স্বাধীনতার ৫২ বছর : কোথায় দাড়িয়ে আমরা

আহমেদ বায়েজীদ ।।
এক
মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট এক দেশ কাতার। তবে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর একটি। সেটি যেমন অর্থনৈতিকভাবে, তেমনি ভূরাজনৈতিক ভাবেও। কয়েকটি উদাহরণ দিলে কাতারের বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তার আগে বলে নেই, কাতারের মোট আয়তন ১১ হাজার ৫৮১ বর্গকিলোমিটার।
আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে, বরিশাল বিভাগের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৫ বর্গকিলোমিটার। না জানলেও ক্ষতি নেই, তবে জেনে রাখুন আয়তনে আমাদের বরিশাল বিভাগের চেয়েও ছোট কাতার। সৌদি আরবের পূর্ব উপকূল থেকে আরব উপদ্বীপের যে অংশটা পারস্য উপসাগরের মধ্যে ঢুকে গেছে সেটা নিয়েই গঠিত হয়েছে কাতার রাষ্ট্রটি।
ভৌগলিক দিক থেকেও যে কাতার খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে তা বলার সুযোগ নেই। তিন দিকে পারস্য উপসাগর, আরেক দিকে সৌদি আরবের সাথে স্থল সীমান্ত। সৌদি ভূখন্ড ব্যবহার না করে দেশটি স্থলপথে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে না। পারস্য উপসাগরের অপর পাড়ে ইরান- যাদের সাথে কয়েক দশক ধরেই চলছে আরবদের বৈরীতা। কাতারের স্থানীয় জনসংখ্যা তিন লাখের কিছু বেশি।
কিন্তু আয়তন, জনসংখ্যা কিংবা ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা কাতারকে আটকে রাখতে পারেনি। দেশটির বয়সও খুব বেশি নয়। ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কাতার স্বাধীনতা পেয়েছে ব্রিটিশদের কাছ থেকে। তবে এরই মধ্যে তারা পৌছে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির শীর্ষ সাড়িতে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলা আফগান যুদ্ধে তালেবান ও মার্কিন বাহিনীর মধ্যে মধ্যস্ততা করেছে কাতার। আরব বসন্তের পর আরব বিশ্বে যে রাজনৈতিক তোলপাড় হয়েছে সেই পরিস্থিতিতেও মাধ্যস্ততার দায়িত্বটা সামলেছে দেশটি।
এত ছোট একটা দেশ হয়েও বিশ^কাপ ফুটবরের মতো মেগা ইভেন্ট আয়োজন করেছে তারা। এসব কাজ শুধু অর্থ থাকলেই হয় না, দরকার সাংগঠনিক ও কূটনৈতিক দক্ষতা। ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কাঠামো তারা এতটা উন্নত করেছে বলেই দেশটিতে এখন স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিদেশী নাগরিক। যারা ব্যবসায় কিংবা চাকরির জন্য দেশটিতে থাকছেন।
২০১৫ সালে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ৪টি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ কাতারের ওপর সব ধরণের অবরোধ আরোপ করেও টলাতে পারেনি। উল্টো বড় দেশগুলোকেই শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হয়েছে কাতারের দৃঢ়তার কাছে।
এটি ঠিক যে, কাতারের প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে প্রচুর। রাশিয়া ও ইরানের পর বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে দেশটিতে; কিন্তু সম্পদ থাকার পরও মাথা তুলে না দাড়ানোর উদাহরণ এই বিশ্বে অনেক আছে।
দুই
কাতারের না হয় প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, সিঙ্গাপুরের তো সেটাও নেই। আয়তন, জনসংখ্যা ও বয়সের দিক থেকেও সিঙ্গাপুর খুব বেশি শক্ত অবস্থানে নেই। ১৯৬৫ সালে দেশটি মালয়েশিয়া থেকে পৃথক হয়ে সিঙ্গাপুর নামে স্বার্বভৌম দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সে হিসেবে সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের বয়স ৫৮ বছর।
১৯৬৫ থেকে ১৯৯৫ এই ৩০ বছর সময়কে ধরা হয় সিঙ্গাপুরের উন্নয়নের সময়। এই তিন দশকে দেশটির মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) হু হু করে বেড়েছে, সেই সাথে পাল্টে গেছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। শাসকদের কৌশল, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আর নাগরিকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ছোট্ট দেশটি আজ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি।
সিঙ্গাপুরের আয়তন ৭৩৩ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৫৬ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে আবার ৩৮ শতাংশ বিদেশী। দেশটির বর্তমান জনংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের জন্ম দেশের বাইরে। এরা বিভিন্ন দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছেন।
সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে মজবুত করেছে দেশটির বাণিজ্যখাত। মুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা দিয়ে দেশটির শাসকরা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছেন। যার ফলে বিভিন্ন দেশের ধনীরা সিঙ্গাপুরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন। ব্যবসায় বান্ধব পরিবেশ দিতে দেশটি চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেনি। ট্যাক্স মওকুফ, নিরাপত্তা, আইনি জটিলতা হ্রাস করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সিঙ্গাপুর। সেই সাথে দুর্নীতি, অর্থপাচার, ঋণখেলাপির মতো অপরাধগুলো দমনে নিয়েছে কঠোর অবস্থান। দুর্নীতি দমন সূচকে বিশ্বে সিঙ্গাপুরের অবস্থান ৫ নম্বরে। যার ফল তারা হাতে নাতেই পেয়েছে।
শুধু বিদেশি বিনিয়োগই নয়, বিদেশি দক্ষ কর্মীদেরও তারা বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে টেনে নিয়েছে। আর দিয়েছে পরিবহনসহ সব ধরণের অবকাঠামোগত সুবিধা। ফলস্বরূপ জিডিপি পার ক্যাপিটা হিসেবে সিঙ্গাপুর বিশ্বে তৃতীয়, আর এশিয়ায় প্রথম অবস্থানে।
তিন
রাষ্ট্র হিসেবে মালয়েশিয়ার ইতিহাসও খুব বেশি পুরনো নয়। ১৯৬৩ সালে আধুনিক মালয়েশিয়া রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু। দেশটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি রাজ পরিবার, যাদের আবার রয়েছে নিজস্ব এলাকা। এসব এলাকার সমন্বয় করেই গঠিত হয়েছে মালয়েশিয়া দেশটি। এছাড়া মালয় ও চীনা- প্রধানত এই দুটি জাতিতে বিভক্ত দেশটির জনগন। আছে আরো বেশ কিছু জাতি-উপজাতি।
এসব সত্ত্বেও দেশটির অভ্যন্তরীণ সঙ্কট মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। বহুজাতি ও বহু সংস্কৃতির মিশেল দেশটির অগগ্রতিতে বাধা হতে পারেনি। বরং সবাই মিলেমিশে মালয়েশিয়াকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে কাজ করছে। জাতি বা গোষ্ঠিগত বিভক্তির কারণে বিশ্বে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাষ্ট্র অনেক আছে; কিন্তু মালয়েশিয়া তাদের সবার জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যার ফলে এক সময়ের কৃষিনির্ভর মালয়েশিয়া আজ শিল্প ও বাজার অর্থনীতিতেও উঠে এসেছে উপরের দিকে।
প্রাকৃতিক সম্পদকে যেমন দেশটি কাজে লাগিয়েছে, এর পাশপাশি পর্যটন, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, শিল্পসহ সব খাতেই পরিকল্পনার ছাপ ছিলো দেশটিতে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে এবং বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোক আকৃষ্ট করতে দেশটি অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। সেই সাথে ছিলো পরিবহন, বিদ্যুৎ, জ¦ালানীসহ সব সেক্টরে ব্যবসায় বান্ধব পরিবেশ এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে মালয়েশিয়ার উন্নয়নে।
দেশটির উন্নতির পথে হাঁটার জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয়া হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মাদকে। ১৯৮০ ও ’৯০ এর দশকে তার সময়েই মালয়েশিয়ার অর্থনীতি গতি লাভ করে। ১৯৯০ এর দশকে টানা ৮ বছর মাহাথির সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম, যিনি বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী। বিশেষজ্ঞদের মতে, আনোয়ার ইব্রাহিমের আর্থিক নীতিই মালয়েশিয়াকে বদলে দিতে ভুমিকা রেখেছে।
চার
স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করছি আমরা; কিন্তু কাঙ্খিত সফলতা পাইনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশ গঠিত হয়েছে- সেটি শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পার করে যৌবনেরও অনেকগুলো বছর কাটিয়ে ফেলেছে। তবুও আমারা উন্নত দেশের সারিতে যেতে পারিনি।
প্রাকৃতিক সম্পদ হয়তো আমাদের খুব বেশি নেই; কিন্তু যেটুকু আছে সেটিও সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়নি। আমাদের আছে পর্যটন সেক্টরে বিশাল সম্ভাবনা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। আছে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, পার্বত্য চট্টগ্রাম। আরো আছে হাওর, বিলসহ অনেক সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট। এ সেক্টরটিতে আমরা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো ব্যবস্থাপনা দাড় করাতে পারিনি।
আমাদের আছে বিশাল জনসংখ্যা। অতিরিক্ত জনসংখ্যা যে কোন সমস্যা নয়, তার প্রমাণ হিসেবে চীন আমাদের সামনে আছে। যদিও বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপ দেয়ার সন্তোষজনক পরিকল্পনা স্বাধীনতা পরিবর্তি সময়ে দেখা যায়নি।
আর্থিক সেক্টরে অনিয়মটাকেই অগ্রগতির বড় বাধা মনে করেন অনেকে। প্রতি বছর পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। লন্ডন, দুবাই কিংবা টরেন্টোতে বাড়ি ও সম্পত্তি কেনার তালিকায় বাংলাদেশীদের নাম উপরের দিকে ওঠার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে পাওয়া যায়।
গত ৫২ বছরে সস্তা ও সহজলভ্য শ্রম থাকার পরও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের খুব একটা আকর্ষণ করেনি বাংলাদেশ। এমনকি আমাদের দেশের মেধাবীদের বড় একটা অংশও প্রতিবছর বিদেশে স্থায়ী হচ্ছে। পড়াশোনার জন্য গিয়ে দেশে ফেরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে তারা। দুর্নীতি পরায়ন দেশের তালিকায় আমাদের অবস্থান উপরের দিকে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাতেও জটিলতা আর অনিয়ম পরিণত হয়েছে নিয়মে।
এসব কিছুই আমাদের সামনে বাঁধা। এর জন্য দায় কারো একার নয়। সবাইকে সম্মিলিতভাবে এই বাঁধা টপকে এগিয়ে যেতে হয়। তবে নেতৃত্বটা দিতে হবে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের। অন্যদের নিজ নিজ জায়গা থেকে তাদের সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। ##

আহমেদ বায়েজীদ, কন্টেন্ট রাইটার, বিডি ভিউজ

One comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *