তাজ ইসলাম :
যখন লঞ্চের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন অন্যরকম অনুভূতি হল আমার। কার কেমন হয় জানি না, আমি দেখলাম পানির খেলা। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পানির প্রতি সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে লঞ্চটি, পাখার ঘূর্ণনে বাতাস হয়ে পানিকে ছুঁড়ে মারছে পিছনে! পানি সবেগে পিছনে যাচ্ছে। ক্ষণিকের মাঝে প্রবল ঘূর্ণনে আবার সামনে চলে আসার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। পানিগুলোকে পিছনে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, পানি আবার ফিরে আসতে চেষ্টা করছে, ফলাফলে প্রবল ঘূর্ণন। এই যেন পানির দ্বন্ধ, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি।
এই ঘূর্ণিপাকে কেউ পড়লে আর রক্ষা নেই। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই এটি যেন আমার জীবন জাহাজে পরিণত হয়ে গেল। আমি আমার নির্দিষ্ট গন্তব্যমুখী এক জাহাজযাত্রী। জীবনের জাহাজে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে পৌছতে প্রচন্ড বেগে নিক্ষেপ করছি জীবনের শক্তি। পিছন থেকে আরও তীব্রবেগে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর নিয়ম-অনিয়ম, প্রেম-বিরহ, বন্ধুত্ব শত্রুতা, উৎসাহ-বাঁধা, প্রশংসা-নিন্দা।
এরকম হাজারও যোগ বিয়োগের উল্টো পানির ঘূর্ণন। ঢেউ কেটে কেটে সামনে এগুতে পারলেই গন্তব্য। একটু এদিক ওদিক হলেই সলিল সমাধি! জীবন যাত্রার সাথে নদীপথে লঞ্চ বা গ্রীনলাইন জাহাজের পিছনের পানির এ ঘূর্ণি যেন হুবহু মিলে যায়। নিচতলা থেকে উপরে ওঠে দেখি অজুর ব্যবস্থা আছে। তাৎক্ষণিক অযু সেরে নামাজের প্রস্তুতি নিলাম। সফরের ইবাদাত আমার কাছে আল্লার সাথে কম বিনিয়োগে বেশি লাভের ব্যবসা বলে মনে হয়। চার রাকাতের আসরের নামাজ দু রাকাতে সেরে নিলাম। নামাজ পরে আবার ভিতরে ঘোরাঘুরি করছি। কফি নিলাম, বসে কফি খেয়ে আবার সিটে এলাম।
আমরা গিয়েছিলাম বরিশাল। আমরা বলতে ঢাকা থেকে চারজনের দুটো গ্রুপ। এক গ্রুপে আমি ও কবি রহমান মাজিদ। অপর গ্রুপে কবি মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন আর কবি ড. ফজলুল হক তুহিন। দুটো গ্রুপ মূলত একগ্রুপই। তবু পরিস্থিতির কারণে দুই গ্রুপ হতে বাধ্য হলাম। ইচ্ছা ছিল চারজন একসাথেই যাব বৃহস্পতিবার রাতে লঞ্চে। লঞ্চকেই আমি জাহাজ বলে আখ্যায়িত করছি। প্রায়োগিক অর্থে ঠিক বেঠিক যাই হোক। নদী পথে আমার যাত্রা সর্বোচ্চ ট্রলার পর্যন্ত। বরিশাল লঞ্চঘাটে মানামী, সুন্দরবন দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। এতো বড় লঞ্চ? আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন কবি রহমান মাজিদ। রহমান মাজিদের লেখা প্রকাশ হয়েছে মুক্তবুলি ম্যাগাজিনে। মুক্তবুলি বরিশাল থেকে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিন। তারা আয়োজন করেছে লেখক ফোরামের ব্যানারে মুক্তবুলি লেখক সম্মেলন। রহমান মাজিদ মুক্তবুলির লেখক আর সেই হিসেবে সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। অপরদিকে সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন আর কবি ফিরোজ মাহমুদ মুক্তবুলির কর্তা ব্যক্তি। তাদের ত্রিমুখী প্রস্তাবে আমিও যেতে আগ্রহী। একই দিনে দুটো প্রোগ্রামের ডাক এসেছিল।
আমার কখনও নদীপথে দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি। তাই দুটো দাওয়াতের মাঝে বরিশাল যাত্রাটাই প্রাধান্য পেল। আমরা প্রস্তুতি নিলাম লঞ্চে বরিশাল যাব। কিন্ত বৃহস্পতিবারে রহমান মাজিদের অফিসিয়াল কাজে ময়মনসিংহ যাওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। ভেবে দেখলাম ময়মনসিংহ থেকে ফিরে লঞ্চের সময় ধরতে পারা হয়তো সম্ভব না। কাজেই যাওয়ার সময় বাস যাত্রাকে সুবিধাজনক মনে করলাম। মুলত আমরা আলাদা যাওয়াই সমীচীন মনে করে সে মোতাবেক প্রস্তুতি নিলাম।
বুধবারের পূর্ব নির্ধারিত শিডিউল পিছিয়ে বৃহস্পতিবারে এলো। একটু চাপ বেড়ে গেল আমার। যাওয়া হবে কি হবে না এমন দোদুল্যমান অবস্থায় রহমান মাজিদ নিশ্চয়তা দিলেন অবশ্যই যাবেন। তারপর বৃহস্পতিবারে চলছে মোবাইল যোগাযোগ। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টানা বৃষ্টি। দুপুরে টিকিট কনফার্ম করা হল। আমি দশটায় গিয়ে টাকা পরিশোধ করে সাকুরা পরিবহনের টিকিট নিলাম। রহমান মাজিদ তখনও আশুলিয়া জ্যামে ।
কাউন্টারে গেলাম পরের গাড়ির টিকিটের জন্য। আগের গাড়ির টিকিট পরিবর্তন করতে বলায় তারা না করে দিলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পরে অবশ্য পরিবর্তন করে দিল। গাড়ি ছাড়বে ১১.১৫ তে।
এগারটা ১৩ বেজে গেছে রহমান মাজিদ আসতে পারেনি। আর এদিকে বাস ছেড়ে দিয়েছে আমি টের পাইনি। উঠেছি ৪০ নম্বর বাসে। ড্রাইভার বলল আপনার বাস ৩৮ নম্বর। দৌড়ে গেলাম কাউন্টারে। সাথে সাথে কাউন্টার থেকে ফোন দিল বাসে। কাউন্টারের ফোন পেয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রহমান মাজিদ তখনও পৌছেনি। গাড়ি মোড় ঘুরে আসতে আসতে রহমান মাজিদ এসে পৌছতেই আমরা গাড়িতে ওঠে পড়লাম।
অপরপ্রান্ত হতে কবি ফিরোজ মাহমুদ ভাই আর সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন ভাই বারবার খোঁজখবর রাখছেন। বাসে চড়ে ফিরোজ মাহমুদ ভাইকে ফোনে জানালাম, বাস চলছে। সাথে চলছে আমাদের নানা প্রসঙ্গে কথা। কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গেলেন রহমান মাজিদ। আমি রাতের বাসযাত্রা উপভোগ করছি। বাস এসে থামছে ফেরিঘাটে। নিচে নেমে দুটো গরম ডিম আনলাম। তখন রাত তিনটা সোয়া তিনটা। ফেরি পার হলাম। ঘাট পারাপার দারুণ লাগছে। আমাদের ডান পাশে আরেকটি ফেরি, লঞ্চ, ফেরিতে বাসের আলো মনে হয় যেন নদীর বুকে হেঁটে যাচ্ছে খন্ড খন্ড গ্রাম। ঘুম সজাগে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। মাঝে মাঝে নদী, রাস্তার পাশে গ্রাম আর প্রকৃতির চোখ জুড়ানো সাজ। নদীর বুকে ব্রীজ, ব্রীজ পার হওয়ার সময় ডানে