ইসরাত জাহান ।।
একটা সময় ছিলো যখন শৈশবে শিশুরা দাদি নানিদের কাছ থেকে রূপকথার গল্প শুনে ঘুমিয়ে যেত। সেই সময়ের শিশুদের বিনোদন ছিলো দাদা দাদি, চাচা চাচী, খালা ফুপু নিকট আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশি সকলেই। তখন মোবাইল ছিলো না। সেই সময় শিশুরা বড় হতো মুরব্বিদের শেখানো আদব কায়দা এসব দেখেই। এভাবেই আস্তে আস্তে বড় হতে হতে স্কুলে যাতায়াত শুরু করতো, তখন ছিলো না অনেক পড়ার চাপ, গাদা গাদা বই, বিশাল বড় ব্যাগ। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ছিলো না। শিশুরা স্কুলে গিয়ে নানা রকম খেলায় মেতে উঠতো। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে তাদের রুটিন মতন স্কুলের পড়া শেষ করে বড়দের সাথে গল্প নইলে একটু আধটু টিভি দেখে ঘুমিয়ে যেত। বাবা মা ভাইবোনের সাথে সময় কাটাতো।
তখন কিন্তু মোবাইল ছিলো না, ছিলো – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, জগদীশচন্দ্র বসু। তখন বাচ্চারা খুব আগ্রহ সহকারে এদের জীবনী পড়ে বড় হয়েছে। অনেক কিছু শিখেছে। একটা সময় বাচ্চারা বড়দের দেখে দেখে খাওয়া শিখে যেত। কিন্তু এখন শিশুদের খাওয়াতে মোবাইলের গেম বিভিন্ন ধরনের কার্টুন না দেখলে শিশুরা খেতে পারেনা।
বর্তমানে ক্লাস সেভেন এইটে পড়া ছেলেমেয়েকে দেখলে ভয়ংকর লাগে। এরা জানেই না শৈশব কি! এরা জানে ইউটিউবে কার কতো ফলোয়ার আছে, কোন নায়ক কোন গায়ক কিংবা কোন ইউটিউবার কোথায় থাকে এইসব। এরা সারাদিন নেট ঘেটে সিরিজ দেখে। এই বয়সেই এরা ডেট করে একে অন্যের সাথে দেখা করে। আবার কেউ যদি এসব ডেট না করে তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে।
ওরা জানেনা তিন গোয়েন্দা কি, চাচাকাহিনি কি, ওরা ক্যারাম খেলা, লুডু খেলা, ধনী হবার মজার খেলা এসব চেনে না! ওরা সালামি জমিয়ে পিকনিক করার কথা ভাবেনা, ওরা ঈদ কার্ড কেনেনা, ওরা ঈদে বন্ধু বান্ধবীদের কার্ডে দাওয়াত দেবার কথা জানেনা, ওরা সিনেটর গল্প জানেনা, ওরা রঙিন কাগজে হ্যাপি বার্থডে লিখে জন্মদিন পালন করা জানেনা! ওরা জানে দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে হাসাহাসি করে একের পর এক ছবি তুলতে, এসব করতে করতে কখন সময় ফুরিয়ে যায় ওরা নিজেরাও জানেনা।
ওরা জানে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টাগ্রামে হ্যাশট্যাগ দিয়ে মধ্যামা আঙ্গুল দেখিয়ে ছবি আপ্লোড করতে, যা আমরা জানতামই না! ওরা জানেই না আমাদের শৈশবটা কেমন ছিল! সবচেয়ে সুন্দর ছিল আমাদের শৈশব! প্রেম ছিল, ভালবাসা ছিল, কিন্তু সেটা ছিল মার্জিত এবং শুদ্ধতম সুন্দর ব্যাপার।আধুনিক শৈশবের এই টেকনোলজির মোহমায়াতে পা দিয়ে এরা এক বিশ্রী শৈশব কাটাচ্ছে!
