মাহমুদ ইউসুফ ।।
মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক ছিলেন জাতীয় মঙ্গলের কবি। মোজাম্মেল হক জাতীয় জাগরণের যাত্রিক ও নকিব। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগঠক, সমাজসেবক, রাজনীতিক, পার্লামেন্টারিয়ান। ১৮৮৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কবি মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হকের জন্ম। জন্মস্থান- বাপ্তা, সদর, ভোলা। বাপ্তা গ্রাম বাপ্তা ইউনিয়নে অবস্থিত যা ভোলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটর উত্তরে। পিতার নাম- মুন্সি আবদুল করিম। ভোলার নায়ক হিসেবে তাঁর খ্যাতি উপমহাদেশ জুড়ে। বরিশালের এ. কে. ফজলুল হক আর ভোলার মোজাম্মেল হক বাঙালি সমাজ ও সভ্যতার প্রবাদপুরুষ। দুজনের নামের শেষেই হক। আর দুজনের মিশন, ভিশন, কর্মপ্রচেষ্টা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিলো একই। মানবতার জয়গান, মানবতার জয়যাত্রা, মানবাধিকার রক্ষা এবং উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠায় উভয়ের কার্যাবলি চিরজাগরূক থাকবে বাঙালি হৃদয়ে।
তিনি ১৯০১ সালে কলকাতা মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আইএ পাস করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ১৯১৫ সালে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভোলা জেলার তৃতীয় গ্র্যাজুয়েট। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ড. মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহর সাথে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেন। তাঁর সম্পাদিত কাগজে বিশ্বখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। বিচারককে ‘মাই লর্ড’ বলার শিরকি আকিদা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি আইন পেশা ত্যাগ করেন।
তিনি একক প্রচেষ্টায় ভোলায় ১০টি হাইস্কুল ও ৩টি সিনিয়র মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯১১ সালে কলকাতা ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ এবং লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। মোজাম্মেল হক ছিলেন এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক। ১৯১৮ সালে সমিতির পক্ষ থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হয়। এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯১৫ সালে কবির প্রচেষ্টায় কলকাতা শহরে ‘মুসলমান ছাত্র সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯১৯ সাল তক তিনি এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মোজাম্মেল হক দীর্ঘ ২৭ বছর বরিশাল জিলা শিক্ষাবোর্ডের সদস্য, ১২ বছর কলকাতা হজ কমিটি ও কলকাতা টেকস্ট বুক কমিটির সদস্য এবং ছিলেন ৩ বছর বেঙ্গল প্রাইমারি এডুকেশন কমিটির সদস্য। ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির মনোনয়নে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যপদ লাভ করেন এবং চিফ হুইপের দায়িত্ব পালনসহ ১৯৪৫ সাল তক এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি আইন পরিষদে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বঙ্গীয় আইন পরিষদে জমিদারি অত্যাচার ও মহাজনি শোষণের বিরুদ্ধে কবি শেরে বাংলার সাথে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষাদীক্ষায় ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত মানুষের উন্নতির জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৭ সালে সিলেট রেফারেন্ডামে অংশগ্রহণ করেন। সমাজসেবার মানসে ১৯১৮ সালে কলিকাতায় তিনি খাদেমুল ইসলাম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং বরিশাল মুসলিম ছাত্র সমিতিও তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ছোলতান এবং মুন্সি রিয়াজউদ্দিন সম্পাদিত মাসিক ইসলাম প্রচারক ও সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। ১৯০৯ সালে তার প্রথম কাব্য ‘জাতীয় মঙ্গল’ প্রকাশিত হয়। সমাজে জাগরণ আনয়নের জন্য কবিতার ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত হয়েছে জাগরণী গান। সমকালীন অবহেলিত ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য কবি গেয়ে উঠেন- “আর কবে তুমি উঠিবে ভাই?/সকাল উঠেছে, সকলি জেগেছে/জাগিতে কি তব বাসনা নাই?/আর কবে তুমি উঠিবে ভাই?” কলকাতার কাগজ এবং বিশিষ্ট মুসলিম ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা তাঁর জাতীয় মঙ্গলকাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সমাজ মঙ্গল (৫০টি কবিতার সঙ্কলন), উত্থাপন সঙ্গীত, কুরআনের বঙ্গানুবাদ (১০ পারা) প্রভৃতি।
তরুণ বয়সেই পশ্চাৎপদ সমাজজীবনে গতি আনয়ন ও উন্নয়নে বিপ্লব পয়দার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। নিজ কাব্য রচনায় ব্যস্ত না থেকে তিনি আরও কবি-সাহিত্যিক তৈরিতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় মনোযোগ দেন। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের’ আদলে তিনি গড়ে তোলেন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ এবং ১৯২১ সাল থেকে প্রকাশ করতে থাকেন সমিতির ত্রৈমাসিক মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি পত্রিকা’। প্রথমদিকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদনা করলেও তাঁর অবর্তমানে মোজাম্মেল হক একটানা ৫ বছর এ সাহিত্য কাগজ সম্পাদনা করেন। এ সময়েই করাচি থেকে কবি নজরুল প্রেরিত ‘ক্ষমা’ নামে কবিতাটি এ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ পায়। ১৯২৬ সালে বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দিলে এই সমিতি এবং পত্রিকা অফিসই হয় নজরুলের ঠিকানা। এ কাগজের মাধ্যমেই আমাদের জাতীয় সাহিত্যের অবকাঠামো নির্মাণের প্রধান লেখকগণ জেগে ওঠেন। ১৯২১ সালে কবি মোজাম্মেল হক প্রতিষ্ঠা করেন ‘দি ওরিয়েন্টাল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স’ নামের প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান। কাজী নজরুল ইসলামসহ বিশিষ্ট লেখকদের ৩২টি মূল্যবান বই এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়।
জাতীয় মঙ্গলের কবি মোহাম্মাদ মোজাম্মেল হক ১৯৭৬ সালের ০১ লা আগস্ট ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তাঁর স্ত্রীর নাম হালিমা থাতুন। তার পুত্র এম মোকাম্মেল হক ভূমি সচিব এবং পরবর্তীতে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ছিলেন। ভোলা জেলা সদরে একমাত্র টাউন হলটি কবি মোজাম্মেল হক টাউন হল নামে প্রতিষ্ঠিত। জেলা সদরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম এখানেই অনুষ্ঠিত হয়।
তথ্যসূত্র:
১. সিরাজ উদদীন আহমেদ: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, ভাস্কর প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ৩১ জুলাই ২০০৩
২. দৈনিক নয়াদিগন্ত, ০১ আগস্ট ২০২১
৩. বরিশালপিডিয়া, সংগৃহীত: ০১ আগস্ট ২০২১
৪. ভোলা জেলা প্রশাসন ওয়েবসাইট, সংগৃহীত: ০১ আগস্ট ২০২১
ধন্যবাদ লেখককে।