বামে নদী দেখি। নদী তীরের সবুজ গ্রাম দ্রুত ফেলে বাস চলছে বরিশালের দিকে। ফিরোজ মাহমুদ ভাই রাত জাগা পাখি হয়ে খোঁজ রাখছেন। কোথায় পৌছেছি। আমরা এ পথে নতুন। তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারিনি। ফোন কেটে রাস্তার সাইনবোর্ড বিলবোর্ড দেখে মেসেঞ্জারে জানিয়ে দিই। ঘুমিয়ে যাই, আবার জাগি। জেগে চোখ খোলা রাখি ভ্রমণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
সকাল ৫.৫০ বাস পৌছে বরিশাল নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে। বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোয় পৌছি সিঅ্যান্ডবি রোড ১ নম্বর পুলের আগে নির্ধারিত দিশা ভবনে। দিশা গেস্ট হাউজের রেজাউল আমাদের রুমে নিয়ে যায়। ওখানে আমাদের আগেই পৌছেছেন কবি ড. ফজলুল হক তুহিন ও কবি সাংবাদিক মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন। উপস্থিত ছিলেন সাজ্জাদুল হক ও জিয়াউর রহমান মনির। কুশল বিনিময়ের পর আমরা আমাদের নির্ধারিত রুমে প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বস্তুত বরিশাল শহরে নেমেই আমরা আথিতেয়তার জালে বন্দি হয়ে যাই।
ফ্রেশ হতেই আমাদের নিয়ে প্রেসক্লাবের দিকে রওয়ানা দিলেন কবি ফিরোজ মাহমুদ ভাই। আমরা বুঝতে পারলাম আয়োজকদের পূর্ব নির্ধারিত সিডিউল মোতাবেক অনুষ্ঠানে যোগদানসহ মেহমানদারীর ভাগও আলাদা। আমরা পড়েছি ফিরোজ মাহমুদ ভাইয়ের ভাগে, তারা দুজন সাজ্জাদ ভাইর ভাগে। শেষ পর্যন্ত আমার ধারণা কিছুটা হলেও ঠিক বলে মনে হল। কবি ফিরোজ মাহমুদের নেতৃত্বে আমরা প্রেসক্লাব এলাকায় প্রবেশ করি। পথে বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনা পরিচিত করতে করতে নিয়ে যান। অটো থেকে নেমে চেনা অচেনা লেখকদের দেখা পেলাম। ফেসবুকের সুবাধে অনেক মুখ পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছিল। নামের গুণে অনেককেই চেনা চেনা লাগছিল।
আমরা হোটেলে নাস্তার উদ্দেশ্যে ঢুকি। তখন আয়োজক আযাদ আলাউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। হয়নি বলতে এই প্রথম। তার সাথে প্রথম সাক্ষাতেই পেলাম তাকে অসুস্থ অবস্থায়। গতরাতের মানসিক চাপে হোটেলে নাস্তারত অবস্থায় তার প্রেসার বেড়ে গেছে। মাথা এলিয়ে পড়ে আছে একজনের বাহুতে। আমি তাড়াতাড়ি পানির ঝটকা দিতে বললাম। সামনেই দেখি রম্যগল্পকার শাহরিয়ার মাসুম। তার সাথেও এই প্রথম মুখোমুখি। সাথে সাথে গ্লাসে পানি নিয়ে প্রস্তুত, বললাম ছিটান, ইতস্তবোধ করছেন ? বুঝতে পেরে আমি হাতে নিয়ে ঘাড়ে মুখে ছিটিয়ে দিলাম, ততক্ষণে অবস্থা স্বাভাবিক।
