১৯৯০ সালে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। প্রথমে ডিগ্রি হোস্টেলের পশ্চিম ব্লকের ১১০ নম্বর রুমে, পরবর্তীতে ২০২ এবং ৩০৮ নম্বর রুমে অবস্থান করি অতিথি বোর্ডার হিসেবে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম দিকে ডিগ্রি হোস্টেল ছাত্রদের বিবাদমান দু’টি গ্রুপের মধ্যে রাজনৈনিক কোন্দলের কারণে হোস্টেল ছেড়ে মেসে ওঠাই সমীচীণ মনে করি। তখন কলেজ অ্যাভিনিউ’র পূর্ব মাথায় মির্জা আবদুর রব মোল্লার মেসে (রব মোল্লার মেস নামে পরিচিত) আমার এক মামা মশিউর রহমানের মাধ্যমে উঠে গেলাম। পড়া-শোনার উপযোগী নান্দনিক এ মেসটির দু’টি ব্লকের পশ্চিম ব্লকের ১১ জন বোর্ডারের মধ্যে আমিসহ প্রায় সকলেই ছিলাম অনার্স প্রথম/দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এম. কামাল হোসেন (অধূণা কামাল আহসান) একমাত্র ডিগ্রি পাস কোর্সের ছাত্র ছিলেন। আমি মশিউর রহমানের ভাগ্নে হওয়ার কারণে সবাই আমাকে ভাগ্নে হিসেবেই মনে করত, আর সেই সুবাধে কামাল আহসান আমাকে মামা ডাকতো।
আমি সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীণ থেকেই অল্প-স্বল্প লিখতাম। সামান্য লেখা-লেখির চেয়ে পড়ার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল আমার। বরিশাল বি.এম কলেজে ভর্তি হওয়ার অনেক আগে কবি আল-হাফিজ এর সম্পাদনায় বরিশাল থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা সৌরভে আমার সর্বপ্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে ঐ সংখ্যায় কবি-ছড়াকার হারুন আল-রাশিদের একটি লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর বি.এম কলেজে ১৯৯০ সনে অনার্স ভর্তি হওয়ার পর কবি আল-হাফিজ এবং নয়ন আহমেদের আরো কাছাকাছি আসার সুযোগে কবিতার উর্বর জমির সন্ধান পেয়ে যাই হাতের নাগালেই। ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি এক ধরণের ভালোবাসা এবং হৃদয়ের টান অনুভব করতাম। ধীরে ধীরে কবিতার মসৃণ পথে হাটতে হাটতেই কবি নয়ন আহমেদ আর আল হাফিজের হাত ধরেই আবিস্কার করি বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ‘শেকড়’ সাহিত্য সংসদকে।
কবি নয়ন আহমেদ ‘শেকড়’ সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি আল হাফিজ সম্পাদক। প্রতি শুক্রবার বিকাল চারটায় এ.কে স্কুলের মাঠে তুল-তুলে সবুজ ঘাসের বিছানায় অনুষ্ঠিত হতো ‘শেকড়’ সাহিত্য সংসদের প্রাণবন্ত সাহিত্য আড্ডা। বরিশালের নবীন-প্রবীণ কবি সাহিত্যিকদের মিলন মেলায় পরিনত হতো আড্ডাস্থল। কবিতা পাঠ, পঠিত কবিতার উপর আলোচনা, সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনাই ছিল আড্ডার মূল অনুসঙ্গ। কখনো এ. কে স্কুলের মাঠ আবার কখনো এ. কে স্কুলের ছাদ আবার কখনো সুবিধাজনক অন্য কোথাও সাহিত্যের প্রাণবন্ত আড্ডায় কাটে প্রতিটি শুক্রবার। আড্ডা শেষে বিবির পুকুর পাড়ে ফারুকের চায়ের দোকানে চায়ের আড্ডার মাধ্যমে যবনিকা ঘটতো প্রতিটি সাহিত্য আড্ডার।
প্রতি বৃহস্পতিবার সাহিত্য সংগঠন ‘অক্ষর’ এর সাহিত্য আড্ডা হতো বর্তমান অমৃত লাল দে’ কলেজের বিপরীত দিকের ‘অক্ষর’ এর অস্থায়ী কার্যালয়ে। কবি হেনরী স্বপন, সাঈদ র’মান, তপঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন এ আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। আর আমরা নবীনরা ছিলাম এ আড্ডায় কবিতার সতীর্থ পাঠক। এভাবেই প্রতি বৃহস্পতি-শুক্রবার সাহিত্য আড্ডায় মেতে উঠি। মেসে গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত লেখা-লেখির রিহার্সাল আর পড়া-শোনায় সময় কাটে বেশ ভালোই। কবি কামাল আহসানের অনুসন্ধিৎসু মন দৃষ্টি এড়োয়নি আমার প্রতি বৃহস্পতি এবং শুক্রবারের আড্ডা থেকে। কামাল একদিন আমাকে বলে বসলো মামা আমি আপনার সাথে ‘শেকড়ের’ আড্ডায় যাবো। প্রথমে ‘শেকড়’ তারপর ‘অক্ষর’ এর আড্ডায় কামাল আহসানের অভিষেক ঘটে। কবি নয়ন আহমেদ এবং আল-হাফিজের সাথে ‘শেকড়ের’ নবাগত সদস্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেই কামাল আহসানকে। সেই শুরু। আর পিঁছু ফিরে তাকাতে হয়নি কামাল আহসানকে।
কামাল আহসান এভাবেই সাহিত্য আড্ডায় হয়ে ওঠে নিয়মিত। ধীরে-ধীরে লেখা নিয়ে আসতে শুরু করে। কবিতা পাঠ করতাম আমরা সবাই। পঠিত লেখার উপর বরাবরই আলোচনা করতেন কবি নয়ন আহমেদ, কবি আল-হাফিজ। কবি নয়ন আহমেদের কবিতার আলোচনায় মনে হতো তিনি কবিতায় কতোটা সাবলীল এবং প্রাজ্ঞ! কী চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিতেন কবিতার ভুল-ত্রুটি, অসঙ্গতি।
আল-হাফিজ কবিতার আলোচনায় ছিলেন গুরুগম্ভীর। আমরা তটস্থ থাকতাম কবি আল-হাফিজের কবিতার আলোচনার সময়। তার আলোচনা বরাবরই কড়া হতো। কবিতার আলোচনায় কখনোই কাউকে কোন ছাড় দিতেন না নব্বই দশকের এই মেধাবী কবি। আমার মনে আছে কামাল আহসানের একটি কবিতার আলোচনায় কবি আল-হাফিজ কড়া মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন ‘কামাল এটা কবিতা, না কী গবিতা’? কবি আল-হাফিজের একই কথা, যদি তোমাকে কিছু লিখতেই হয়, তাহলে সে লেখাটি যেন হয় সময়ের বিচারে সেরা এবং মানোত্তীর্ণ। এ কড়া এবং তীর্যক মন্তব্যটিই পরবর্তীতে একজন অপেক্ষাকৃত দূর্বল কামাল আহসানকে একজন শক্তিশালী কামাল আহসানে পরিণত করতে সহায়তা করেছিল। যার জ্বলন্ত স্বাক্ষী আমি নিজেই।
সেই থেকে কামাল আহসানকে দেখেছি একটি মান সম্পন্ন লেখার জন্য কী প্রানান্তকর চেষ্টা! কোন লিটলম্যাগ কিম্বা কবিতার বই পড়ার সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কবিতার শব্দ চয়ন, কবিতার ভাব এবং বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে তার একটি নান্দনিক আলোচনা উপস্থাপন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন খুব কম সময়ে। ‘শেকড়’ সাহিত্য সংসদের নিয়মিত এবং মূখ্য আলোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে খুব বেশী সময় লাগেনি কবি কামাল আহসানের। ‘শেকড়’ সাহিত্য সংসদের নিয়মিত মুখপত্র ‘শেকড় সাহিত্য পত্রিকার’ বেশ কয়েকটি সংখ্যার সম্পাদনা করেছিলেন কামাল আহসান। তার নিখুঁত সম্পাদনায় ‘শেকড়’ এর প্রতিটি সংখ্যায় নান্দনিকতার ছাপ লক্ষ্য করেছি। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কামাল আহসান।
এমনও দেখেছি কবি কামাল আহসান সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছেন পড়া-শোনায়। বেশীর ভাগ সময়ই সেটা ছিল কবিতার বই। কবিতার পাশাপাশি গল্প এবং গদ্যেও কামাল আহসান ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মনে হতো কামাল আহসান পড়াশোনায় কারো সাথে যেন প্রতিযোগীতায় প্রথম হওয়ার দৌড়ে টিকে থাকার জন্য একটা সম্মুখ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সদ্য প্রয়াত এ তরুন কবি অল্প সময়ের ব্যবধানে কবিতার মত একটি জটিল শিল্পকে আয়ত্ত্ব করতে পারঙ্গমতা দেখিয়েছিলেন ঈর্ষণীয়ভাবে।
কবি কামাল আহসান কবিতায় ছন্দ এবং গদ্যে ছিলেন সমান পারদর্শী। তার কবিতা পড়লে পাঠক মাত্রই তা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও এ মেধাবী কবি যে শিল্পবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন তা বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কবি কামাল আহসানের গদ্য বোদ্ধা পাঠক মহলে তুমূল প্রশংসা কুড়িয়েছে, এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তার প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘প্রণয়দষ্টিতা’ এবং প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘আহসান জেনে গেছে বরফের ছল’ বই দু’টি প্রকাশের সাথে কবি নয়ন আহমেদ, কবি আল-হাফিজ এবং আমার মত অধমের উৎসাহ আর প্রেরণা স্মৃতি হিসেবে আজো হৃদয় মন্দিরে গেঁথে আছে। কবি কামাল আহসানের এ দু’টি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে তাকে অমর করে রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ঢাকার শাহবাগ, মগবাজার, আজিজ সুপার মার্কেটসহ দেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল সাহিত্য আড্ডার সাথে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। সাহিত্য আড্ডার ব্যাপারে বরাবরই উদার মানসিকতা পোষণ করতেন কবি কামাল আহসান। কামাল আহসানকে আপাদমস্তক একজন বিশ্বাসী কবি হিসেবেই আমরা জানি। সত্য, সুন্দর, একেশ্বরবাদ,পরকাল, নবী-রাসুল, দেশপ্রেম এবং প্রেম-ভালোবাসার মতো ইতিবাচক বিষয়-আসয়ই ছিল এ কবির লেখার মূল অনুষঙ্গ।
অত্যন্ত সাদা-মাঠা জীবন যাপনে অভ্যস্থ কবি কামাল আহসান ছিলেন নিরহঙ্কারী এবং নির্লোভ। উচুঁ মানসিকতার এ মানুষটি জানতেন একজন মানুষকে নিমিষেই আপন করার যাদুকরী কৌশল। তার অনেক গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় এ গুনটি তার বন্ধু-স্বজনদের আজো কাঁদায়।
বাউলিয়ানা স্বভাবের এ কবির দরাজ কন্ঠের গান বিমুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। অবশ্য পরে শুনেছি বেশ কিছু গানও তিনি লিখেছেন। সদ্য গঠিত কবি কামাল আহসান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তার সকল রচনাকে একত্রিত করে কবি কামাল আহসান রচনা সমগ্র বের করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা প্রদানে সচেষ্ট থাকব ইনশাআল্লাহ।
অতি অল্প বয়সেই কবি কামাল আহসান আমাদের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের আসনটি শুণ্য করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমরা এ বিশ্বাসী কবির রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ পাক কবি কামাল আহসানের ভালো কাজগুলোর উছিলায় তাকে মাফ করে জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। কবি কামাল আহসানের স্ত্রী এবং একমাত্র আদরের কন্যা সদা ভালো থাকুক এ দোয়া করছি। কবির রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ গুলোকে সু-সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেবে তার সাহিত্য অঙ্গনের ভালোবাসার সহযোদ্ধারা, তাহলেই তাকে ভালোবাসা হবে, মূল্যায়ন করা হবে তার কাজের।
.
.