মো. জিল্লুর রহমান:
প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস (ওয়ার্ল্ড রেডিও ডে) একটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে ও সংবাদমাধ্যমে বেতারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের বেতারের মাধ্যমে তথ্য যেন সুলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং বেতার সম্প্রচারকদের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সহায়তা ও পারস্পরিক মতামত ও তথ্যবিনিময় জোরদার করা। ইউনেস্কো প্রতি বছর সারা বিশ্বের সম্প্রচারক, সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় বেতার দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ ছাড়া এই দিনে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেতারের গুরুত্ব আলোচনা করা হয়, যাতে সবাই সচেতন হয়। এটি আরও অবহিত করা হয় যে, বেতার এমন একটি পরিষেবা, যার মাধ্যমে কেবল বেতারকে ফ্রিকোয়েন্সিই বলা যায় না; বরং দুর্যোগের সময় যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমগুলো ব্যাহত হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরও সহায়তা করা যেতে পারে।
প্রথমবার ২০১০ সালে স্পেন রেডিও সংস্থার পক্ষ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস উদযাপন করার প্রস্তাব আসে। এরপর ২০১১ সালে এটি ইউনেস্কোর সদস্য দেশগুলো ঘোষণা করে এবং ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো প্রথম এই দিনটি বিশ্ব বেতার বা রেডিও দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। তারপর থেকে বিশ্ব বেতার দিবসটি সারা বিশ্বে পালিত হতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ রেডিওর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং এ কারণেই এদিনটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল।
মূলত চারটি ধারায় রেডিও সম্প্রচার করে থাকে। যথা-পাবলিক সার্ভিস, আন্তর্জাতিক রেডিও, বাণিজ্যিক রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও। পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ বেতার যেমন অনুষ্ঠান ও খবর সম্প্রচার করছে; তেমনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ভয়েস অব আমেরিকা, এনএইচকে, রেডিও তেহরান, রেডিও চায়না ও অন্যান্য বিদেশি মাধ্যমেও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারছি। আবার দেশে সাম্প্রতিক কালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সম্প্রচার করছে শহরভিত্তিক বেসরকারি এফএম রেডিও। সব মিলিয়ে রেডিওর প্রচার দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওর সাফল্যও অনেক।
অনেকেরই ধারণা ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার এই সময়ে রেডিও তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। কারণ সময় যেমন বদলেছে, ঠিক তেমনই সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে প্রচারণার ধরনও বদলে গেছে। এখনও বহু মানুষ বেতার শোনে। এখনও অনেক মানুষ বেতারের ওপর নির্ভর করে। সারাবিশ্বে বেতার এখনও অন্যতম জনপ্রিয় গণমাধ্যম। বেতারের রয়েছে প্রথিবীর দুর্গম স্থানে পৌঁছানোর শক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে সম্প্রচার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিযোগিতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। গ্রামগঞ্জ ও দুর্গম এলাকায় এখনও বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম।
বেতার হলো তারবিহীন যোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এতে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য প্রেরণ বা গ্রহণ করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে অনেক দেশের বিজ্ঞানী প্রায় একই সময়ে বেতার আবিষ্কার করলেও গুলিয়েলমো মার্কনিকে বেতারের আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। আগে শুধু রেডিওতে ব্যবহƒত হলেও বর্তমানে বেতার প্রযুক্তির ব্যবহার চলছে সর্বত্র। রেডিও (বেতার), টেলিভিশন (দূরদর্শন), মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রভৃতি তারবিহীন যেকোনো যোগাযোগের মূলনীতিই হলো বেতার। বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে মহাকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা রেডিও টেলিস্কোপ।