আমি ট্যাবলেট খেতে পরামর্শ দিলে বললেন সকালে খেয়েছি। মিনিট পাঁচেক বসার পর ঠিক হলে আমরা নাস্তায় মনোযোগী হলাম। আমি পরাটার ইচ্ছা প্রকাশ করলে শাহরিয়ার মাসুম খিচুড়ি খেতে উৎসাহিত করায় আমরা খিচুড়িই নিলাম। হোটেল থেকে বের হয়ে রঙ চা আর মুখে বরিশালের এক খিলি পান পুরে প্রবেশ করলাম প্রেসক্লাব মিলনায়তনে। প্রথমেই ফুল দিয়ে বরণ করা হল মেহমানদের। তারপর যথাসময়ে পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হল অনুষ্ঠান। আগত মেহমানদের পরিচয় পর্বের পর চলল অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্ব। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল আনলিমিটেড নাস্তা ও কফির আয়োজন। যার যখন প্রয়োজন গ্রহণ করেছে ইচ্ছে মতো।
অতিথিদের বক্তব্য, কবিগণের কবিতা পাঠ, গান এমন বৈচিত্রময় আয়োজনে সময় গড়িয়ে দুপুর হয়। দিনটি ছিল শুক্রবার। নামাজের বিরতিতে আমরা বরিশাল বায়তুল মোকাররমে জুময়া আদায় করি। বায়তুল মোকাররম নামটি আমাকে আকর্ষণ করে। আকৃষ্ট হই মসজিদের অযুখানার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে। নামাজান্তে শুরু হয় দুপুরের খাবার।
দুপুরের খাবারের পর শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। এপর্বে আমি চমকে গেলাম। অবশ্য প্রথম অধিবেশনে যখন আমাকে অতিথির আসনে বসার সুযোগ করে দিয়েছিল তখনই আমি আনন্দবোধ করছিলাম। আমিতো গিয়েছি একজন নগণ্য দর্শক শ্রোতা হিসেবে। অতিথির আসনে ডেকে নিয়ে বসতে দেয়া এটি আয়োজকদের সৌজন্যতা এবং আমার জন্য আনন্দেরও বটে। দ্বিতীয় অধিবেশনে যখন আমাকে বিশেষ অতিথির মর্যাদায় স্মারক সম্মাননার ক্রেস্ট আনতে ডাকা হল তখন সত্যি সত্যি আপ্লুত হলাম। আমি এমনটি প্রত্যাশা করিনি। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের জন্য নিশ্চয়ই এটি একটি বিরাট সম্মান, আনন্দ ও ভালোবাসার পাওয়া। কবিতাই আমাকে এ সম্মান এনে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। সামান্য লেখালেখির কারণেই দেশের অন্য একটি জেলায় আমার এ ক্ষুদ্র নাম পৌছে গেছে।
ক্রেস্ট গ্রহণ করলাম। আমি কখনও মুক্তবুলিতে লিখিনি। অনুষ্ঠানে মুক্তবুলির সকল লেখককে সম্মাননা প্রদান করা হল। মুক্তবুলির লেখকদের মাঝে প্রদান করা হল সেরা লেখক সম্মাননা। প্রদান করা হল অন্যান্য গুণীজনদের সম্মাননা। বিকাল চারটা কি পাঁচটায় অনুষ্ঠান সমাপ্তির পর বিভিন্ন লেখকদের সাথে চলল ফটোসেশান। ফটোসেশন পর্ব শেষ করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বরিশালের কিছু জায়গায় ঘুরবো।
আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে সহযাত্রী হল অনুজ প্রতিম কামাল উদ্দিন তুহিন। খুব আন্তরিক ছেলে, লাজুক মেজাজ। ফিরোজ মাহমুদ ভাই ব্যস্ততায় আমাদের ভ্রমণ পর্বে সঙ্গী হতে পারেননি। তবে তুহিনকে আমাদের সঙ্গী করে দিয়েছেন। আমরা বরিশালের বিখ্যাত গুঠিয়া মসজিদের উদ্দেশ্যে অটো রিক্সায় চড়লাম। পথে দুর্গা সাগর ও অন্যান্য স্থান দেখতে দেখতে সামনে চললাম। বরিশাল নগরীর পথঘাট খুব পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি মনে হল। জ্যাম বা যানজটমুক্ত শহর। শুক্রবার ছিল বলে হয়তো আরও ফাঁকা ছিল নগরীর রাস্তাঘাট। জেলখানা মোড়, সার্কিট হাউজ, পলিটেকনিক কলেজ, হাতেম আলী কলেজ, টাউন হল সবই ইতিমধ্যে দেখা হয়েছে। আমরা পৌছলাম গুঠিয়া মসজিদে। অসাধারণ নির্মাণশৈলী। এটি একটি মসজিদ কমপ্লেক্স। এখানে আছে এতিমখানা, স্কুল, নার্সারী, পার্কসহ অনেক কিছু। বিশাল এরিয়া। বেশ নান্দনিক। আমাদের হাতে সময় কম। দ্রুত দেখে আমরা রওয়ানা দিলাম চাখারের উদ্দেশ্যে।
