মাহমুদ ইউসুফ
সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সমৃদ্ধশালী জনপদ। প্রাগৈতিহাসিককালে নুহ নবির প্রপৌত্র বং এ জাতির গোড়াপত্তন করেন। সেই থেকে আমাদের পথচলা। তাই বঙই বাঙালি জাতির আদি জনক। বাংলাদেশের অধিবাসীরা বঙের ওয়ারিশ-উত্তরসূরী। বঙের রক্ত বহন করে চলছে নিরবধি। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এই বর্ণালী অতীতের ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে তাওহিদবাদী অর্থাৎ মুসলিমরাই সোনার বাংলা গড়ে তোলে। শুধু অর্থবিত্তে উন্নত নয়; সংগীত, শিল্পকলা, সংস্কৃতি চর্চায়ও এ জাতি শীর্ষে। গানে ভরা, সুরে ভরা এদেশ আমার। মাঠে গান, ঘাটে গান, নদীতে গান। গান আর গান, সুর আর সুর। সেই সুরের সুুরলহরীতে সুকুমার বৃত্তির বিকাশে অঙ্গীকারাবদ্ধ জাতি। এই গান জীবনের, প্রেমের, বিরহের, নবিদের, রসুলদের, দীনের, ইসলামের, ইমানের, তাওহিদের। আবহমানকাল থেকেই বাঙালির বিনোদন সংগীতকলার সাথে রিশতাযুক্ত। ব্রিটিশ আমলে ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ প্রবঞ্চনা ও জুয়াচুরিতে বাঙালি মুসলমানরা হয় কোনঠাসা। তাহযিব-তমদ্দুন থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়। হয় তারা গৃহবন্দি। এই বন্দিদশা থেকে বিশ শতকে তাদের উদ্ধার করেন নজরুল-আব্বাস। নজরুল বাঁধার প্রাচীর উপড়ে ফেলেন আর আব্বাস অচলায়তন ভেঙে সুরের জগতে টেনে আনেন স্বগোত্রকে। নজরুল-আব্বাস যুগল প্রতিভায় বাঙালি সংস্কৃতি ঝলমলিয়ে ওঠে। বর্তমানের কথিত সেকুলার বা পৌত্তলিক সংস্কৃতি নয়; একত্ববাদের কালচারই বাঙালি কালচার। বাঙালি সংস্কৃতি কোনোকালেই মুশরিকি প্রভাবাধীন ছিলো না। বাঙালিরাই মুসলমান মুসলমানরাই বাঙালি। মূল বাঙালি, আসল বাঙালি, আদি বাঙালি, ঐতিহাসিক বাঙালি। (অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস ১ম খণ্ড, পৃ ২৮৯) আধুনিক যুগে নজরুল-আব্বাস ছিলেন সেই বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের প্রধান সেনাপতি। আব্বাসউদ্দীনের সুকণ্ঠী গলার মাদকতায় মাতোয়ারা হয়ে উঠল বাংলার আপামর জনতা। সে এক ঐন্দ্রজালিক কাণ্ড। সেই ঝড়ো হাওয়ায় পাল তুলে জাতি এগিয়ে চলল লক্ষ্যপানে। এই মহানায়কের মহাজীবনের কয়েকটি টুকরো খবর নিয়ে আজকের আয়োজন।
ফুলচোর
গান আর ফুল ছিলো তাঁর প্রিয়। কবি বলেছেন, জোটে যদি মোটে একটি পয়সা/খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/দুটি যদি জোটে তবে/একটিতে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী। এই কবিতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি তাঁর জীবনকাহিনি। বাড়ির কাছেই পিডব্লিউডি’র ডাকবাংলো। সেখানে গোলাপ, বেলি, গন্ধরাজ ও আরও নানান ফুলের সুন্দর এক বাগান। সেই বাগান থেকে রোজ অতি ভোরে ফুল চুরি করতেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। একদিন মালির কাছে ধরা পড়ে যায়। মালি বললেন, ‘না বলে ফুল নাও কেন? বরং ফুলের ডাল নিয়ে যাও। বাড়িতে পুঁতে দিও, ফুল হবে’। এমনি করে গড়ে ওঠে তাঁর বাড়িতে ফুলবাগান। তবুও রোজ সকালে ডাকবাংলো থেকে ফুল চুরি করে আনতেন। মালির কাছে আবার ধরা পড়লেন। মালি বললেন: দুষ্ট ছেলে, তোমাদের বাগানে তো এখন খুব ফুল ফোটে। আমার এখান থেকে ফুল নিয়ে যাও কেন? আব্বাস সরলভাবে বললো: মালি, আমার নিজের বাগানের ফুল ছিড়তে বড় মায়া লাগে’। মালি রাগ না করে জবাব দিল: ঠিক কথা খোকা, নিজের বাগানের ফুল ছিড়তে বড্ড মায়া লাগে। তবে আমার বাগান থেকে না বলে নিলে সেটা তো চুরি করা হয়। আর ওতে আমারও তো ফুল কমে যায়। আমি দুঃখ পাই।’ আব্বাসউদ্দীন লিখেছেন, ‘… ফুলের দিকে তাকালেই সৃষ্টির রহস্য জাল বুনতে থাকে মনের কোনে। বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি এই ফুল।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৫)
নামের আগে শ্রী
বিশ্ববিখ্যাত এই সংগীত তারকার ছেলেবেলার নাম ছিল ‘শ্রী শেখ আব্বাসউদ্দীন আহমদ’। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ২০) আবার তাঁর ছাত্রজীবনের তাকালে দেখি তাঁকে ধুতি পড়ে স্কুলে যেতে হত। আশ্চর্য ! ভাবতে অবাক লাগে! একটা ধর্মের অনুসঙ্গ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা তখন কত জোরালো ছিলো তা এখান থেকেই অনুমেয়।
কাব্য রত্নাকর: নামের শেষে লেজ
একসময় বিশেষ দাওয়াত উপলক্ষে কবি নজরুল ইসলাম আসেন কুচবিহারে। স্কুল-কলেজের দাওয়াতে অংশগ্রহণের জন্যেই তাঁর এখানে আসা। আব্বাস প্রথম জীবনে কবিতা লিখতেন। কবিতা লেখার জন্য উস্তাদ ও ইয়াররা তাঁকে ‘কাব্য রত্নাকর’ খেতাব দেয়। আব্বাস নামের শেষে এই উপাধি ব্যবহার করেছেন দেখে নজরুল তাঁকে বললেন, ‘কি ব্যাপার নামের শেষে লেজ লাগিয়েছো কেন? আব্বাস শরমে নত হয়ে গেলেন। লেজ ছাড়াও খ্যাতি অর্জন করা যায়। নামজাদা হবার জন্য লেজের কোনো দরকার নেই। তিনি আর কখনও নামের শেষে কাব্য রত্নাকর খেতাব যোগ করেননি। পরবর্তীকালে লেখাই ছেড়ে দিলেন। (এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১১)
বিয়ের মধুর স্মৃতি
১৯২৯ সনে রংপুরের চিকনমাটি গ্রামের ফজিলউদ্দিন সরকারের কন্যা লুৎফুন্নেছার সঙ্গে বিয়ে হয় আব্বাসউদ্দীনের। মেয়ে দেখার সময় লুৎফুন্নেছা গান গেয়ে শোনান আব্বাসউদ্দীনকে। আর আব্বাসউদ্দীনও অনেক গান শোনালেন ভাবী স্ত্রী আর উপস্থিত সবাইকে। আব্বাসউদ্দীন তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়েছিলেন ‘আলেয়া’। আলেয়া নামেই তিনি তাকে ডাকতেন। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ১৯)
আব্বাসউদ্দীন ও জসীম উদ্দীন
মাটি ও মানুষের কবি জসীম উদ্দীন। তিনি গত শতাব্দির নামজাদা কবিশিল্পী। তিনি খ্যাতিমান হয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীনের সহযোগিতায়। ইহা অনেকেরই অজানা। উভয়ের মোলাকাত করার সুযোগটা বড়ই মধুর। এমএ পরীক্ষার পর অবসর সময় কাটাচ্ছেন কবি। আব্বাসউদ্দীনের কাছে যেতে চাইলেন। কিন্তু পকেটে যে পয়সা নেই। আব্বাসের কাছে চিঠি লিখতে চাইলেন। কিন্তু চিঠি লেখার ঠিকানা যে জানা নেই। ভীষণ ভাবনায় পড়লেন, কীভাবে লিখবেন তাঁকে। হঠাৎ করে মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। খামের ওপর লিখলেন: কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, পার্কসার্কাসের যে বাড়িতে তিনি থাকেন, পো: কলকাতা, জেলা: কলকাতা। এই আজব চিঠি পেয়ে হয়ত রানারও মুচকি হাসছিলেন। আব্বাসউদ্দীন সবারই পরিচিত শিল্পী। ডাকপিওন যথাভাবেই চিঠি পৌঁছে দিলেন। আব্বাসউদ্দীন জসীম উদ্দীনকে কলকাতা সেটেলড করার বন্দোবস্ত করলেন। (এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, পৃ ২৪-২৫)
চলচ্চিত্র অভিনেতা
গণমনে তিনি সুরশিল্পী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। তিনি যে চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন তা অধিকাংশ মানুষই অনবহিত। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মোট চারটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এগুলো হলো বিষ্ণুমায়া (১৯৩২), মহানিশা (১৯৩৬), একটি কথা ও ঠিকাদার (১৯৪০)। ঠিকাদার সিনেমাতে আব্বাসউদ্দীন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এসব সিনেমাতে তিনি গানও পরিবেশন করেন।
স্বাধীনতার কাণ্ডারি
জীবনীকর, সুসাহিত্যিক এম রুহুল আমিন লিখেছেন, ‘আব্বাসউদ্দীন গ্রামবাংলার অসংখ্য সভায় গান-গজল গেয়ে দেশকে জাগিয়েছেন, দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার বারো বছর পর তাঁর মৃত্যু হয় ঢাকায়। মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্তও তিনি বলতেন, ‘গোলাম হয়ে জন্মেছিলাম। আযাদ হয়ে মরতে পারছি, এই আমার আনন্দ।’ (এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১৮) আব্বাসউদ্দীন সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আব্বাস উদ্দিন কেবল গায়ক ছিলেন না, এই প্রজন্মের গায়করা যদি ভাবেন আব্বাস উদ্দিন শুধু গান গেয়ে এদেশের মানুষের মন জয় করেছেন তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে। আব্বাস তাঁর সময়কালের আকাঙ্খা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল এবং আরো অনেকে।” তাঁর সন্তান ফেরদৌসী রহমান এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসীও গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন।
মঞ্চে আব্বাসউদ্দীন
১৯৫৪ সনে পুরান ঢাকায় বার লাইব্রেরিতে একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়। এই ঘরোয়া প্রোগ্রামে আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকসহ বহু বোদ্ধা শ্রোতা-দর্শকের হাজিরা ঈর্ষণীয়। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন যখন সঙ্গে এলেন তখন তিনি হলের সব লাইট নিভিয়ে দিতে এবং কোনরূপ শব্দ না করতে অনুরোধ জানান। তাঁর হুকুমমতোই সব ব্যবস্থা হলো। শিল্পী গান ধরলেন ‘নদীর কূল নাই কিনার নাইরে’। সুরের ইন্দ্রজালে মোহমুগ্ধ জনতা। গান শেষ হলে কোনো শব্দ নেই শুধু মনে হয়েছিল সুর তখনও অনুরণিত হচ্ছে। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম মোস্তাফা কামাল লিখেছেন, ‘তিনি যখন গান গাইতেন- কি বাসায়, কি বাইরে- মনে হত তাঁর শরীরটাকে মর্তে রেখে তিনি তাঁর কণ্ঠকে তুলে দিয়েছেন মহাকালের হাতে। গানের এই বিমূর্ত প্রকাশ ঘটে থাকে কিছুটা বিধিদত্ত প্রতিভা, কিছুটা সাধনা এবং অনেকটা আরাধনার ভেতর দিয়ে। তাঁর গানে বিশেষ করে ইসলামী গানে মরমী হৃদয়ের যে নিবেদিতচিত্ততা লক্ষ্য করি তা কোন আকস্মিক কণ্ঠগত কৌশল নয়। জন্মগত প্রতিভার সাথে ব্যাপক চর্চার মিশ্রণ ঘটিয়ে এসব গানে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির প্রয়াস নেই। এ-গানগুলো যাঁরা শুনেছেন তাঁদের হৃদয়ের গভীর অর্ন্তলোকে স্পন্দন এসেছে। তার কারণ, ভক্ত হৃদয়ের আকুতি ও উচ্ছ্বাস এইসব গানে ধরা পড়ে আছে।’ (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১৪৪ ও ৬৬-৬৭)
ফুলবাগানের মালি
সুন্দর, সৌন্দর্য, মনোহর, লাবণ্যময়তার প্রতি ইনসানের আকর্ষণ স্বাভাবিক সহজাত। আব্বাসউদ্দীনের এক্ষেত্রে এ সত্য আরও বেশি প্রযোজ্য। তাঁর জিন্দেগির সকল কাজেই সুরুচির পরিচয়বাহী। আগেই উক্ত হয়েছে: শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন ফুলপ্রেমিক, ফুলের অনুরাগী। পুরানা পল্টনস্থ তার বাসভবন ‘হীরামন মঞ্জিলে’ নিজ হাতে গড়া ফুলবাগান ছিলো তাঁর হৃদয়ের অবিচ্ছেদ অংশ। এই বাগানকে ঘিরে একটি স্মরণীয় ঘটনা: একদিন এক ইংরেজ ভদ্রলোক আসেন শিল্পীর সঙ্গে দেখা করতে। ভদ্রলোক গাড়িতে করে এসেছিলেন। আব্বাসউদ্দীন তখন বাগানের কাজে মশগুল। ভদ্রলোক বাড়িতে প্রবেশ করে বাগানের মালিকে বললেন, সাহেবকে খবর দাও। খানিকক্ষণ পর ধোপদূরস্ত হয়ে শিল্পকার হাজির। ইংরেজ নাগরিক অসহিষ্ণু হয়ে আবার গৃহকর্তার খোঁজ করলেন। আব্বাসউদ্দীন বিনীত গলায় জানালেন, আমার নামই আব্বাসউদ্দীন। শুনে ভদ্রলোক তাজ্জব। (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ৯৪)
গানে গানে বৃষ্টি
আব্বাসউদ্দীনের গায়ক জীবন নানা স্মৃতিতে ভরপুর। সুখ-দুঃখের স্মৃতি নিয়ে রচিত জীবনালেখ্য ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে। বইটি অসাধারণ সুখপাঠ্য ও শিক্ষণীয়। আব্বাসউদ্দীন লিখেছেন, ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে- গানখানা বহুবার গেয়েছি। যতদিনই গেয়েছি। গানের শেষে ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে’ উপখ্যান বা প্রবাদ বাক্য কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
চীনের প্রধানমন্ত্রী মি. চৌ এন্ লাই ঢাকায় এলেন। আমরা এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গুলিস্তান সিনেমা হলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাই। সন্ধ্যা সাতটায় নাচ-গান আরম্ভ হল। রাত নটায় অনুষ্ঠান শেষ হয়। এই অনুষ্ঠানে আমি ‘‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’’ গানখানি পরিবেশন করেছিলাম।
অনুষ্ঠান শেষে প্রতিটি শ্রোতা হলের বাইরে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বাইরে আরম্ভ হয়েছে ঝমঝমাঝম বৃষ্টি। অথচ প্রেক্ষাগৃহে যখন সবাই ঢুকেছিলাম তখন ছিলো তারকাখচিত নির্মল আকাশ।
মিঃ চৌ এন্ লাই ঢাকা পরিত্যাগের পূর্বমুহূর্তে বিমানঘাঁটিতে বলে গিয়েছিলেন, এদেশের অনেক কিছুই হয়ত ভুলে যাব কিন্তু স্মৃতির মনিকোঠায় একটি চিত্র বহুদিন দাগ কেটে থাকবে। সেটা হচ্ছে- তোমাদের দেশের শিল্পী গান দিয়ে আকাশের পানি আনতে পারে।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৩৯-১৪০) ইসলামি গান দিয়েই তিনি সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছেন। সুনীল কুমার মখোপাধ্যায় বলেন, ‘ইসলামী গান গেয়েই আব্বাসউদ্দীন বাঙালী মুসলমানের প্রাণের তারে ঘা দিতে পেরেছিলেন সবচেয়ে বেশি।’ (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১১৯)
মৃত্যুশয্যায়
১৯৫৯ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি রোজনামচায় লিখেন, ‘… সারাদিনরাত শুয়ে শুয়ে আর ভাল লাগে না। কি সুন্দর আস্তে আস্তে অজানা দেশে চলেছি। কারো ক্ষমতা নেই সে দেশ যাওয়া থেকে প্রতিনিবৃত্ত করা; … চলমান দুনিয়ায় কোনো শক্তি নেই সেই মহা আকর্ষণ থেকে কোনো উপায়ে ঠেকিয়ে রাখে।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৪০) এর দুমাস পর ১৯৫৯ সনের ৩০ শে ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৮ বছর ২ মাস ৪ দিন। অথচ তাঁর আব্বা জাফর আলী আহমদের আয়ুষ্কাল ছিলো ১০৫ বছর।
সারাদেশে কুখ্যাত, অখ্যাত, অপরিচিত, অজানা, অচেনা লোকের নামেও হয়েছে নানাবিধ স্থাপনা। অথচ ইতিহাসের মহান শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের নামে নেই কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম। সড়ক, এভিনিউ, সংগীত একাডেমি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ তাঁর নামে হতে পারত। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে চরম উদাসীন। এই অবিমৃশ্যকারিতার অবসান হোক।
হদিস:
১। সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, বাংলা একাডেমি ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮
২। আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, হাসি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ৩৪ নর্থব্রুক হল রোড, ঢাকা-১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২
৩। শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, রেড ক্রিসেন্ট হাউস, মতিঝিল ঢাকা ১০০০, প্রথম সুলভ সংস্করণ সেপ্টেম্বর ২০১৪
৪। এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ২০০০
৫। অতীত দিনের স্মৃতি; আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, মোহাম্মদ মাহ্ফুজ উল্লাহ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯৪
৬। আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, সেগুনবাগিচা ঢাকা ২, প্রকাশ: জুন ১৯৭৯
৭। অধ্যাপক ড. এস.এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস ১ম খণ্ড, ধারণী সাহিত্য সংসদ, ঢাকা, প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৪