মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ
প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে যে পানির দরকার হয় তা আসে বর্ষা থেকে। ধূ ধূ বালুচর, তপ্ত রোদে ফেটে চৌচির হওয়া মাটি হা করে চেয়ে থাকে এক পশলা বৃষ্টির জন্য। মেঘরা জমা হয়ে যখন সেই কাঙ্খিত বৃষ্টি ঝরায় তখনই হয় প্রাণের সঞ্চার। মাটি তার উর্বরতা মেলে ধরে। তাপদাহে হাঁসফাঁস করা মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। জেগে ওঠে সবুজের সমারোহ। পাতারা জাগে। গাছেরা জাগে। জাগে মানুষের মনও। তাই বলা যায় বর্ষার স¤পর্ক প্রাণের সাথে। জীবনের সাথে। বর্ষার নিবিড় সম্পর্ক মানুষের মনের সঙ্গেও।
আবার এই মনকে শান্ত করতে, মনে প্রশান্তি এনে দিতে তথাপি মনের খোরাক যোগাতে রচিত হয় সাহিত্য। আয়নার মতো করে সাহিত্য মানুষের মনের ছবি তুলে ধরে নিপুণভাবে। মানুষের আনন্দও ফুটে ওঠে, আবার মানুষের দুঃখ কষ্টের উপাখ্যানও ফুটে ওঠে সাহিত্যে। সাহিত্যের প্রধান যে তিনটি ধারা-গান, কবিতা ও কথা সাহিত্য-তার মধ্যে সবচেয়ে জীবন ঘনিষ্ঠ হল গান ও গীতিকবিতা। প্রবল আনন্দেও মানুষ গান বাঁধে আবার তীব্র শোকেও গান বাঁধার প্রবণতা দেখা যায়। প্রিয়জন মারা গেলে সুরে সুরে বিলাপ করতে দেখা যায়। তাই বলা যায় গানের সঙ্গে মানুষের মনের স¤পর্ক যেমন, ঠিক বর্ষার সঙ্গেও মানুষের মনের স¤পর্ক তেমন। বর্ষা ও বিরহ যেন একই সুতায় গাঁথা। আধুনিকতার ছোঁয়া যে সময়টাতে লাগেনি, সেই সময়ে টানা বর্ষায় পথঘাট ডুবে যেত। মানুষ দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্দী হয়ে পড়ত। বণিকরা বর্ষা শুরুর আগেই বাড়ি ফিরে আসত। যারা ফিরতে পারত না তারা আটকে যেত বিরহের জটিল জালে। নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হতো দুর পরবাসে। এভাবে বর্ষা নিয়ে আসত বিরহ।
আবার বর্ষা আনন্দের উপাদানও নিয়ে আসে। বৃষ্টির পানিতে মাটি চাষযোগ্য হয়ে ওঠে। কৃষকের মনে আনন্দের সীমা থাকে না। চৌচির মাটি তখন প্রাণের সঞ্চার ঘটানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। বর্ষা হয়ে ওঠে তখন উপভোগ্য। আনন্দ ও বেদনার দুই দিক নিয়েই বর্ষার স¤পর্ক হয়ে উঠেছে জীবনের সঙ্গে। আর সাহিত্য যেহেতু জীবনেরই কথা বলে তাই সাহিত্যের বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছে এই বর্ষা। যেমন এসেছে কাব্যে, গল্প কিংবা উপন্যাসে। তেমনি বর্ষা প্রসঙ্গ এসেছে গানেও। গীতবিতানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি পর্যায়ে গান লিখেছেন ২৮০টি। এর মধ্যে বর্ষা পর্যায়ের গান ১২০টির মতো। তাই বর্ষাসাহিত্যে সম্রাটের মুকুট পড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথই।
বর্ষা এলে প্রকৃতি সাজে নতুন বউয়ের মতো। প্রকৃতির এই সাজকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে কদম ফুল। যেন কদম ফুলের পাঁপড়িতে ভর করেই নেমে আসে বর্ষা। কদম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান
মেঘের ছায়ায় অন্ধাকারে রেখেছি ঢেকে তারে
এই যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান।
বর্ষায় প্রকৃতির এই নতুন সাজ মুগ্ধ করেছে কাজী নজরুল ইসলামকেও। বর্ষায় যেমন নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে তেমনি মানষের মনের বনেও মুকুল খোলে। গেয়ে ওঠে পাখিরাও। এমনই দৃশ্য নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে কবির এই গানে-
রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে
কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে
কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে
কুহু পাপিয়া ময়ুর বোলে
মনের বনের মুকুল খোলে
নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে।
বর্ষায় মনের বনের মুকুল খোলে বলেই হয়তো না বলা কথা প্রিয়জনকে বলার জন্য মন উসখুস করতে থাকে। মন উতলা হয়ে ওঠে। ঘন বরষায় সিক্ত শীতল পরিবেশ যেন হয়ে ওঠে মনে কথা খুলে বলার উত্তম পরিবেশ। যেমনটা ফুটে উঠেছে রবীন্দনাথ ঠাকুরের গানে-
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়,
এমন মেঘস্বর বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়…
টানা ঘন বর্ষা মানুষকে অনেক সময় কর্মহীনও করে দেয়। তখন কোনো কিছুতেই আর মন লাগে না। মন বসে না কোনো কাজে। মন তখন কেমন কেমন করে। এটা উপলব্ধি করেই কবিগুরু লিখেছেন-
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না ।।
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।
শ্রাবণের বর্ষণমুখর রাতে টিনের চালে বৃষ্টির যদি কখনো ছন্দপতন ঘটে তখন সেই বিরামে প্রিয়তম মানুষের স্মৃতিচারণে দু চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসতেই পারে। সেই নিঃসঙ্গ রাতে যেন সঙ্গি হয়ে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই গান-
শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে।।
ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ-স্বপন সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে।।
বর্ষার আবার মনকে জাগিয়েও তোলে। দারুণভাবে উতলা করে তোলে। উদাস নয়নে বৃষ্টির দেখার বিলাসিতা পেয়ে বসে কবি মন। কবি তখন গুণগুণিয়ে গেয়ে ওঠেন-
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে॥
চেনাশোনার কোন বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে॥
ঘরের মুখে আর কি রে কোনো দিন সে যাবে ফিরে।
যাবে না, যাবে না
দেয়াল যত সব গেল টুটে॥
বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা কোন বলরামের আমি চেলা,
আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে
যত মাতাল জুটে।
আবার কখনো কখনো অধরা হয়ে ওঠে এই বর্ষা। দীর্ঘদিন বর্ষার বিরহে মাটির বুক ফেটে চৌচির হয়ে ওঠে। মানুষেরও মন ফেটে চৌচির হয়। শীতলতার পরশ খুঁজের বেরায় সবুজ পাতারাও। পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে পাখিরাও। চারদিকে শুধু দেখা যায় ধূ ধূ বালুচর। তীব্র তাপদাহে দেহ পোড়ে, ত্বক পোড়ে আর পোড়ে কৃষকের মনও। দিন যায় রাত যায় কিন্তু বৃষ্টি ধরা দেয় না। অসহায় চোখ তাকিয়ে থাকে আসমান পানে। স্রষ্টাই তখন ভরসা হয়ে ওঠে। তাইতো লোকসঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ গেয়ে ওঠেন-
আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে।
আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে।
আসমান হইল টুটাটুটা জমিন হইল ফাটা,
আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা।
মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিব তোর কেডা।
আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে পানি,
ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে……
স্রষ্টার কাছে বৃষ্টির প্রার্থনার পর যখন এক পশলা বৃষ্টি এসে অতীতের গ্লানি মুছে দিয়ে যায় তখন আনন্দে মন নেচে ওঠে। বর্ষায় সিক্ত কবি মন তখন গানে গানে ফুটিয়ে তোলেন বর্ষার এক অপূর্ব শৈল্পিক সৌন্দর্য অপূর্ব উপমা ও অলঙ্কারে-
বৃষ্টি নুপুর পরে বর্ষা এসে
মেঘের কাজল দিয়ে সাজায় আঁখি।
কবি ফররুখ লিখেছেন ‘বৃষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে গাছের ডালে টিনের চালে /বৃষ্টি নামে হাওয়ার তালে/বাদলা দিনের একটানা সুর/বৃষ্টি নামে ঝুমুর ঝুমুর’। কবির এই উপমার সাথে মিল রেখে যখন সত্যি সত্যি টিনের চালে রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি পড়ে তখন বৃষ্টির শব্দ এক অপূর্ব আবহ তৈরি করে। সেই আবহের শীতল পরশে চোখে নেমে আসে শান্তির ঘুম। সেই আবহ ফুটে ওঠে তারিক মুনাওয়ারের এই গানে-
ওগো বরষা, এলে সহসা
তোমারি রুমঝুম, আঁখিতে আনে ঘুম
স্বপ্ন পরশা।
এভাবে বর্ষা নানাভাবে মিশে আছে বাংলা সাহিত্যের শাখায় শাখায়। বাংলা গানে গানে। বর্ষা নিয়ে যে কত গান লেখা হয়েছে তার হিসেব তুলে ধরা অসম্ভব। এই গান লেখা থেমে নেই। বর্ষার সুরও থেমে নেই। বর্ষা মিশে আছে আমাদের জীবনের সঙ্গে। বর্ষা দিয়ে যাক অবিরাম প্রাণের ছোঁয়া। বৃষ্টি নেশাভরা দিনগুলোতে আমরা যেন স্রষ্টাকে ভুলে না যাই। বর্ষার পরশে পরশে স্রষ্টাকে অনুভব করতে হবে পরম কৃতজ্ঞতায়।