চাখার শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের পৈতৃক নিবাস। বরিশাল এসে এই মহাপুরুষের পৈতৃক ভিটা দেখে যাব না! তা কী করে হয়? আমরা অটো নিলাম। বরিশালের বেশিরভাগ অটোকে অটো বলা যায় না। এগুলো টমটম, ভটভটি বা এ জাতীয় বাহন। নামতে হল গুয়াচিত্রা নামক তিন রাস্তার মোড়ে। সেখান থেকে ভ্যানে চড়ে মহানায়কের বাড়ির সামনে। চলতি পথ ছায়া সুনিবিড়। গাছের ছাতার নিচ দিয়ে যেন যাচ্ছিলাম। ভ্যান থেকে নেমেই স্কুল অ্যান্ড কলেজ। নামটি স্মরণ করতে পারছি না।
বাম পাশে শেরেই বাংলা স্মৃতি যাদুঘর। ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা পৌছে গেলাম তাঁর মূল বাড়িতে। মূল বাড়ির সামনে আধুনিক প্রাসাদ আড়াল করে রেখেছে ঐতিহাসিক সে বাড়িটি। ঠিক যেন জাতীয় ইতিহাসে ধামাচাপার মতো। গিয়ে দেখলাম জীর্ণ শীর্ণ বাড়িটি। কাঠ ও টিনের দোতলা। খড়ের ছাউনির রান্নাঘর। রান্নাঘরের টিন আর খড় দিয়ে সাবেকি অবকাঠামো ধরে রাখার চেষ্টা। তবে এগুলো যে সাবেক নয়, বারবার সংস্কারের হাত পড়েছে তা স্পষ্টত বুঝা যায়। তবে বসত ঘরটিকে সংস্কারহীন বলেই মনে হল। শতবছর আগের টিন কাঠের দোতলা বাড়িটি শের-ই- বাংলা এ কে ফজলুল হকের পিতার প্রতিপত্তিরই সাক্ষ্য বহন করে। তৎকালে বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দোতলা বাড়ি করা সহজ কথা নয়। বাড়িটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সরকারি তদারকি প্রয়োজন। নতুবা ঝড় তুফানে যেকোন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং এই বাড়িটিকে কেন্দ্র করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। বাড়ির আশপাশে এখনও প্রচুর গাছপালায় ঘনআধার পরিবেশ বিরাজমান। রাস্তা সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থান। কবরস্থানে নাম ফলকে শের-ই-বাংলার দাদা চাচা চাচিসহ অনেকের নাম খুদিত।
আমরা ফিরে আসলাম। গুঠিয়া বাজারে এসে ছোট একটি মসজিদে মাগরিবের নামজ পড়লাম। তারপর তুহিন সন্দেশ খেতে প্রস্তাব দিলে আমরা তিনজনে তিন পিচ সন্দেশ নিলাম। সাথে ছোট আকারের একটি মিষ্টি। সন্দেশ কুড়ি টাকা, আর মিষ্টি দশ টাকা, সস্তাই মনে হল। ওদিকে কবি হেলেন রহমান আমাদের বারবার ফোন দিচ্ছেন তার বাসায় যেতে। আমরা চলে আসলাম আবার জেলখানা মোড়ে। ওখান থেকে কবি ফিরোজ মাহমুদকে নিয়ে আমরা চারজন বরিশাল শহরের গ্রামীণ আবহে শহুরে রাস্তার বুক চিরে কবি হেলেন রহমানের বাসায় পৌছলাম চারজন।