অনেকেই ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনিকে বেতারের আবিষ্কারক হিসেবে জানেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু মার্কনির আগেই বেতার আবিষ্কার করেছিলেন। এ তথ্য প্রকাশ করেছেন খোদ মার্কনির নাতি পারসেশচে মার্কনি, যিনি ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির একজন জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ। কারণ ১৯০১ সালে মার্কনি আটলান্টিকের ওপারে প্রথম বেতার সংকেত পাঠান এবং পাল্টাসংকেত গ্রহণ করেন কিন্তু এর আগেই ১৮৯৯ সালে মার্কনি বাংলার জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বসুই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি রেডিও এবং মাইক্রোওয়েভসের অপটিকসে নিয়ে কাজ করেছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৯৪ সালে ইতালীয় বিজ্ঞানী গুগলিয়েলমো বেতার নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিশ্বে প্রথম রেডিও আবিষ্কারই হয়েছিল ১৮৯৮ সালে এবং ১৯০০ সালে ব্রাজিলিয়ান ধর্মযাজক রবার্ট ল্যান্ডেন ডি মউরা মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিজের কণ্ঠস্বরকে বেতার পদ্ধতিতে দূরে পাঠিয়ে স্থানান্তর করেন। ১৯০০ সালের ৩ জুন সর্বপ্রথম তিনি এটি সাংবাদিকদের সামনে সফলভাবে প্রদর্শন করেন। ১৯০৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিজ্ঞানী রেজিনাল্ড ফেনসডেন রেডিও সম্প্রচার শুরু করেছিলেন। ১৯১৮ সালে লি দ্য ফরেস্ট নিউইয়র্কের হাইব্রিজ অঞ্চলে বিশ্বের প্রথম রেডিও স্টেশন শুরু করে। তবে পুলিশ এটিকে অবৈধ বলেছিল এবং এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে স্যার জগদিশ চন্দ্র বসু, স্যার অলিভার লজ এবং আলেক্সান্ডার প্যাপোভ বেতারের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখেন। ১৯৩৬ সালে ভারতে অফিশিয়াল ‘ইম্পেরিয়াল রেডিও’ শুরু হয়েছিল যা স্বাধীনতার পরে অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে বেতারের যাত্রা শুরু ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব বেতার দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর এতে অংশ নেয় বাংলাদেশ বেতার, প্রাইভেট এফএম এবং কমিউনিটি রেডিওগুলো। বাংলাদেশে সরকার ইতোমধ্যে ২৮টি প্রাইভেট এফএম এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিওর অনুমোদন দিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া, বাংলাদেশ বেতার ১২টি আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্র এবং ৩৫টি এফএম স্টেশন পরিচালনা করছে। ২০০০ সালে থেকে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি) বাংলাদেশে গ্রামীণ জনপদে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উন্নয়নমূলক তথ্য ও জ্ঞান বিনিময়ের পাশাপাশি, সরকারি ও বেসরকারি সেবা, জীবনঘনিষ্ঠ যাবতীয় তথ্য জনগণের মাঝে সহজ ভাষায় প্রচারের লক্ষ্যে কমিউনিটি রেডিও চালু করে সরকারের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি করে আসছে। দেশে বর্তমানে ১৬টি কমিউনিটি রেডিও প্রতিদিন ১২৫ ঘণ্টারও বেশি সময় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। ১ হাজার তরুণের অংশগ্রহণে নতুন ধারার এ গণমাধ্যমটি দ্রুত বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিএনএনআরসির তথ্য মতে, ১৪টি জেলার ৬৮টি উপজেলার প্রায় ৫৫ লাখ জনগোষ্ঠী কমিউনিটি রেডিওর সুবিধা ভোগ করছে এবং শ্রোতাদের সমন্বয়ে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন পর্যায়ে ৫ হাজার ‘শ্রোতা ক্লাব’ গঠিত হয়েছে।
এদিকে, ইতোমধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিও বিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে কমিউনিটি রেডিও বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নকারী দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ। নতুন গণমাধ্যম হিসেবে কমিউনিটি রেডিও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশের ক্ষেত্রে পল্লী অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে তথ্য এবং যোগাযোগের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। সুশাসন নিশ্চিতকরণে জনপ্রতিনিধি, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনসাধারণের সংলাপ আদান-প্রদানের ক্ষেত্র তৈরি করে এবং সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় মহাসেন এবং কমেনের সময় উপকূলীয় অঞ্চলে স্থাপিত কমিউনিটি রেডিওগুলোর ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ খবর জানার ক্ষেত্রে উপকূলের মানুষের প্রধান উৎস ছিল কমিউনিটি রেডিও।
আসলে বেতার এমন একটি গণমাধ্যম পৃথিবীতে যার ব্যাপ্তি অন্য সব গণমাধ্যম অপেক্ষা অনেক বেশি। এটি একাধারে যোগাযোগের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং সাশ্রয়ী মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। দূরবর্তী জনসম্প্রদায় ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কাছে (নি¤œ সাক্ষরতার হার বিশিষ্ট জনসম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নারী, তরুণ-তরুণী এবং দারিদ্র্যের শিকার ব্যক্তি) পৌঁছাতে বেতারের কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে এটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে জনবিতর্কে মানুষের অংশগ্রহণের একটি মঞ্চ। অধিকন্তু, জরুরি অবস্থাকালীন যোগাযোগ ও বিপর্যয়কালীন ত্রাণকর্মে বেতার একটি শক্তিশালী ও নির্দিষ্ট ভূমিকা রাখে। বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সমধর্মিতা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। তাই বেতার সেবাগুলোও প্রযুক্তির নতুন নতুন রূপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, মুঠোফোন, এফএম, কমিউনিটি ও ট্যাবলেটে ভিন্ন ভিন্নরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও বিশ্বের প্রায় শত কোটি লোকের কাছে এখনও বেতার সেবা সহজলভ্য নয়।
সংবাদপত্র যদিও সবচেয়ে পুরোনো গণমাধ্যম কিন্তু এক সময় শহর বন্দর গ্রাম সর্বত্রই প্রচার মাধ্যমের আভিজাত্যই ছিল বেতার। গল্প, উপন্যাস, নাটক এমনকি সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের দেখা যেত তারা বেতারে গানের রেকর্ডিং করছেন। সেই গান শুনছেন দেশের হাজারও মানুষ ও অগণিত শ্রোতা। কী যে সেই আকুলতা ও আগ্রহ! কখন শুরু হবে সেই প্রিয় নাটক কিংবা সিনেমার গান। বেতারে প্রোগ্রাম করা মানেই শিল্পীর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়া। তখন বেতারই ছিল সাধারণ মানুষের আনন্দ বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। টেলিভিশন ছিল কিন্তু তার গণ্ডি ছিল হাতেগোনা মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের ড্রয়িংরুমে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন শোভা পেত ঠিকই, কিন্তু তাও আবার হাতে গোনা কিছু মানুষের কাছে এবং টেলিভিশনের আবেদন থাকতো মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
তখন পরিবারের বিনোদনের প্রধান ও একমাত্র অনুষঙ্গ ছিল বেতার। ঘরে ঘরে রেডিও, পাড়ায় পানের দোকানে রেডিও, সেলুনে রেডিও, জেলে নৌকায় রেডিও, খেতে কাজ করছেন কৃষক তার ধারে কাছেও থাকতো রেডিও। অলস গৃহিণীর কোনো কাজ নেই, দুপুরে অখণ্ড অবসর। কানের কাছে রেডিও রেখে শুনতেন ‘অনুরোধের আসর’ অথবা পাঁচমিশালী গান কিংবা আধুনিক গানের অনুষ্ঠান। শুধু কি গান, নাটকের ক্ষেত্রেও রেডিওর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ইদানীং যেমন পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ব্যস্ততা সত্ত্বেও টেলিভিশনে সন্ধ্যা ও দুপুরের খবর দেখতে ভুল করেন না। তেমনি রেডিওর সেই যুগে সন্ধ্যার খবর এবং দুপুরের খবর বেশ আগ্রহভরে শুনতো শ্রোতারা। চায়ের দোকানে রেডিওতে খবর শুনতে মানুষ ভিড় করত। দুর্যোগ প্রতিরোধে রেডিওর খবরই ছিল মূল ভরসা। মোট কথা সংবাদপত্রের পাশাপাশি রেডিও, একমাত্র রেডিওই ছিল একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ প্রচারমাধ্যম।
এখনও গান, খবর, নাটকের পাশাপাশি জনসংখ্যা সমস্যা, বাল্যবিবাহ রোধসহ নানা বিষয়ে নাটক/নাটিকা প্রচার হয়। শ্রোতারা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে সেসব শুনে। খবরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা জরুরি। রেডিওর খবর এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। বিশেষ করে বিভিন্ন দুর্যোগ, খেলাধুলা কিংবা ব্রেকিং নিউজ শোনার জন্য রেডিওতে কান পেতে রাখে। রেডিওতে দেশের মানুষ চরম সংকটেও এগিয়ে চলার প্রেরণা খুঁজে পায়।
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে দেশের অসহায় মানুষকে উজ্জীবিত করার কাজে রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট নামে খ্যাত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ প্রচার কাণ্ডারি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কালজয়ী গান ও অনুষ্ঠানগুলো একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে দেশের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে অনুপ্রাণিত করেছে। কেবল কী তাই, মানুষের জীবনে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, মহামারিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রকৃত বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ বেতার। এখনো বাংলাদেশ বেতার অবিরাম তথ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে।
তবে সেই রেডিও এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। একদম হারিয়েও যায়নি। এখনও অনেক মানুষ রেডিও শুনে। তাদের অধিকাংশই স্বাধীনতার আগের প্রজন্ম। নতুন প্রজন্ম অবশ্য এফএম, ইন্টারনেট বা স্মার্টফোনে রেডিও শুনতে অভ্যস্ত। রেডিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অনেকে মনে করেন, দেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংখ্যা যতই বাড়ছে, দিনে দিনে রেডিওতে শ্রোতার সংখ্যা ততই কমছে। অনেক আন্তর্জাতিক রেডিও ইতোমধ্যে শর্টওয়েভে প্রচার বন্ধ করে শুধু ডিজিটাল মাধ্যম ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব আছে। এ কারণে এক সময় রেডিওর ভূমিকা যেন অনেকটাই ম্রিয়মান হয়ে ওঠে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী রেডিওকে এখনও ধরে রেখেছেন গ্রামবাংলার মানুষ ও শ্রোতারা, তাদের কেউ কেউ মিলে গড়ে তুলেছেন রেডিও শ্রোতা ক্লাব। শ্রোতা ক্লাবগুলো শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, তারা আন্তর্জাতিক বেতারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, নানা সমাজ সচেতনতামূলক কাজ করছে। মূলত তারাই গণমাধ্যমের পুরোতন মাধ্যম রেডিও বাঁচিয়ে রেখেছেন।
সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে বেতার শক্তিশালী হাতিয়ার। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ সম্পাদন করা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেতারের ভূমিকা অনন্য। তারবিহীন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো বেতার বা রেডিও। সবচেয়ে প্রাচীন, সহজলভ্য ও একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে বেতার পৃথিবীব্যাপী বহুল পরিচিত। প্রবল প্রযুক্তিনির্ভর এই সমাজেও বেতার তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। সহজলভ্যতা এবং বহনযোগ্যতার কারণেই বিশ্বব্যাপী বেতার সগৌরবে টিকে আছে এবং সার্বজনীন গণমাধ্যম হিসেবে থাকবেও অনন্তকাল। ইন্টারনেট লাইভ স্ট্রিমিং এবং ফেসবুক, ইউটিউব অডিও-ভিডিও লাইভ শোনা-দেখার সুবিধা থাকায় সব শ্রেণির শ্রোতার কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে আজকের বেতার। এ কারণে পুরোনো গণমাধ্যম হিসেবে রেডিওকে বাঁচিয়ে রাখা শ্রোতা ও পাঠকদের দায়িত্ব।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক