মাহমুদ ইউসুফ ।।
বাঙালি রেনেসাঁর প্রাণভোমরা। বাঙলার ও বাঙালির পুনর্জাগরণের অন্যতম প্রধান কান্ডারি আব্বাসউদ্দিন আহমদ। ইসমাইল হোসেন সিরাজী, আকরম খাঁ, মুজিবর রহমান খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোজাম্মেল হক, ইমদাদুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম শিল্প-কৃষ্টির যে নবজাগরণের নেতৃত্ব দেন আব্বাসউদ্দিন আহমদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম সহযোদ্ধা ও সহযাত্রী। বাঙালি রেনেসাঁ রণাঙ্গনের রণপতি কবি ফররুখ আহমদের কাব্যান্দলনে যে ভূমিকা,সঙ্গীতাঙ্গনে একই ভূমিকা আব্বাসউদ্দিনের। আবহমানকালের আবাহনী। আবহমান বাংলার শিল্পিত মননশিল্পী। বাঙালি কৃষ্টির উৎকর্ষ সাধনে যার সমকক্ষ সহযোদ্ধা দুর্লভ। গান বাংলার গায়ক সম্রাট। বাঙালি সংস্কৃতির রাজতোরণ। আব্বাসউদ্দিনের আবাদি ভূমিই আজকের বাংলাদেশ।
গানে গানে বৃষ্টি ঝড়িয়েছেন মহান শিল্পী। নিজেই লিখেছেন, ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে গানখানা বহুবার গেয়েছি। যতদিনই গেয়েছি গানের শেষে ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে উপাখ্যান বা প্রবাদবাক্য কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী মি. চৌ এন লাই ঢাকায় এলেন। আমরা এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গুলিস্তান সিনেমা হলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাই। সন্ধ্যা সাতটায় নাচ-গান আরম্ভ হলো। রাত ন’টায় অনুষ্ঠান শেষ হয়। এই অনুষ্ঠানে আমি ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’ গানখানি পরিবেশন করেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে প্রতিটি শ্রোতা হলের বাইরে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বাইরে আরম্ভ হয়েছে ঝমঝমাঝম বৃষ্টি। অথচ প্রেক্ষাগৃহে যখন সবাই ঢুকছিলাম তখন ছিল তারকাখচিত নির্মল আকাশ। মি. চৌ এন লাই ঢাকা পরিত্যাগের পূর্বমুহূর্তে বিমানঘাঁটিতে বলে গিয়েছিলেন ‘এদেশের অনেক কিছুই হয়ত ভুলে যাব কিন্তু স্মৃতির মণিকোঠায় একটি চিত্র বহুদিন দাগ কেটে থাকবে। সেটা হচ্ছে- তোমাদের দেশের শিল্পী গান দিয়ে আকাশের পানি আনতে পারে।’ শতাব্দীর আলো, যুগযুগান্তরের আলো, যুগের আলো, কালের আলো, সময়ের আলো আব্বাসউদ্দিন আহমদ। বাঙলার আলো, বাঙালির আলো, বাঙালি কৃষ্টির কূলনায়ক। আলোকিত সমাজের সমরনায়ক।
আদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন নিরেট সাদা মনের মানুষ। জাতির মানসপরিচয়কে করেছেন শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ। গ্রীষ্মের ফাটল মাঠ বৃষ্টি সিক্ত করে সজীব করেছেন। অক্সিজেন হয়ে মুমূর্ষু রোগীকে রক্ষা করছেন মৃত্যুকূপ থেকে। বৈরি রাজনীতি, বৈরি সমাজ, বৈরি সংস্কৃতি, বৈরি জাতি, বৈরি পরিবেশের মধ্যে থেকেও সৃষ্টি সুখে উল্লসিত। ভাবজগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাঙালি কৃষ্টির করুণ প্রকৃতিতে বৃষ্টির ফল্গুধারা প্রবাহিত করেছেন। সংস্কৃতি মনকে আসমানি আলোয় আলোকিত করেছেন। মোমবাতির মতো আলোক বিতরণ করে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন।
কালজয়ী সভা-গায়ক আব্বাসউদ্দিন। সভা, সমাবেশ, অনুষ্ঠান, উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানকে জমাতে হলে তাঁর হাজিরা ছিলো অত্যাবশ্যকীয়। তিনি লিখেছেন, ‘রাজরাজড়ার সভা-গায়ক হবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়নি বটে, কিন্তু বাংলাদেশে এ-জীবনে অন্ততঃ ৫ হাজার সভায় যোগদান করার মহাসৌভাগ্য তো হয়েছিল। আর সে সব সভায় শ্রোতা ছিলো দেশের আপামর জনসাধারণ। তাদের মাঝে গানে গানে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি দেশাত্মবোধ, বাঁচার অধিকার, জাগিয়ে দিয়েছি হারিয়ে যাওয়া পল্লীর কথা, পল্লীর গাঁথা, পল্লীর সুর, তাদের অবচেতন মনে জিজ্ঞাসা দিয়েছি, বলেছি, উত্তিষ্ঠিত, জাগ্রত।’
শৈল্পিক অভিযাত্রা ঘটে ১৯৩০ সালে ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়’ ও ‘কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো’ রেকর্ডের মাধ্যমে। তবে ফিল্মের অগ্রযাত্রা বিকশিত হয়নি বিশেষ কারণে। পরবর্তীতে ছেলে মুস্তফা জামান আব্বাসীকে ফিল্মস্টার করার ইচ্ছা ছিলো। সেটাও হয়ে ওঠেনি। শিশির কুমার ভাদুড়ী আব্বাসউদ্দিন সম্পর্কে বলেছেন, ’Here is True Artist’। শিশির ভাদুড়ীর ‘সীতা’ ছায়াছবিতে বৈতালিকের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব ছিলো। কিন্তু প্রযোজক মুসলিম নাম থাকায় অভিনয়ের সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার পর আর চিত্রজগতে আত্মপ্রকাশ করবার বাসনা বহুদিনের জন্য মৃত হয়ে রইল।’
সংগীতে আব্বাসউদ্দিনের উত্থান যখন শুরু তখন বাঙালির নবজাগরণের কাল। বিলম্বিত রেনেসাঁয় আব্বাসউদ্দিনের শুভাগমন দেরিতে হলেও কৃতিত্বে তিনি সবার থেকে এগিয়ে। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, ‘ আব্বাসউদ্দিনরা যুগে যুগে আসেন না। তিনি হলেন শত বছরের শ্রেষ্ঠ সংগীত গুরু। আব্বাসউদ্দিন তাঁর গানের মধ্য দিয়েই ’৪৭ সাল থেকেই যে সকল আন্দোলন হয়েছে সব আন্দোলন বেগবান করেছেন। তিনি ছিলেন সংগীত জগতের সম্রাট। … আব্বাসউদ্দিনের জন্ম না হলে আজকের এই সংগীত জগৎ এতোটা সমৃদ্ধ হতো না। আব্বাসউদ্দিন শুধু গায়ক ছিলেন না। তিনি অভিনেতাও ছিলেন। জাতির পিতা সব সময় তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন’।’ আপন প্রতিভা ও স্বোপার্জিত দক্ষতার গুণে তিনি পৌঁছেন খ্যাতির শীর্ষে ।
আব্বাসউদ্দিন আহমদের আত্মজীবনী ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন। স্মৃতিকথা মহামূল্যবান অঢেল তথ্যসমৃদ্ধ আত্মচরিত। এক বৈঠকে পাঠ শেষ করার মতো সুখপাঠ্য। ফুলেল ফুলঝুড়ির শুভেচ্ছা ছড়ানো বই। নান্দনিক স্মৃতিচারণ, সহজবোধ্য শব্দচয়ন, সহজপাচ্য স্মৃতিকথা, সুনন্দিত আত্মচরিত, নান্দনিক শব্দচয়ন। নন্দনতত্তে¡র অসাধারণ এক আধার। সমকালীন সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্মনীতি, যুবনীতি, মানবনীতি ও সমাজনীতির অনবদ্য দলিল। রাজনীতিকরা রাজনীতির পাঠ পাবেন। তরুণ সমাজ দিকনির্দেশনা পাবেন। ধার্মিকেরা ধর্মের অনুষঙ্গ পাবেন। সাহিত্যের উপাদানেও উদ্দীপিত। সমাজতাত্তি¡করা পাবেন তদানীন্তন সমাজের হালহকিকত। সমাজের সংস্কৃতির সাগরসৈকতে সাঁতরানো সম্ভব শিল্পিসমাজের। সাধুপুরুষের সাধুচিন্তার সমাহার স্মৃতিকথা।
সুরশিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ দুর্দিনের যাত্রী, হতাশা দিনের আশা, মেঘলা রাতের তারা, অন্ধকারের আলোকবর্তিকা, দুঃখের দিনে সুখের বার্তাবাহী। আব্বাসউদ্দিনের আলো ঘরে ঘরে জ্বলো। তাঁর পরিবার দেশশ্রেষ্ঠ পরিবার। তাঁর সুযোগ্য সন্তান মোস্তফা কামাল সুশীল সমাজ ও আইনবিভাগকে আলোকিত করে চলে গিয়েছেন অদৃশ্য সুতোর টানে। মোস্তফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসি রহমান এখনও আলো দিয়ে যাচ্ছেন শিল্পকৃষ্টির উৎকর্ষতায়।
১৯৫৯ সালে সেই সুর থেমে যায় চিরতরে। মৃত্যুকালে তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হয়: পরাধীন যুগে জন্ম হলেও স্বাধীন দেশে মৃত্যুবরণ করছি- এটাই পরম শান্তি, পরম প্রাপ্তি।’ মৃত্যুর পর সুর-সংগীতের সেই ধারা বহমান থাকে আবদুল আলিমের ধমনীতে। ১৯৭৪ সালে তাঁর প্রয়াণে ম্লান হয়ে যায় মেঠো সুর। ম্রিয়মান হয়ে যায় লোকসঙ্গীতের উজ্জ্বল প্রবহমান ধারা। শুভ শ্রদ্ধাঞ্জলি, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, স্তুতিপাঠকের স্তুতি হোক আব্বাসউদ্দিন আহমদের সৌজন্যে।