প্রফেসর ড. মামুন উর রশিদ ।।
যাকাত (زكاة ) শব্দটি আরবি যাকাহ্ শব্দ থেকে উৎসারিত হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি পাওয়া বা পরিশুদ্ধ করা। যাকাত আল্লাহ রব্বুল আল-আমিন কর্তৃক নির্ধারিত একটি ফরয ইবাদত। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ্ ৮০ বারের অধিক যাকাতের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুরা রূম এর ৩৯ নং আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুুষ্টির জন্য তোমরা যাকাত দাও, যাকাত দানকারী প্রকৃতপক্ষে তার মাল বর্ধিত করে’। অপর একটি আয়াতে মহান আল্লাহ তায়লা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, সালাত কায়েম করেছে এবং যাকাত দান করেছে, তাদের জন্য তাদের পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কাছে আছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না’। (সুরা বাকারাহ : ২৭৭)
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং নামাযের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইবনু উমার থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন : ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি। এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রসুল, সালাত ক্বায়িম করা, যাকাত দেয়া, বাইতুল্লাহ হাজ্জ¦ করা এবং রমযানের সওম পালন করা। (সহিহ মুসলিম হা/১২২; সহিহুল বুখারি হা/৭) যাকাতের বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামের প্রথম খলিফা আবুবকর সিদ্দিক (রা.) যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতিদানকারী লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন, যদিও তারা সালাতসহ ইসলামের অন্য হুকুম আহকামগুলো মেনে চলত। তার মতে, মানুষের এমনটি করার অধিকার নেই, সে শরিয়াতের কিছু অংশ মেনে চলবে আর কিছু অংশ মানবে না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ রব্বুল আল-আমিন বলেন, ‘তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? তোমাদের মধ্যে যারাই এরূপ করবে দুনিয়ার জীবনে তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা ও অপমান আর কি¦য়ামাতের দিন তাদের নিক্ষেপ করা হবে কঠিন আযাবের মধ্যে। আলাøহ্ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন। এরাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করেছে। অতএব এদের শাস্তি লঘু হবে না এবং এরা সাহায্যও পাবে না।’ (সুরা আল-বাকারাহ: ৮৫, ৮৬)
যাকাত আদায় কাদের জন্য ফরয ?
সহিবে নিসাব সকল মুসলিম নরনারীর জন্য যাকাত ফরয। সহিবে নিসাব হলো এমন নারী বা পুরুষ যার কাছে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্য (৫২.৫ ভরি) অথবা ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ (৭.৫ ভরি) কিংবা সমমূল্যের অর্থ বা ব্যবসায়ের পণ্য এক বৎসরের জন্য মজুদ থাকে। ১৩ জুন ২০১৭ তরিখে প্রাপ্ত দর অনুযায়ী ৫৯৫ গ্রাম রৌপের দাম ২৬,৩৯০ টাকা এবং ৮৫ গ্রাম স্বর্ণের দাম ২,৭৭,৬০০ টাকা। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি সম্পদের মালিক হয়েছে, যে পর্যন্ত না উক্ত সম্পদ তার কাছে এক বৎসর থাকে সে পর্যন্ত তাকে যাকাত দিতে হবে না। (তিরমিযি) তবে এক বৎসর পূর্ণ হওয়ার আগেও যাকাত আদায় করা যায়। আলি (রা.) থেকে বর্ণিত- একবার আব্বাস (রা.) বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যাকাত আদায় করা সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (স.) কে জিজ্ঞেস করে ছিলেন এবং রসুলুল্লাহ তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ) মনে রাখা প্রয়োজন ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ, শেয়ার, বন্ড, প্রাপ্ত ভাড়া, সিকিউরিটিজ, গরু বাছুর, কৃষি উৎপাদন, ইত্যাদি যাকাত প্রদানের জন্য উপযুক্ত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে ব্যবহৃত জমাকাপড়, গৃহে ব্যবহৃত ফার্নিচার, তৈজসপত্র, গাড়ি, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ডায়মন্ড, মুক্তা, প্রভৃতির জন্য যাকাত প্রযোজ্য নয়। কোন ব্যক্তির যদি তার সম্পদের সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি দায় থাকে তবে তাকে যাকাত দিতে হবে না। উল্লেখ্য, বাড়ি বন্ধক ব্যক্তিগত দায় হিসেবে বিবেচিত হবে না। সোনা কিংবা রূপা যদি অন্য ধাতুর সাথে মিশ্রিত করে অলংকার তৈরি করা হয় এবং সেই অলংকারে যদি সোনা কিংবা রূপার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি হয় হয় সেক্ষেত্রে যাকাত দিতে হবে।
কারা যাকাতের অর্থ বা সম্পদ পাওয়ার জন্য উপযুক্ত?
যাকাতে অর্থ লাভের উপযুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়লা সুরা আত তওবার ৬০ নং আয়াতে বলেন ‘(এসব) সাদাকা (যাকাতের অর্থ) হচ্ছে ফকির-মিসকিনদের জন্য, এ (ব্যবস্থার আওতাধীন) কর্মচারীদের জন্য, যাদের অন্তকরণ (্দ্বীনের প্রতি) অনুরাগী করা প্রয়োজন তাদের জন্য, (কোন ব্যক্তিকে) গোলামীর (বন্ধন) থেকে আযাদ করার জন্য, ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির (ঋণমুক্তির) জন্য, আল্লাহর পথে (সংগ্রামী) ও মুসাফিরদের জন্য (এ সাদাকার অর্থ ব্যয় করতে হবে); এটা আল্লাহর নির্ধারিত ফরয; নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়লা (সবকিছু) জানেন এবং তিনিই হচ্ছেন বিজ্ঞকুশলী।’ ইসলামি আইন এবং শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বাতিল প্রতিরোধে যে কোনো ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রচেষ্টায় যাকাত প্রদান করা যাবে। তাছাড়া অ-মুসলিম দেশে মসজিদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় যাকাত প্রদান করা যেতে পারে। অ-মুসলিম দেশে বসবাসকারী নিপীড়িত নির্যাতিত দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য যাকাত দেয়া যাবে। নিজের স্ত্রী বা স্বামী, বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি তাদের বাবা মা, নিজের সন্তান, নাতি-নাতনি তাদের সন্তান ব্যাতিত অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের প্রয়োজন থকলে যাকাত প্রদান করা যাবে।
ব্যক্তি জীবনে যাকাতের প্রভাব
জন্মগতভাবেই মানুষ লোভী এবং তার মধ্যে রয়েছে বেশি বেশি সম্পদ লাভের দুর্নিবার আকাক্সক্ষা যা কখনও তৃপ্ত হয় না। মানুষের মনের এ অতৃপ্ত আকাক্সক্ষ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সে ধীরে ধীরে যন্ত্রে পরিণত হয় এবং তার মনুষত্ব হারিয়ে ফেলে। যাকাত মানুষকে এ অবস্থার বাইরে নিয়ে এসে দয়া এবং মহানুভবতা শিক্ষা দেয়। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে এসে সে সমাজের অন্যান্য মানুষের কল্যাণের জন্য চিন্তা করতে শিখে। দরিদ্র এবং অভাবী মানুষদের প্রতি তার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে দেয়। ফলে তার মনের মধ্যে যে ধনলিপ্সা, স্বার্থপরতা এবং কৃপণতা আছে তা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। আল্লাহ তায়লা বলেন ‘যাদের মানসিক কৃপণতা (সংকীর্ণতা) থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, তারাই হচ্ছে সফলকাম।’ (সুরা আল হাশর: ৯) আসলে কৃপণতা মানুষের ইমানকে নষ্ট করে দেয়। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হদিসে রসুল (স.) বলেন ‘কৃপণতা ও ইমান কোনো বান্দাহর অন্তরে কখনো একত্রিত হতে পারে না।’ (নাসায়ি)
যাকাত মানুষের মধ্যে সত্যবাদিতার গুণ সৃষ্টি করে। যাকাতকে ‘সাদাকা’ শব্দ দ্বারাও প্রকাশ করা হয় যা মূল শব্দ ‘সাদিক’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সত্যবাদিতা। যাকাত প্রদান করার জন্য বান্দাকে সঠিকভাবে সম্পদের হিসাব করতে হয় যা তার মধ্যে সত্যবাদিতার গুণ সৃষ্টি করতে সক্ষম। আল্লাহ তায়লার নির্দেশনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআনের দৃষ্টিতে ‘অবশ্যই মুনাফিকেরা আল্লাহ তায়লাকে ধোকা দেয়’। (সুরা আন নিসা: ১৪২) সত্যবাদিতার গুণ মানুষকে মহাসফলতার দিকে ধাবিত করে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত; মহানবি (স.) বলেছেন: তোমরা সদা সত্য কথা বলবে, নিশ্চয়ই সত্য কথা সৎকর্মের দিকে পরিচালিত করে এবং সৎকর্ম বেহেশতের দিকে পথ প্রদর্শন করে। আর নিশ্চয়ই মানুষ যখন সদা সত্য কথা বলতে থাকে ও সত্যের সন্ধানে লিপ্ত থাকে অবশেষে সে পরম সত্যবাদী বলে লিখিত হয়ে থাকে (সিদ্দিক হিসেবে তার নাম লিখা হয়ে থাকে)। (বুখারি, মুসলিম)
আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনেও যাকাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন- ‘যাকাত প্রদানকারির আত্মা যেমন কল্যাণ লাভ করে তেমনি তার সম্পদও কল্যাণ লাভ করে।’ যাকাত একদিকে দাতার অন্তরকে স্বার্থপরতা এবং উদাসীনতা থেকে মুক্ত করে অন্যদিকে এটি গ্রহীতার অন্তর থেকে ধনী লোকদের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা বিদুরিত করে। ফলে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি হয় যা একটি সুস্থ এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে অত্যন্ত অপরিহার্য। তাছাড়া যাকাত মানুষকে উদাসীনতা এবং আত্ম-অহংকার থেকে মুক্ত করে।
যাকাত মানুষকে আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তাকে দয়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত করে। আল্লাহ তায়লার আইন মেনে চলার চর্চার মাধ্যমে তার মধ্যে নাগরিক আইন মেনে চলার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে সুরা আন নিসার ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন ‘হ ইমানদার মানুষেরা, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, আনুগত্য করো (তাঁর) রসুলের এবং সেইসব লোকদেরও, যারা তোমাদের মাঝে (বিশেষভাবে) দায়িত্বপ্রাপ্ত।’
প্রকৃতপক্ষে যাকাত প্রদানের ফলে মানুষ আল্লাহ তায়লার পক্ষ থেকে নানাবিধ কল্যাণ লাভ করে। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন ‘যারা নিজেদের ধন সম্পদ আল্লহর পথে খরচ করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে একটি বীজের মত, যে বীজটি বপন করার পর তা থেকে (একে একে) সাতটি শীষ বেরুলো, আবার প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ শস্য দানা; আসলে আল্লাহ তায়লা যাকে চান তাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন; আল্লাহ তায়লা অনেক প্রশস্ত, অনেক বিজ্ঞ।’ (সুরা আল বাকারাহ: ২৬২) হাদিস অনুযায়ী যাকাত প্রদান করলে মানুষ যে কল্যাণগুলো লাভ করে তা হল- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে, সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে, সম্পদ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও কল্যাণ লাভ করে, আল্লাহর ক্রোধ এবং অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়, শেষ বিচারের দিনে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ করে এবং সত্তরটি অকল্যাণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
সামাজিক জীবনে যাকাতের প্রভাব
সামাজিক সমতা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধনী এবং দরিদ্রের মাঝে যে পার্থক্য রয়েছে যাকাত তা ঘুচিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে সম্পদ সমাজের গুটি কয়েক লোকের হাতে পুঞ্জিভুত হয় এবং সমাজের অভাবী এবং দরিদ্র মানুষ আরও অভাবী হতে থাকে। যাকাত ব্যবস্থার একটি অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই হল সমাজের এ ধরনের পার্থক্য দুরীভূত করা। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়লা বলেন ‘(সম্পদ তোমরা এমনভাবে বণ্টন করবে) যেন তা (কেবল) তোমাদের (সমাজের) বিত্তশালী লোকদের মাঝেই আবর্তিত না হয়।’ (সুরা আল হাশর: ৭) যাকাত আসলে সমাজের সকলের জন্যই একধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করে। আজ যিনি যাকাত দিচ্ছেন তিনি যদি ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় আপতিত হন তাহলে তিনি আবার যাকাত গ্রহণ করে তার জীবন যাত্রার পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন।
যাকাত মনুষের মাঝে সম্পদ সঞ্চয় বা জমিয়ে রাখার যে কুপ্রবৃত্তি রয়েছে তা দুর করতে সাহায্য করে। যাকাত মানুষের আয়ের উপরে নির্ধারিত না হয়ে বরং জমানো সম্পদের উপর আরোপ করা হয়। ফলে যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি সম্পদ জমিয়ে না রেখে তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন যাতে বাড়তি আয় দ্বারা তিনি যাকাত দিতে পারেন ফলে তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আর এভাবেই যাকাত শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ ‘বৃদ্ধি পাওয়া’ মূুর্ত হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন ‘যা (কিছু ধন সম্পদ) তোমরা সুদের উপর দাও, (তা তো এ জন্যই দাও) যেন তা অন্য মানুষের মালের সাথে (শামিল হয়ে) বৃদ্ধি পায়, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা কিন্তু মোটেই বাড়ে না, অপরদিকে যে যাকাত তোমরা দান করো তা (যেহেতু একান্তভাবে) আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে দান করো, তাই বরং বৃদ্ধি পায়, জেনে রেখো এরাই হচ্ছে (সেসব লোক) যারা (যাকাতের মাধ্যমে) আল্লাহর দরবারে নিজেদের সম্পদ বহুগুণে বাড়িয়ে নেয়।’ (সুরা আর রূম: ৩৯) যকাত ধনী ও দরিদ্রের মাঝে সম্পদের স্থানান্তরকে নিশ্চিত করে। নবি করিম (স.) যখন মুয়াজ (রা.) কে ইয়ামেনে পাঠিয়ে ছিলেন তখন তাঁকে বলেছিলেন তুমি আহলে কিতাবদের এক জাতির নিকট পৌছবে। তাদেরকে এই কথার সাক্ষ্য দিতে আহবান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহ তায়লার রসুল। তারা যদি তোমার এই কথা মেনে নেয় তারপর তাদের জানিয়ে দাও যে আল্লাহ তায়লা তাদের প্রতি রাত দিনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। তোমার এ কথা যদি স্বীকার করে নেয়, তবে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে আল্লাহ তায়লা তাদের প্রতি তাদের ধনসম্পত্তির উপর যাকাত ফরয করেছেন। তা তাদের ধনী লোকদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরিব-ফকির লোকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ) আর সম্পদের এ ধরনে পুনঃর্বণ্টনের ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র দুরীভূত হয়।
যাকাত সমাজকে রিবা বা সুদ মুক্ত করে। আল্লাহ সকল প্রকার সুদকে হারাম করেছেন। ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বৃদ্ধি করেন। আর তিনি কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। (সুরা আল বাকারা : ২৭৬) আসলে সুদ এমন একটি প্রথা যা ধনীকে আরও ধনী করে এবং দরিদ্রকে করে আরও দরিদ্র। আর এ বৈষম্য সৃষ্টির ফলে সমাজে নানা ধরনের অরাজকতা দেখা দেয়। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় নানা অস্থিরতা। ‘যারা সূদ খায় তারা (মাথা উঁচু করে) দাঁড়াতে পারবে না, (দাঁড়ালেও তার দাঁড়ানো হবে সে ব্যক্তির মতো যাকে শয়তান নিজস্ব পরশ দিয়ে (দুনিয়ার লোভ লালসায়) মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।’ (সুরা আল বাকারাহ: ২৭৫)
যাকাত আত্মসম্মান বৃদ্ধি করে। যাকাত ধনীদের অনুগ্রহ নয় বরং গরিব এবং অভাবী মানুষের অধিকার। যাকাত প্রদানকারীকে বরং গ্রহীতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত কেননা সে তাকে আল্লাহর নির্দেশ পালন করার সুযোগ করে দিয়েছে। ‘হে ইমানদার (বান্দা)-রা, তোমরা (উপকারের) খোঁটা দিয়ে এবং (অনুগৃহীত ব্যক্তিকে) কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান সদকা বরবাদ করে দিয়ো না, ঠিক সেই (হতভাগ্য) ব্যক্তির মতো, যে শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশ্যেই দান করে, সে আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করে না।’ (সুরা আল বাকারাহ: ২৬৪) আসলে যাকাত সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে আর্থিক ভারসাম্য সৃষ্টি করে যা সমাজে অপরাধ প্রবণতা এবং সন্ত্রাসের বিস্তারকে কমিয়ে আনে। সৃষ্টিকরে ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন যা সমাজকে উন্নতির শীর্ষ শিখরে নিয়ে যায়।
যাকাত প্রদান না করার শাস্তি
যাকাত প্রদান না করলে বা প্রদানে গড়িমাসি করলে কুরআন ও হাদিসে নানাবিধ শাস্তির নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সুরা আত্ তাওবার ৩৪ এবং ৩৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়লা এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন ‘হে ইমানদার লোকেরা, (আহালে কেতাবদের) বহু প-িত ও ফকির-দরবেশ এমন আছে, যারা অন্যায়ভাবে সাধারণ মানুষের সম্পদ ভোগ করে, এরা (আল্লাহর বান্দাদের) আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়েও রাখে; (এদের মাঝে) যারাই সোনা-রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তুমি তাদের কঠিন পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। (এমন একদিন আসবে) যেদিন (পুঞ্জীভূত) সোনা-রূপা জাহান্নামের আগুনে উতপ্ত করা হবে, অতঃপর তা দিয়ে (যারা এগুলো জমা করে রেখেছিলো ) তাদের কপালে, তাদের পার্শ্বে ও তাদের পিঠে চিহ্ন (এঁকে) দেয়া হবে (এবং তাদের উদ্দেশ্যে করে বলা হবে) এ হচ্ছে তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, অতএব যা কিছু সেদিন তোমরা জমা করে রেখেছিলে (আজ) তার স্বাদ গ্রহণ করো।’ আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন: যাকে আল্লাহ মাল দিয়েছেন, অথচ সে তার যাকাত আদায় করে না। কিয়ামতের দিন তার ওই মাল একটি ভয়াবহ বিষধর সাপের রূপ ধারণ করবে, যার মাথায় থাকবে কালো বর্ণের দুটি ফোঁটা। (কালো ফোঁটা হল ভয়ংকর বিষধর সাপের চিহ্ন) উক্ত সাপ তার গলদেশে হাসলির ন্যায় জড়িয়ে দেয়া হবে। তারপর সাপ উক্ত ব্যক্তির দুচোয়াল কামড়িয়ে ধরে বলতে থাকবে: আমি তোমার মাল আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ। অতপর রসুল (স.) কুরআনের নি¤œলিখিত আয়াত তিলওয়াত করলেন: ‘আল্লাহ যাদেরকে সম্পদ দান করেছেন, অথচ তারা কৃপণতা করে। তারা যেন এ কথা মনে করে না যে, তাদের এ কৃপণতা তাদের জন্য কোন কল্যাণ আনবে। বরং তাদের জন্য চরম ক্ষতির কারন হবে।’ (বুখারি)
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, সহিব-ই-নেসাব সকল নর-নারীর জন্য যাকাত আদায় করা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। যাকাত প্রদানের ফলে নানাবিধ ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ লাভ করা যায়। তাছাড়া যাকাত আত্মা ও সম্পদের পরিশুদ্ধি ঘটিয়ে ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধির বারতা আনতে সক্ষম। অতএব, মহান রব্বুল আল-আমিন আমাদের সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের তৌফিক দান করুন। আমিন।।
লেখক: প্রফেসর, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।