কবি ও কবিতার প্রতি তার উৎলে উঠা আবেগ। সারি সারি বৃক্ষ আর একেকটি বাড়ির বিশাল বিশাল বাউন্ডারিতে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত। আমাদের বিস্ময়ে পানি ঢেলে দিলেন ভোলার কবি ফিরোজ মাহমুদ। তিনি বললেন এসব দেখেই বিস্মিত আর ভোলা গেলেতো আপনারা টাসকিত হবেন। তিনি জানালেন, তার বাড়িটি সাত একর জায়গায়। ওরে বাপরে বলে আমি হেসে ফেললাম। হেলেনের মেহমানদারি থামিয়ে আমরা এক প্রকার জোর করেই বিদায় নিলাম। বরিশাল শহরে এসে রাতের খাবার গ্রহণ করে আমরা গেস্ট হাউজে ফিরে আসলাম। আমাদেরকে যথাস্থানে রেখে তারা বিদায় নিলেন। আমরা চারজন কিছুক্ষণ কথা বলে নিজ নিজ রুমে চলে গেলাম।
ও হ্যাঁ সে কথা বলা হয়নি। বাসযাত্রায় সারারাতের ঘুমহীন থাকায় সারাদিন ছিলাম ঘুম কাতুরে। দুজনেই তাড়াতাড়ি শুয়ে গেলাম। সকালে ড. ফজলুল হক তুহিন আর কবি মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন চলে গেলেন বাতেন ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে। আমরা নিচে নেমে কোথায় যাব ভাবছি। সিদ্ধান্ত ছিল প্রথমেই চারণ কবি মুকুন্দ দাসের বাড়িতে যাব। রিকসাওয়ালাকে জিঙ্গেস করলে চিনে না বলায় আমরা আর উৎসাহবোধ করিনি। বললাম অক্সফোর্ড গীর্জায় যাবে কিনা। ভাড়া চাইল চল্লিশ টাকা। আমাদের আলোচনায় যখন বুঝতে পারল এই শহরে আমরা নতুন তখন ভাড়া আরও দশটাকা বাড়িয়ে দিল। বললাম তুমি না চল্লিশ টাকা চাইলে। ও বলল ভুল হয়ে গেছে। ভাড়া পঞ্চাশ টাকাই।
কথা না বাড়িয়ে রিকসায় উঠে গির্জার সামনে গেলাম। গির্জার গেট বন্ধ। একটা গেট আটকানো কবি রহমান মাজিদ বললেন, কবি চলেন ভিতরে ঢুকি। তালা নাই শুধু আটকানো। আমি প্রবেশ করতে ইচ্ছুক নই। তবু প্রবেশ করে সামনে আগালাম। ভিতরে কিছু ছেলে পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। আমরা মূলত প্রবেশ করেছি গীর্জার সংলগ্ন স্কুলের গেটে। এটি একটি মিশনারী স্কুল। ছেলেদের সাথে কথা বলছি|
ইতোমধ্যে প্রহরীর চোখে পড়তেই সে হন্তদন্ত হয়ে আমাদের কাছে এলো। আমাদের পরিচয় দেওয়ার পরও অবস্থানের সুযোগ দিতে নারাজ। উপরন্ত আমরা কেন প্রবেশ করলাম এই কারণে মনঃক্ষুন্ন। আমরা বেরিয়ে গেলাম। তারপর সকালের নাস্তা সেরে কোথায় যাব ভাবছি। একটু হোটেলের চেয়ারে সময় ক্ষেপণ করছি। ওয়েটার ফ্যান বন্ধ করে দিলে আমরা ধরে নিলাম নাস্তা হয়ে গেছে এখন বসে বাতাস খাওয়ায়ে বিল বাড়াতে রাজি নয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। বিল দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
এখান থেকে কোথায় যাওয়া যায়। আমরা উপলব্ধি করলাম যে কোন শহরে গাইড ছাড়া ভ্রমণ এক ধরণের বোকামী। ফোন দিলাম বরিশালের কবি বশিরুজ্জামান বশিরকে। তার নির্দেশনায় গেলাম কবি জীবনানন্দ দাশ পাঠাগারে। গীর্জা ও কবির পাঠাগারটি বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে অবস্থিত। এরপর আবারও কবি ফিরোজ মাহমুদের স্মরণাপন্ন হলাম। নির্দেশনামতো আমরা চলে গেলাম ব্রজমোহন কলেজ সংক্ষেপে বিএম কলেজে। কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে দেখছি আর দুজনে ছবি তুলছি। পুকুরপাড়ে বসে কিছু ছবি তুললাম। ততক্ষণে কলেজে ছেলেমেয়েরা চলে আসছে। কিছু দর্শনার্থীও আছে। আমরা দুজন একসাথে ছবি তুলতে এক তরুণীর সহযোগীতা নিলাম।
আযাদ আলাউদ্দীন ফোন দিয়ে তার অফিসে যেতে বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর কারও সাথে দেখা করব না। কিছুক্ষণ এখানে অবস্থান করে পরবর্তীতে অন্য কোথাও যাব। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি। ততক্ষণে আমাদের সাথে যোগ দিলেন কবি ও ব্যাংকার সুয়েজ করিম। আযাদ আলাউদ্দীন সুয়েজ করিমকে ফোন দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতে বললেন। বিএম কলেজে কিছু সময় ব্যয় করে চলে গেলাম আযাদ আলাউদ্দীনের অফিস সাতরং এ। জমিয়ে আড্ডা দিলাম চারজনে।
রহমান মাজিদ বলছিল বাসে ফিরতে। আমার এক কথা আমি লঞ্চে যাব। বরিশাল আসার উদ্দেশ্যই নৌপথে ভ্রমণ। আমরা আড্ডার এক ফাঁকে আলাপ তুললাম টিকিটের। ফিরব গ্রীণ লাইন ওয়াটার বাসে। তখনও জানতাম না এর নাম ওয়াটার বাস। লঞ্চঘাটে পৌছে সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন যখন পরিচিতি দিচ্ছিলেন তখন জানতে পারলাম গ্রীণ লাইন মূলত ওয়াটারবাস। আমরা আড্ডার সমাপ্তি দিয়ে বেরিয়ে পরলাম টিকিটের উদ্দেশ্যে। আযাদ আলাউদ্দীনের সাতরং থেকে নগরীর অলিগলি দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি। আযাদ আলাউদ্দীন ও কবি সুয়েজ করিম পরিচয় করাচ্ছেন একেকটি স্থাপনার।
আমরা পথে দেখলাম সার্কিট হাউস, হাতেম আলী কলেজসহ বরিশাল নগরীর নামকরা প্রতিষ্ঠানসমুহ। সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন’র অর্থায়নে টিকিট সংগ্রহ করে আমরা পৌঁছলাম বিবির পুকুরপাড়ে। মনোরম পরিবেশ। শহরের বুকে এক টুকরো স্বচ্ছ পানির সরোবর। চারপাশে দর্শনার্থীদের উপভোগের নগরায়ন ব্যবস্থা। ছোট ছোট মুখরোচক সিঙ্গারা সমুচা খেতে হল। তারপর চা। চায়ের রেসিপিটাও সাধারণ চা থেকে ভিন্ন। পুদিনাপাতা, মালটা, লেবু, আদা, কালজিরা, তেজপাতাসহ রঙ চা। এখানকার মেহমানদারির পর কবি সুয়েজ করিম বিদায় নিলেন। আমরা আবার ফিরে আসলাম আযাদ আলাউদ্দীনের সাতরংয়ে। দীর্ঘসময় আড্ডা দিলাম। অনেক কথা হল।
তার সাজানো প্রতিষ্ঠানটি ঘুরেফিরে দেখে, আড্ডা দিয়ে জোহরের নামাজ শেষে দুপুরের খাবার খেলাম আযাদ আলাউদ্দীনের অফিসেই। নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা পৌছে গেলাম লঞ্চঘাটে। আরেক দফা সেলফি তুলে লঞ্চে প্রবেশ করলাম। লঞ্চ ছাড়তে তখনও দেরী। এই সময়টা আমরা লঞ্চের ভিতরেই কফি আড্ডায় অতিবাহিত করলাম। ছাড়ার মিনিট তিনেক আগে আমাদের বিদায় দিয়ে- বিদায় নিলেন আযাদ আলাউদ্দীন। তার আন্তরিকতা, আথিতেয়তা, কবি ফিরোজ মাহমুদের মেহমানদারি ও সঙ্গ দেয়া, তুহিন কামালের হৃদয়ের উষ্ণতার পরশ বুকে নিয়ে নদী পথে আমরা চললাম ঢাকার দিকে। সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত নদী পানি আর প্রকৃতির গভীর সৌন্দর্যে ডুবে ছিলাম গভীরভাবে। বরিশাল যাত্রা মনে থাকবে অনেকদিন। হয়তো ছুটে যাব আবার একদিন।
তাজ ইসলাম
কবি, ঢাকা।
ভালো লাগলো
চমৎকার