আযাদ আলাউদ্দীন ।।
চালতা পাতাকে নিয়ে গান লিখেছেন বিশ্বাসী কবি গোলাম মোহাম্মদ। তিনি লিখেছেন ‘চালতা পাতার কাজ দেখে আমি বুঝেছি/শিল্পীর চেয়ে তিনি বড় শিল্পী’। অপরদিকে চালতা ফুল নিয়ে লিখেছেন প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি তার কবিতায় লিখেছিলেন, আমি চলে যাব বলে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে…।
কবি বেঁচে না থাকলেও এই বর্ষায় তার প্রিয় চালতা ফুল ফুটে আছে। চালতা ফুল যেমন সুন্দর, তেমনি তার পাতাও। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বিষ্ণু দে তাই লিখেছিলেন, আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে/ চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে…। ভীষণ পরিচিত ফল চালতা বাংলাদেশে বহুকাল ধরে টিকে আছে। বরিশাল নগরীর উত্তর আলেকান্দায় অবস্থিত আইটি প্রতিষ্ঠান সাতরং সিস্টেমস’র বেলকনিতে দাড়িয়ে এমনই মনোমুগ্ধকর একটি চালতা গাছের চিত্র ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। চালতা পাতা, ফল, ফুল সবই যেন আকৃষ্ট করে প্রকৃতি প্রেমীদের।
চালতার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে হয়। বিশেষত এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এ কারণেই বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা। ইন্ডিকা শব্দটি ইন্ডিয়া থেকে নেয়া। আর ডিলেনিয়া নামটি নেয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত তরুবিদ জে. জে. ডিলেনিয়াসের নাম থেকে। চালতার ইংরেজী নাম এলিফ্যান্ট আপেল। বাংলাদেশে চালতাকে চালিতা-চাইলতে ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। এ গাছ আপনি বেঁচে থাকে, বড় হয়। গাছে পাকা ফল বেশিদিন থাকলে তা এক সময় ঝরে পড়ে। সেই বীজ থেকে গাছের নিচে আরও গাছ জন্ম নেয়। চালতার আয়তাকৃতি পাতার খাঁজকাটা আউটলাইন করাতের দাঁতের মতো দেখতে। ভয়ঙ্কর নয় মোটেও। মনে হয়, কেউ কাঁচি দিয়ে কেটে চমৎকার নক্সা করে দিয়েছে। পাতার শিরা উঁচু সমান্তরাল। গাছের ঘন পাতার আড়ালে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে থাকে চালতা ফুল। সাদা পাঁচটি পাপড়ি। বেশ মোটা ও মাংসল। গোলাকৃতি ফুলের পরাগকেশর অসংখ্য। সব মিলিয়ে দৃষ্টিনন্দন। এ কারণে শহরের কোন কোন উদ্যানে যত্ন করে লাগানো হয় গাছটি।
তবে চালতা মূলত বেঁচে আছে গ্রামে। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে খোঁজ করলে গাছটির দেখা মেলে। বাড়ির পেছনে ঝোপজঙ্গল ধরনের জায়গায় অযত্নে বেড়ে ওঠে চালতা গাছ। চেনাজানা গাছের সৌন্দর্য হয়ত খুঁটিয়ে কেউ দেখে না। তবে মেয়েরা সবুজ বৃতি আলাদা করে তাতে লবণ-মরিচ মিশিয়ে খায়। এই টক স্বাদের সঙ্গে শহুরেরাও অল্পবিস্তর পরিচিত বটে।
উদ্ভিদবিদদের মতে, মধ্যমাকৃতি চিরহরিৎ বৃক্ষ চালতা। উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শাখা-প্রশাখা এলোমেলো। বাকল লালচে মসৃণ। গাছের আয়ু মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর। পাতা ৮ থেকে ১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ হয়। বছরের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। ফুলের ব্যাস হয় ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। বৃতির সবুজ, দলের শুভ্রতা, পরাগের হলুদ ও তারকাবৃতি গর্ভমুল- সব মিলিয়ে চালতা ফুলের গড়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। চালতা ফুলের বৃতিই একসময় ফলে রূপান্তরিত হয়। টক স্বাদের ফল গ্রামীণ নারীরা ভীষণ পছন্দ করেন। লবণে মেখে নিয়ে গল্প করতে করতে খান। শরৎ-হেমন্ত ফল পাকার সময়। শীতকাল পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। চালতার ফল হয় টকমিষ্টি। আচার, চাটনি, টক ডাল রান্নায় ব্যবহৃত হয়। পাকা ফল পিষে নিয়ে লবণ, কাঁচামরিচ দিয়ে মেখে খাওয়া যায়। চালতার শাঁস নানা খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। জেলি ও শরবত তৈরি হয় চালতা ফল থেকে। গাছটি থেকে শক্ত কাঠ হয়। নৌকা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এ কাঠ। ব্যবহৃত হয় বন্দুকের বাঁট তৈরিতেও। এমন আরও অনেক উপকারের কথা বলা যাবে।
কিন্তু এর সৌন্দর্যগুণের কোন তুলনা হয় না। চালতা ফুলের পাপড়ির ওপর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পরে যখন, যখন বিন্দু বিন্দু জলের কণা কোমল পাপড়ির গায়ে স্থির হয়ে থাকে তখন চোখ সরানো যায় না। বর্ষা যে এসেছে, অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই ফুল তা জানিয়ে দেয়। বৃষ্টির জলে ধুয়ে সাফ প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর যারা খুঁজে বেড়ান, চালতা ফুল তাদের অভিভূত করে। বৃষ্টিভেজা সতেজ সাদা ফুল বর্ষার অমূল্য উপহার। প্রকৃতিপ্রেমীরা এই ফুলের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকেন। এই অনিন্দ্যসুন্দর সবসময় বেঁচে থাক।