হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীতে আমি…

আযাদ আলাউদ্দীন

১৯৯৯ সালে বিএম কলেজের বাংলা বিভাগে অনার্স ভর্তি হওয়ার পর জন্মস্থান ভোলা থেকে বরিশাল চলে আসি। তখন থাকতাম বরিশাল নগরীর কলেজ অ্যাভিনিউর পূর্ব মাথায় রব মোল্লার ম্যাসে। সেখানে আমার সাথে ভোলার আরো অনেকে থাকতেন। প্রতিদিন কলেজ ক্যাম্পাসে যাওয়া, ক্লাস করা, কলেজ লাইব্রেরি ও পাবলিক লাইব্রেরিতে বই, পত্রপত্রিকা ম্যাগাজিন পড়া, বিকেলে ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক হলের (মুসলিম হল) পিছনের ওয়ালের সিড়ি বেয়ে হলের ডায়নিংয়ে টিভি দেখা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়।

২০০০ সালের কোন একদিন বরিশালের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর একজন সংগঠক এলেন আমার মেসে। বললেন- আমরা শুনেছি আপনি ভোলা আলহেরা শিল্পীগোষ্ঠীর সহকারি পরিচালক ছিলেন। এখন থেকে আমাদের সাথে হেরাররশ্মিতে কাজ করবেন। আমি সম্মতি জানালাম। আমাকে ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকার জর্জবাড়িতে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হলো। সময়মতো ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি হেরাররশ্মির আরো বেশ কয়েকজন সংগঠক। অনুষ্ঠানে আলোচনার ধরন শুনে বুঝলাম এটি হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর কমিটি গঠনের অনুষ্ঠান। পরিচালক হিসেবে ঘোষণা হলো বিএম কলেজের ক্যামেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মনিরুজ্জামানের নাম (বর্তমানে তিনি ইসলামী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার)। একটু পরেই সহকারি পরিচালক হিসেবে ঘোষিত হলো আমার নাম। শুরু হলো হেরাররশ্মিতে আমার পথ চলা। আমি এবং মনির ভাই দুজনই ছিলাম হেরাররশ্মিতে নতুন। পুরনো সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন মুজাহিদ আল মুসা সহ আরো অনেকে। তাদের সাথে পরামর্শ করে কাজ শুরু করি আমরা। একে একে হেরাররশ্মির জন্য বাই সাইকেল ক্রয়, ভালোমানের অডিও ক্যাসেট প্লেয়ার কেনা, বইপত্র এবং প্রকাশনা সংরক্ষণের জন্য শো-কেস ক্রয়সহ আত্ননির্ভরশীল সংগঠন হিসেবে হেরাররশ্মিকে দাড় করানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি আমরা।

২ বছর পর মনির ভাইর ছাত্রজীবন শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০০২ সালে পরিচালকের দায়িত্ব আসে আমার উপর। আমি হেরাররশ্মির কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য প্রথমেই অডিও অ্যালবাম বের করার উদ্যোগ নেই। উদ্দেশ্য ছিলো অ্যালবাম বের করতে পারলে এমনিতেই শিল্পীরা অ্যাকটিভ হবে এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গতিশীল হবে। তখন সিডি-ভিসিডির এতো প্রচলন ছিলো না। ক্যাসেট প্লেয়ারের ফিতাই ছিলো বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। শুরু হলো অডিও অ্যালবাম তৈরির প্রস্তুতি।

আমার সময়ের সহকারি পরিচালক ওসমান গণি ও বোরহান মাহমুদ এবং সংগীত পরিচালক মুজাহিদ আল মূসা সহ সব সংগঠকদের দায়িত্ব ভাগ করে দেই। কাউকে দেয়া হয় রিহার্সালের দায়িত্ব, কেউবা অর্থনৈতিক কালেকশন, কেউ কেউ পালন করেন অনুষ্ঠান মঞ্চের যাবতীয় আয়োজন। আমি সবচেয়ে বেশি খেয়াল রেখেছি সংগঠকদের ব্যক্তিগত মান সংরক্ষণ ও উন্নয়নের দিকে। যাতে সংস্কৃতির কাজ করতে গিয়ে কেউ যেন হারিয়ে না যায়।

আল্লাহর অশেষ রহমতে কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে আমরা সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস) থেকে আমাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বিতীয় অডিও অ্যালবাম ‘নীল আসমান’ প্রকাশ করতে সক্ষম হই। এর কিছুদিন পর সিএইচপি থেকে বের হয় কিশোর শিল্পী এনামুল হকের একক অডিও অ্যালবাম ‘সবুজের আলপনা’। বরিশাল নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলে ২০০৪ সালে এই দুটি অডিও অ্যালবামের জমকালো প্রকাশনা উৎসব করি। সাথে ছিলো হেরাররশ্মির ২ যুগ পূর্তি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ। ওই প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন- বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল হক । প্রধান আলোচক ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। ওই অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রকাশনা এখনো ফ্রেমবন্দী হয়ে সংরক্ষিত আছে বরিশাল সংস্কৃতি কেন্দ্রের দেয়ালে।

আমি তিন বছর হেরাররশ্মির পরিচালক থাকাকালে হেরাররশ্মির সবচেয়ে বড় অর্জন ছিলো সাংস্কৃতিক পরিষদ আয়োজিত ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন ২০০৪’ এ সারাদেশের শতাধিক শিল্পীগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করা। এই অর্জনের স্বীকৃতি স্বরূপ রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে হাজার হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক উৎসবে পারফরম্যান্স করার সুযোগ পায় হেরাররশ্মি। স্মরণীয় এই বিজয় অর্জনের জন্য আমি শুধু একজন পরিচালক/সংগঠক হিসেবে আমার ভূমিকা রেখেছি। মূল কৃতিত্ব ছিলো আমার হেরাররশ্মির তৎকালীন শিল্পীদের। হেরাররশ্মির সেই বিজয়ী টিমের সদস্য হিসেবে যারা ছিলেন- তাদের মধ্যে রয়েছেন- ওসমান গণি, বোরহান মাহমুদ, মুজাহিদ আল মুসা, আহমদ আল আমিন, মশিউর রহমান মামুন, এনামুল হক, মিরাজুল হক, মুন্না সিরাজী প্রমুখ। এই জাতীয় এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনের থিম সং লিখেছেন হেরাররশ্মির তৎকালীন সহকারি পরিচালক (পরে পরিচালক) বোরহান মাহমুদ। স্মরণীয় সেই দিনের একটি ছবি উৎসব পরবর্তী স্মারকগ্রন্থ ‘সংস্কৃতি’ থেকে এই লেখার সাথে এখানে তুলে ধরা হলো।

২০০৫ সালে আমার ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাই আমাকে বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্রের সহকারি পরিচালক ও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব দেন। পর্যায়ক্রমে সহকারি পরিচালক থেকে এখন পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।  সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি আমার সাংবাদিকতা পেশার কার্যক্রমও সমানভাবে অব্যাহত রাখি।

এখন কর্মজীবনে যতো ব্যস্তই থাকিনা কেন- হেরাররশ্মির কোন প্রয়োজনে ডাক পেলে- সেই ডাককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি। কারণ পরিশুদ্ধ ধর্মীয় জীবন যাপনের জন্য হেরাররশ্মি আমার এবং আমাদের সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে।

গৌরনদীর বাটাজোর শাহী পার্কে হেরাররশ্মির শিক্ষা সফরে এক ফ্রেমে আবদ্ধ হন সাবেক ৮ জন পরিচালক।

 

আযাদ আলাউদ্দীন, সাবেক পরিচালক, হেরাররশ্মি শিল্পীগোষ্ঠী, বরিশাল।

 

One comment

  1. হেরাররশ্মি তথা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য নিবেদিত এ মানুষগুলোকে আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত করুক।

Leave a Reply to শহীদুল্লাহ্ হাদী Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *