আযাদ আলাউদ্দীন
১৯৯৫ সাল। তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিলো ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মির্জাকালু এলাকায়। পুরাতন মির্জাকালু বাজারটি ছিলো ভোলা জেলার অন্যতম একটি ব্যবসায়িক জোন। তখন সেই একটি বাজারেই একশত কপির বেশি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা বিক্রি হতো। আমরা সবাই ছিলাম দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠক। পত্রিকায় সব লেখার পাশাপাশি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম চিঠিপত্র কলাম। পড়তে পড়তে ভাবনায় কাজ করতো- দেশের বিভিন্ন এলাকার পাঠকরা তাদের স্ব স্ব এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনার কথা চিঠিপত্র কলামে তুলে ধরছেন। আমিও তো আমার এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনার কথা এই পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে তুলে ধরতে পারি।
সেই ভাবনা থেকেই একটি লেখা লিখলাম ‘মির্জাকালু ডাকঘরের নানা সমস্যা’। এফোর সাইজ কাগজের এক পিঠে সুন্দরভাবে পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাসহ লিখে ২ টাকার খামে ভরে পাঠিয়ে দিলাম দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ঠিকানায়। এরপর প্রতিদিন পত্রিকা আসলে প্রথমে চোঁখ বুলাই ‘চিঠিপত্র’ কলামে। দিন যায় সপ্তাহ যায় কিন্তু আমার লেখা ছাপা হয় না। ভাবলাম হয়তো আর ছাপা হবে না। আশা ছেড়ে দিয়েছি। প্রায় একমাস পর একদিন বিকেলে মির্জাকালু বাজারের মধ্যে হাটছিলাম। হঠাৎ নিজের দোকান থেকে ডাক দিলেন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী হারুন চৌধুরী। তিনি আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষ। দীর্ঘদিন যাবত আমাদের পরিবারের যত কাপড় কেনাকাটা সব ওই হারুন চৌধুরীর দোকান থেকেই। আব্বার সাথে ছিলো তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক। আমার আব্বা মাওলানা আবদুল খালেক তখন ছিলেন মির্জাকালু সিনিয়র মাদরাসার উপাধ্যক্ষ। পরে ২০০১ সালে তিনি ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।
যাইহোক- হারুন চৌধুরী আমাকে ডেকে বললেন, আজকের পত্রিকায় তোমার লেখা ছাপা হয়েছে। আমরা পড়েছি, খুব ভালো লিখেছো, আমাদের ভালো লেগেছে। নিয়মিত লেখার চেষ্টা করো। এরপর তার দোকানে বসে জীবনের প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটি পড়লাম। সে এক অন্যরকম অনুভূতি! সেই দোকান থেকে বের হয়ে একটু এগুতেই পরিচিত আরেক দোকানদারের ডাক ‘আজকে তোমার লেখা ছাপা হয়েছে পত্রিকায়’ দেখেছো? তিনিও উৎসাহ দিলেন। সেই যে লেখালেখির প্রথম প্রেরণা। তারপর থেকে আর কলম থেমে থাকেনি। চিঠিপত্র কলামে নিয়মিত লিখতে লিখতে হয়ে গেলাম লেখক। এরপর ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশ হতে থাকে আমার লেখা।
১৯৯৮ সালে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার পর লেখালেখিতে পুরোপুরি যুক্ত হই। মূলত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ফিচার লিখতাম। তখন দৈনিক মুক্তকণ্ঠ পত্রিকার রমরমা বাজার। একদিকে পত্রিকাটি ফোরকালার ছাপা, অন্যদিকে নান্দনিক মেকআপ-গেটআপ। আর ফিচার পাতাগুলোও ছিলো বেশ সমৃদ্ধ। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা ছিলো বেশ তুঙ্গে। সেই মুক্তকণ্ঠে একাধিক ফিচার ছাপা হওয়ার পর লেখালেখির প্রতি আরো আগ্রহ বেড়ে যায়।
তখন বরিশালের দৈনিক আজকের বার্তা পত্রিকার বোরহানউদ্দিন প্রতিনিধি ছিলেন সাংবাদিক শিমুল চৌধুরী। তার সাথে যোগাযোগ করে যুক্ত হই দৈনিক জনতা পত্রিকার বোরহানউদ্দিন উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে। দৈনিক জনতা পত্রিকা ছিলো জাতীয় পার্টির মুখপত্র। নাজিউর রহমান মঞ্জু ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব। তিনি যেহেতু ভোলায় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এজন্য তাঁর ভক্তরা অনেকেই দৈনিক জনতা পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। দৈনিক জনতা পত্রিকায় চলতে থাকে আমার সাংবাদিকতা। তখন দৈনিক জনতা পত্রিকার সাহিত্য এবং ফিচার সম্পাদক ছিলেন আমাদের বোরহানউদ্দিন এলাকার বড় ভাই কবি হাসান মাহমুদ। তিনি আমার নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড পেতে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। প্রতিদিন আমরা ফিচারধর্মী নিউজগুলো ছবিসহ কুরিয়ারে কিংবা ডাকযোগে প্রেরণ করি। আর জরুরি নিউজ পাঠাই ফ্যাক্সে। আমাদের ইয়াসিকা ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো প্রিন্ট করতাম স্টুডিও দুলালীতে। এভাবে চলতে থাকে আমার সাংবাদিকতা।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা শহর থেকে মির্জাকালু বাজার প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার দূরে হলেও সাংবাদিকতার টানে প্রতিদিন চলে আসতাম উপজেলা শহরে। আস্তে আস্তে পরিচিত হই তখনকার কর্মরত অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে। তখন বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন ওমর ফারুক তারেক। থানার মোড়ে তার একটি দোকান ছিলো। সেটির নাম ছিলো নিশাত ইলেকট্রনিক্স। আমি, শিমুল চৌধুরী আর দীন ইসলাম রুবেল মিলে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যেতাম নিউজের সন্ধানে। তখন যেহেতু মোবাইল ফোনের ব্যবহার ছিলোনা সেহেতু বক্তব্য গ্রহণের জন্য সরাসরি যাওয়া ছাড়া অন্যকোন উপায় ছিলো না। আমাদের মিনি একটি রেকর্ড প্লেয়ার ছিলো। সেটি সবসময় আমাদের পকেটে থাকতো। সেটিতেই রেকর্ড করতাম সব বক্তব্য। কোন নিউজের তথ্য পেলে সেটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং প্রয়োজনীয় ছবি ও বক্তব্য সংগ্রহ করে ফিরতাম ফারুক ভাইয়ের সেই নিশাত ইলেকট্রনিক্সে। সেখানে চা-সিঙ্গারা খেয়ে চলে যেতাম প্রেসক্লাবে। সারাদিনের নিউজ লিখে- বেশি জরুরী হলে ফ্যাক্সে, আর কম জরুরী হলে কুরিয়ারে নিউজ পাঠিয়ে যার যার বাড়ি ফিরতাম। এভাবে কাজ করতে করতে পর্যায়ক্রমে বোরহানউদ্দিন প্রেসক্লাবের সদস্য পদ লাভ করলাম। পরের বছর প্রেসক্লাবের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হলাম।
১৯৯৯ সালে কম্পিউটার শেখার জন্য ৬ মাস ভোলা শহরে অবস্থান করি। তখনো চলতে থাকে আমার সাংবাদিকতা। এসময় ভোলা শহরে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে পরিচিত হই। বিশেষ করে ভোলার সিনিয়র সাংবাদিক নজরুল হক অনু ভাইয়ের সাথে সখ্যতা ছিলো অনেক বেশি। কারণ অনু ভাইয়ের ওয়েস্টার্ন পাড়া বাসার কাছেই একটি বাসায় আমি ভাড়া থাকতাম। প্রতিদিনই তার সাথে সাংবাদিক সংস্থা অফিসে বসতাম। তিনি ছিলেন সাংবাদিক সংস্থার ভোলা জেলা সভাপতি, আর সেক্রেটারি ছিলেন লালমোহনের মরহুম সাংবাদিক এম জাকির হোসেন। আমার বসার আরেকটি জায়গা ছিলো দৈনিক আজকের ভোলা। তখন আজকের ভোলার অফিস ছিলো নতুন বাজারে কবি মোজাম্মেল হক টাউন হলের সামনে। যাইহোক এভাবে ছয়মাস ভোলা শহরে অবস্থানকালে কম্পিউটার শেখা আর সাংবাদিকতার কাজ শিখে অবশেষে ভর্তি হই বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে।
অনার্স লাইফ শুরু হওয়ার পর ফিচার লেখায় মনোনিবেশ করি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের ফিচার পাতায় লেখা ছাপা হতে থাকে। বিশেষ করে দৈনিক ইনকিলাব আর যুগান্তর পত্রিকায় ফিচারের জন্য বিল দেয়া হতো। প্রতিটি লেখার জন্য তিনশত টাকা থেকে আটশত টাকা পর্যন্ত বিল দেয়া হতো। এসব টাকার অধিকাংশই ব্যয় করতাম বই কেনার কাজে। এভাবে চলতে থাকে আমার অনার্স ও মাস্টার্স লাইফ। কলেজ, লাইব্রেরি আর লেখালেখিই ছিলো আমার প্রিয় ঠিকানা।
ছবির ক্যাপশন
প্রায় এক যুগ আগে যখন দিগন্ত টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলাম- তখন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া এলাকায় টর্নেডোর সংবাদ সংগ্রহকালে বরিশালের টেলিভিশন সাংবাদিকদের সাথে আমি।
.
আযাদ আলাউদ্দীন, বরিশাল ব্যুরো চিফ, দৈনিক নয়া দিগন্ত
সদস্য, বরিশাল প্রেসক্লাব, 01712189338
আপনার আগামী দিনগুলোর পথচলা হোক আরো মসৃন ও কল্যাণময়।
ধন্যবাদ।
সংগ্রামী জীবন আরো সুন্দর ও সুখময় হোক শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আপনার মেধা ও মননশীলতার জন্য.
❤❤