মোহাম্মদ নূরুল্লাহ্ ।।
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী
আর হাতে রণতূর্য।
সব্যসাচীর মতো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পরবর্তী সময়কালে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিবেশে বাংলা কাব্যধারায় কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) আবির্ভাব। পরাধীনতার গ্লানিময় পরিবেশে সারা ভারতবাসী যখন বিক্ষুব্ধ বেদনার্ত, তখনই তিনি ভাঙনের পদশব্দ নিয়ে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হন। সমসাময়িক কালের সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম-সংঘর্ষ, বিদ্রোহ প্রতিবাদকে ধারণ করে তিনি হয়েছেন বর্ধিত ও পরিণামমুখী। বিদ্রোহ আর ভাঙনের আহ্বানই ধবনিত- প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এ ভাঙনের আহ্বান সমাজ কাঠামোকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য নয়, বরং নতুন সৃষ্টির জন্য তার কণ্ঠে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। মানুষ এবং মানবতাই এই বিদ্রোহের চরম ও পরম লক্ষ্য।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য শোষিত মানুষের যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সে সংগ্রামের ঢেউ বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষকেও আন্দোলিত করে। একজন সচেতন রাজনীতিবিদের মত নজরুলও আবিসিনিয়ার যুদ্ধ, আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রা্ম, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের নবজাগরণ এবং ভারতের সমকালীন আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
তিনি শুধু সমসাময়িককালের বিদ্রোহ আর বিপ্লবের চিত্রকরই ছিলেন না বরং ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কষাঘাতে জাতিকে বারবার নবজাগরণ উদ্বুদ্ধ হতে প্রেরণা যুগিয়েছেন। তার এই রাজনৈতিক চেতনার উৎসভূমি ছিল মানবপ্রেম। প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে।এ বিদ্রোহের মূলে ছিল ঔপনিবেশিক ভারতের স্বাধীনতা।
ধ্বংসের মধ্যেই যে সৃষ্টির সম্ভাবনা সুপ্ত থাকে, তা নজরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন। ধ্বংসস্তূপের উপরেই একটি জাতি নতুন সম্ভাবনা নিয়ে জেগে উঠতে পারে। জীবনের একটি বিশেষ পর্যায়ে নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বলেছিলেন, ‘এদেশের নাড়িতে-নাড়িতে অস্থিমজ্জায় যে পচন ধরেছে তাতে এর একবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না।‘ সুস্থ-সবল জাতিসত্তা নির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় পৃথিবী থেকে চিরতরে অন্যায়-অত্যাচার নির্মূলের কথা নজরুল বারবার বলেছেন:
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
[বিদ্রোহী]
নজরুল যুগস্রষ্টা, যুগন্ধর। পুরাতনের সব আবর্জনা-জঞ্জাল কে নির্মূল করে সব প্রথা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে সমাজ, দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে তিনি চেয়েছিলেন জাতির প্রাণকেন্দ্রে তীব্র আলোড়ন জাগাতে এবং নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মানুষের প্রাণ প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে। এরকম পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তিনি রচনা করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা। এ কবিতায় কবি নতুন সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন এবং বিপ্লবী মতাদর্শকে নতুন যুগের অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন:
মাভৈঃ মাভৈঃ জগৎজুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে।
জরায় মরা মুমূর্ষুদের প্রাণ লুকানো ওই বিনাশে!
এবার মহা নিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে
করুণ বেশে!
প্রলয়োল্লাস কবিতায় নবজীবনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত লক্ষণীয়। কবি বিশ্বাস করেন নিশাবসানে একদিন নতুন সূর্য উদিত হবে। তাই তিনি নতুনকে বরণ করতে চান এবং সেজন্য সকলকে জয়ধ্বনি করতে বলেন। প্রলয়োল্লাস কবিতার একটি এলাকা স্মরণীয়:
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর,
আলো তার ভরবে এবার ঘর।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
দিগম্বরের জটায় প্রলয়ের যে আহ্বান, তার পরিণাম আকাঙ্ক্ষিত সুন্দর ও সুষম সমাজ। দিগম্বরের জটা হচ্ছে ধ্বংসের বিদ্রোহের প্রলয়-প্রতীক এবং জটা লগ্নশিশু চাঁদ হচ্ছে প্রলয়ান্তিক রোমান্টিক অনুভবময় নবসমাজের প্রেম ও সুন্দরের প্রতিরূপ।
নজরুল ইসলাম ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন অন্যায়, অসুন্দর, অত্যাচার অসত্যের ভিত্তিমূলকে। চির অসুন্দর ও চির পুরাতনকে বর্জন করে সুখী সুন্দর আলোকিত দিনের অনুসন্ধান করেছেন নজরুল।
আজও সারাবিশ্বের আনাচে-কানাচে মাজলুমের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। মজলুমরা প্রতিনিয়ত কায়মনোবাক্যে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করেন যে প্রার্থনা নজরুলের ভাষায় এভাবে এসেছে:
‘প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায়।
তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার
লেখায় তাদের সর্বনাশ।‘
এভাবে বিদ্রোহী কবির লেখনিতে মজলুমের পক্ষে হাজারো বাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে। জাতির বন্দিত্ব মোচনের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা ছিল চোখে পড়ার মত। কারাগারে আটক রেখে যে সত্যকে গলা টিপে হত্যা করা যায়না; সে কথা তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন এভাবে:
‘লাথি মার ভাঙরে তালা,
যতসব বন্দীশালা,
আগুন জ্বালা আগুনজ্বালা।‘
এ আগুন ধ্বংসের আগুন নয়। আত্মমুক্তির বন্দিত্ব মোচনের আগুন। তিনি ভালোবেসেছেন দেশকে, এদেশের নির্যাতিত কোটি জনতাকে। তাই সত্য সৈনিকের বেশে তিনি চারণ কবির মত জাগরণী বাণীতে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আত্মবলে বলীয়ান হবার প্রেরণা দিয়েছেন। আজকের উইঘুর, রোহিঙ্গা,কংগো, কাস্মীর, ফিলিস্তিন সিরিয়ার আবালবৃদ্ধ বণিতার কান্নায় মেঘমালা হয়ে বর্ষিত হচ্ছে অঝোর ধারায়। এসব জনপদের লোক কবি নজরুলের মত কাউকে প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়ায়। কবির ভাষায় বলতে হয়:
‘আমি যুগে যুগে আসি
আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।‘
আজ নজরুল আমাদের বাস্তবজীবনে অতি প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিয়েছেন। প্রতিনিয়ত আমরা তাঁর দ্বারস্থ হই। নজরুলকে মনে প্রাণে ধারণ করে মাজলুমের পক্ষে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের পরিগণিত করতে হবে। নজরুল যেভাবে বলেছিলেন:
‘আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। আর যা অন্যায় বলে বুঝেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি,- কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরি নাই-‘
[রাজবন্দীর জবানবন্দী, নজরুল রচনাবলী- ১ম খণ্ড, পৃ-৭২২]
মোহাম্মদ নূরুল্লাহ, সহকারী অধ্যাপক (বাংলা), সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ফরিদপুর।