সৈয়দ আলী আহসান: অনন্য এক মনীষী

ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান ।।

আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের   অনন্য সাধারণ এক মহা মনীষীর নাম  সৈয়দ আলী আহসান। একাধারে  আধুনিক কবি , মেধাবী সমালোচক, প্রখর শিল্পবোদ্ধা, শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং আধুনিক বাংলা গদ্যের নিপুণ কারিগর তিনি।  ইংরেজী সাহিত্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও আজীবন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন সুদীর্ঘকাল। অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন বাংলা গদ্যে রচিত তাঁর  কতিপয় রচনায়।

শিক্ষা সমাপ্তির পর কলকাতায় শুরু করেন সাহিত্য সাধনা ও চাকুরি জীবন। আধুনিক বাংলা কবিতার পাশাপাশি লিখেনঃ বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, আধুনিক কবিতাঃ শব্দের অনুষঙ্গে, রবীন্দ্রনাথঃ কাব্যবিচারের ভূমিকা, জীবনের শিলান্যাস ও মহানবী (স.)। এসব গ্রন্থে  আধুনিক বাংলা গদ্যের বিস্ময়কর উৎকর্ষতা ফুটে ওঠেছে চমৎকার ভাবে এবং মাধুরী মন্ডিত ভাষায় ও উৎকৃষ্ট শৈলীতে।

চল্লিশের দশকে কলকাতায় আর্বিভাব ঘটেছিলো কতিপয় আধুনিক কবির- যাঁরা আধুনিক বাংলা কাব্যে নব এক জীবন জিজ্ঞাসা, প্রগতিবাদ এবং নাস্তিকতার চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ের বাইরে অবস্থান করে এঁরা কাব্য জগতে আবির্ভূত হন। ইতোপূর্বে পুটুজিবাদী ধ্যান ধারনা পরিহার করে সমাজতান্ত্রিক তথা কম্যুনিস্ট চিন্তা চেতনার নিরিখে সব কিছু তথা জীবন ও জগতকে ঢেলে সাজানোর আকুতি নিয়ে এঁরা কলমী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। চমকও সৃষ্টি করেছিলেন খানিকটা। এঁদের পুরো ভাগে ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণুদে ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এঁরা সৈয়দ আলী আহসান ও ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবিদের তাঁদের মেধা ও রচনা কুশলতায়  চমৎকৃত ও বিস্ময়াভূত করেছিলেন। কিন্তু এঁরা  যখোন নাস্তিকতাকে  তাঁদের প্রবৃত্তির আদর্শ করেছিলেন, সাহিত্যের লক্ষ্য বস্তু বানিয়েছিলেন বস্তুবাদী মতাদর্শ প্রচার – প্রসারের তখোন সৈয়দ আলী আহসান ও ফররুখ আহমদরা এঁদের পথ ও মতের বিপরীত মেরুতে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সংগত কারণেই। কারণ এঁরা অর্থাৎ সৈয়দ আলী আহ্সান ও ফররুখ আহমদরা পূর্বাহ্নেই হেরার রাজতোরণের দিকে দৃষ্টি ও হৃদয় নিবদ্ধ করেছিলেন আদর্শিক ভাবেই।  মস্কো- পিকিং নয় মক্কা-মদীনার জ্যোতি এঁদের চোখ ও মনকে মুগ্ধ-অভিভূত করেছিল।  তাই এঁরা লিখলেনঃ চাহার দরবেশ, সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরা।

বর্তমান নিবন্ধকারের কাছে লিখিত একপত্রে মনীষী সৈয়দ আলী আহসান লিখেনঃ একসময় কলকাতায় যখন সুধীন্দ্র নাথ দত্ত , বিষ্ণুদে প্রমুখ কবি নাস্তিকতাকে তাঁদের প্রবৃত্তির আদর্শ করেছিলেন তখনই আমার মনে একটি বিরুদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল। আমি এঁদের উভয়কেই জানতাম এবং উভয়ের মেধা এবং রচনা কুশলতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল কিন্তু তাঁদের বিশ্বাসহীনতা আমাকে খুব পীড়িত করত।  বলা যেতে পারে তাঁদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদের ইচ্ছায় আমরা অর্থাৎ আমি  ও ফররুখ সত্য ও বিশ্বাসকে প্রকাশ করার অঙ্গীকার করেছিলাম।’

মনীষী সৈয়দ আলী আহ্সান পৃথিবীর অনেক দেশ-জাতির লীলা কেন্দ্র গুলো, বিশেষ করে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান গুলো ব্যাপকভাবে ঘুরে ফিরে অবলোকন করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলোর পুরোধা বৃন্দের সঙ্গেঁ সখ্য স্থাপন করেছিলেন। অত্যন্ত কাছ থেকে এঁদের জীবন ও জীবিকার হালচাল এবং মননের গভীরে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সৈয়দ আলী আহ্সানরা এঁদের ব্যক্তিত্বের বিভায় বিমুগ্ধ হয়েও মন্ত্র মুগ্ধ হননি মোটেই। তাঁদের জীবন পদ্ধতি ও জীবনদর্শনের কাছে আত্মসর্ম্পিত হন নি। বরং হেরার রাজতোরণের সম্মুখে সর্মপিত হয়েই লিখলেনঃ হে প্রভু আমি উপস্থিত, ‘মহানবী (স.) নামক অসামান্য সব রচনা সম্ভার।

মনীষী সৈয়দ আলী আহসান সত্য কে আকড়ে ধরে ছিলেন সেই  কৈশোরেই। সুফী পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী সৈয়দ আলী আহসান মানব জীবনে সত্য-সুন্দরের প্রকাশকে সর্বদাই অগ্রাধিকার দিয়েছেন । জীবনের নানা ক্ষেত্রে ও স্থানে তাঁকে কর্মরত থাকতে হয়েছে। নানা ধরন ও আদর্শের মানব মন্ডলীর সঙ্গে সর্ম্পক স্থাপিত হয়েছিল তার। সকলের মাঝেই সত্য- সুন্দরের বিভা খুঁজে ফিরেছেন আমৃত্যু ।

একসময় তাঁর ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনকে ঘিরে কিছু লোক অনেক কটু-কাটুব্যও করেছিলেন কিন্তু তিনি সর্বদা অটল থেকেছেন তাঁর পথ ও মতে। এসব ক্ষেত্রে তিনি একমাত্র আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন রাসূল আকরাম (স.) কে। মনীষী সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন অসাধারণ মেধাবী । প্রখর মেধা শক্তি ব্যবহার করে মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও প্রায় পাঁচ-ছটি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করে, অনেক ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। বিশ্ব সাহিত্যের মূল্যবান ও প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলী তিনি নিবিষ্ট মনে পাঠ করেন এবং সাহিত্যের রস গ্রহণ ও আনন্দ উপভোগ করেন। বিচিত্র বিষয়ে জানার ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের প্রণোদনা তাঁকে একদেশ থেকে অন্য দেশে টেনে নিয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবে নানা শ্রেডুর গুণীজন, প্রাজ্ঞ মনীষী গণের সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছেন। যুগ ও কালের ব্যবধানে কাউকে তিনি মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছিলেন, আবার কাউকে বেমালুম ভুলেও গিয়েছেন। কিন্তু কদাচিৎ স্মরণের পর্দায় কারো ছবি স্মৃৃতি ভেসে ওঠা মাত্র- তাঁর সম্পর্কে দু’চার কলামে তার ভালো লাগা ও  মন্দ লাগার বিষয়টা লিপিবদ্ধ করে গেছেন।  এইযে, কৃজ্ঞতাবোধ এইটে মনীষী সৈয়দ আলী আহসানের বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য। যা সচরাচর দেখা পাওয়া দুর্লভ আমাদের এই অকৃতজ্ঞ ও স্বার্থপরতার কালো পর্দায় আপাদমস্তক আবৃত পলিমাটির এই  দেশে।

মনীষী  সৈয়দ আলী আহসান জীবনে অনেক ভাষা ভাষী অনেক গুণী জনের  নৈকট্য লাভ করেছেন বটে,  মিশেছেন নিবিড় ভাবেও। কিন্তু কারো দ্বারাই বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে  খোল – নলচে পালটে ফেলেননি কোনোদিন। জীবনের যৌবনারম্ভে যে প্রত্যয়ের প্রতি তিনি প্রতীতি প্রকাশ করেছিলেন – ‘ইসলামের মূল প্রজ্ঞায় প্রত্যাবর্তন’ এবং ‘ইসলামের প্রথম যুগের সৌরভের কাছে আতœসর্¤úনই’ তাঁকে এক স্থির লক্ষের পানে ধাবিত করেছে সারাটি জীবন। এক্ষেত্রে মনীষী  সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন নিতান্ত নিরাপোস। শাশ্বত সত্যের লক্ষ্যা ভিসারী, রাসুল প্রেমিক, বিশ্ব নিয়ন্তার একান্ত বাধ্যগত বান্দা।

অন্যদিকে আমরা লক্ষ করি কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবি নিজেদের ক্ষুদ্র মেধা ও মননকে পুজি করে পদ ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে বিশেষ বিশেষ সুযোগ ও সুবিধার স্বাদ গ্রহণে প্রবল ভাবে উদগ্রীব। বিবেক বর্জিত ভূমিকা গ্রহণে সর্বদা আগুয়ান এবং স্বার্থ উদ্ধারে মুক্তকচ্ছের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে কখনো পিছপা হন্না বরং যতোধরনের নিম্মস্তরের  তদবীর ও লবিং এর প্রয়োজন তা করতে উদভ্রাত্তের মতো আচরণ করেন।

মনীষী  সৈয়দ আলী আহসান কর্ম জীবনে যতো রকম পোষ্ট- পজিশন  পেয়েছেন যতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, সেসব তিনি তাঁর প্রখর মেধা ও অসাধারণ যোগ্যতার বলেই পেয়েছেন। সেখানে তেমন দতবীর ও তোষামদের প্রয়োজন পড়েনি।

অথচ  দীর্ঘকাল এ মহান মনীষীর বিরুদ্ধে একদল অপরিণামদর্শি সুচতুর মানুষ, এক শ্রেডুর পরগাছা বুদ্ধিজীবি কতোনা কটুবাক্য উচ্চারণ করেছেন, কতোভাবে না  তাঁকে অপমানিত করবার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন তার কোনো ইয়াত্তা নেই।

মনীষী সৈয়দ আলী আহসান সারা জীবন ঐসব তথাকথিত ‘মহাজনদের’ কোপানলে পড়ে অনেক মর্মপীড়া অনুভব করেছেন। ব্যথিত চিত্তে – মর্মবেদনায় সীমাহীন কস্ট ভোগ করেছেন; তবু ঐসব মেধাশূণ্যদের দাপট ও প্রভাবের নিকট মাথা নত করেন নি কোনো দিন। কেননা তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল, পরমত সহিষ্ণু এবং প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মর্দে মুমিন; যাঁর মাথা শুধু মাত্র অবনত হতো সেই মহান মাওলার সমীপে – যিনি সকল শক্তি ও সামর্থের একমাত্র উৎস ও আধার।

কুপমন্ডকরা তাঁকে ছোট করতে চেয়েছেন বার বার , দুর্নাম রটিয়ে কর্তা ব্যক্তিদের চটিয়ে তাঁকে খাটো করে ফায়দা লুটতে চেষ্টিত হয়েছেন। কিন্তু তেমোন সফল হননি।  সৈয়দ আলী আহসানরা মনীষার বরপুত্র হয়েই জন্মেন এবং জীবন ব্যাপী সেই মনীষার আলোক ছটায় শুধু স্বদেশ নয় ; পুরো বিশ্বকেই উদ্ভাসিত করে বিশ্ববরেণ্য হয়ে যান। এরা কালিক হয়েও চিরকালীন এবং  দৈশিক হয়েও বৈশ্বিক রূপে বরিত হন। এমন বিরল প্রতিভার জন্ম সব শতকে হয়না বরং কয়েক শতকের ব্যবধানে এঁরা আবির্ভূত হন দেশ-জাতি তথা বিশ্বের সমূহ কল্যাণের নিমিত্তে। এঁরা আঘাত প্রাপ্ত হন কিন্তু প্রত্যাঘাত করেন না কাউকে। সে শিক্ষা তাঁরা পান না। সৈয়দ আলী আহসানরা জীবনের সকল স্তরে এমন মহৎ চরিত্রের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন বলেই মনীষা তাঁদের জীবনের জ্যোতি হয়ে যায়। যে জ্যোতি তাঁদেরকে পিচ্ছিল – বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকা পালন করে।

স্বার্থান্ধ, পরশ্রীকাতর, পরমত অসহিষ্ণু, চরম বিদ্বেষ পরায়ন ও অকৃত্রিম অকৃতজ্ঞ মানুষের পদভারে পৃথিবী যখন ভারাক্রান্ত মনীষী আলী আহসানরা তখন দু:খ বেদনা অকপটে হজম করে প্রকৃত মানুষের অন্তর জয় করেই স্বদেশ , স্বজাতি ও বিশ্বকে বিস্ময়কর অবদানে সুশোভিত করে না ফেরার দেশে গমন করেন।

তথ্যসূত্র: মুক্তবুলি নবম সংখ্যা, প্রকাশকাল- জুলাই ২০১৯

 

ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান

সাবেক সহকারী অধ্যাপক, দৌলতখান সরকারি আবু আব্দুল্লাহ কলেজ

দৌলতখান, ভোলা। ০১৭১২৯৮৪০৯৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *