মাহমুদ ইউসুফ।।
একদা সুপারপাওয়ারের দেশ বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবদান ছিলো কমবেশি ১০ শতাংশ। সময়টা ছিলো চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যগগন পর্যন্ত। ভারত সম্রাট আওরঙজেব আলমগিরের সুশাসনামলে বাংলার অর্থনীতি সমৃদ্ধির পর্বতচূড়ায় উপনীত হয়েছিল। সেই বেগবান অর্থনীতির ধ্বস ঘটায় ব্রিটিশরা লুটতরাজের মাধ্যমে। বাংলার অর্থে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। বর্তমান দেশ বিদেশি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। অথচ তৎকালে বিদেশ ছিলো বাংলাদেশের দানে ঋদ্ধ। শ্রী প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ লিখেছেন, ‘বাংলার দুর্ভিক্ষের কথা শোনা যায় না; বাংলাই দিল্লি সাম্রা রাজ্যের খাদ্য ও বস্ত্রের উৎস ছিলো।’ (বাঙালী,পৃ ২৫) শ্রী সুধীরকুমার মিত্র লিখেছেন, ‘মুসলমান আমলে শেষের দিকেও বাঙলায় এমন বহু পরিবার ছিল যারা সোনার থালায় ভাত খেত।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘ইংরেজ আমলেই ভারতবর্ষে শোষণ-নীতির প্রথম সূত্রপাত হয়।’ (হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ প্রথম খণ্ড, পৃ ১৮৮) ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সফরে আসা জ্যা ব্যাতিস্ত টার্ভানিয়ার বাংলা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘Bengal has hundred gates open for entrance but not one for departure.’’ চিনা পরিব্রাজকদের বর্ণনানুসারে, বাংলার মুসলমান বণিকগণ তাদের ধনসম্পদের প্রাচুর্য, বিলাসিতা ও কারবারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। জনৈক চিনদেশীয় দূত লক্ষ্য করেন যে, বণিকদের প্রত্যেকেই ব্যবসায়ে নিয়োজিত এবং প্রত্যেকের মূলধনের পরিমাণ ১০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
সেই স্বপ্নিল রাষ্ট্রের রাজধানী ছিলো সোনারগাঁও। সোনারগাঁও সৃষ্টি করেছিল গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ’র মতো শতাব্দীশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক আর আবু তাওয়ামার মতো মহামানব ও মহান শিক্ষাবিদ। দুশতাধিক বছর যাবত প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ নগর ছিলো সোনারগাঁও। দুর্ভাগ্যবশত পাঠ্যবইয়ে এই শহরের গৌরবগাঁথা অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীরা জানতে পারছে না সোনারগাঁওয়ের কীর্তিগাঁথা। এই শহর থেকেই শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিক মহাসড়ক গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ভারত, কাশ্মির, পাকিস্তান হয়ে সোনারগাঁও টু কাবুল। বাংলা-ভারতের শাসক শের শাহ সুরি ছিলেন এর উদ্যোক্তা। সোনারগাঁওকে কেন্দ্র করেই পোশাক সম্রাট মসলিন শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। মসলিন জয় করে নিয়েছিল সারা দুনিয়া। অফুরন্ত স্বর্ণ, রৌপ্য ও ফসলের ভান্ডার সৃষ্টি হয় এ নগরীতে।
প্রাচ্যের এই রহস্যনগরীর বাইরে দেশে আরও একটি শহর ফুলেফেঁপে সমৃদ্ধ হয়ে বহির্বিশ্বে খ্যাতি লাভ করে। ‘বাঙালা’ নামের সেই শহরটির অবস্থান ছিলো বর্তমানকার বরিশালের কোনো একটি অঞ্চলে। তবে কেউ কেউ বলেছেন হাতিয়া ও সন্দ্বীপের মাঝ বরাবর। ড. এম. এ. রহিম মনে করেন, ‘বাঙ্গালা শহর হাতিয়া ও সন্দ্বীপের মাঝামাঝি স্থানে সম্মিলিত নদীগুলোর মোহনায় অবস্থিত ছিল এবং ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমদিকে সাগরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ এই বাঙালা শহরের অদূরে সন্দ্বীপেই আবির্ভাব ঘটেছিল দুনিয়ার প্রথম মানব নবি আদমের। সন্দ্বীপ থেকে পরবর্তীতে জেদ্দার উদ্দেশে যাত্রা করেন নবি আদম। (রিচার্ড এম. ইটন, পৃ ৩৬৪) রোহিনী কুমার সেন লিখেছেন, ‘ইউরোপীয় ভ্রমণকারীগণের বিবরণী মধ্যে বেঙ্গালা নামক স্থানের উল্লেখ আছে। তাঁরা এই নগরীকে অতীব সমৃদ্ধিশালী বলে উল্লেখ করেছেন। বর্তমান সময়ও ঢাকায় একটি বাজারের নাম বাঙ্গালা বাজার দেখতে পাওয়া যায়।’ কিন্তু ঢাকার বাংলাবাজার যে বাঙালা বন্দর নয় সেটা সুনিশ্চিত। তবে ইতিহাসবিদ সিরাজ উদদীন আহমেদ লিখেছেন, ‘অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারণা বাঙ্গালা শহর ও বাকলা এক। তাঁর মতে, বাঙ্গালা থেকেই বাকলা। (পৃ ৫২-৫৩)
তবে এমনও হতে পারে, বাঙালা বন্দর আর ভোলা জেলার অবস্থান একই ভূখণ্ডে। ভোলা আজও নদী ভাঙনের শিকার। ভোলা আয়তনে ছোটো হয়ে আসছে ক্রমশ। সমৃদ্ধশালী বাঙালা শহর হয়ত এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কালের পরিক্রমায় সাগরের আগ্রাসন ও নদি ভাঙনের ফলে বাঙালা বন্দর বিলুপ্ত হয়ে যায় নদীগর্ভে। শহরটির উত্থান-ঐতিহ্যও ভুলে যেতে থাকে মানুষ। যেভাবে দুনিয়াবাসী ভুলে গেছে ‘আটলান্টিস’ মহাদেশের হারানো স্মৃতিগাঁথা।
বাঙালা বা বেঙ্গল বন্দর প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধশালী শহর। ইউরোপীয় বণিক বারথেমা ও বারবোসার বিবরণে ‘বেঙ্গালা’ (বাঙালা) শহরে বড় বড় আরবি, ইরানি ও আবিসিনিয় বণিকদের উল্লেখ রয়েছে। ইতালিও সওদাগর লুই বারথেমা জাহাজযোগে টেনাসেরিম থেকে ‘বাঙ্গেলা’ শহরে আগমন করেছিলেন ১৫০৩-১৫০৮ সালের মধ্যে। তিনি মন্তব্য করেন, এই শহরটি ছিলো তাঁর দেখা শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং এর সুতি ও রেশমি বস্ত্রের পর্যাপ্ত রপ্তানি বাণিজ্য ছিলো। পর্তুগিজ বণিক দুয়ার্তে বারবোসা ১৫১৮ সালের দিকে বাংলাদেশ সফর করেন। তিনিও উত্তম পোতাশ্রয় সমেত প্রসিদ্ধ সমুদ্র বন্দররূপে ‘বেঙ্গলা’ শহরের নামোল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এই শহরের অধিবাসীদের বেশির ভাগই ছিলো মুসলিম, যাঁদের অনেকেই ছিলেন বড় বড় বণিক এবং বিরাট বিরাট জাহাজের মালিক। বেঙ্গলা শহরের অধিবাসীরা বিভিন্ন প্রকারের সূক্ষ্ম ও সুন্দর সুতিবস্ত্র প্রচুর পরিমাণে তৈরি করতো। এগুলো তাদের ব্যবসায়ীরা চিনি ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে কোরোমন্ডাল, মালাবার, কাম্বে, পেগু, টেনাসেরিম, সুমাত্রা, সিংহল ও মালাক্কায় রপ্তানি করত। ১৫৬১ সালে ভেনিসের গ্যাসতালদি কর্তৃক প্রকাশিত এশিয়ার একটি মানচিত্রেও বাঙালা শহর ও সাটিগাঁয়ের উল্লেখ আছে। এই মানচিত্র এবং দুজন বিদেশি পরিব্রাজকের সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায় যে বাঙালা নামক একটি বড় শহর ও বন্দর বঙ্গ উপসাগরের উপকূলভাগে ষোড়শ শতকের প্রারম্ভে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। শ্রী প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ বাঙালা বন্দর সম্পর্কে আমাদের জানান, ‘বৈদেশিক বিবরণ থেকে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার অনেক কথা জানতে পারা যায়। ইতালীয় ও পোর্তুগিজ পর্যটকরা বাংগেলা শহরের সমৃদ্ধির কথায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। এই শহর ছিল বিরাট ব্যবসাকেন্দ্র। বস্ত্র, আখ, চিনি, আদা ইত্যাদি বহুদ্রব্যের ব্যবসা হত…।’ বহিরাগত বণিক জন ডি সালভা ও লি ব্লাঙ্কও বাঙালা বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ লিখেছেন, টলেমি বর্ণিত বারাকোরার পরিবর্তিত রূপ বাঙ্গালা। উল্লেখ্য, বাঙালা শব্দটি ফারসি পরিভাষা থেকে আগত। আরও একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো। বাঙালা শহর ঐতিহাসিক গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানীও হতে পারে। বিষয়টি ব্যাপক গবেষণার দাবি রাখে।
মুক্তবুলি পাঠকদের কাছে অনুরোধ:
বাঙালা বন্দর ও নগর সম্পর্কিত আলাপকে সামনে আনা জরুরি। কারণ, শুধু দক্ষিণ বাংলার নয়, বাঙালি জাতির সোনালি ইতিহাসের সাথে বিষয়টি সম্পর্কিত। নানা তথ্য উপাদান ও মাল মশলা সংগ্রহ করে লেখক, গবেষক, পাঠকরা বিষয়টিকে ফ্রন্টে নিয়ে আসতে পারেন। সবার কাছেই বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
দক্ষিণ বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান গরিমা, গৌরব-অহঙ্কারের সাথে বিযুক্ত বাঙালা শহর। ইতিহাসের পাতায় নিদ্রিত সেই কিংবদন্তি। বাঙালি চিন্তা গবেষণায় পুনরায় ঝলসে উঠুক বাঙালা বন্দরের বাঙালিদের বীর্যবান বীরত্ব। বাঙালি ও বরিশাইল্যা ভাবনায় বেগবান হোক বাঙালা বন্দর।
তথ্যপঞ্জি:
১. ড. এম. এ. রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
২. সিরাজ উদদীন আহমেদ, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারি ২০১০
৩. শ্রী প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ, বাঙালী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬০
৪. আনিসুল হক চৌধুরী, বাংলার মূল, ডিসেম্বর ১৯৯৫
৫. রিচার্ড এম. ইটন, ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, ইফাবা, জুন ২০০৮
৬. রোহিনী কুমার সেন, বাকলা, ১৯১৫
৭. সুধীরকুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ প্রথম খণ্ড, কলকাতা, মার্চ ১৯৬০