সৈয়দ আবদাল আহমদ ।।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম অবশেষে জামিনে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জেল-জুলুমের শিকার হন তিনি। গত ১৭ মে সচিবালয় থেকে একটি খবর উদঘাটন করতে গিয়ে রোজিনা নিজেই দেশ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম হন।
নথি ঘেঁটে রোজিনার বের করে আনা খবরটি কী ছিল আমরা এখনো তা জানতে পারিনি। খবরটি প্রকাশের আগেই রোজিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েন। সরকারি কর্মকর্তারা তাকে স্বাস্থ্যসচিবের পিএসের কক্ষে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা করেন। পরে রাতে হাসপাতালে নেয়ার কথা বলে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়। এর আগে কর্মকর্তারা বিশেষ করে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব তার দেহ ও ভ্যানিটি ব্যাগ তল্লাশি করেন। মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। এক পর্যায়ে তার গলাও চেপে ধরা হয়। অসুস্থ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেও তাকে চিকিৎসাও দেয়া হয়নি। শাহবাগ থানায় নেয়ার পর গ্রেফতার দেখানো হয়। শত বছরের পুরনো অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টে মামলা দেয়া হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে সচিবালয়ের গোপন নথি চুরি এবং মোবাইল ফোনে ফাইলের নথির ছবি তোলার অভিযোগ আনা হয়।
রোজিনার বিরুদ্ধে মামলাটি দেয়া হয়েছে অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের ৩ নম্বর ও ৫ নম্বর এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায়। এসব ধারার ব্যাখ্যায় আইনজীবীরা জানান, অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের ৩ নম্বর ধারায় তখনই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, যখন নিরাপত্তার স্বার্থে নিষিদ্ধঘোষিত কোনো এলাকা থেকে নথি সরানোর অভিযোগ ওঠে। রোজিনার কাছ থেকে নথি জব্দ করা হয়েছে স্বাস্থ্যসচিবের পিএসের কক্ষ থেকে বলে বলা হয়। পিএসের কক্ষ নিষিদ্ধ কোনো স্থান নয়। ৫ নম্বর ধারাটি নথি যখন শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ উঠবে, তখন প্রয়োগ হবে। দণ্ডবিধির ৩৭৯ ধারাটি চুরির শাস্তি এবং ৪১১ ধারা চুরি হওয়া কোনো বস্তু কারো জিম্মা থেকে উদ্ধার করা হলে।
রোজিনার কাছ থেকে নথি পুলিশ সরাসরি উদ্ধার বা জব্দ করেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নথিটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে জানান যে, এ নথি সাংবাদিক রোজিনার শরীরে লুকানো ছিল। তার মোবাইল ফোনটিও তারাই পুলিশকে দিয়ে বলেন, এই ফোনেই ছবি তোলা হয়েছে। গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে নথি শত্রুপক্ষের কাছে তুলে দেয়ার অপরাধের কথা ৫ নম্বর ধারায় বলা আছে। কিন্তু রোজিনা একজন পেশাদার ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক। খবরের জন্য তিনি নথি দেখা বা খবরটি তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। ফলে আইনজীবীদের মতে এটা ৫ নম্বর ধারায় আমলে নেয়ার বিষয় নয়।
যে নথিকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অতি গোপনীয় বলা হচ্ছে তা গোপনীয় নয়। মানুষের এসব বিষয় জানার অধিকার রয়েছে। জব্দ তালিকায় যে নথির তালিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন-সংক্রান্ত কথাবার্তা। এতে বলা হয়, নথিতে রয়েছে জেনেভাস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের অ্যাম্বাসেডরের পাঠানো ডিও, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় চিকিৎসাসামগ্রী ও সরঞ্জাম ক্রয়সংক্রান্ত বিবরণ, মন্ত্রিসভা কমিটির জন্য সার-সংক্ষেপ এবং করোনোর টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় পরামর্শ কমিটির অনুমোদিত সার-সংক্ষেপ। আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ওইসব ডকুমেন্ট বড়জোর ওষুধ সংক্রান্ত বাণিজ্যিক চুক্তি হতে পারে। এ নিয়ে দায়ভার রাষ্ট্রের ওপর পড়ে না। এখানে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কোনো বিষয় নেই। জনস্বার্থে এসব বিষয় সংবাদ আকারে আসতে পারে।
রোজিনার মামলার এজাহার ও জব্দ তালিকার মধ্যেও গরমিল রয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে ‘অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির’ নথিপত্র পাওয়া গেছে। অথচ পুলিশের জব্দ তালিকায় ‘অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির’ নথিপত্রের বিষয়টি নেই। পুলিশ তদন্ত করে মামলা দেয়ার কথা। কিন্তু মামলাটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা করেছেন। শাহবাগ থানার ওসি মামুনুর রশীদ বলেন, এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলার ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের একটি কক্ষে আটকে রেখে একজন সাংবাদিককে হেনস্তা, গ্রেফতার, মামলা দেয়া এবং পরে জেলে নেয়ার ঘটনায় দেশ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিভিন্ন দেশের ১৩১টি সংবাদপত্রে এ নিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছে। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও সাংবাদিকদের সংগঠন ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সব সংগঠন রোজিনাকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে।
এ ঘটনা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের গুটিকয়েক লোকের কারণে সরকারের বদনাম হচ্ছে। এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। রোজিনা কী প্রতিবেদন করতে চেয়েছিলেন সে বিষয়ে না জানলেও তার মামলার এজাহার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট তিনি একটি রিপোর্টের খোঁজে ছিলেন। সেটি যে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনসংক্রান্ত কিংবা কোভিড-১৯ চিকিৎসার সামগ্রী ও সরঞ্জাম ক্রয়সংক্রান্ত তাও স্পষ্ট। তাছাড়া বিবিসিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যে বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে বিজ্ঞাপন মিডিয়ায় এসেছে তাতে স্পষ্ট সাংবাদিক রোজিনা একান্তই একটি সংবাদের জন্য কাজ করছিলেন। অর্থাৎ তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতেই সচিবালয়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিক রোজিনা তো সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে কাজ করেন না। কোন ফাইল কোথায় আছে তিনি কী করে জানবেন। সাংবাদিকরা সাধারণত তাদের বিশ্বস্ত সোর্সের মাধ্যমে গোপনীয় খবর পেয়ে থাকেন। রোজিনাও সংবাদ উপযোগী কোনো নথি পেয়ে থাকলে তা সোর্সের মাধ্যমেই পেয়েছেন। বলা হচ্ছে, পিএসের কক্ষে রাখা ফাইলের নথি তিনি চুরি করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হলে তা পিএসের উন্মুক্ত কক্ষে রাখা হয়েছে কেন? এর দায় তো রোজিনার নয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা, দেশের জন্য ক্ষতিকর ইত্যাদি বলছেন। কিন্তু তাদের জানা উচিত একজন সাংবাদিক তো রাষ্ট্রের ক্ষতির জন্য কোনো রিপোর্ট বা সংবাদ করেন না। দেশ ও জনগণের কল্যাণেই সাংবাদিকতা। সাংবাদিকরা যেকোনো রিপোর্ট কিংবা লেখালেখিও সে লক্ষ্যেই করে থাকেন। তা ছাড়া একজন রিপোর্টার রিপোর্ট দিলেই পত্রিকায় তা ছাপা হয়ে যায় না। রিপোর্টের বস্তুনিষ্ঠতা, সঠিকতা, যেসব সূত্র থেকে পাওয়া গেছে তার যথার্থতা যাচাই-বাছাই করেই তা ছাপা হয়। রাষ্ট্রের ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তাদের শুধু দায়িত্ব আছে, অন্য নাগরিকদের দায় নেই এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
সচিবালয়ে নথির খোঁজ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা
সচিবালয়ভিত্তিক রিপোর্ট কিংবা সচিবালয়ের সরকারি ফাইল খুঁজে রিপোর্ট করার বিষয় নতুন কিছু নয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা সবসময়ই এ ধরনের রিপোর্ট করে আসছেন। ঢাকায় আমার ৩৮ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন অনেক জাঁদরেল রিপোর্টারকে দেখেছি; যারা সারা দিন সচিবালয়ে পড়ে রয়েছেন। সন্ধ্যায় সংবাদপত্র অফিসে এসে রিপোর্ট করেছেন। প্রকাশিত এসব রিপোর্ট হইচই ফেলে দিয়েছে, আলোড়ন তুলেছে। এসব রিপোর্ট দেশের কল্যাণই বয়ে এনেছে। এক সময় সচিবালয়ভিত্তিক রিপোর্টে সংবাদের সাংবাদিক কাশেম হুমায়ূন, শওকত মাহমুদ, মতিউর রহমান চৌধুরী, মোনাজাত উদ্দিন, আমির খসরু, দৈনিক বাংলার জহিরুল হক, আহমেদ নূরে আলম, আবদুল খালেক, দিলীপ দেবনাথ, ইত্তেফাকের নাজিম উদ্দিন মোস্তান, বাংলার বাণী ও খবরের আশরাফ খানের খুব নামডাক ছিল। কাশেম হুমায়ূন কোনো মন্ত্রণালয়ে ঢুকলে কানাঘুষা হতো আজ কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে তিনি বের করে নিয়ে যান! সচিবালয়ে তাদের বিশ্বস্ত সোর্স থাকত। তাদের মাধ্যমেই পাওয়া যেত গুরুত্বপূর্ণ খবর। এসব সোর্সের মধ্যে সরকারের মন্ত্রী, সচিব থেকে নিচের কর্মকর্তারা ছিলেন। রাষ্ট্র এবং জনগণের স্বার্থেই তারা খবরগুলো দিতেন। নথি দেখা, নথি থেকে টুকে নেয়া কিংবা ফটোকপি করা নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। পে-স্কেল সংক্রান্ত এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট শওকত মাহমুদ তো সংবাদে কয়েকবারই করেছেন। তেমনি যৌথ নদী কমিশন সংক্রান্ত তার সাড়া জাগানো রিপোর্ট এই নথি থেকেই তো হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে তার অনুসন্ধানী সিরিজ রিপোর্ট পুলিশ বিভাগকে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল।
মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী দেশের একজন সেরা কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনেক সাড়া জাগানো রিপোর্ট নথি অনুসন্ধান করেই করেছেন। তার ‘কূটনীতির অন্দর মহল’ বইটিতে এর কিছু বর্ণনাও দিয়েছেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘ফরেন অফিস কভার করতে গিয়ে দুয়েকবার আমি সরকারি ফাইলও বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। যা আজকে বলছি, সে সময় হয়তো মনেই হয়নি যে আমার এটা নেয়া ঠিক হয়েছে কি-না। আমি একবার দুটি ফাইল নিয়েছিলাম। ফটোকপি করে আবার ফেরত দিয়েছিলাম।’
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এমন কিছু অভিজ্ঞতার কথা আমারও আছে। আশির দশকে একবার আমার কয়েকটি রিপোর্ট আলোচিত হয়েছিল। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে একবার একটি রিপোর্ট পেয়েছিলাম। একজন কর্মকর্তার ফাইলের একটি নোট দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। সেটি ছিল পরিবেশবাদী আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘গ্রিন পিস’ থেকে আসা একটি তারবার্তার সারসংক্ষেপ। এতে বলা হয়েছিল, ক্ষতিকর বর্জ্যবাহী একটি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় যাচ্ছে। বাংলাদেশের কোথাও জাহাজটি বর্জ্য ফেলতে পারে। এর মধ্যে পারমাণবিক বর্জ্যও রয়েছে। খবরটি নোট করে সাথে সাথে বিভিন্ন পরিবেশ বিশেষজ্ঞের প্রতিক্রিয়ার জন্য শরণাপন্ন হই এবং পরে দৈনিক বাংলায় রিপোর্ট করি। ছাপা হওয়ার পর হইচই বেধে যায়। পরদিন অন্যান্য পত্রিকাতেও রিপোর্টটি করা হয়। সরকার সময়মতো অ্যাকশন নেয়ায় জাহাজটি আর বর্জ্য ফেলতে পারেনি। দৈনিক বাংলায় চাঁদাবাজি নিয়ে খায়রুল আনোয়ার মুকুলের অনুসন্ধানী রিপোর্ট সাড়া জাগিয়েছিল। তেমনি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তেজস্ক্রিয় গুঁড়ো দুধের রিপোর্ট করেছিলেন দৈনিক বাংলার কৃতী রিপোর্টার আহমেদ নূর আলম। এটাও নথি থেকেই। মাসব্যাপী এ রিপোর্ট হয়। চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লি দুর্ঘটনার পর তেজস্ক্রিয় এই গুঁড়ো দুধ বাংলাদেশে ঢোকে।
নোটারি পাবলিক একশ দেড়শ টাকায় যেকোনো বিষয় নোটারি করে দেয়। এ নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় চাঞ্চল্যকর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিলেন আসিফ নজরুল। সেটি ছিল নোটারি করে বঙ্গভবন বিক্রি করে দেয়ার একটি রিপোর্ট। ড. আসিফ নজরুল এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষক। সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন এখন বিবিসিতে আছেন। তারও আছে অসংখ্য অনুসন্ধানী রিপোর্ট। বিবিসিতে তিনি নূর হোসেনকে নিয়ে একটি সুন্দর রিপোর্ট করেছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন বুকে পিঠে স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের দাবিতে লেখা স্লোগান নিয়ে এসেছিলেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে তোলা নূর হোসেনের ছবি পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তার শরীরে কে লিখে দিয়েছিল এই স্লোগান, এই তরুণ কী ভেবে সেদিন নিজের শরীরকে জীবন্ত পোস্টার করে তুলেছিলেন? ৩৩ বছর পর মোয়াজ্জেম অনুসন্ধান করে তা তুলে আনেন। পপুলার আর্টের ইকরাম হোসেন আজো আক্ষেপ করেন, নূর হোসেনের শরীরে কেন লিখেছিলেন স্লোগান, নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই তিনি দায়ী করেন।
শুধু রিপোর্ট নয়, সাংবাদিকের একটি প্রশ্নও যে একটি বড় খবর হতে পারে সে বিষয় নিয়েও অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন মোয়াজ্জেম। জেনারেল এরশাদ প্রশ্ন করার অপরাধে বাসসের সিনিয়র সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেনকে প্রথমে চট্টগ্রামে বদলি ও পরে চাকরিচ্যুত করেছিলেন। রিপোর্টটি সে বিষয় নিয়েই। এরশাদকে ৩৮ বছর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক প্রশ্ন করা হচ্ছিল, কারণ তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডেকে ছিলেন। এক পর্যায়ে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেন দাঁড়িয়ে এরশাদকে প্রশ্ন করেন- ‘মে আই আস্ক ইউ এ নন-পলিটিক্যাল কোয়েশ্চেন’ অর্থাৎ আমি কি আপনাকে একটি অরাজনৈতিক প্রশ্ন করতে পারি? জেনারেল এরশাদ খুব খুশি হন। কিন্তু যে প্রশ্নটি তাকে জাহাঙ্গীর হোসেন ছুড়ে দেন, সেটির জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। প্রশ্নটি ছিল- ‘আপনি ক্ষমতায় আসার আগে কেউ জানত না আপনি একজন কবি। এখন সব পত্রিকার প্রথম পাতায় আপনার কবিতা ছাপানো হয়। পত্রিকার প্রথম পাতা তো খবরের জন্য, কবিতার জন্য নয়। বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানেরও তো এই ভাগ্য হয়নি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনার কবিতা প্রথম পাতায় ছাপানোর জন্য কি কোনো নির্দেশ জারি হয়েছে।’
‘কবি খ্যাতি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল এক সেনাশাসক’ শিরোনামে মোয়াজ্জেমের এই অসাধারণ রিপোর্টটি বিবিসিতে প্রচার হয়েছিল। অর্থনৈতিক বিষয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন, শামসুল হক জাহিদ, বদিউল আলম, মাসুমুর রহমান খলিলী, শওকত হোসেন মাসুম, সৈয়দ শাহনেওয়াজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট করেছেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক পথিকৃৎ ছিলেন সাংবাদিক আতাউস সামাদ। তিনি সারা জীবনই এমন অসংখ্য রিপোর্ট করে গেছেন যা ছিল জনস্বার্থে, দেশের কল্যাণে। তার রিপোর্টে মহলবিশেষের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিন্তু জনস্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। রিপোর্টের কারণে জেনারেল এরশাদ তাকে জেলে ঢুকিয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের চাপে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘ওপেন সিক্রেট’ নামে অনুসন্ধানী সিরিজ রিপোর্ট করতেন সাংবাদিক আবেদ খান। এসব রিপোর্টেও মানুষের কল্যাণই হয়েছে।
সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন কালাকানুন এবং মতলবি লোকদের মাধ্যমে গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির অনিয়মের ছিটেফোঁটা রিপোর্টও সংশ্লিষ্ট মহল সহ্য করতে পারছে না। রোজিনার ওপর নির্যাতন এরই সর্বশেষ নজির।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৫ মে ২০২১