সাব-এডিটরের কর্মজীবন

আহমেদ বায়েজীদ ।।

পরিচয় পর্ব শেষে ডেপুটি ইনচার্জ বিদেশী পত্রিকার একটি সংবাদের প্রিন্টআউট কপি ধরিয়ে বললেন- ‘এটা করুন’। জানতে চাইলাম- ‘অনুবাদ করবো?’
বললেন- ‘অনুবাদ, তবে বাংলা পত্রিকায় যে স্টাইলে সংবাদ লেখা হয় সেভাবে সাজাবেন।’
নিজের ইংরেজীর দৌড় সম্পর্কে আমার চেয়ে আর কে ভালো জানবে। মনের মধ্যে খচখচানি শুরু হলো। মনে পড়ে গেল সাব-এডিটরদের অনুবাদ নিয়ে কয়েকটি গল্প। কোন এক সাব-এডিটর নাকি ‘পুলিশ ওয়াজ পেট্রোলিং অন হাইওয়ে’র অনুবাদ করেছিলেন, ‘পুলিশ রাস্তায় পেট্রোল ছিটাচ্ছিল’। স্পোটর্স নিউজ করতে গিয়ে কে নাকি রিয়াল মাদ্রিদের বাংলা করেছিল ‘প্রকৃত মাদ্রিদ’।
এগুলো নিছকই গল্প- নাকি সত্যি ঘটনা সেটি জানি না। তবে নিজের মধ্যে ভয় ধরে গেল। তারপরও চাকরি যেহেতু করতে এসেছি- কাজ তো করতেই হবে। নিয়োগ পরীক্ষায় এরকম একটি অংশ ছিলো। সেই অভিজ্ঞতাকে সাহসে রূপান্তর করে শুরু করলাম। শেষ করে জমা দেয়ার পর বস টুকটাক সংশোধনী দিয়ে নিউজটি প্রকাশের জন্য অনুমোদন করলেন।

পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতাটুকু ছিলো এমনই। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতার সাথে পরিচয় থাকলেও সেটি ছিলো রিপোর্টিংয়ে; কিন্তু সাব-এডিটর বা সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদান করার পর যেন নতুন একটি জগতের দরজা খুলে গেল চোখের সামনে। সে এক বিশাল জগত। যেখানে একটি পত্রিকাকে পাঠকের কাছে সুন্দর করে উপস্থাপনের জন্য থাকে বিশাল কর্ম তৎপরতা। বিশাল একটি টিম কাজ করে এর পেছনে। সাধারণ চোখে রিপোর্টার রিপোর্ট লেখে, আর পত্রিকায় ছাপা হয়- বিষয়টা এমন মনে হতে পারে; কিন্তু একটি সংবাদ লেখার পর থেকে ছাপার জন্য প্রেসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে আরো অনেকগুলো ধাপ। যেগুলো বেশির ভাগ পাঠকেরই অজানা।

নিউজ লেখার পর্ব শেষ হওয়ার পর বস বললেন- মেকাপ রুমে চলুন। অবাক হলাম। আমি মেকাপ রুমে গিয়ে কী করবো! যাওয়ার পরে বুঝলাম এই মেকাপ মানুষের নয়, পত্রিকার অঙ্গসজ্জা। কম্পিউটার রুমে গিয়ে অপারেটরকে নির্দেশনা দিয়ে প্রতিটি সংবাদ সাজাতে হয়। কোন নিউজটা কত কলাম হবে, কোথায় ছবি বসবে, ছবির ক্যাপশন কী হবে- এসবই মিলেই মেকাপ।

আমি যোগদান করেছিলাম আন্তর্জাতিক ডেস্কে। যে কারণে সব আন্তর্জাতিক সংবাদ লেখা, সম্পাদনা, ছবি বাছাই ইত্যাদি শেষ করেই যেতে হত মেকাপ রুমে। পৃষ্ঠাসজ্জার কাজ শেষ হওয়ার পরে পাতাটি বার্তা সম্পাদক বা হেড অব নিউজের কাছে জমা দেয়া হয়। তিনি অনুমোদন করলে সেটি ছাপার জন্য প্রেসে যায়।
পাতা ভেদে সাব এডিটরদের কাজের পার্থক্য আছে। যেমন পত্রিকার প্রথম ও শেষ পাতাসহ দেশীয় সব গুরুত্বপূর্ণ নিউজ যেখানে সম্পাদনা করা হয় সেটিকে বলা হয় সেন্ট্রাল ডেস্ক।

একজন রিপোর্টার অ্যাসাইমেন্ট থেকে ফিরে রিপোর্টটি লিখে চিফ রিপোর্টার বা নিউজ এডিটরকে দেবেন। তারা সেটা সম্পাদনার জন্য পাঠাবেন সেন্ট্রাল ডেস্কে। একজন সাব-এডিটর সংবাদটি সম্পাদনা করবেন। সম্পাদনার মাঝে অনেকগুলো বিষয় থাকে যেমন- সংবাদ কাঠামো, পত্রিকার পলিসিগত দিক, ভাষা বা বাক্যগঠনের ত্রুটি, তথ্য যাচাই করা, শিরোনাম ঠিক করা, সংশ্লিষ্ট ছবি বাছাই করা ইত্যাদি। সম্পাদনা শেষে তিনি সংবাদটি পাঠাবেন সম্পাদনা সহকারীদের কাছে। তারা বানানে কোন ত্রুটি থাকলে সেটি ঠিক করবেন। এরপর সংবাদটি যাবে মেকাপের জন্য কম্পিউটার রুমে। সেখানে পৃষ্ঠাসজ্জা শেষে পত্রিকা যাবে প্রেসে।

এভাবে মফস্বল বিভাগ, স্পোর্টস বিভাগ, ফিচার বিভাগ- যার যার পৃষ্ঠার কাজ শেষ করেন। প্রথম ও শেষ পাতার পৃষ্ঠাসজ্জার কাজটি সাধারণত বার্তা সম্পাদক সরাসরি নিজেই করেন। এগুলো সবই করতে হয় নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে। কারণ ঢাকা কিংবা পঞ্চগড়- সব জায়গাতেই পত্রিকা যেতে হবে নির্দিষ্ট সময়ে।

সংবাদ মাধ্যমে সম্পাদনা হচ্ছে একটি ‘থ্যাঙ্কস লেস জব’। কোন সংবাদ ভালো হলে সব প্রশংসা পান সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার। আর কোন ত্রুটি থাকলেই ধরা হয় সাব-এডিটরকে। যেহেতু সংবাদটি ছাপার যোগ্য করে তোলা তারই কাজ, তাই তিনি এই দায় তার ঘাড়েই চাপে। এর বাইরে পাঠকদের চাপ তো রয়েছেই।

আমি তখন স্পোর্টস ডেস্কে- একটি ফুটবল ম্যাচ শুরুর সময় ভুল ছাপা হয়েছিল, পরদিন দর্শকদের একের পর এক ফোন। কেউ অভিযোগ করে, আবার কেউ রীতিমতো রূঢ় ভাষায় শুনিয়ে দেয় কয়েক লাইন। একবার ভুল করে নওয়াজ শরীফকে পাকিস্তানের ‘প্রেসিডেন্ট’ লেখায় নালিশ চলে এসেছিল সম্পাদকের কাছে। এছাড়া কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নামের বানান ভুল ছাপা হলে, ধর্মীয় স্পর্শকারত বিষয়ে ভুল তথ্য থাকলেও একই অবস্থা। কখনো কখনো মারত্মক ভুলের কারণে চাকরিও চলে যেতে পারে। আবার প্রশংসাও যে জোটে না তেমনটি নয়। সেটি অবশ্য পাঠকদের কাছ থেকে নয়। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

একজন সাব-এডিটরকে তাই নিরবে নিভৃতে পত্রিকাটিকে সুন্দর করতে কাজ করে যেতে হয়। সংবাদের স্টাইল, পৃষ্ঠাসজ্জা, শিরোনাম ইত্যাদি নিয়ে অল্প সময়ে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় পত্রিকার পলিসির বিষয়ে, অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনের দিকেও রাখতে হয় সজাগ দৃষ্টি। একজন সাব-এডিটরের একটি ভুলে দেশ অস্থিশীলও হয়ে উঠতে পারে। যে কারণে সাব-এডিটরদের হতে হয় খুঁতখুতে স্বভাবের। ত্রুটিগুলো যার যত দ্রুত চোখে পড়বে তিনি তত দক্ষ সাব-এডিটর হয়ে উঠতে পারবেন।

একজন সাব-এডিটরকে একই সাথে সৃজনশীলতা, ভাষার ওপর দখল, ইংরেজীতে দক্ষতা, নিউজ সেন্সসহ অনেকগুলো বিষয়ে দক্ষ হতে হয়ে। একই ঘটনা দেখা যাবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে একভাবে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যমে ঠিক উল্টোটা। আবার আন্তর্জাতিক কোন মিডিয়া হয়তো খবরটি পরিবেশন করেছে আরেকভাবে। একজন দক্ষ সাব-এডিটরকে তখন ওই তিনটি সংবাদমাধ্যম থেকে আসল ঘটনাটি খুঁজে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হয়। আবার একজন ক্রিকেটার জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন- এমন খবরের সাথে তার হাসিমুখের ছবি ছাপা হলে বিষয়টি দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে পাঠকের কাছে। এগুলো খেয়াল রেখেই কাজ করতে হয় সাব-এডিটরকে। ##

আহমেদ বায়েজীদ, কন্টেন্ট রাইটার
বিডি ভিউজ ও বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্ট (ইউটিউব চ্যানেল)
সদস্য, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন।

 

 

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *