আমাদের আবাসস্থল শিক্ষিতজন , অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মিলনভূমি। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই আমাদের কায়কারবার। তাই বিভিন্ন শ্রেণি, আদর্শ এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক মানুষের সাথে গভীর রিশতা গড়ে ওঠে। নানা ব্যস্ততার মাঝেও পরস্পরে মেতে উঠি আড্ডায়। সে আড্ডায় উঠে আসে আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, জাতীয় রাজনীতি, প্রতিরক্ষা নীতি, জননিরাপত্তা, ভায়োলেন্স, সংস্কৃতি, গণমাধ্যমসহ নানা অনুষঙ্গ। কাজের একঘেয়েমী ভাব দূর করতে এসব আলোচনা একেবারে মন্দ নয়। বিনোদন, পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রতি তো আছেই। এমনি এক আড্ডাস্থলে বিনোদন সংস্কৃতি প্রসঙ্গ ওঠলে এক শিক্ষক হলিউড, বলিউডের হালহকিকত, বর্তমান ক্রেজ, বিখ্যাত চিত্র তারকাদের জীবন কাহিনির বিবরণ দিয়ে পান্ডিত্য জাহির করলেন। সাম্প্রতিককালের হিন্দি এবং ইংরেজি ফিল্ম-সংগীত অঙ্গনের সকল শিল্পী সম্পর্কেই তার রয়েছে কমবেশি ধারণা। আমি নিজে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাস এবং শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁকটা একটু বেশি। যদিও এসব বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। তাই তার কাছ থেকে কিছু জ্ঞান হাসিলের চেষ্টা করলাম। দেশজ সংস্কৃতি, ইসলামি সংস্কৃতি এবং আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি কী এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘নাচ গানই আমাদের সংস্কৃতি’। হলিউড বলিউডের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি কমবেশি জানেন, অথচ বাংলাদেশের মানবসংস্কৃতি সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অপ্রতুল। সর্বশেষে বললাম, ‘বিশ্বের খ্যাতিমান ফিল্ম স্টার, নায়ক নায়িকা, শিল্পী, খেলোয়াড়দের সম্পর্কে ভাল জানাশোনা আছে আপনার। এখন কয়েকজন নবি রসুল, সাহাবি এবং মুসলিম মনীষীদের সম্পর্কে ধারণা দেন’। তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হলেন। দুনিয়ার মানুষকে কারা সঠিক পথ দেখাল, কারা জ্ঞান বিজ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতি শিক্ষা দিল, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষ ও ইউরোপে কারা জ্ঞানের মশাল নিয়ে প্রবেশ করল- কিছুই তিনি বলতে পারলেন না। জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি কী হতে পারে, কী হওয়া উচিত তা তিনি আমাদের জানাতে পারলেন না। অথচ তার একটি সুন্দর আরবি নাম এবং ইসলামি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। আদমশুমারি হিসেবে তিনি মুসলিম!
এই সমস্যা শুধু একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নয়, জাতির শিক্ষিত জনগোষ্ঠির প্রধান অংশেরই একই অবস্থা। সচেতন নাগরিকদের এই অসচেতন চিন্তাভাবনা কর্মকান্ডের জন্যই জাতিরাষ্ট্রের বর্তমান দূরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জাতির কান্ডারিরাই দেশকে ধ্বংস তথা পরাশক্তির অনুগত স্টেটে পরিণত করছে। বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাঁদের মনমস্তিস্ক, লেখালেখি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্রাজ্যবাদ তথা ইহুদিবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও খ্রিস্টবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। দেশের সাধারণ নাগরিকরাও সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা দূতাবাসগুলোর নির্দেশিকা বাস্তবায়নে তৎপর। ক্ষমতাসীনরা প্রতিবেশী দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী। নিজেদের ইতিহাস, সত্যিকারের ইতিহাস ভুলে পরকীয়াকে ধারণ, হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নেয়ার ফলেই রাষ্ট্রের এই অবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিষ্ঠাতা, লেনিনের সহকর্মী, সোভিয়েত রাশিয়ার তদানীন্তন পলিটব্যুরোর সদস্য, বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক শ্রী মানবেন্দ্র নাথ রায় বলেছেন, ‘(ভারতবর্ষে) মুসলিম বিজয়ের দ্বারা সমাজদেহে যে আঘাত লাগলো তাতেই হলো কবীর, নানক, তুকারাম ও চৈতন্য প্রমুখ সমাজ-সংস্কারকের আবির্ভাব সম্ভব। আর অনেকটা তারই জন্য তারা ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বহু জনসমর্থিত একটা বিপ্লবও দাঁড় করিয়ে দিয়ে যান। রঙিন চশমা না চড়িয়ে এই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস পড়লে মুসলমান ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি হিন্দুদের উদ্ধত আচরণ উপহাস্য বলে মনে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই ইতিহাসকে অপ্রমাণিত করেছে আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেও ব্যহত করেছে। মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার অধিনায়ক হয়ে রইল। এমনকি আজও তার শ্রেষ্ঠ মনীষীরা অতীত ঋণের বোঝা স্বীকার করতে সঙ্কুচিত হন না। দুর্ভাগ্য আমাদের, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামের সংস্কৃতি সম্পদ থেকে ভারতবর্ষ উপকৃত হতে পারেনি, কেননা অনুরূপ সম্মানের অধিকারী হবার যোগ্যতা তার ছিলো না। এখনও এই অবিস্মরণীয় অধ্যায় থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবাসীরা প্রভূত লাভবান হতে পারে। মানব সংস্কৃতিতে ইসলামের দান সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ আর উক্ত দানের ঐতিহাসিক মূল্যের যথার্থ অনুধাবন তাদের উদ্ধত আত্মপ্রসাদের প্রাসাদ থেকে বাইরে টেনে নিয়ে এসে হিন্দুদের চকিত বিস্ময়ে অভিভূত করে দেবে আর আমাদের এ যুগের মুসলমানদের সঙ্কীর্ণতা মুক্ত করে তারা যে ধর্মে বিশ্বাসী, তার মর্মবাণীর সঙ্গে তাদের মুখোমুখি পরিচয় করিয়ে দেবে’। (পৃ-৮৮, ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, মল্লিক ব্রাদার্স, কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা, ১৯৯৪)
বাংলা পাক ভারতবর্ষে ইসলাম এসেছিল মানবতার মুক্তির মহাসনদ নিয়ে। মুসলমানরা এ উপমহাদেশে আগমনের পরই এখানকার শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি, পোশাক, আহার বিহার, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়। তুর্কিদের আসার আগে এদেশে তৈরি পোশাকের প্রচলন ছিলোনা। ধূতি, চাদর, শাড়িই ছিল নারীপুরুষের একমাত্র পোশাক। তাইতো দর্জির বিকল্প কোনো শব্দ বাংলা কিংবা সংস্কৃত ভাষায় লক্ষ্য করা যায় না। ভূবন বিজয়ী ‘মসলিন’ মুসলিম কারিগরদেই অবদান। আটশ’ বছর ধরে রাজকীয় যেসব খাবার উপকরণের লক্ষ্য করা যায় তা সবই মুসলমানদের সৃষ্টি। কোরমা, কাবাব, কোপ্তা, পোলাও, হালিম, মোগলাই পরোটা, শরবত, পনির, মাখন, ছানা, বিরিয়ানী, বাকরখানি ইত্যাদি মুসলমানদেরই সৃষ্টি। মুঘল আমলের অর্থনীতি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশই হত বাংলাদেশে। বখতিয়ার খিলজীর হাতে সেনদের পরাজয়ের সাথে সাথেই ‘সোনারবাংলা’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। স্বাধীন সুলতানী আমলে ইহা পূর্ণ বিকশিত হয়। সুবাদারী আমলেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর উন্নয়নের অগ্রযাত্রার দ্রুত অবনতি ঘটে। মুসলিম আমলে তদানীন্তন বিশ্বের বিনোদনের সব উপাদানই প্রচলিত ছিল। কবিতা, মেলা, সুর সংগীত. নৃত্য. যাত্রা কোনোটাই অপ্রচলিত ছিলো না। ইংরেজ আমলে সেই সোনালী যুগের সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। কলকাতাকেন্দ্রিক এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদে। এরা সবাই ছিল বর্ণহিন্দু, যাদেরকে ইতিহাস ‘বাবুশ্রেণী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এই দুই শক্তি মিলে মুসলমানদের স্মৃতিচিহ্ন সব মুছে ফেলে। মুসলমানদের নামিয়ে দেয়া হয় তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। মুসলমানদের গণ্য করা হতো হিন্দু জমিদারদের লাইভ স্টক বা গৃহপালিত পশু হিসেবে। শুধু তখনই নয় আজও ভারতের অধিপতিরা বাংলাদেশীদের ‘মানুষ’ হিসেবে গণ্য করেননা। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সার্বিক কর্মকান্ড এ কথারই সাক্ষ্য দেয়।
শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে ভারত এদেশের ওপর একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে। এ প্রভাবের পিছনে ভারতীয়দের যত না বেশি অবদান, তারচেয়ে বেশি অবদান আমাদের ধর্মনিরপেক্ষবাদী বুদ্ধিজীবীদের। ওপারের খুঁত কুড়ো খেয়ে তারা বেঁচে আছেন তো? তাই ওপারের ওকালতী করতেই বেশি অভ্যস্ত। তারা বেদ, পুরাণ, রামায়ন ও মহাভারতের গুনগানে বেশি তৎপর। কিন্তু কুরআন হাদিসের জ্ঞানের প্রসারের বিরুদ্ধে তাদের একরোখা অবস্থান। তাদের জন্যই আমাদের পাঠ্যপুস্তক, টিভি চ্যানেল, পত্রপত্রিকায় মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতির চিহ্নমাত্র লক্ষ্য করা যায় না।
ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষার অধ্যাপক আলফ্রেড গিলম বলেছেন, ‘ইবনে সিনা, আল ফারাবী ও গায্যালীর রচনার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টান পাশ্চাত্য অ্যারিস্টটলের সঙ্গে পরিচিত হন’ (পাশ্চাত্য সভ্যতায় ইসলাম- টমাস আরনল্ড ও আলফ্রেড গিলম সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ-২৬৪)। ম্যাক্স মেয়ারহফ বলেছেন, ‘ইবনে হায়সাম ও জনৈক কামাল উদ্দিনের গাণিতিক দক্ষতা ইউক্লিড ও টলেমীর দক্ষতাকে ম্লান করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের এই বিভাগে তাঁরা বাস্তব ও স্থায়ী অবদান রেখে গেছেন’ (প্রাগুক্ত- পৃ ৩৫২)। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। এখানকার পাঠ্যপুস্তকে ইবনে সিনা, গাযযালী, ফারাবী, রুশদ, খালদুন, আল বেরুনী, শেখ সাদী, কামাল উদ্দিনদের পরিচয় নেই। কিন্তু এ্যারিস্টটল, প্লেটো, আর্কিমিডিসদের অবস্থান রাজকীয় পর্যায়ে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য পশ্চিমা মনীষীদের দ্বার্থহীন ঘোষণা, আরব মনীষীরা এ্যারিস্টটল, প্লেটো তথা গ্রিক দর্শন উদ্ধার না করলে বর্তমান বিশ্ব তাদের সম্পর্কে কোনো ধারণা পেতনা। প্রকাশিত পুস্তকাবলি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় চেগুয়েভার, লেনিন, মাওসেতুঙ, এম এ গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনদের প্রতিষ্ঠিত করছে। অথচ সালাহউদ্দিন, তারিক, মুসা, মুহাম্মদ বিন কাসেম, বখতিয়ার, ঘুরী, আওরঙজেবদ, শামসুদ্দিন ইলিয়াশ শাহ, মহাবীর ঈশা খাঁ, শায়েস্তা খানদের মহান জীবন সম্পর্কে তরুণ সমাজ কিছুই জানেনা। তারা শুধু ভারতীয় সোপ অপেরা, ইন্ডিয়ান আইডল ও বলিউডের নর্তন কুর্দন সম্পর্কেই অবহিত। ভারতীয় সিরিয়াল না দেখলে আমাদের গৃহিণীদের চোখে ঘুম আসেনা, হিন্দী গান না শুনলে ছাত্র-ছাত্রীর স্মার্ট হতে পারেনা, মোবাইলের রিং টোনে হিন্দী গান না বাজলে প্রগতিবাদীতায় আঘাত লাগে। এর সমালোচনা করতে গেলে সম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গালি শুনতে হয়। এই কী আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাখ শহীদের রক্তে গড়া এই কী আমাদের সবুজের বাংলাদেশ। সিরাজ, মোহনলাল, মীর মদন, দৌলত আলী, মজনু শাহ, টিপু সুলতান, তিতুমীর, বাল্কী শাহ, আহমাদুল্লাহ, রজব আলীরা কী এজন্যই জীবন দিয়ে গেছেন। নবাব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী, আকরম খাঁ, নজরুল, আব্বাসউদ্দিন, শেরে বাংলার স্বপ্নের দেশ কী এই বাংলাদেশ।