সুমাইয়া সুলতানা তামীমা:
শিক্ষা বলতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই মূল্যায়ন করা যাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ততক্ষন পর্যন্ত পূর্ণতা পায় না, যতক্ষন পর্যন্ত তাতে যুক্ত হয় সাংস্কৃতিক শিক্ষা। শিক্ষার্থীকে শিক্ষা বিষয়ে সঠিক ধারণা ও নির্দেশনা দিতে হলে শিক্ষকের এসব বিভিন্ন সংস্কৃতি ও উপসংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। সারাদিন লেখাপড়া কারই বা ভালো লাগে! আমরা সবাই একটু বিনোদন চাই। কিন্তু সাংস্কৃতিক শিক্ষা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় দিতে পারে না। এটি দেয় প্রধানত পরিবার ও সমাজ।
সংস্কৃতি হচ্ছে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের বিশ্লেষণ ও পার্থক্য করতে শেখা এবং নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী হয়ে নিত্য নতুন সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো। শিক্ষা ও সংস্কৃতিই সভ্যতাকে নির্মাণ করে এবং ভিত্তিটি গেঁথে এর দেয়াল তুলে দেয়। শুধু শিক্ষা মানুষের মধ্যে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করতে পারে না। এজন্য একটি আবহের প্রয়োজন হয়। আবহটা আসবে সমাজ থেকে, জনগোষ্ঠী থেকে এবং এই সমাজ বা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিনের চর্চায় একটি গ্রহণ ও বর্জন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যের উপাদানগুলো ছেঁকে আনবে অসুন্দরকে বিসর্জন দিয়ে।
আমি সবসময়ই একটা উদাহরণ দেই যে, অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে কি হবেনা এর নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতি খাতে ৫ টাকা ব্যয় করলে ১০ টাকা আসবে ইনশা’আল্লাহ্। একটি জাতি যদি শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়, দেখা যাবে সেই জাতির সকল কাজেই সৌন্দর্য রয়েছে। সে জাতির দৈনন্দিন জীবনাচরণে, আহার গ্রহণে, ঘর সাজানোতে, শহর পরিকল্পনায়, শিশুদের লালন-পালন সকল ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে।
কিন্তু আমরা সৌরজগতের বিপরীতে ঘোরতেই অভ্যস্ত। আমাদের রান্নাঘর আর বাথরুমের দিকে নজর দিলেই তা বুঝতে পারব কী অসম্ভব অসুন্দর আমাদের জীবনযাত্রা! আমরা যে ঘরে খাদ্য তৈরি করি, সে ঘরটিই বেশিরভাগ সময় সবচেয়ে নোংরা থাকে। শিশুদের আমরা যথেষ্ট আদরযত্নে লালন করি বটে, তবে তাদের জন্য পরিবেশটা অসম্ভব নোংরা করে রাখি। যে মানুষ ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝে না তাঁর থেকে কিইবা বা আশা করা যায়! আমরা যারা মুসলিম তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু তা কতটুকু চর্চা হয়? আমরা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি করা অনৈতিক সংস্কৃতিতে গাঁ ভাসিয়ে দেই।
অপসংস্কৃতি ও অশ্লীলতা মুনাফেকির জন্ম দেয়। মুসলিম উম্মতের জন্য চরিত্র ধ্বংস করতে এটুকুই যথেষ্ট। চরিত্র রক্ষার তাগিদে প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য উত্তম সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরা, দেশ ও উম্মতের কল্যাণে ভূমিকা রাখা যাতে ইসলামী সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে। হযরত জাবের রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম বলেছেন, “গান-বাজনা মানুষের অন্তরে মুনাফেকি উৎপন্ন করে”- (বায়হাকি)
সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা করার জন্য অতিব জরুরি ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা। কারণ এর মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে একটি সুস্থ সমাজ। মন্দের বিপরীতে অবশ্যই ভালোকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম বনি কুরাইজাহর সাথে যুদ্ধের দিন হাসান ইবনে সাবিত রাদিআল্লাহু আনহুকে বলেছিলেন “(কবিতা আবৃতি করে) মুশরিকদের দোষত্রুটি তুলে ধরো। এ ব্যাপারে জিবরাইল আলাইহি ওয়া সল্লাম তোমার সঙ্গী। হাসান ইবনে সাবিত রাদিআল্লাহু আনহুকে ইসলামের কবি বলা হতো। কারণ, কাফির কবিরা যেমন আল্লাহর রাসূল ও ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা ও বদনাম করত, তেমনি তিনিও কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমে কাফিরদের জবাব দিতেন”- (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর-৪১২৪)।
শিশু, কিশোর ও তরুণদের মাঝে সুস্থ সংস্কৃতি প্রবেশ করাতে হলে যারা নাটক, সিনেমা তৈরি করছেন তাদেরকে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। তারা ভালো কিছু তৈরি করলেই তরুণদের মগজ থেকে উত্তেজিত চিন্তাভাবনা দূরীভূত হবে এবং এর মাধ্যমেই ফিরে আসতে পারে সুস্থ, সুন্দর এবং স্বাভাবিক একটি আচার-অনুষ্ঠান। এসব কাজ যত দিন আমরা করতে সফল হবো তত দিন অবধি এ দেশের তরুণ প্রজন্ম অসুস্থই থেকে যাবে।
অপসংস্কৃতির প্রবল বন্যায় যখন পুরো জাতি ঈমান ও আকিদা হারাতে বসেছিল তখন সর্বপ্রথম সুস্থ সংস্কৃতির পথিকৃৎ কবি মতিউর রহমান মল্লিকের হাত ধরে এদেশকে সুন্দর মহিমায় উদ্ভাসিত করতে এবং সকল মুসলমানদের মাঝে ইসলামী সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ১৯৭৮ সালে সাইমুম (মরুঝড়) নামে একটা নান্দনিক সংগঠন আসে আলোর দিশারী হয়ে। বাংলাদেশে ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ সংগঠন হিসাবে সাইমুমের নাম সর্বজনবিদিত। সংগঠনটি বর্তমানে ৬টি বিভাগীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মসূচির বাস্তবায়ন করে চলছে। বিভাগগুলো হচ্ছেঃ সংগীত, থিয়েটার, শিশু, কিশোর, তেলাওয়াত, শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তি বিভাগ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি এই সংগঠনটি পরিচালনা করে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, মাওলানা তারেক মনোয়ার, সাইফুল্লাহ মানসুর অন্যতম।
সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর ছায়াতলে গড়ে ওঠা বহু সাংস্কৃতিক কর্মী জাতীয়ভাবে ভূমিকা রেখে চলছেন। তাদের অনেকেই খ্যাতিমান হয়েছেন নিজ নিজ অঙ্গনে, তাদের মধ্যে রয়েছেন কবি,সাহিত্যিক, কণ্ঠশিল্পী ক্বারী, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, অভিনেতা আবার কেউ বা সংগঠক। এছাড়াও ইসলামী চিন্তাবিদ, আবৃত্তিকার, নাট্যনির্দেশক, উপস্থাপক, সাংবাদিক, অনুষ্ঠান নির্মাতাসহ মিডিয়া অঙ্গনের নানা দিকে ছড়িয়ে আছে এই সংগঠনের গড়া বহু কর্মী। অডিও-ভিজুয়াল প্রকাশনার জগতেও সাইমুমের অর্জন কম নয়।
আজ ৪৪ বছরের পথচলায় সাইমুম গান, অভিনয় ও কবিতার সমন্বয়ে অডিও ও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে প্রায় ৭০ টি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে । মঞ্চস্থ করেছে ৩০০ টিরও বেশি জনপ্রিয় মঞ্চনাটক। এছাড়া এই দীর্ঘ পথচলায় সাইমুম উপহার দিয়েছে ৩০ বছর পূর্তি স্মারক ও মল্লিক স্মারকের মতো বর্ণাঢ্য প্রকাশনা।
আর সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিভিন্ন শাখা। যার মাধ্যমে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের পথ এখন উন্মুক্ত।
তাই সকল মুসলিম বন্ধুদের বলব আপনি এবং আপনার সন্তানদের অপসংস্কৃতির ভয়াল থাবা থেকে বেরিয়ে এসে ইসলামের আলোকে গড়া সুস্থ সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হন। ছড়িয়ে দিন এই মুক্তির সৌরভ।
সুমাইয়া সুলতানা তামীমা
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, বরিশাল সরকারি বিএম কলেজ
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা
সাইমুম কে নিয়ে যেটুকু লেখা আছে এখানে সেটুকু সাইমুমের ওয়েবসাইট থেকে কপি করা। কিন্তু সেখানে তথ্যসুত্র উল্লেখ না করে নিজের নামেই দেখানো হয়েছে।
মাশাআল্লাহ
খুব সুন্দর এবং গুচানো আলোচনা💕
অসাধারণ
ইসলামী বিপ্লব সাধনের পূর্ব শর্ত
সুস্থ্য সাংস্কৃতির বিপ্লব সাধন।।
সুস্থ সংস্কৃতি বিষয়ক অনন্য প্রতিষ্ঠান
মরুভূমির ঝড় (সাইমুম)।
নিরন্তর শুভকামনা রইলো
সাইমুম এর জন্য।
নেক হায়াত কামনা রইলো muktibuli.com এ
লেখার জন্য ধন্যবাদ অফুরন্ত সুমাইয়া সুলতানা তামিমা।