আবু রূশ্দ ।।
শ্যন কনেরি। ০০৭, পৃথিবীখ্যাত জেমস বন্ড ছবির হার্টথ্রব নায়ক। ড. নো ছিল বন্ড সিরিজের প্রথম ছবি। কনেরিকে চেনে না এমন শিক্ষিত মানুষ দুনিয়ায় বিরল। তিনি ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন ২০২০ সালের ৩১ অক্টোবর বাহামার একটি দ্বীপে। ওই দ্বীপে তিনি বন্ড সিরিজের ছবির শুটিং করেছিলেন বিগত শতকের ষাট দশকে। জেমস বন্ড সিরিজের লেখক আয়ান ফ্লেমিংও কম বিখ্যাত নন। তিনি কিন্তু বহুমুখী পেশাদার ছিলেন। আমাদের সাংবাদিকদের অনেকে হয়তো জানেন না, আয়ান ফ্লেমিং একসময় বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের সংবাদদাতা ছিলেন। আয়ানকে তার মা স্কুল পাস করার পর রয়্যাল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট-এ পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাকে সেনা অফিসার বানানো। কিন্তু আয়ান সেখানে স্বয়ং কমান্ডান্টের স্ত্রীর সাথে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়েন। সঙ্গতকারণেই তাকে একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি নাছোড়বান্দা আয়ান লেখাপড়া শেষ করে যোগ দেন রয়টার্সে। তাকে একসময় পাঠিয়ে দেয়া হয় সদ্য গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে রয়টার্সের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানে গিয়ে তিনি সোভিয়েত সরকারের এক ভয়াবহ অপকর্মের নথিপত্র জোগাড় করেন বহু কষ্টে। একটি সমাজতান্ত্রিক দেশে গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব জোগাড় করা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু আয়ান তা করেছিলেন। রিপোর্ট লিখে তিনি যখন হেড অফিসে পাঠান তখন সবার চক্ষু চড়কগাছ। তার সম্পাদক আয়ানের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রথমে তা ছাপাবেন কি না ভেবেছিলেন। কিন্তু আয়ান দৃঢ়তার সাথে ওই রিপোর্ট প্রকাশ করতে বলেন যাতে দুনিয়ার সব দেশের সংবাদমাধ্যমে তা ছাপা হয়। রিপোর্টটি ছাপা হওয়ার সাথে সাথে চতুর্দিকে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। আয়ান ফ্লেমিং একদিনেই বিশ্বখ্যাত হয়ে পড়েন। কিন্তু ওদিকে সোভিয়েত গোয়েন্দারা তাকে হত্যার জন্য মাঠে নামে। ইতোমধ্যে আয়ান অসম সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন ও অলৌকিকভাবে একপর্যায়ে গোয়েন্দাদের ছোড়া গুলি থেকে বেঁচে যান। ব্রিটেনে ফেরত আসার পর একদিন তাকে বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা এমআই-সিক্স থেকে দেখা করার অনুরোধ করা হয়। স্বয়ং এমআই-সিক্স প্রধান তার সাথে কথা বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তার পাঠানো প্রতিবেদন ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করেন। আয়ানকে অনুরোধ করা হয় গুপ্তচর সংস্থায় যোগ দিতে। আয়ান তো তাই চাইছিলেন জীবনে, অ্যাডভেঞ্চার। তিনি যোগ দেন ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থায়। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে কমিশন প্রদান করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জার্মানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি সাড়া জাগানো গোয়েন্দা অপারেশন পরিচালনা করেন যা আজও মিথ হয়ে রয়েছে। তবে কমান্ডার বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হওয়ার পর তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন ও বাহামায় চলে যান। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে বসে লিখতে শুরু করেন জেমস বন্ড সিরিজ যা আজও পৃথিবীর মানুষের কাছে সমান আদৃত। গোয়েন্দা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছিলেন বলেই তিনি এমন চমৎকার গোয়েন্দা সিরিজ লিখতে পেরেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।
আয়ান ফ্লেমিংয়ের কথা বললাম এই কারণে যে, তিনি বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিলেন যে রিপোর্টের মাধ্যমে সেই রিপোর্টের মাল মসলা, নথিপত্র তিনি চুরি করেছিলেন। এখন কোন সাংবাদিক তা দক্ষতার সাথে করবেন আর কে করতে পারবেন না বা করতে গিয়ে ধরা খাবেন সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে নথি চুরি করে বা গায়েব করে দিয়েই কিন্তু দুনিয়ার বিখ্যাত সব কাজ হয়েছে সাংবাদিকতায়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও দেশী-বিদেশী বহু সাংবাদিকের এই ‘চুরি’ কার্যক্রম বাঙালির সংগ্রামের যৌক্তিকতাকে পৃথিবীবাসীর সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
গত ১৭ মে বাংলাদেশে একটি ঘটনা ঘটে সচিবালয়ে যাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ‘চুরি’ বলে আখ্যায়িতই শুধু করেননি, একজন নারী সাংবাদিককে রীতিমতো আটকে রেখে, গায়ে হাত তুলে, মামলা দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন। এখানে আবার টেনে আনা হয়েছে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের প্রসঙ্গ! সাংবাদিকতায় পৃথিবীর কোথায় অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট প্রযোজ্য তা আমরাও হয়তো জানি না! খোদ ব্রিটেনে কখনো কোনো সাংবাদিককে কোনো সরকারি নথি প্রকাশ, দুর্নীতি প্রকাশ, এমনকি সামরিক তথ্যাদি প্রকাশের জন্য অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের আওতায় আনা হয়নি। ধরা পড়লেও সাংবাদিকতায় ইমিউনিটি আছে যা বিশ্ব স্বীকৃত। দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামও সেই ইমিউনিটির বাইরে নন। ঘটনাটি যখন ঘটছে তখন সাংবাদিকরা জানতে পারেন, রোজিনাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে রাখা হয় একটি ঘরে। অভিযোগ ওঠে, তাকে সেখানে নির্যাতনও করা হয়েছে। পরে সোস্যাল মিডিয়ায় যেসব ছবি প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায় বিধ্বস্ত রোজিনাকে একজন মহিলা শারীরিকভাবে হেনস্থা করছেন। একজন অতিরিক্ত সচিবের নামও ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়ায়। তিনিও নারী! রাজনীতিতে যেমন কথায় কথায় পাকিস্তান প্রসঙ্গ, জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গ শুনতে শুনতে মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, তেমনি মিডিয়াতে প্রতিবাদী কণ্ঠকেও রাষ্ট্রবিরোধী, গোপন তথ্য চুরি ইত্যাকার ‘বাণী বচন’ দিয়ে হেয় করা হয়েছে! যেন এসব ডালভাত! কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা! এখন এসেছে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট! এসব যেন খুবই হালকা বিষয়! পান্তাভাত!
সাংবাদিক তথ্য সংগ্রহ করবেন, তা সে নথিপত্র সংগ্রহই হোক বা অন্য কিছু। সেটিও আর দশটা চুরির মতো চুরি হয়ে গেল! সাংবাদিক তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তা যার বা যে বিষয়ে তৈরি হবে সেখানে গিয়ে সুবোধ মানুষের মতো বলবেন, হে মহামান্য, আপনার ওই তথ্যগুলো সুন্দর করে ফাইল করে দিয়ে দিন তো! আমি আপনার সম্পর্কে রিপোর্ট করব! বা কোন লকারে ওই নথিপত্রটি আছে খুঁজে দেখুন তো, বের করে ফটোকপি করে দিন! সাংবাদিকরা কখনোই কোনো দুর্নীতি বা অপকর্মের তথ্য, নথিপত্র এভাবে সংগ্রহ করতে পারেন না। তাকে তা জোগাড় করতে হয় যেভাবেই হোক। সোজা কথায় এটা গোয়েন্দাবৃত্তি। ঝুঁকিপূর্ণ। তবে হ্যাঁ, তথ্য সংগ্রহের পর অভিযুক্ত বা যার সম্পর্কে রিপোর্ট করা হবে তার মতামত চাইতে পারেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক। সব সাংবাদিকই তা করেও থাকেন।
আমাদের দেশে সবার উপরে আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ ব্যাকবেঞ্চে চলে গেছে। এ জন্যই ‘গোপন তথ্য চুরি’, ‘গোয়েন্দা সূত্রে প্রকাশ’, ‘দেশদ্রোহিতা’র মতো শব্দগুলো এখন জলবৎ তরলং হয়ে গেছে। কোনো কিছু স্বার্থবিরোধী হলেই, কোনো কিছু পছন্দ না হলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা! এসব বুদ্ধি যে করিৎকর্মা কিছু আমলার মাথা থেকে আসে তা বলাই বাহুল্য। আবার রাজনৈতিক কারণে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে রাজনীতিবিদ ও অন্য পেশার মানুষকে (আমলাও অন্তর্ভুক্ত) নিয়ে প্রায়শ চটকদার সংবাদ ছাপানো হয় না, তাও নয়। অন্য পক্ষের সাংবাদিক বিপদে পড়লে আরেকপক্ষ চুপ থাকে, পর্দার আড়ালে হেসে হেসে মজা দেখে। এমনকি কোনো কোনো সংস্থায় নিজেরই সহকর্মী ভাইবোনদের নিয়ে গল্প করে। এগুলো নতুন নয়। ক্ষমতার কেন্দ্রের কত কাছে থাকা যায়, কত সুবিধা নেয়া যায় সেটিই লক্ষ্য! সেখানে জাহান্নামে যাক পেশার মর্যাদা। এ জন্যই একসময় কয়েকটি বড় দৈনিক ও মিডিয়া হাউজ বন্ধ করে দেয়া হলেও ওই সব সাংবাদিক ‘মহোদয়’ কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। বরং তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন এই ভেবে যে, ওটা তো বিরোধী মতের পত্রিকা, টেলিভিশন! আপদ গেল! ওদের জন্য সরকারের গল্পগুলো জমছে না ভালোমতো। এরপর, তারাও ওই আমলাতন্ত্র, সংস্থার বৃত্তে ঘুরেছেন ব্যক্তিস্বার্থে, দলীয় স্বার্থে। এখন নিজেরা সবাই পড়তে শুরু করেছেন বিপদে। এখন প্রায়ই শোনা যায়, ওই জেলার ডিসি সাংবাদিক নির্যাতন করেছে, জেলে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ওই সাংবাদিক নাস্তানাবুদ হয়েছেন, পেশাদার সংগঠনের নির্বাচনে অদৃশ্য হাতের স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে! আরো কত কী! এদের কেউ একবারও ভাবল না যে যেই পেশায় কাজ করছেন সেই পেশাটার মর্যাদা হারিয়ে গেলে আপনার দলও আপনাকে রক্ষা করতে আসবে না। কারণ দলের কাছে আপনি উদ্দেশ্য সিদ্ধির হাতিয়ার মাত্র। গত কয়েক মাসে কয়েকটি সাড়া জাগানো ঘটনায় এসবই প্রতীয়মান হয়েছে। পুরো সাংবাদিক সমাজকে টালমাটাল অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এখন দেখা যাক, সাংবাদিকতায় তথ্য বা ডকুমেন্ট ‘চুরি’ কি বৈধ না অবৈধ? সাংবাদিকরা কি দুনিয়ায় সবকিছু প্রকাশ্যে করে, না পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সব হাতিয়ে নেয়? এজন্য কি কোথায়ও সাংবাদিককে দায়ী করা হয় নাকি ইমিউনিটি দেয়া হয়?
কেস স্টাডি-১ : ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাক সরকার ১৯৭২ সালে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন গঠন করেন। বিচারপতি হামুদুর রহমানকে করা হয় কমিটির প্রধান। তিনি ছিলেন বাঙালি। পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন। ওই কমিশনকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনকালীন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণ করা পর্যন্ত ঘটনাবলির তথ্য সংগ্রহের ও সুপারিশ প্রদানের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ যুদ্ধে জড়িত সিনিয়র অফিসারদের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ও কমান্ডার ইন চিফ ইয়াহিয়া খান তখন ছিলেন গৃহবন্দী। তাকে নিরাপত্তার কারণে কমিশনের সামনে নিয়ে আসা হতো হেলিকপ্টারে করে। এ ছাড়া সে সময়কার সব নথিপত্রও সংযোজিত হয় কমিশন রিপোর্টে। লে. জেনারেল নিয়াজি বন্দী অবস্থা থেকে ফিরে গেলে তাকেও হাজির করা হয় কমিশনের সামনে। বিচারপতি হামুদুর রহমান নিজ হাতে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে রিপোর্ট হস্তান্তর করেন। সমগ্র রিপোর্ট পড়ে ভুট্টো অনেকটা আতঙ্কে ওটিকে অতি গোপনীয় মার্ক করে রাষ্ট্রীয় তোষাখানায় পাঠিয়ে দেন। ব্যবস্থা করেন কঠোর নিরাপত্তার। কারণ এতে অনেক স্পর্শকাতর বিষয় ছিল যা প্রকাশ হলে পাকিস্তানের অনেক বিশেষ ব্যক্তির ইমেজের বারোটা বেজে যাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সময় ওই রিপোর্ট হঠাৎ ভারতের একটি পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে! পাকিস্তানে যেন বাজ পড়ে! পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মাথাখারাপ হয়ে যায়। সর্বশক্তি দিয়ে তারা বের করতে চেষ্টা করেন যে কিভাবে ওই ডকুমেন্ট ভারতীয় সাংবাদিকের হাতে গেল? তবে তারা কখনোই বের করতে পারেনি কিভাবে কী হয়েছে? ভারতীয় সাংবাদিক নিশ্চয়ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় তোষাখানায় গিয়ে হাতজোড় করে নিরাপত্তা রক্ষীদের বলেননি যে, ভাই, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টটা দিয়ে দোজাহানের নেকি হাসিল করো! তাকে সোজা কথায় ওই রিপোর্ট চুরি করতে হয়েছে এবং এটা ওই সাংবাদিকের ক্রেডিট, সাংবাদিকতায় উদাহরণ।
কেস স্টাডি-২ : সিক্রেট এফিডেভিট অব ইয়াহিয়া খান : এই অপকর্মটি আমার নিজের! এই ডকুমেন্টটিও পাকিস্তানের অতি গোপনীয় নথি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। ১৯৭৮ সালে মারা যাওয়ার আগে দীর্ঘদিন তিনি মারাত্মক অসুস্থ ছিলেন। পুরো শরীর প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছিল। বিছানায় নিশ্চল পড়ে থাকতেন। ওই সময় ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকতে লাহোর হাইকোর্টে তিনি ১৯৭১ সালের গোপন ঘটনাবলি নিয়ে একটি এফিডেভিট করে যান। তার মৃত্যুর পর পাক সরকার ওই ডকুমেন্টটিকেও রাষ্ট্রীয় তোষাখানায় পাঠিয়ে দেয়। আমি যেকোনোভাবেই হোক সেটি হস্তগত করি। ২০০৬ সালে ওই গোপন দলিল নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট প্রকাশিত হয় দৈনিক আমার দেশ-এ যা ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। তখন সম্পাদক ছিলেন আমানুল্লাহ কবীর। ওই সময় প্রথম কিস্তি বের হওয়ার সময় ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন আমাকে বহু অনুরোধ করে ওটা কার কাছ থেকে পেয়েছি তা বলতে। আমি সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে বলে দিয়েছি দিতে পারব না, দেইওনি। ওরা কিছু বলেনি। তবে ওই দলিল নিয়ে আমার নিজ প্রকাশনা সংস্থা থেকে বেরুনো বইটি পাকিস্তানে এখনো ঢুকতে দেয় না। তা আমি ওই ডকুমেন্ট কি এমনিই পেয়েছিলাম। না। সিম্পলি গায়েব করে দিয়েছিলাম। এ জন্য আমি গর্বিত। আমি স্বস্তি বোধ করি যে ওই ডকুমেন্টটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় বিশ্বব্যাপী আজ কাজে লাগছে।
আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখলে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেনাবাহিনীতে কমিশন পাই অর্থাৎ অফিসার হই ১৯৮৫ সালে। তখন দেশব্যাপী মার্শাল ল’ চলছিল। কিন্তু কখনো এমন কোনো কাণ্ড দেখিনি যে, একজন নারী সাংবাদিককে শারীরিকভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে বা আটকে রাখা হয়েছে। এটাও দেখিনি যে, কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার জিগির তোলা হয়েছে।
সাংবাদিকের কাজই রিস্কি, গোয়েন্দার মতো। তারা প্রায়ই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্নীতি ও অসঙ্গতির তথ্য তুলে ধরেন। তবে সাংবাদিকরা পুরো পৃথিবীতে ইমিউনিটি পেয়ে থাকেন। তাদের সরকারি নথিপত্রসহ পাওয়া গেলেও ভদ্রভাবে ডিল করা হয় সর্বত্র। আমাদের এখানেও করা হতো একসময়। কিন্তু এখন সব মিশে গেছে এক মোহনায়- আমলাতন্ত্র সবার উপরে, না হলে যে উপায় নেই গোলাম হোসেন!
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের প্রধান সম্পাদক
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৯ মে ২০২১