নীলা আহমেদ ।।
এক
হেমন্তের শেষে শীতের হিমেল হাওয়ায় কুয়াশার চাদর ঢাকা এক সকালে, মুয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠের আযান শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজা খুলতেই অজানা এক ভালো লাগায় মনটা ছুঁয়ে গেলো। ভোরবেলা না জাগলে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য আবিষ্কার করা যায় না। ব্রাশ করতে করতে চোখে পড়ল পশ্চিম ঘরের সামনে লাইটের ফকফকা আলো। একটা আমড়া গাছের ছায়াও পরেছে। হঠাৎ কি যেন এক রোমাঞ্চকর শিহরণ মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠলো। এক মূহুর্তের জন্য হারিয়ে গেলাম আঠারো বছর আগের সোনালী কৈশোরে। ঠিক এমনই কোন ক্ষণে সহপাঠী/বান্ধবীদের সাথে এরকম ফকফকা আলো আর গাছের ছায়ায় লুকিয়ে স্নান করার কষ্ট আর আনন্দ যেনো মিলেমিশে একাকার ছিল। এসএসসি পরীক্ষার সময় পরীক্ষা কেন্দ্র ও উপজেলা ছিলো স্কুল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে।
মফস্বলে থাকি বলে রাস্তাঘাট ও যানবাহনের সুব্যবস্থাও তখন ছিলনা। পায়ে হেঁটে বাড়ী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরের স্কুলে যেতাম। মা বলতেন- ‘আশেপাশে কোনদিকে তাকাতে পারবে না, শুধু নীচের দিকে তাকিয়ে স্কুলে যাবে আর নীচের দিকে তাকিয়ে আসবে।’ মায়ের কথা মতই চলেছি। পাশের বাড়ীর ফারুক ভাই টিটকারী করে একদিন বললেন- ‘পয়সা খুঁজতাছো নাকি, না হলে নীচের দিকে চাইয়া হাঁটতাছো ক্যান? এরকম কইরা হাঁটলে তো রাস্তার বাইরে পইরা যাইবা।’ ভরা বর্ষায় এক হাটু জল আর কাঁদা মাড়িয়ে স্কুলে যেতাম। মাঝে মাঝে জোঁক আর সাপ স্বাগতম জানাতো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতাম আর পা ফেলতাম। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম বলে শিক্ষকরা ভালোবাসতেন। বিজ্ঞানের মিলন স্যার মাঝে মাঝে আমাকে দিয়ে দূর্বল শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নিতেন। দুস্টুমি করে আমাকে ‘আপা’ ডাকতেন। কাউকে পড়া না পাড়ায় শাস্তি দিলে আমার সম্মতি চাইতেন। অনেক মারতেন আমার সহপাঠীদের। তাদের জন্য আমার খুব মায়া হতো। কিন্তু স্যারের ভয়ে কিছুই বলতে পারতাম না।
দুই
অনেক দুস্টু ছিলাম, একবার পেয়ারা পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙ্গে ছিল। ক্লাশের ফাঁকে কতজনকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছি ঠিক নেই। সবাই এতো ভালোবাসতো যে অভিযোগ করার কথাই ভূলে যেতো। তখনও গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছেনি। হারিকেন আর কুপির আলোতে পড়তে হতো। মেঝ ভাইয়ের সাথে পড়ার টেবিলে হারিকেন নিয়ে ঝগড়া হতো। এত বছর পরেও স্থানীয় বাজারে টিফিন বিরতিতে গিয়ে দুই টাকা দামের গুলগুলা খাওয়ার স্বাদ যেন মূখে লেগে আছে। কত তৃপ্তি নিয়ে খেতাম! হাসানের দোকানে এখন কফি, আইসক্রিম আর দামি দামি খাবারের মেলা। এখন কি আর দুই টাকার গুলগুলা চলে?
এসএসসি পরীক্ষার সময় চলে এলো। উপজেলা সদরে ঘনিষ্ট কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না, ৩০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ২ জন শিক্ষক ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা দুটি ঘর ভাড়া করলেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সবাই স্যারকে পাহারা দিতাম আর দুস্টুমি করতাম। বুয়া মাঝে মাঝেই থাকতো না। এত আনাড়ি হাতে রান্না করে খেতে হয়েছে আমাদের। কাজ নিয়ে সবার মধ্যে কত ঝগড়া হত আবার মিশে যেতাম সবাই। রুমের সামনের পুকুরটিকে ডাস্টবিন বানিয়ে রেখেছে আশেপাশের লোকজন। তাই আমি, মিতু, নাসিমা সহ আরো পাঁচ ছয়জন মিলে গোসলে যেতাম একটু সামনেই উপজেলার সরকারী পুকুরে। চারপাশে শান বাঁধানো ঘাট আর পাকা রাস্তার পাশে বড় বড় গাছের সারি। শেষ রাতে চাঁদের আলো আর ভোরের আবছা অন্ধকারে যেন হেসে উঠতো চারপাশ। একজন পানিতে নামতো ও বাকিরা তাকে পাহারা দিতো পাড়ে দাড়িয়ে কেউ আসছে কিনা। এভাবেই কেটে গেছে পরীক্ষাকালীন দিনগুলো।
তিন
উপজেলার গেটের ভিতরেই ছিল শিল্পকলা একাডেমি। নাচ-গানের প্রতি ছোটবেলা থেকেই ভীষণ দূর্বলতা ছিল। একদিন বিকেলে শ্যামল স্যার হাটতে বের হলেন। একাডেমির গান আর বাদ্য শুনে থাকতে পারলাম না দৌড়ে ছুটলাম আমি, মাসুমা, মিতু আর নিশি। দরজায় দাড়ানো দেখে ওরা আমাদের ইশারা করে ভেতরে যেতে বললেন। পলাশ ভাই একটি আধুনিক গান শুনালেন যুথি ও শিমুল আপুকে। আরও ২টা দেশের গানের পর শুরু হলো নৃত্য। রবীন্দ্র সংঙ্গীত কি বুঝতাম না। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান আর শিল্পীদের নৃত্যের মূর্ছনায় হারিয়ে গেলাম যেন। মিউজিক থেমে যেতেই পেছন ফিরে দেখি স্যার আসছেন। আমি দৌড়ে পালাতে লাগলাম। রুমের পেছন দিয়ে ঢুকতে গিয়ে সবাই পার হয়ে গেছে শুধু কাঁটাতারের বেড়ার সাথে নানুর দেয়া সেই শখের জামাটি আটকে ছিঁড়ে গেলো। স্যারের ভয়ে মনের কষ্টটি কাউকে প্রকাশ করতে পারিনি।
পাশেই ছিল হাসপাতাল। স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে পেছনের গেইট দিয়ে ঢুকে কত সূর্যমুখী ফুল চুরি করেছি। সেই চেনা হাসপাতাল, মডেল স্কুল, শান বাঁধানো ঘাট আগের মতই আছে। গ্রামের টিনশেড স্কুলটি দ্বিতল ভবন হয়েছে। জলকাঁদা মিশ্রিত কাঁচা রাস্তাটি পাকা হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুতের ঝলসানো আলোয় ভরে গেছে। মেজ ভাই এখন ফুটফুটে দুই শিশুর বাবা হয়েছে। কতদিন বিজ্ঞানের স্যারকে দেখিনা, কোথায় আছেন কেমন আছেন তাও জানিনা। সহপাঠী দুই-চার জনের সাথে দেখা হয় বাকিদের খবর জানিনা, খুব মিস করি সবাইকে। চেনা পথের অচেনা অলিগলি প্রকাশ করতে পারিনা কাউকে। মাঝে মাঝে ভাবনার অতীতে হারিয়ে যাই। অবাধ দুষ্টুমি ছোটবেলার নিষ্পাপ রোদেলা দিনগুলো হারিয়ে গেছে কর্মজীবন আর সংসার জীবনের লকডাউনে পড়ে। সাক্ষী হয়ে আছে শৈশবের ছোট্ট স্মৃতির জানালা। ফজরের নামায পড়ে সকলের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলাম। ##
নীলা আহমেদ লালমোহন, ভোলা।