সৈয়দ ওয়ালিদুর রহমান।।
বইয়ের সজ্ঞায় ধর্ম সংস্কৃতিরই একটা উপাদান। আবার অনেকের মতে ধর্মের আবার নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। কে কাকে ধারণ করে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে। তবে ধর্ম ও সংস্কৃতির একটা পারস্পরিক সম্পর্ক অনস্বীকার্য। আর ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা ইসলাম তার বিধিবিধানের একটা ছাপ তার অনুসারীদের সামগ্রিক জীবনাচরণ ও অভ্যাসের মধ্যে দেখতে চায়। এখানে বিশ্বাস ও অভ্যাস একসূত্রে গাঁথা। শুধু কিছু স্প্রিচুয়ালের মধ্যে ধর্মকে আটকে রাখলে ইসলামের দাবি পূরন হয় না। আর এ সূত্রেই আমাদের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রোযার একটা ব্যাপক সাংস্কৃতিক প্রভাব আছে। আমাদের ব্যবহার, শিষ্টাচার, রসনা বিলাশ, পোষাক-পরিচ্ছদ, মার্কেট ইকোনমি, বিজ্ঞাপন, কর্পোরেট সংস্কৃতি, মিডিয়া, পলিটিক্স, ক্রাইম – সকল ক্ষেত্রেই রোজার ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান।
রোযার মাসে আমাদের পদ্ধতি ও বিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অফিস আদালত বা পরিবার পাড়ায় সব জায়গাতেই মানুষ একটু বেশি বিনয়ী হয়ে ওঠে। পূণ্যের আশায় হোক বা দূর্বল দেহের কারণে হোক সামাজিক আচরনে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এমনকি রোযার মাসে কুয়েতের মতো দেশে পাবলিক প্লেসে খাওয়াটা ছোটোখাটো অপরাধ হিসেবে জরিমানা করা হলেও আমাদের দেশে বেরোযদাররা বিনা নোটিশে প্রকাশ্য কিছু খেতে এখনও ইতস্তত বোধ করে। তাছাড়া অফিস আদালতে বা আড্ডায় মিথ্যা, চাটুকারিতা বা চোগলখুরিতা কমে আসে। কারন এসব “কাউল আযযুর” বা বাজে কথা ত্যাগ না করলে যে শুধু উপবাসে কোনো কাজ হবে না-হাদিসের এ বাণী মোটামুটি সবারই জানা। অবশ্য যারা আত্মশুদ্ধির সাথে একাত্ম না হয়ে শুধু সওয়াবের আশায় বা লোকলজ্জায় রোজা রাখে তাদের ক্ষুধার্ত পেট আবার মস্তিস্ককে উত্তপ্ত করে তোলে। এছাড়া ইফতার-মাগরিব-এশা-তারাবির টাইট সিডিউলে বাজে আড্ডারও তেমন ফুসরত থাকে না। তাই সবমিলিয়ে ‘দুই ঠোটের মাঝে ‘ যা আছে তা কন্ট্রোলের ভালো চর্চা হয় এই মাসে এবং সমাজও এর একটা ইতিবাচক ফল পায়।
রোযার এক মাসে ভালো সামাজিক পরিবর্তন হয়। ইফতার মাহফিলগুলোতে পারস্পরিক অনুভুতি ও সামাজিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং মতবিনিময় হয়। পূণ্যের পাশাপাশি এর উৎসব মুখরতারও একটা সামাজিক মূল্য আছে যদি না তা উৎকট হয়ে ওঠে। কেননা অনেক সময় ইফতারের এই উৎসব মুখরতাকে কেন্দ্র করে রোযার শিক্ষা বিরোধী অনেক কাজও হয়। যেমন ভার্সিটিগুলোর ক্যাম্পাসে বা বিভিন্ন সমিতি বা এলামনাইয়ের ইফতারিতে ছেলেমেয়ে একসাথ হয়ে ‘বার্থডে পার্টি স্টাইলে’ ইফতারি করে। রোযা বা নামায এখানে মুখ্য নয়; আড্ডা আর উৎসবই মুখ্য। অবস্থা এতো ভয়াবহ যে আজকাল ঢাকার অভিজাত এলাকায় সেহরি পার্টি হচ্ছে যা নাকি অনেকটা ডিজে পার্টির ছদ্মবেশী সংস্করণ। আবার রাজনৈতিক দলগুলোরও রোযার আসল উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে অনেক সময় ইফতার মাহফিলগুলোকে নিছক অপপ্রচার হিসেবে ব্যবহার করে। আসলে ‘ধর্মের নামে ব্যবসা’ বলে যদি কিছু থেকে থাকে এগুলো তাই।
প্রচলিত আছে বাঙালি রসনা বিলাসী। আর এ বিলাস যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে সংযমের মাসে। পুরোনো ঢাকার চকবাজার বা বেইলী রোডে ঘুরে আসলেই এর প্রমাণ মেলে। মোঘল আর নবাবি আমলের খাবারের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার এই মেলা যেন রমযান ছাড়া আর কোনো মাস খুঁজে পেল না। সারা দেশের মোটামুটি একই অবস্থা। যেখানে কম খেয়ে বেশি ইবাদাত করার কথা সেখানে তৈলাক্ত পিঁয়াজু-ছোলার ঢেকুরে তারাবিতে আর শরীর সায় দেয় না। যাহোক বাঙালির মসলাজাত গুরুপাকের সাথে রোযার উছিলায় কিছু বেশি পানীয় ও ফল খাবার অভ্যাস যোগ হয় এ মাসে। সব মিলিয়ে রমযানে কমার পরিবর্তে ভোগ্য পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়।
‘রমজানের অর্থনীতি’ নামের আলাদা চ্যাপ্টার খুলতে হচ্ছে অর্থনীতিবিদদের। এ মাসে মমিন মুসলমান মুত্তাকি মজুদদাররা মজুদদারি আর ভেজালীকরণ অন্যমাসের চেয়ে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। হিন্দুদের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু এসকল বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ীদের ভাগ্য ভালো যে তাহারা সৌদি আরব বা ইরানে জন্মে নাই। ওখানে থাকলে নিশ্চিত গলাকাটা।
কর্পোরেট কোম্পানিগুলো অধিক ভোগবাদীদার এই সুযোগে রমযানে তাদের বাহারি বিজ্ঞাপন নিয়ে এমনভাবে হাজির হয় যেন তাহাদের পণ্য না কিনলে ভোক্তারা দোজাহানের অশেষ নেকি থেকে বঞ্চিত হবে। কোকাকোলার মতো ইয়াহুদি মলিকানা ও ইজরাইলকে অর্থায়ন করা কোম্পানিও এমনভাবে বিজ্ঞাপন দেয় যেন এই অমিয়সুধা ইফতারির টেবিলে না থাকলে পুরা রোযাটাই যেন মাটি। এছাড়া দেশি বিদেশি বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের কোম্পানিগুলো রোযার মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে তাদের বিজ্ঞাপনের রমযান সংস্করণ বের করে।
অবশ্য রোযার মাসে প্রিন্ট ও টিভি চ্যানেলগুলো যেসব ইসলামি অনুষ্ঠান প্রচার করে তা প্রশংসার দাবিদার। পাড়ামহল্লার পুচকে ছেলেদর সেহরিতে চোঙা নিয়ে মধুর চেঁচামেচি অনেকটা কমে আসলেও টিভি চ্যানেলগুলো সেহরি অনুষ্ঠান নিয়ে আরও সরব হয়ে উঠছে। তাছাড়া মাসব্যাপী শিশুদের কুরআন তিলওয়াত কিংবা ইসলামি গান ও জ্ঞানের প্রতিযোগিতাগুলো ‘ক্ষুদে গানরাজ’ টাইপের প্রোগ্রামগুলোর সমান্তরালে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পুরো বছর জুড়ে এই অনুষ্ঠানগুলো থাকলে আরো ভালো হতো। তবে এসকল কুরআনের অনুষ্ঠানের ফাকে ফাকে অশ্লীল এ্যাডগুলো অস্বস্থি বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া কড়া মেকআপ করা বা চুলখোলা নারী শিল্পীর কন্ঠে হামদ নাতও কেমন যেন বেমানান লাগে। তার উপর রমজান শুরুর সাথে সাথেই আবার ঈদকেন্দ্রিক উৎকট অনুষ্ঠানগুলোর আগাম বার্তা কেমন জানি রমযানের পবিত্রতাকে মলিন করে দেয়। এটা অনেকটা ইফতারে গোগ্রাসে গেলার জন্যই যেন রোযা রাখার মতো মনে হয়।
মোটাদাগে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির মতোই রোযার সংস্কৃতিও মিশ্র প্রকৃতির। অর্থাৎ ভালো-মন্দের মিশেলে গঠিত। কেননা অনেক ভালো দিক থাকলেও এ মাসের অনেক চর্চাই রোযার বিধান বা স্পিরিট এর সাথে যায় না-বরং তা স্ববিরোধীতা আর দ্বিমুখীতার দোষে দুষ্ট। নগ্ন পুঁজিবাদী ও বিজাতীয় সংস্কৃতি তথা শয়তানের কূটচালে পড়ে সত্য ও মিথ্যার এই চতুর্মুখী মিশেলের কারনে আমরা মুসলমানরা রোযার ধর্মীয় বিধান ও শিক্ষাকে আমাদের অভ্যাসে, আচরণে তথা সামগ্রিক লাইফ স্টাইলে এখনো ধারণ করতে পারি নি। তাই সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার জন্যই আমাদের কুরআনের কাছে যেতে হবে; কারণ রমযানে নাযিল হওয়া এ মহাগ্রন্থই হলো আমাদের কাছে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড ।
লেখক : সৃজনশীল লেখক, গবেষক ও ব্যাংকার