক একজন স্থানীয় নৃপতি গৌড় রাজ্যের শাসন কর্তৃত্ব করতলগত করেন (আনু ৬৫০ খ্রি) এবং শক্তি সঞ্চয় করে তিনি সম্রাট হর্ষবর্ধনের বিরোধিতা করতে পর্যন্ত অগ্রসর হন। রাজা শশাঙ্ক ছিলেন গোঁড়া হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের ঘোরতর বিরোধী। তাঁর শাসনামলে গৌড়, বঙ্গ ও সমতট অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর অকথ্য অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু শশাঙ্কের এই রাজত্ব খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শশাঙ্কের মৃত্যুর (আনু ৬৩৫ খ্রি.) সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রাজত্বের অবসান ঘটে।
এরপর প্রায় শতাব্দী কাল পর্যন্ত দেশের এই অঞ্চলে প্রকৃতপক্ষে অরাজক অবস্থা চলতে থাকে। এ সময়টাকে ঐতিহাসিকরা ‘মাৎস্যন্যায়ের শাসন’ বলে অভিহিত করেছেন। অবশেষে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের শেষ শেষ দিকে (আনু ৭৫৫ খ্রি) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিখ্যাত পাল রাজাদের আবির্ভাব ঘটে। তাদের সময়েই, বিশেষ করে বিখ্যাত পাল রাজা ধর্মপালের শাসনামলে (খ্রি. ৭৭০-৮১০ অব্দ) পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় প্রভৃতি স্থানে বৌদ্ধবিহার, বৌদ্ধস্তূপ ও মন্দিরাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। পাল রাজারা প্রায় দুই শতাব্দী কাল গৌড়ে রাজত্ব করেন। ৯৮৮ খিস্টাব্দে মহিপালের রাজত্বকালে এই বংশের গৌরব মহিমা ও শক্তি হ্রাস পায় এবং তখন থেকেই তাঁদের রাজ্যসীমা ক্রমে সঙ্কুচিত হতে থাকে। এসময় সমতট অঞ্চলে প্রথমে খড়গ বংশ (আনু ৬৫০-৭০০ খ্রি.) অতঃপর দেব বংশ (আনু. ৭৫০-৮০০ খ্রি.) এবং তারও পর চন্দ্রবংশীয় রাজাদের (৮০০-১০৭০ খ্রি.) আবির্ভাব ঘটে। এসব রাজবংশও বৌদ্ধ ধর্মানুসারী ছিল এবং ময়নামতীর ‘শালবন বিহার’ নামক বৌদ্ধবিহারটি দেব বংশীয় রাজা ভবদেব কর্তৃক (আনু খ্রি. ৮ম শতাব্দী) নির্মিত হয়েছিল।
খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের গোড়ার দিকে (আনু ১১৬২ খ্রি.) পাল বংশীয় রাজাদের শাসন কর্তৃত্বের অবসান ঘটে এবং এসময় বরেন্দ্র ভূমিতে দিব্যক নামক একজন কৈবর্ত রাজার আবির্ভাব হয়। দিব্যক রাজার পুত্র রুদক এবং রুদেকর পুত্র ভীম-এই তিনজন কৈবর্ত রাজার নামই ইতিহাসে পাওয়া যায়। বগুড়া জেলার মহাস্থানে ‘ভীমের জাঙ্গাল’ নামক প্রাচীন সড়কটি সম্ভবত এই কৈবর্ত রাজা ভীমের স্মৃতি বহন করছে। অতঃপর খিস্টীয় দ্বাদশ শতকে (আনু ১০৭০ খ্রি.) সেন বংশীয় রাজারা গৌড়, বঙ্গ ও সমতট অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেন। সামন্ত সেন এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁর পরে হেমন্ত সেন, বিজয় সেন, বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনই এই বংশের উল্লেখযোগ্য ণৃপতি। লক্ষ্মণ সেনের সময়ে ১২০৩ খিস্টাব্দে তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন্ বখতিয়ার খিলজি প্রায় বিনা যুদ্ধে লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নবদ্বীপ ও লক্ষণাবর্তী দখল করে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন।
সেন বংশীয় রাজারা ছিলেন রাজা শশাঙ্কের মতোই গোঁড়া হিন্দু এবং বৌদ্ধবিদ্বেষী। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য তাঁরা কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেন এবং দেশ থেকে বৌদ্ধ প্রভাব তিরোহিত করার চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়ে অবতীর্ণ হন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ইতিহাসের এই বিবর্তন গৌড়-বঙ্গ-সমতট অঞ্চলে ইসলাম বিস্তৃতির ক্ষেত্র তৈরি করার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে ব্যাপক সাহায্য করেছিল।
সেন রাজাদের (আনু. ১০৭০-১২০৩ খ্রি.) কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে হিন্দু সমাজে একটি কৃত্রিম অভিজাত শ্রেণি সৃষ্টি করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে একই সঙ্গে স্বভাবতই আরেকটি বিরাট আকারের অধিকার বঞ্চিত অবহেলিত সমাজও গড়ে ওঠে। অজ্ঞাত এই বিরাট জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বা সামাজিক কোন মর্যাদা ছিল না বললেই চলে। অন্ত্যজ হিসেবে সমাজের এক কোণে অবহেলার স্থানই তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। শূদ্র নামে পরিচিত হিন্দু সমাজের নমঃশূদ্র বা চন্ডাল, মালো, ঝালো, ঋষি বা চামার, মালি প্রভৃতি সম্প্রদায় এরূপ সামাজিক অবজ্ঞারই পরিণামে অধঃপতনের নিম্মস্তরে অবনমিত হয়ে পড়ে। কোন মানুষের পক্ষেই চিরস্থায়ীভাবে এরূপ অবজ্ঞা মাথা পেতে সহ্য করা সম্ভবপর নয়। কাজেই কৌলীণ্যগর্বী অভিজাত হিন্দুদের বিরুদ্ধে অকুলীন অন্ত্যজদের মনে একটা বিদ্রোহের ভাব জেগে ওঠার সম্ভাবনা গোড়া থেকেই ছিল। মোট কথা, হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিম্ম বর্ণের বিরাট জনসমষ্টি কুলীন নামধারী অভিজাত শ্রেণির ওপর মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না এবং তাদের এরূপ অসন্তষ্টিই এদেশে ইসলাম প্রসারের পথ বহুলাংশে সহজ করে দিয়েছিল।
তৎকালীন হিন্দু সমাজে ধর্মের নামে এমন কতকগুলি ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, যা সমর্থন করা কোন বিবেকবান মানুষের পক্ষেই সম্ভবপর ছিল না। সতীদাহ ও গঙ্গা সাগরে সন্তান বিসর্জন দেয়ার মতো নির্মম প্রথার কথা এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। নৈতিকতা বিরোধী অথচ বহুল প্রচলিত দেবদাসী প্রথা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির সংমিশ্রণে উপজাত তান্ত্রিক ও সহজিয়া মতবাদও ছিল এই ধরনেরই আপত্তিকর কিছু ব্যাপার। তান্ত্রিক কাপালিকদের নরবলি প্রথা ও সহজিয়াদের লালসাপূর্ণ নানাবিধ আচার আচরণের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। দেশের সাধুসজ্জন ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা অবশ্যই এসব নির্মম ও দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন এবং প্রকাশ্যে না হলেও তাঁরা যে মনে মনে এসবের বিলোপ কামনা করতেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ইসলামের আবির্ভাব সংস্কারকামীদের এই কামনা পূরণের পথই সহজতর করে দেয় এবং এ দেশে ইসলামের বিস্তৃতির পথও প্রশস্ত হয়।
প্রস্তরময় পার্বত্য ভূমি ও উষর মরু অঞ্চলের বাসিন্দাদের চেয়ে বাংলাদেশের ন্যায় সমভূমি অঞ্চলের লোকেরা অধিকতর ভাবপ্রবণ ও কোমল প্রকৃতির হয়ে থাকে একথা যেমন সত্য, তেমনি এও অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, ভাবপ্রবণতা থেকেই ধর্মবোধের উৎপত্তি এবং কোমল অন্তঃকরণই ধর্মের অনুকূল আশ্রয়স্থল।
এ সমস্ত দিক বিবেচনা করলে বিনা দ্বিধায়ই বলা চলে যে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, সেকালের ঐতিহাসিক পরিবর্তন, সমাজ ব্যবস্থা এবং তখনকার জনগণের বিশেষ মনোভঙ্গি এদেশে ইসলামের দ্রুত ব্যাপ্তিতে যথেষ্ট অবদান যুগিয়ে ছিল।
তবে এ সকল কারণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে আরব ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত সুফি দরবেশদের কৃতিত্ব ও অবদান সর্বাপেক্ষা অধিক। যদিও সেকালের স্থানীয় পারিবেশিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রসার এবং মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছিল, তথাপি এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, এই নতুন পরিবর্তন আনয়নের সবটুকু না হোক, প্রধান কৃতিত্বটুকু ছিল বিদেশাগত মুসলিম সুফিসাধকদেরই। তাঁরা কোন রূপ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজেদের দায়িত্বে অমুসলিম এই বাংলাদেশে এসে এদেশের প্রতিপক্ষীয় ধর্মনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, যুক্তিতর্ক ও ধর্মপ্রাণতায় তাদেরকে পরাজিত করতেন এবং ব্যক্তিগত সত্য নিষ্ঠা, উদারতা, মানবতাবোধ, ব্যক্তিত্ব, নিখুঁত চরিত্র এবং অলৌকিক কার্যাবলি দ্বারা স্থানীয় জনসাধারণের হৃদয় জয় করে শেষ পর্যন্ত উক্ত ধর্মীয় নেতাদের এলাকায় নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতেন। এইসব মুসলিম সুফীদরবেশ ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে সেখানে সাধারণত স্থানীয় রাজাদের শাসনকেন্দ্রের নিকটবর্তী কোন স্থান অথবা ধর্ম সাধকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন স্থান বা মন্দির অথবা ধর্মকেন্দ্র থাকার দরুন যে সকল স্থান পূর্ব থেকেই এর অধিবাসীদের নিকট পবিত্র ছিল। এরূপ স্থানেই ‘খানকা’ বা সাধনকেন্দ্র নির্মাণ করে বসবাস আরম্ভ করতেন। এর ফলে এদেশের অধিক সংখ্যক লোকের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের সুযোগ হয়। স্থানীয় লোকজনও এসব সুফিদরবেশের ধর্মপ্রাণতা, গভীর প্রজ্ঞা, অপূর্ব ধর্মব্যাখ্যা, চরিত্র মাহাত্ম, অলৌকিক ক্রিয়া কলাপ প্রভৃতি অসাধারণ গুণের দ্বারা বিমুগ্ধ ও বিমোহিত হয়ে শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয় বরং দলগতভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এভাবে দিন দিন বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত ও প্রচলিত কতকগুলো উপাখ্যানে দেখা যায়, তুর্কি বিজয়ের পূর্বে একাধিক মুসলমান সুফি সাধক বাংলাদেশে আগমন করেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। এঁদের মধ্যে বাবা আদম শহিদ (র.) শাহসুলতান রুমি (র.), শাহ সুলতান বলখি মাহিসওয়ার (র.), শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশিকন (র.), মাখদুম শাহ দৌলাহ শহিদ (র.) প্রমুখ মনীষীদের নাম বিষেভাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা জিলার বিক্রমপুর পরগনায় রামপাল নামক স্থানে সেন রাজা বল্লাল সেনের কথিত রাজধানীর অনতিদূরে সুলতান জালাল উদ্দীন ফতেহ শাহের সময়কার একখানি মসজিদের সম্মুখে বাবা আদম শহিদ (র.)’র দরগাহ অবস্থিত। ময়মনসিংহ জিলার নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জিলা) মদনপুর নামক স্থানে শাহ সুলতান রুমি (র.) এর মাযার দেখা যায়। শাহ সুলতান মাহিসওয়ার (র.) দরগাহ বগুড়া জেলার মহাস্থানে অবস্থিত। পাবনা জিলার শাহজাদপুরে মাখদুম শাহ দৌলাহ শহিদ (র.) এর মাযার পরিদৃষ্ট হয়। বর্তমান ঢাকা নগরীর পুরানা পল্টন এলাকায় দিলকুশা বাগ সংলগ্ন পাঠান আমলে নির্মিত একখানা প্রাচীন মসজিদের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আছে শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশিকন (র.) এর মাযার। কিন্তু কিংবদন্তি বা প্রচলিত উপাখ্যানে এসব সুফিদরবেশকে প্রাক তুর্কি যুগের বলা হলেও এদেশে তুর্কি বিজয়ের পূর্বে এঁদের আগমন এবং ইসলাম প্রচারের প্রামাণিক কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, বরং ঐতিহাসিক বিচারে বাবা আদম শহিদ (র.) কে খিস্টীয় চতুর্দশ শতকের শেষ পাদের সুফিদরবেশ বলে অনুমান করা হয়। শাহ সুলতান মাহিসওয়ার (র) ও মাখদুম শাহ দৌলাহ শহিদ (র.) এর কাল নির্ণয় করা বা তাদের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করা বর্তমানে সম্ভব নয়।
শাহ সুলতান রুমি (র.) ও শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশিকন (র) তুর্কি বিজয়ের পরবর্তী কালের ধর্ম প্রচারক বলে মনে করা হয়। তবে তুর্কি বিজয়ের পূর্বে এঁদের আগমনের কোন প্রামাণ্য সূত্র পাওয়া না গেলেও প্রচলিত জনশ্রুতি ও পরবর্তীকালের মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য প্রমাণ করে যে, আলোচ্য যুগে বেশ কিছু ধর্মপ্রচারক এদেশে এসেছিলেন। তাঁদের চেষ্টাতেই এদেশে তুর্কি বিজয়ের পূর্বেই ইসলামের মাহাত্ম্য প্রচারিত হয় এবং ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ প্রসঙ্গে মিনহাজ বর্ণিত ইখতিয়ারুদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নদীয়া বিজয়ের কাহিনী, হলায়ূধ মিশ্রের সেক শুভোদয়ার বিবরণ, হযরত শাহ জালাল (র.) এর সিলেট অভিযান, পাহাড়পুর ও মহাস্থানে আরবীয় মুদ্রা প্রাপ্তি, এবং রামাই প-িতের শূন্যপুরাণের অন্তর্গত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ অংশটি স্মর্তব্য। আমাদের মনে হয় তখনো এদেশের মুসলিম সমাজে সুফিবাদ প্রসার লাভ করেনি। সুফি মতবাদের উদ্ভব মধ্য এশিয়ায়। মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারত হয়ে সুফি মতবাদের উদ্ভব মধ্য এশিয়ায়। মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারত হয়ে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে এই মতবাদের আগমন ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই এতে কিছুটা সময় লাগে। সুতরাং সুফি মতবাদের অনুপস্থিতি এবং দ-শক্তি বিধর্মীদের হাতে ছিল বলে এসময়কার ইসলাম প্রচারকরা পরবর্তী সুফিদরবেশদের ন্যায় ব্যাপক প্রসিদ্ধি অর্জন করতে পারেননি। দরবেশ না হলে তথা কেরামত বা অলৌকিকতার আভাস না পেলে অজ্ঞ লোকেরা ভক্তি করার কারণ খুঁজে পায় না। কাজেই তেমন লোকের স্মৃতি রক্ষার গরজও তারা বোধ করে না। আর যদি মুসলিম বিজয়ের পূর্বে কোন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন
সুফিদরবেশ এসেও থাকেন। তা হলেও মুসলিম বিরল বিধর্মীদের রাজ্যে তাঁর স্মৃতি রক্ষার আয়োজন করার হয়ত তেমন লোকই ছিল না। সুফি মতবাদের প্রসারের সঙ্গে মধ্য এশিয়া থেকে দলে দলে সুফি দরবেশরা তাঁদের বিপুল সংখ্যক শিষ্য সাগরেদসহ বিজিত উত্তর ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন। তখন থেকেই বাংলাদেশে সুফিদরবেশগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত খানকা বা দরগাহ কেন্দ্রিক ইসলামী সমাজ ও পরিবেশ সৃষ্টির ইতিহাসের যথারীতি যাত্রা শুরু হয়।
এভাবে ব্যবসা বাণিজ্য ব্যপদেশে আরবীয় বণিকদের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ, এদেশীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, এদেশের ধর্মীয় অধঃপতন, ভেদবুদ্ধি সঞ্জাত অনৈতিক ও বিকারগ্রস্ত সামাজিক ব্যবস্থার ফলে- অধিকার বঞ্চিত এদেশের সাধারণ হিন্দু ও নিপীড়িত বৌদ্ধদের বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ, বিদেশি সমর নায়কদের সাথে আগত বিপুল সংখ্যক বিদেশি সৈন্যসামন্তের এদেশে স্থায়ী বসতি স্থাপন, তাদের এদেশীয় স্ত্রী গ্রহণ ও তাদের গর্ভে সন্তান সন্তুতি জন্ম এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মধ্য এশিয়া ও বিজিত উত্তর ভারত থেকে দলে দলে শিষ্য সাগরেদসহ সুফিদরবেশ ও আলিমউলামার আগমনের ফলে বাংলাদেশে বিপুল হারে মুসলিম জনবসতি গড়ে ওঠে।
দুই.
খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে বাংলাদেশে মুঘল খান বিজয় সংঘটিত হয়। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি খ্রিস্টীয় ১২০৩ সালে প্রায় বিনা বাঁধায় বাংলার শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী ‘নোদিয়াহ’ বা নবদ্বীপ এবং পরে ‘লখনৌতি’ বা লক্ষ্মনাবতী তথা গৌড় দখল করে এদেশে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। তারপর উপর্যুপরি রাজনৈতিক নানা গোলযোগ সত্ত্বেও মুসলিম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান সমাজেরও বিস্তার ঘটতে থাকে। ইসলামী পরিবেশ বলতে ইসলামী শিক্ষাদীক্ষা, ধর্মকথা, আচার ব্যবহার, আহার বিহার, ব্যবহারিক ও পারস্পরিক কথাবার্তা প্রভৃতির মাধ্যমে দেশের জনসাধারণের মধ্যে যে বিশেষ আবহ বা বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল তাকেই এখানে বোঝানো হয়েছে। এই পরিবেশ শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এদেশের অমুসলমানেরাও এই আবহাওয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। এই বিশেষ পরিবেশে রচিত রামাই পন্ডিতের ‘শূন্য পুরাণে’র অন্তর্গত নিরঞ্জনের রুষ্মা’ শীর্ষক কবিতাটি এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। ইসলামী পরিবেশের একটা প্রাথমিক বা অপরিণত রূপ এতে ফুটে উঠেছে ।
তুর্কি বিজয়ের বহুকাল পূর্বেই বাংলাদেশের সাথে ইসলামের পরিচয় ঘটেছিল এবং জনগণের ভিতর মোটামুটি একটা ইসলামী পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। এ সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল প্রথমত ব্যবসা বাণিজ্য সূত্রে, দ্বিতীয়ত ধর্ম প্রচারের সূত্র ধরে সুফি দরবেশদের আগমনে। বাংলাদেশে তুর্কি বিজয় তথা মুসলিম রাষ্ট্র শক্তির অভ্যূদয়ে এদেশের সঙ্গে ইসলামের পূর্বে সংযোগ স্বভাবতই দৃঢ়তর ও বিস্তৃততর হয়েছিল। এই অনুকূল পরিবেশে পরবর্তীকালে তাই ইসলাম ধর্মের প্রসার, মুসলমান সমাজের বিস্তার তথা ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি যথেষ্ট ব্যাপকতা লাভ করেছিল।
তুর্কি বিজয়ের পর ইসলাম ধর্মের প্রসার তথা ইসলামী সমাজ বিস্তার ও ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টির কাজ প্রধানত দুইভাবে সম্পন্ন হয়। প্রথমত- সুফি দরবেশ ও মুসলমান জ্ঞানী গুণীদের (আলিম ও ওলামাদের) প্রচার তৎপরতা ও প্রভাব এবং দ্বিতীয়ত- মুসলমান সুলতান ও আমির ওমরাহদের গৃহীত বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম ও পদক্ষেপ। এই দুই ধরণের কর্ম প্রচেষ্টা মুসলিম বাংলার ইতিহাসকে লক্ষণ সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি মুসলমান সমাজ বিস্তারে ও ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টিতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে।
(ক)
বাংলাদেশে ইসলাম বিস্তারে সুফি দরবেশদের অবদান অত্যন্ত বেশি। প্রধানত তাদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই এদেশে ইসলামের বিস্তৃতি সম্ভবপর হয়েছিল। বাংলাদেশে মুসলমান বিজয়ের পূর্ব থেকেই ধর্ম প্রচার ব্যাপদেশে বহু সুফি দরবেশের আগমন ঘটে বলে জানা যায়। মুসলমান বিজয়ের পরেও এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং এদেশে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই অজস্র ধারায় পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং উত্তর ভারত থেকে অসংখ্য সুফি দরবেশ ও মুসলমান জ্ঞানীগুনীরা আগমন করতে থাকেন। তারা এদেশের বিভিন্ন স্থানে ‘খানকাহ’ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এভাবে মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকজন বিখ্যাত সুফির জন্ম হয়। তুর্কি বিজয়ের পর ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে ইসলাম প্রচারক এসব সুফি দরবেশ ও জ্ঞানীগুণীর আগমন ও আবির্ভাব এত অধিক সংখ্যায় হয়েছিল যে, বলতে গেলে সমগ্র বাংলাদেশ তারা একরূপ ছেয়ে ফেলেছিলেন। ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে শেখ আলাউল হক পান্ডুবির সাগরেদ হযরত মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানি (র.) কতৃক জৌনপুরের সুলতান ইবরাহিম শারফির নিকট লিখিত এক পত্রে আছে : ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর’ কী চমৎকার এই বাংলাদেশ। এখানে বহুদেশ থেকে অসংখ্য সুফি ও দরবেশ এসে বসতি স্থাপন করেছেন। যেমন- দেব গাঁয়ে শায়খ উল শায়খ হযরত শায়খ শাহাবুদ্দিন সুহরাওয়ার্দির সত্তরজন নেতৃস্থানীয় সাগরেদ চিরনিদ্রায় নিদ্রিত আছেন। মহিসনে সুহরাওয়ার্দিয়া তরিকার বেশ কিছু সংখ্যক সুফি সাধক এবং অনুরূপভাবে দেওতলাতে জালিসিয়া তরিকার বেশ কিছু সুফি দরবেশ সমাধিস্থ হয়েছেন। নারকোটিতে শায়খ উল শায়খ আহমদ দামেশকির (র.) কতিপয় শ্রেষ্ঠ সঙ্গীর কবর বিদ্যমান আছে। কদরখানি তরিকার দ্বাদশ আওলিয়ার অন্যতম সুফি সাধক হযরত শয়খ শরফুদিন তাওয়ামা (র.), যাঁর প্রধান সাগরেদ হযরত শয়খ শরফুদ্দিন মানেরি (র.) এর কবর সোনারগাঁয়ে অবস্থিত। তারপর হযরত বাদ আলম (র.) এবং হযরত বদর আলম জাহিদি (র.) ও সেখানে আছেন। মোট কথায় নগর সমূহের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের এমন কোন শহর বা গ্রাম ছিলনা যেখানে মহান সুফি দরবেশগণ পদার্পন করেননি এবং বসতি স্থাপন করেননি। সুহরাওয়ার্দিয়া তরিকার অধিকাংশ সুফিসাধক ইন্তেকাল করেছেন এবং মাটির নিচে চলে গিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা এখনো জীবিত আছেন তাঁদের সংখ্যাও অনেক। তুর্কি বিজয়ের পর খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের মধ্যেই বাংলাদেশে কী অসংখ্য পরিমাণে সুফি দরবেশ আগমন করেছিলেন এবং তাঁদের প্রভাব কী গভীরতা ও বিস্তৃতি লাভ করেছিল এ থেকে সহজেই উপলব্দি করা যায়। সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমান করা যায় যে, মুসলিম বিজয়ের প্রথম যুগে বাংলাদেশটি সুফি দরবেশদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল।
তুর্কি আমলে (১২০৩-১৩৫২খ্রি.) বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের দ্বার যিনি উদঘাটন করেন, তাঁর নাম মাখদুম শয়খ জালালুদ্দিন তাবরেজি (র) (মৃত্যু ১২২৫ খ্রি)। তিনি যখন পান্ডুয়ায় আসেন তখন গৌঢ়ে শেষ হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজত্ব করাছলেন। তিনি পান্ডুয়ায় একটি মসজিদ র্নিমান, একখানি উদ্যান রচনা ও একটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কিভাবে শত শত লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন তার বহু কাহিনী রাজা লক্ষণ সেনের সভাপন্ডিত হলায়ুধ মিশ্র কর্তৃক রচিত ‘শেখ শুভোদয়া’ নামক একখনি সংস্কৃত পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে।
এ যুগের আর একজন বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক সুফি সাধক হযরত শাহজালাল মুজররদ-ই-ই-ইয়ামেনি (র)-এর (মৃত্যু ১৩৪৭ খ্রি)। তাঁর সঙ্গে মাখদুম শয়খ জালালউদ্দিন তাবরেজি (র)-এর কোন সম্বন্ধ নেই। তিনি বাংলার তুর্কি সুলতান শামস-উদ্দীন ফিরোজ শাহ দেহলভির (১৩১১-১৩২২ খ্রি.) সেনাপতি সিকান্দার খান গাজির সহায়তায় ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে শ্রীহট্র জয় করেন। তাঁর সঙ্গে ১৩৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতার সাক্ষাৎ হয়। হযরত শাহজালাল (র.) সিলেটের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন একং অনেক হিন্দু তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি একজন মস্তবড় আবেদ ছিলেন।
তুর্কি আমলে একদিকে শয়খ জালালুদ্দিন তাবরেজি (র.), আর দিকে হযরত শাহাজালাল মুজররদ-ই-ইয়ামেনি (র.) ইসলাম প্রচার তথা ইসলাম সমাজ বিস্তারের জন্য যে কার্যক্রম চালিয়েছিলেন, সে কার্যক্রম বা মিশন তাঁদের উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ে আরো বহু সুফি দরবেশ ও আলিম-উলামা দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছিল। তাঁদের মধ্যে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জের পারিল গ্রামে সমাহিত গাজি মুলক ইকরাম খান (আগমন ১২১৪ খ্রি ), বীরভূম জেলার খস্তিগিরি অঞ্চলে আব্দুল্লাহ কিরমানি, বর্ধমান জিলার মঙ্গল কোটে মখদুম শাহ মাহমুদ গজনবি (আগমন ১২০২ খ্রি ) সপ্তগ্রামের ত্রিবেণী অঞ্চলে ছোট পান্ডুয়ায় সমাহিত শাহ সফিউদ্দিন শহিদ (শাহাদাত ১৩শ শতকের শেষ দশকে), পাবনা ও বগুড়া অঞ্চলে মখদুম শ্হদৌলা (১২৫০ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ), চব্বিশ পরগনার বালতা অঞ্চলে সৈয়দ আব্বস আলী মক্কি পীর গোরাচাঁদ (১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে জীবিত), চট্টগ্রাম অঞ্চলে বদর উদ্দিন আল্লামা বদর শাহ, সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে (১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রি.), দিনাজপুর অঞ্চলে মৌলানা আতা (১৩০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে), লখনৌতির কাজি রুকন-উদ-দীন সমরকন্দি (মৃত্যু ১২১৮ খ্রি), সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খালজির রাজত্বকালে (খ্রি. ১২১৩-১২২৭ অব্দ) লখনৌতির দরবারে আগত মাওলানা জালাল উদ্দিন গজনভী, রাজশাহী জিলার মাহিসন্তোসে মাওলানা তকি-উদ-দীন (১৩শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে), সোনারগাঁয়ে মাওলানা শয়খ শরফ্উদ্দীন আবু তাওওয়ামা (মৃত্যু ১৩৫০ খ্রি.) প্রমূখ সুফিদরবেশ ও আলিম উলেমা ইসলাম প্রচার করেন এবং ইসলামী সমাজ বিস্তার তথা ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টির কাজে সর্বাত্মভাবে অবদান রাখেন। তুর্কি মুসলমান শাসক সুলতানরা বঙ্গ বিজয়ের পরেও বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহ ও দেশের অভ্যন্তরীন গঠন কার্যে ব্যস্ত ছিলেন। কাজেই এদেশে ইসলাম প্রচার ও মুসলিম প্রভাব প্রতিপত্তি প্রসারের জন্য এসময়কার দেশীয় ও বহিরাগত এ সমস্ত সুফিদরবেশ ও আলিম উলেমাকে সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
স্বাধীন সুলতানী আমলে দেশে মুসলিম রাজত্বের স্থায়ীত্বের সঙ্গে ইসলাম ধর্মও স্থায়ী হয়। মুসলিম বিজয়ের পূর্ব থেকে ইসলামের বিস্তার ঘটতে থাকে ও এদেশে এ বিস্তারের পরিধি ছিল অতি সংকীর্ণ। দেশে মুসলিম রাষ্ট্রীয় সীমাবৃদ্ধির সঙ্গে ইসলাম বিস্তৃতির পরিধি ও সীমাও বর্ধিত হতে থাকে। একদিকে মুসলিম সেনাপতি ও সৈন্যরা রাজ্যের পর রাজা জয় করেছেন, অন্যদিকে সুফিসাধক ও আলিমগন দলে দলে ইসলাম প্রচার করেছেন। এ সময়ে দেশে যে সমস্ত সুফিদরবেশ ও আলিম উলেমা প্রচার কার্য চালিয়ে ছিলেন, তাঁদের মধ্য গৌড়ের শয়খ আঁখি সিরাজ-উদ-দীন (মৃত্যু ১৩৫৭ খ্রি ), পান্ডুয়ার শয়খ আলাউল হক (মৃত্যু ১৩৯৮ খ্রি ) ও শয়খ নূর কুতুব-ই-আলম (মৃত্যু ১৪১৬ খ্রি), হুগলির ফুরফুরার শাহ আনোয়ার কুলি হলভি (মৃত্যু ১৩৭৫ খ্রি), রংপুরে শাহ ইসমাইল গাজি (মৃত্যু ১৪৭৪ খ্রি), খুলনার খান জাহান আলী (মৃত্যু ১৪৫৮), সোনারগাঁয়ের হাজি বাবা সালিহ (মৃত্যু ১৫০৬ খ্রি.), চট্টগ্রামের শাহ মহসিন আউলিয়া (মৃত্যু ১৩৯৭ খ্রি), ত্রিপুরার রাস্তি শাহ্ (মৃত্যু ১৩৫১ থেকে ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে), গৌড়ের মৌলানা বরখুরদার (মৃত্যু ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে), দেবকোটের মৌলানা আতা সহিদউদদীন ( মৃত্যু ১৩৫৫ খ্রি), রাজশাহীর মৌলানা শাহদৌলা (জীবিত ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে), মুরশিদাবাদের শাহ চাঁদ দাদাগীর (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মৃত্যু), সপ্তগ্রামের সৈয়দ আমুলি (মৃত্যু ১৫৩১ খ্রি.) প্রমুখ সুফিদরবেশ ও আলিম উলেমাই প্রধান। এমনি করেই স্বাধীন সুলতানি অমলে সারা বাংলাদেশ সুফি, দরবেশ ও আলিমদের ইসলাম ধর্মের প্রচার তৎপরতায় মুখর হয়েউঠেছিল। মুঘল আমলে (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রি) বাংলাদেশে উত্তর ভারত থেকে বহু কলন্দর, দরবেশ ও আউলিয়া আখ্যাধারী সুফি সাধকের আগমন ঘটে। এজন্য এদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই সুফি দরবেশের আগমনের একটি নিরবিচ্ছিন্ন ধারা প্রবাহমান ছিল। তখন এই ধারার প্রধান উৎস ছিল ভারতের বাইরে মুসলিম দেশসমূহে। মুঘল আমলে এই ধারা প্রবল থেকে প্রবলতর আকার ধারণ করল এবং এর প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ালো উত্তর ভারত। ভারতের বাইরে অবস্থিত মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম দেশসমূহ থেকে যে সমস্ত সুফি দরবেশ উত্তর ভরতে প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই মুঘল আমলে বাংলাদেশে আগমন করেন। এর মধ্যে সুহরাওয়ার্দি, চিশতি, কলন্দরি, মাদারি, আদহমি, নক্শবন্দি ও কাদরি সম্প্রদায়ভুক্ত সুফিরাই প্রধান ছিলেন। বাংলাদেশের জনসাধারণের জীবনে এই সুফি সম্প্রদায় সমূহের মধ্যে কলন্দারি, মাদারি ও আদহাসি সম্প্রদায়ভুক্ত সুফিদের ব্যাপকতার প্রভাব পড়েছিল বলে অনুমান করা হয়। বিশেষ করে কলন্দরিয়া সম্প্রদায় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে বাংলাদেশ প্রায় ছেয়ে ফেলেছিল। তাদের প্রচার প্রচারণা ও প্রভাব এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, মুঘল আমলে সুফিসাধক বুঝতে বাংলা ভাষায় কলন্দর শব্দই ব্যবহৃত হত।
উপরে উল্লিখিত এই সুফি দরবেশ ও আলিম উলেমাগণ বাংলাদেশে ইসলামি সমাজ-সংস্কৃতি বিস্তারে এবং ইসলামি পরিবেশ সৃস্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের জীবন সাধনা ও যাবতীয় কর্ম-তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য ছিল এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা কেবল বড় বড় শহর নগরে নয়, বরং বাংলাদেশের পুর্বে চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে শুরু করে পশ্চিমে মঙ্গলকোট পর্যন্ত এবং দক্ষিণে বাগেরহাট ও ছোট পান্ডুয়া থেকে উত্তরে কান্তপুর (রংপুর) পর্যন্ত সর্বত্র অসংখ্য খানশাহ বাদরগাহ স্থাপন করেছেন, গরিব, দুঃখী ও মুসাফিরদের জন্য লঙ্গরখানা খুলেছেন এবং মক্তব মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে জনগনের লেখাপড়া ও ইসলামী জ্ঞানানুশীলনের ব্যবস্থা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা অসংখ্য মসজিদও স্থাপন করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে এ দেশে মুসলমান সমাজ সংস্কৃতি বিস্তৃতির উপযুক্ত পরিবেশ তারা সৃস্টি করেছেন। এই সুফি দরবেশদের তৎপরতা তাঁদের খানকাহ সমুহের চারদেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং প্রয়োজনবোধে ইসলাম প্রচার এবং মুসলমান সমাজ বিস্তার ও সংরক্ষণের স্বার্থে তাঁরা অমুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এই যুদ্ধ কেউ করেছেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত দায়িত্বে অন্য কোন শক্তির সহায়তা ব্যতিরেকে, আবার কেউ করেছেন কোন মুসলমান শাসক শক্তির সহায়তায়।
মৃত্যুর পর কোন কোন রণ বিজয়ী মুসলিম যোদ্ধা জনগণের কাছে লাভ করেছেন সুফিসাধকের মর্যাদা। তাঁদের সমাধিস্থল জনসমাজে অর্জন করেছে পবিত্র দরগাহের শ্রদ্ধা ও সম্মান।
বাংলা মুসলমান সমাজের বিস্তার ও স্থায়িত্বের ব্যাপারে এই সুফি দরবেশ ও আলিম উলেমাগণ এতই সচেতন ও উদগ্রীব ছিলেন যে, এ কাজের সামনে যে কোন হুমকির বিরুদ্ধে গঠিত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়াতে তারা কিছু মাত্র ইতঃস্ততা করতেন না। সে কারণেই তারা কখনো কখনো শাসন দ-ের ভ্রুকটি উপেক্ষা করে দেশের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন এবং কখনো কখনো সুলতানের রাস্ট্রীয় নীতিনির্ধারণেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে দ্বিধা করতেন না। যদিও এজন্য পরে তাদেরকে কখনো কখনো দ- ভোগ করতেও হয়েছে।
প্রথম থেকেই এই সুফিদরবেশ ও আলেম উলেমাগন জন সাধারণের শিক্ষা দীক্ষার প্রতি নজর দিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্য তারা দেশের বিভিন্ন্ স্থানে মক্তব, মাদ্রাসা, এমন কি কলেজ পর্যন্ত স্থাপন করেন। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনো তারা নিজেরা শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তাদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা প্রান্তে বেশ কিছু ছাত্র পরবর্তীকালে বিশেষ খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সুফি দরবেশদের তৎপরতা এতই ব্যাপক হয়েছিল যে, দেশে ‘সুফিবাদ’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠে এবং দেশে নতুন নতুন অনেক অধ্যাত্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এর অধিকাংশ সম্প্রদায়ের নাম বাংলাদেশের সুফি সাধকদের নামের সঙ্গে যুক্ত। এতে অনুমান হয় যে, এসব সুফিসাধকের এত অধিক সংখ্যক শিষ্য সাগরিদ ছিলেন, তারা এই সুফি সাধকদের নামেই পরিচিত হতো।
এদেশে মুসলমান সমাজ সংস্কৃতির বিস্তারে এবং ইসলামী পরিবেশ সৃস্টিতে বহির্বাংলা থেকে আগত মুসলমান বিদ্বান ও জ্ঞানীগুণীদের ভূমিকাও বেশ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের অনেকেই এদেশে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছেন, মাদরাসা স্থাপন করে শিক্ষা দানের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, পুস্তকাদি রচনা করে লেখা পড়ার পথ প্রশস্ত করেছেন, এবং কেউ কেউ ধর্মের বিতর্কে অমুসলিম বিদ্বান ও সাধু সন্ন্যাসীদের পরাজিত করে ইসলাম ধর্মকে সত্য ধর্ম হিসাবে লোক সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁদের প্রণীত অতি অল্প সংখ্যক বই পুস্তক আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তাদের প্রণীত অধিকাংশ বইপুস্তককই কালগর্বে বিলীন হয়ে গেছে। যে অল্প সংখ্যক লেখা পাওয়া গেছে তা হচ্ছে ; (ক) আরবি ও ফারসি থেকে অনূদিত একখানা যোগ গ্রন্থ; (খ) একখানা তাসাউফ গ্রন্থ; (গ) একখানা ফিক্হ গ্রন্থ; (ঘ) একখানা ধর্মভিত্তিক কাহিনীগ্রন্থ ; (ঙ) একখানা ফারসি অভিধান (চ) একখানা হাদিস গ্রন্থ ও (ছ) একখানা ধনুর্বিদ্যা গ্রন্থ।
বাংলাদেশের জন সমাজে জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের উপর এই সুফিদরবেশ ও আলিমদের প্রভাব ছিল অপরিসীম। পর্ণকুটিরবাসী ভিক্ষুকের আঙ্গিনা থেকে আরম্ভ করে দন্ডমুন্ডের কর্তা রাজা বাদশাহর প্রাসাদ পর্যন্ত তাদের প্রভাব সমভাবে বিদ্যমান ছিল। জনসাধারণ তাদেরকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলে মনে করতো। তারা বিশ্বাস করতো সুফি দরবেশদের অন্তর আল্লাহর নূরে আলোকিত ও এশী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। তাদের সকল প্রার্থনাই আল্লাহর নিকট গৃহীত হয়। সুতরাং তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তারা দারিদ্র মোচন করতে পারেন, মৃতকে জীবন দান করতে পারেন, একই সময়ে একাধিক স্থানে অবস্থান করতে পারেন এবং ভূত ভবিষ্যত সবকিছু জানেন, তারা পরকালে আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করে পাপীকেও মুক্তি দিতে পারেন। তাই তারা ছিলেন সকল শ্রেণির মানুষের পরম ভরসা। তাদের খানকাহ সমূহে তাই প্রতিদিন দলে দলে লোক গমন করে আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উন্নতি লাভের চেষ্টা করতো। এই খানকাহ বা আস্তানা সমূহ ছিল সকল শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য অবারিত দ্বার। লোকজন মনে করত, খানকা ‘পৃথিবীতে শান্তির আধার’ যেখানে সকলে ‘নিজ নিজ অভিস্ট লাভ করতে পারবে।’ আবার এই খানকা বা দরগাহগুলির অধিকাংশই এমন সব কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছিল, যা প্রাচীন কাল থেকে লোকজনের নিকট পবিত্র তীর্থভূমির শ্রদ্ধা ও পূজা পেয়ে এসেছে। সুতরাং ধর্ম পরিবর্তনের পরেও এসব পবিত্র স্থানের প্রতি পূর্বতন শ্রদ্ধাভক্তি বশত মানুষ গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিল। উপরন্তু খানকা সংলগ্ন লঙ্গরখানায় সবার জন্য ভোজ্য ও পানীয় সর্বদা মজুদ থাকত এবং তা সহজ লভ্য ছিল।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে, মুসলমান সমাজ সংস্কৃতির বিস্তারে এবং ইসলামী আবহ সৃস্টিতে সূফি দরবেশগণের এই খানকাহ বা দরগাহসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রকৃত অর্থে, এগুলি ছিল বাংলারমুসলমান সমাজের এক একটি স্নায়ু কেন্দ্র বিশেষ। ধর্ম, শিক্ষা ও সমাজ, সব কিছুরই জীবন্ত প্রতীক ছিলো এই খানকাহ ও দরগাসমূহ।
এতো প্রভাব ও প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও সুফি দরবেশগণ অত্যন্ত সাধারণ সহজ জীবন যাপন করতেন। যে কোন নিচু কাজ করতেও তারাঁ কুন্ঠাবোধ করতেন না। তাঁরা ছিলেন সরলতা, উদারতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সত্যনিষ্ঠু এবং শান্তির মূর্তপ্রতীক। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের প্রতি সকল মানুষ আকৃষ্ট হতা। সহজ সরল জীবন, সুদৃঢ় চরিত্রবল, উদারতা আন্তরিক দরদ, সততা প্রভৃতি গুণ দিয়ে তারা অতি সহজযই মানুষের হৃদয় জয় করে ফেলতেন। তাঁদের কাছেই মানুষ লাভ করত ক্ষুধায় অন্ন, পিপাশায় পানীয়, রোগের প্রতিকার, শোক দুঃখের শান্তনা ও নিরাশার আশা। এরূপ সাধু চরিত্রের সুফি দরবেশদের দ্বারাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। হয়েছে ইসলামী সমাজ সংস্কৃতির বিস্তৃতি এবং ইসলামী পরিবেশ সৃস্টি।
মোটকথায় বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার, ইসলামী সমাজ সমাজ সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতি এবং ইসলামী পরিবেশ বা বাতাবরণ সৃষ্টি ও স্থিতি- সবকিছুর পেছনে সুফিদরবেশ ও মুসলমান আলিমদের অবদান ছিলো সর্বাধিক- এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
(খ)
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে এবং ইসলামী সংস্কৃতির প্রসার তথা ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টিতে মুসলমান সুফি দরবেশ ও আলিম উলেমাদের পাশাপাশি মুসলমান শাসক সুলতানদেরও যথেস্ট অবদান ছিল। বঙ্গ বিজেতা মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খালজি থেকে শুরু করে বিশিষ্ট তুর্কি শাসকদের প্রায় সকলেই এবং পরবর্তীকালে গৌড়ের সুলতানগণ ও মুঘলরাজ প্রতিনিধিগণের সমাজ সংস্কৃতি বিস্তৃতিতে তথা ইসলামী পরিবেশ বা ইসলামী আবহ সৃষ্টিতে নানাভাবে সহায়তা করেন। মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না, তাদের রাজ্যকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত করে এর স্থায়িত্বকে সুনিশ্চিতভাবে করাও তাদের উদ্দেশ্য ছিল। মুসলমান সমাজ সংস্কৃতির পরিপূর্ণ বিস্তার ও বিকাশ একটি সুষ্ঠু ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি ব্যাতিরেকে এটা সম্ভবপর ছিলোনা। সুতরাং তাঁরা এই উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ বা কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এগুরেলার মধ্যে মসজিদ নির্মাণ, মাদ্রাসা মক্তব স্থাপন, সুফি দরবেশ ও আলিম উলামাদের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দান, জ্ঞানানুশীলন, ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, জনকল্যাণমূলক কর্মপ্রয়াস প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে মুসলমান সমাজ বিস্তার এবং ইসলামী তাহজিব তমদ্দুনের বিকাশে মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবিজয়ী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি (১২০৩-১২০৬ খ্রি:) থেকে এই মসজিদ স্থাপনার শুরু। তিনি বুঝেছিলেন যে, মুসলমান সমাজই মুসলমান শাসনের সুদৃঢ় ভিত্তি। সুতরাং তিনি মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে মুসলমান শাসক গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি লাখনৌতিতে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ তৈরী করেন। তাঁর ওমরাহগণও তাঁর দেখাদেখি ঐসব জনহিতকর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরী করেন। তাঁর পরবর্তী শাসকরা, বিশেষ করে গিয়াস-উদ-দীন ইওজ খলজী (১২০৮-১০ এবং ১২১৩-২৪ খ্রি:) সুলতান রুকন উদদীন কায়কাউস (১২৯১-১৩০১ খ্রি:) তথা সুলতানী আমলের (১৩৩৮-১৫৭৫ খ্রি:) অবকাশ পর্যন্ত সকল সুলতানই তার প্রবর্তিত নীতি অক্ষুন্ন রাখেন।
মুঘল আমলেও (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রি:) তাঁর এই নীতির অনুবর্তন চলে। ফলে মুঘল আমলের অবসান পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্র অগণিত মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো প্রধানত সুলতানদের নিজেদের তত্ত্বাবধানে অথবা তাদের কর্মচারীদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে। নেহাত জাঁকজমক প্রদর্শন বা চোখ ধাঁধাঁনোর জন্য সুলতানেরা বা তাঁদের কর্মচারীরা এই মসজিদ নির্মান করতেন না বরং ধর্ম প্রচার ও মুসলমান সমাজ বিস্তৃতির ক্ষেত্রে এগুলোর অবশ্যম্ভাবী কার্যকারিতা অনুধাবন করেই তারা এগুলো নির্মান করেতেন।
মসজিদকে কেন্দ্র করেই মুসলমান সমাজ নিয়ন্ত্রিত ও সম্প্রসারিত। এ হচ্ছে মুসলমানদের পার্লামেন্ট বা আলোচনা সভা। নিয়মিত খোতবা পাঠ ও ইসলামী শিক্ষা প্রচারের ব্যবস্থা থাকতো এতে। পৃথিবীর যেখানেই মুসলিম শক্তি প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে, সেখানেই বিজেতা ধর্মান্তরিত নও মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য পালনের জন্য মসজিদ নির্মিত হয়েছে। আবার কোথাও সুফি দরবেশদের মাজার বা খানকাহ্ সন্নিকটে নির্মিত হয়েছে এসব মসজিদ। তখন মুসলমান সমাজ সংস্কৃতি ও ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টিতে এই মসজিদ অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে মুসলমান সমাজ সংস্কৃতি ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে সুলতানদের ও তাদের কর্মচারীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান অসংখ্য মক্তব মাদরাসা ও কলেজ প্রতিষ্ঠা। বখতিয়ার খলজি থেকেই এ রীতির প্রবর্তন। পরবর্তী শাসক-সুলতানেরা অনেকেই এই রীতি অনুসরণ করেন। মুঘল আমলের পতন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্র এই অসংখ্য ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বলতে গেলে তার জের বর্তমানকাল পর্যন্ত চলে এসেছে।
পরবর্তীকালে মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় যে সব মুসলিম শাসক সুলতান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে সুলতান গিয়াস উদ্দিন ইত্তজ খালজি (১২০৮-১২১০ এবং ১২১৩-২৭ খ্রি.) সুলতার রুকন উদদীন কায়কাউস (১২৯১-১৩০১খ্রি.) সুলতান শামস উদদীন ফিরোজ শাহ (১৩০১-১৩২২ খ্রি.) এবং সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ( (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে গৌড়ের দরস বাড়ি ও ছোট সাগর দিঘীর ‘বেল বাড়ি’ মাদরাসার কথাও স্মরণ করতে হয়। মাদ্রাসাগুলো সাধারণত মসজিদের পাশেই নির্মিত হতো অথবা মাদরাসার মধ্যেই মসজিদ স্থাপন করা হতো। যেখানে শুধু মসজিদ নির্মাণ করা হতো সেই মসজিদ মাদরাসা ও মসজিদ উভয় কাজই সমাধা করতো।
অধিকাংশ মুসলিম সুলতান ইসলামী চেতনার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং ধর্মের অনুশাসন গুলোকে গভীর নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। তাঁরা ইসলামের খিলাফত প্রথার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা পোষণ করতেন।
ইসলাম প্রচারে মুসলমান সুলতান ও তাঁদের কর্মচারীরা সুফিদরবেশ ও আলিম উলামাকে প্রচুর পরিমাণে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন এবং সর্বপ্রকার সাহায্য সহায়তা দিয়েছেন। বখতিয়ার খালজি থেকেই এই রীতির সূচনা: তিনি সর্বপ্রকার সুফী দরবেশদের জন্য খানকা নির্মাণ করেন এবং তাদের সুবিধা সুযোগের ব্যবস্থা করেন। তার পরবর্তী সুলতানেরা এমনকি মুঘল আমলের শাসকরাও তাঁর এই রীতির অনুস্মরণ করেন।
বাংলার সুলতানগণ সুফী দরবেশদের প্রতি এতখানি সহনুভূতিশীল ছিলেন যে, সুলতান মুগিফ উদদীন তুগরল খাঁন (১২৭২-৮১ খ্রি.) কলন্দর ফকিরদেরকে একই সময় তিনমন সোনা দান করেছিলেন। সুলতান ফখরউদদীন মুবারক শাহের (১৩৩৮-৫০ খ্রি.) সময় সরকারি ফরমান ছিল নৌকায় ভ্রমণকালে ফকিরদের নিকট থেকে কোনপ্রকার অর্থ নেয়া যাবে না। যখন তারা কোন শহর বা নগরে আগমন করেন। তখন তাদের অর্ধদিনার দিতে হবে। সুলতান ফখর উদ্দিন মুবারক শাহ সুফি দরবেশদের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট ছিলেন যে, তিনি ‘শায়দা’ নামক এক দরবেশকে সাতকাওয়ানের (চাটগাঁয়ের) শাসনকর্তা নিয়োগ করেছিলেন।
মুঘল আমলে শাহ সুজা (১৬৩৯-৬০ খ্রি:) পির দরবেশদের বিশেষ ভক্ত ছিলেন বলে যানা যায়। এভাবে মুসলিম শাসক সুলতানেরা সুফিদরবেশ ও আলিম উলামাদের জন্য অসংখ্য খানকাহ এবং তাদের সমাধির উপর মাকবারা ও মসজিদ নির্মান করেছেন, তাদের জীবন জীবিকার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। তাদের খানকা ও মাজারের ব্যয়ভার বহনের জন্য তারা প্রচুর লাখেরাজ সম্পত্তিও দান করেছেন।
কয়েকজন মুসলিম সুলতান ও তাদের কিছু কর্মচারী বিদ্যাবত্তা ও জ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তারা কেউ কেউ ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞানে, কেউ কেউ চিকিৎসা ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন।
ফারসি ভাষায় তাদের কেউ কেউ কাব্য চর্চাও করেছেন। অসি আর মসির প্রভু বলে তারা নিজেকে কেউ কেউ দাবিও করেছেন। মুসলিম সুলতাণগণ ও তাঁদের কর্মচারীগণ কল্যাণকর ও বিভিন্ন জনহিতকর বিভিন্ন কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে দেশের জনগণকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। সুলতান গিয়াস উদ্দিন ইওস খালজি সর্বপ্রথম এ ধরণের কাজের সূত্রপাত করেন। বন্যারোধ কল্পে দেশের মধ্যে তিনি বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করেন এবং চলাচলের সুবিধার জন্য অসংখ্য রাস্তাঘাট তৈরী করেন। পরবর্তীকালের শাসক সুলতানেরা এ ধরণের অসংখ্য জনহিতকর কাজ সম্পাদন করেন। মানুষের সুবিধার জন্য তারা অসংখ্য বাঁধ নির্মান করেন এবং পানীয় জলের জন্য পুকুর দিঘি খনন করান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ভূমি দান করেন এবং দুঃখী দরিদ্রকে উদার হাতে দান দক্ষিণা প্রদানের মাধ্যমে নিজের উদারতার পরিচয় দেন। এভাবে দেশের মানুষদের তাঁরা সহজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন।
এভাবে মুসলমান সুলতান ও কর্মচারীদের একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা মোতাবেক অথবা নিছক হৃদয়ের তাগিদে মসজিদ মাদ্রাসা খানকাহ প্রতিষ্ঠা, দেশের বাইরে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন, আলিম, ফাজিল ও সুফিদরবেশদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা উৎসাহ দান এবং জনহিতকর এবং বিভিন্ন কার্যকালাপ সব কিছুই মুসলমান সমাজ সংস্কৃতির বিস্তৃতিতে এবং ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যুগিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে মুসলিম শাসক সুলতানদের যথেষ্ট ভূমিকা ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল এ কথা নিসন্দেহে স্বীকার্য।
বাংলাদেশ ইসলামের বিস্তৃতি, মুসলমান সমাজ সংস্কৃতির প্রসার এবং পরিবেশ সৃষ্টির কিছু পরোক্ষ কারণও ছিলো। এ প্রবন্ধের শুরুতে উল্লিখিত এ দেশীয় রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় অধঃপতন, ভেদবুদ্ধি সঞ্জাত ও নৈতিক বিকারগ্রস্থ সামাজিক ব্যবস্থা এই কারণগুলির অন্যতম। ধর্মকলহ, সাম্প্রদায়িক ভেদ বৈষম্য, কৌলীণ্য প্রথা অস্পৃশ্যতার গ্লানির ফলে শতধাবিচ্ছিন্ন সমাজ জীবনে হতাশাগ্রস্থ ও সর্ব অধিকার বঞ্চিত বৌদ্ধ ও সাধারণ হিন্দুদের নিকট ইসলাম ধর্ম ঐশি আশীর্বাদ রূপে গৃহীত হয়েছিলো। ফলে দলে দলে সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলীরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় অতি সহযেই আশ্রয় গ্রহণ করে ইসলামী সমাজ ও পরিবেশ সৃষ্টিতে বিপুলভাবে সহায়তা করে।
এছাড়া তুর্কি মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর বহুবিদেশীয় মুসলমান নানা সুত্রে বাংলাদেশে আগমন করতে থাকেন। কেউবা ভাগ্যান্বেষণে কেউবা বাণিজ্য ব্যাপদেশে, কেউবা রাজকার্য উপলক্ষে আবার কেউবা অন্যস্থান থেকে উৎপীড়িত ও উৎখাত হয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকেন। উপরšুÍ মহম্মদ বিন বখতিয়ার ও তাঁর পরবর্তী সমর নায়কদের সাথে যে বিশাল তুর্কি বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, তারা অনেকেই এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের মধ্যে খুব অল্প লোকই সস্ত্রীক আগমন করেছিলেন। এসব বহিরাগত মুসলমানদের অনেকেই এদেশে স্ত্রী গ্রহণ করেন এবং এসব স্ত্রীর গর্ভে বহু সন্তান সন্ততিও জন্মগ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশে মুসলমান সমাজের পরিধি দিনের পর দিন সম্প্রসারিত হতে থাকে এবং বহিরাগত মুসলমানদের আচার ব্যবহার, ধর্ম কর্ম, কথা বার্তা ও জীবন যাপন পদ্ধতি এদেশীয় মুসলমান ও অমুসলমানদের কাছে একটি আদর্শে পরিণত হয়। এভাবে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু মুসলমান সমাজ-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে এবং একটি স্থায়ী ইসলামী পরিবেশ বা আবহের সৃষ্টি হয়।
লেখক পরিচিতি
আ. খা. মো. আবদুর রব, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল।
লেখাটির তথ্যসূত্র:
১. ড. আবদুল করিম : বাংলার ইতিহাস
২. Dr. Hitte : The orginis of the islamic state
৩. History of Bengal
৪. ড. মুহম্মদ এনামুল হক, পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম
৫. John A. Subhan ; Sufism, Its Saiuts and Shriues
৬. চৌধুরী শামসুর রহমান ; পূর্বপাকিস্তানে ইসলামের আলো
৭. মোহাম্মদ আকরাম খাঁ; মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস
৮.Eoiot and Dowsom : History of India as told by it’s our historiaus
৯. E. Harvey : History of Barma
১০. ড. মুহম্মদ এনামুল হক : মুসলিম বাঙ্গলা সাহিত্য
১১. ড. এ. রহিম : সোস্যাল অ্যান্ড কালচারাল হিসটরি অব বেঙ্গল
১২. ড. আহমদ শরীফ : বাংলা একাডেমি পত্রিকা :
১৩. ড. আশরাফ সিদ্দিকী : বাংলা একাডেমি পত্রিকা
১৪. মাও. মু. আকরম খাঁ : মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস
১৫. ড. সুশিলা চৌধুরী মন্ডল : বঙ্গদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, ১ম পর্ব, ১ম প্রকাশ, ১৯৬০
১৬. শামসুর রহমান : পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামের আলো
১৭. অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ : মাসিক মোহাম্মদী, পৌষ সংখ্যা, ১৩৬০।
১৮. আরবি প্রবাদ বাক্য।
১৯. আল কুরআন।
২০. আল হাদিস।
২১. চৌধুরি শামসুর রহমান : পূর্বপাকিস্তানে ইসলামের আলো
২২. আহমদ শরীফ : মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ-সংস্কৃতির রূপ, ১ম প্রকাশ
২৩. বাংলা একাডেমি পত্রিকা, আষাঢ় সংখ্যা, ১৩৭৬।
২৪. আরবুঁকে জাহাজরানি (গ্রন্থ)
২৫. তুহফাতুল মুজাহিদিন (গ্রন্থ)
২৬. ইবনে বতুতা : রেহলায়ে ইবনে বতুতা।
২৭. হলায়ুধ মিস্ত্র : সেক শুভোদয়া ।
২৮. রামাই পন্ডিত : শূন্যপুরাণ (নিরঞ্জনের রূষ্মা) ।
২৯. আহমদ শরীফ : বাঙ্গালি ও বাঙলা সাহিত্য।
৩০. ড. আবদুল করিম- স্যোসাল হিস্টরি অব দি মুসলিম বেঙ্গল।
৩১. তাবাকাতে নাসিরি: নদীয়া বিজয় প্রসঙ্গ।
৩২. হলায়ূধ মিশ্র: শেখশুভোদয়া, সুকুমার সেন সম্পাদিত।
৩৩. সিলেট জেলার কিংবদন্তি;
৩৪. কে.এন. দীক্ষিত: মোমোরিস্ অব দি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া।
৩৫. রামাই পন্ডিত: শূন্যপুরান, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত, ১৯৩৬।
৩৬. ড. আবদুল করিম: সোস্যাল হিস্টরি অব বেঙ্গল।
৩৭. চারু চন্দ্রবন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত শূন্যপূরাণ : ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ
৩৮. ডা. কাজীউদ্দীন মুহাম্মদ : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
৩৯. ড. মুহাম্মদ এনামুল হক : বঙ্গে সুফি প্রভাব
৪০. তাবাকাত ই নাসিরি,
৪১. জার্নাল অব দি পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সোসাইটি, ভল্যুম-১
৪২. মিনহাজ
৪৩. আবদুর রহমান চিশতী: সিরাতুল আসরার পান্ডু নং ৪২-৫৫
৪৪. ড. আবদুল করিম: সোস্যাল হিস্টরি অফ দি মুসলিম বেঙ্গল
৪৫. সুখময় মুখোপাধ্যায়: বাংলাদের ইতিহাস
৪৬. ফিরিস্তা
৪৭. রিয়াজ উল সমোতির
৪৮. তাবাকাতে নাসিরি, লাহোর
৪৯. ইপিগ্রাফিয়া ইন্দো মুসলিমিকা ১৯১৭
৫০. টমাস: ইনিশিয়াল কয়েন্স অব বেঙ্গল
৫১. ড. সুশীলা মন্ডল: বঙ্গদেশের ইতিহাস
৫২. জার্নাল অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ।
৫৩. ড. আব্দুল করিম: বাংলা একাডেমি পত্রিকা
৫৪. আখবার-উল-আখিয়ার।
৫৫. সেক শুভোদয়া: সুকুমার সেন সম্পাদিত
৫৬. রিহলা-ই-ইবনে বতুতা– ভল্যুম-৪।
৫৭. জার্নাল অব দি পাকিস্তান হিস্টরিক্যাল সোসাইটি, ভল্যুম
৫৮. চিশতি: সিরাতুল আসরার, আলীয়া মাদ্রাসা পান্ডুলিপি
৫৯. হাসান আসকারি : বেঙ্গল : পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট
৬০. তাবাকাতে নাসিরি, লাহোর থেকে প্রকাশিত
৬১. ড. কাজী দীন মুহাম্মদ: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
৬২. অধ্যক্ষ শইখ শরফুদ্দিন : সুফিবাদ ও আমাদের সমাজ।
৬৩. খান সাহিব আবিদ অলী : মেমোরিজ অব গৌড় এন্ড পান্ডুয়া।
৬৪. ইপিগ্রাফিয়া অব ইন্দো মুসলেমিকা, ১৯৩৯।
৬৫. প্রভাস চন্দ্র সেন : বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি, ১৯২৯,
৬৬. কে অব দীক্ষিত: মেমোরিজ অব দি আর্টিফিসিয়াল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ১৯০৮।
৬৭. স্টাার্ট : হিস্টরি অব বেঙ্গল, ১৯০৩।
৬৮. শায়খ আবদুল হক দেহলভি : আখবারউল আখইয়ার।
৬৯. অধ্যা. হাসান আসকারি : বেঙ্গল হিসটোরি অব বেঙ্গল।
৭০. গওসী: গুলজার-ই-আবরার।
৭১. ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য ।
আর্টিকেলটি এক কথায় অসাধারন। ধন্যবাদ।