সত্যি যখন ইমেইল ছিলো না, তখন ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম। যখন ইউটিউব ছিলো না, তখন ছিলো রেডিও। ছিলো বাংলা সিনেমার গান, নজরুল সঙ্গীত, লালনগীতি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, আরও কতো মাটির গান। যখন ডিজে বক্স ছিলো না , তখন ছিলো অডিও ক্যাসেট তাতে ছিলো হেমন্ত, মান্না, সতীনাথ আরও কতো শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর গান। যখন সেলফি ছিলো না, তখন মানবজমিনের ছবি আঁকতেন লালন ফকির।
যখন বহুতল ভবন ছিলো না, তখন বাংলায় ছিলো জসীমউদ্দীনের ধূ ধু প্রান্তর। তখন ছিলো নিমন্ত্রণ কবিতা। আমরা আসলে কিসে এগোলাম?এই যে সভ্যতার বিপুল আয়োজন, এই যে দুরকে কাছে টানার ব্যাপক প্রচেষ্টা। এই যে মোবাইল ফোনেই বিশ্বের বিপুল তরঙ্গ, এর সত্যিইকারের ফল কী? বিভূতিভূষণ লিখেছেন, যে নদীর জলে আমি প্রথম স্নান করলাম, যে গাছের নীচে বসে আমি হাওয়া খেলাম, সেটাই আমার কাছে নতুন।
কিন্তু এখন তো নতুন কিছু নেই। কোনও বিস্ময় নেই। ইঁদুরের গর্ত, জব ডুমুরের গাছে
টুনটুনি পাখির বাসা, বিলের ধারের হাঁসপাখি, সাদা সাদা বক। বাড়ির পুকুরের লাল শাপলা। সেই বড় বটগাছ যার নীচে মেলা বসতো, হিন্দূ পাড়ায় পুজোর মন্ডপের খৈ বাতাসা। সবই তো চলে গেছে। যে উৎসব গুলোর সাথে ধর্মের ভেদাভেদ ছিলো না। সবাই একসাথে উৎসব করতাম।
মুখের কথা ফুটল কি ফুটল না, আমি সব আবিষ্কার করে ফেললাম। আমার মধ্যে কোনও বিস্ময় নেই, আমি কান পেতে দূরের রেলগাড়ির আওয়াজ শুনিনি। সব আমি মোবাইলেই দেখে ফেলেছি। চিলের কান্না, কোকিলের বিরহ, নেড়ি কুকুরের ডাক আমি মোবাইলেই শুনে ফেলেছি। আমার কোন বিস্ময় নেই। আমি বলতে পারছি না, বিস্ময়ে …
তাই আমার মনে জাগে আকাশভরা সূর্যতারার নীচে আমরা সবাই একলা ,বড্ড বেশি একলা। বলতে পারেন আমরা তাহলে কে?
এই ভয়ংকর শৈশব নামের বিশ্রী পরিবেশে মানাতে গিয়ে আমিও আমাকে চিনতে পারিনা! আমার মৃত্যুর পর টেকনোলজি নিশ্চই আরও আধুনিক হবে! সেই আধুনিক টেকনোলজির সময়গুলি হয়তো কখনো আমার দেখার ভাগ্য হবেনা! হয়তো কখনো আমার জীবনে ধরা দেবেনা!
এটা কোনও শৈশব হতে পারেনা। এখন শিশুদের গায়ে শৈশবের গন্ধ নেই। শিশুরা মায়ের আচঁলের মিষ্টি ঘ্রাণ খুঁজে না। তারা চায় মোবাইল।
প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে অনেক কিছু। আবার কেড়ে নিয়েছে ঢের বেশি, মধুর সেই শৈশব, প্রকৃতির হাওয়া বাতাসে বেড়ে ওঠা কৈশর, সেই যৌবনের রঙিন দিন আরও কতো কি….
ইসরাত জাহান খুলনা
বেশ চমৎকার বলেছেন