জিশান মাহমুদ ।।
চিঠি হলো কোনো ব্যক্তির প্রতি লিখিত বার্তা প্রেরণের মাধ্যম। এর অর্থ পত্র, লিপি। লিখিত বর্ণমালা আবির্ভাবের আগে মানুষ চিত্র বা ছবির মাধ্যমেই মনের ভাব আদানপ্রদান করে থাকতো। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছর আগে মানুষ ছবি এঁকে ভাব প্রকাশের পদ্ধতি আবিষ্কার করে যেটি পিক্টোগ্রাম (Pictograms) নামে পরিচিত। এই পদ্ধতির সর্বপ্রথম প্রচলন ঘটে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান অঞ্চলে।
পৃথিবীতে কবে চিঠি লেখা শুরু হয়েছিলো বা কে কাকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন সে বিষয়ে সঠিক খবর না পাওয়া গেলেও পৃথিবীর প্রথম প্রেমপত্রটি কে কাকে লিখেছিলেন সেটি জানা গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ সালে ব্যাবিলনিয়াতে প্রেমিক ‘গিমিল’ এক খণ্ড ইটের উপর ভালোবাসার কথা খোদাই করে প্রেমিকা ‘কাসবুয়ার’ কাছে পাঠিয়েছিলেন। এটিই পৃথিবীর প্রথম প্রেমপত্র। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো চিঠিটি হচ্ছে ৩৩০০ বছর আগে পাথরে খোদাইকৃত একটি চিঠি, যা মিশর রাজসভা থেকে ইসরায়েল রাজসভায় পাঠানো হয়েছিলো।
ঐতিহাসিকদের মতে প্রথম লিখিত চিঠির ইতিহাস পাওয়া যায় ফারাও সাম্রাজ্যের প্রাচীন মিসরে। যিশুর জন্মের ২৪০০ বছর আগে ফারাও রাজারা দূত মারফত তথ্য আদান-প্রদান করতেন। প্রাচীন মিসরীয় অনেক নথিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
দূরবর্তী অঞ্চলে দ্রুত খবর পাঠানোর কাজে জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল কবুতর। কবুতরকে চিঠি বহন করার কাজে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেইসব প্রশিক্ষিত কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে উড়িয়ে দিলে কবুতর নির্দিষ্ট গন্তব্যে চিঠি পৌঁছে দিতো। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে সিরিয়া এবং ইরানে কবুতরের মাধ্যমে বার্তা বহন শুরু হয়৷ খ্রিষ্টাব্দ ১২শতকে সিরিয়া, মিশর, বাগদাদসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সাথে বার্তাবাহক কবুতরের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা হতো।
প্রাচীনকাল থেকেই চিঠির আদান-প্রদান ছিল। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘রয়েল মেইল’ কে পৃথিবীর প্রথম ডাক বিভাগ বলা হয়। ১৫১৬ সালে ব্রিটিশ রাজা হেনরি অষ্টম-এর রাজত্বকালে পোস্ট অফিসটি চালু হয়। ইংল্যান্ডের রাজা সে সময় ‘মাস্টার অব দ্য পোস্ট’ নামে একটি সার্ভিস চালু করেন। ১৭১০ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘পোস্ট মাস্টার জেনারেল’ রাখা হয়। ১৮৩৯ সালে রয়েল মেইলের পোস্ট মাস্টারদের ইউনিফর্ম চালু হয়। এবং ১৮৫২ সালে চালু হয় পিলার পোস্টবক্স। রাস্তার পাশে অলি-গলিতে পোস্ট বক্স বসানো হয়।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩২২ বছর আগে প্রাচীন ভারতীয় মৌর্য রাজবংশীয়রা ডাকব্যবস্থায় কাজ করতেন। এরপর উপমহাদেশের ডাক বিভাগের আনুষ্ঠানিকতা হয় ১৭৭৪ সালে।
চীনের জিয়াং বা সাং বংশের লোকের দ্বারা ডাকবিভাগের প্রচলন হয়েছে বলে তারা দাবি করে। ২২০ খিস্টপূর্বাব্দে হ্যান রাজবংশীয় লি পুনরায় ডাকব্যবস্থা চালু করেন। তার শাসনামলে ১৬৩৯টি পোস্ট অফিস এবং ২০ হাজারেরও বেশি ডাকপিয়ন ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৬২ সালে রোমের রাজা অগাস্টাস কেসারের সময় ডাক সার্ভিসকে ‘কারসাস পাবলিকাস’ নামে ডাকা হতো। সে সময় ঘোড়ায় চড়ে চিঠি বিতরণের খবর পাওয়া যায়।
মোগল সাম্রাজ্যের সময় অধিপতি চেঙ্গিস খান ‘ওরতো’ নামের সার্ভিস চালু করেছিলেন।
কুবলাই খানের অধীনে ইউয়ান রাজবংশের সময় এই ব্যবস্থার চীন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কুবলাই খানের সময় ১৪০০ পোস্ট অফিস ছিল। চিঠি বিতরণের জন্য ৫০ হাজার ঘোড়া, ১৪০০ ষাঁড়, ৬৭০০ খচ্চর, ৬০০০ নৌকা, ২০০-এর বেশি কুকুর এবং ১১৫০ মেষ ব্যবহার হতো।
ইসলামী বিশ্বের খলিফা মুয়াবিয়া (রা.)-এর সময়ও চিঠি এবং ডাকব্যবস্থা প্রচলন ছিলেন। এর নাম ছিল বারিদ।
কিন্তু বর্তমানে চিঠির ব্যবহার কমে গেছে। চিঠির পরিবর্তে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে ই-মেইল এবং বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন। তারপরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাড়িতে দেখা যায় দেয়াল পোস্টবক্স। আমাদের দেশে ডাক বিভাগ জনপ্রিয় না হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আমেরিকায় এখনো পোস্ট অফিস বেশ জনপ্রিয়তা আছে। দেশটির প্রতিটি পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টারদের রয়েছে দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা। ডাক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ২,৬৮,৮৯৪টি চিঠি আদান-প্রদান হয়। বিভিন্ন দেশের ১৫১ লাখ ঠিকানা রয়েছে আমেরিকান পোস্টাল সার্ভিসের।
জাপানে এই পোস্টাল সার্ভিসটি ব্যাপক জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন সরকারি কাজও করে থাকে জাপান পোস্ট অফিস।
কোরিয়ান পোস্ট সার্ভিস প্রতিবছরই সেরা পাঁচ-এর মধ্যে থাকে।
কানাডা পোস্ট অফিসও এই তালিকায় পিছিয়ে নেই। গোটা পোস্ট অফিসে মাত্র ১,৫১৬ জন নাগরিক। তা সত্ত্বেও সেবা আর জনপ্রিয়তায় রয়েছে সেরা। জার্মানির বিখ্যাত ডিউচি পোস্ট অফিসটি জার্মানির পাশাপাশি গোটা বিশ্বেই সমাদৃত এবং বিশ্বস্ততার প্রতীক। ডিউচি গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবা, পার্সেল, চিঠি ও জরুরি কাগজ আদান-প্রদান, শপিং থেকে শুরু করে নানা ব্যক্তিগত সেবাও প্রদান করে থাকে। এখানেই শেষ নয়, প্রাচীন এই সভ্যতা চায়না, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, লন্ডন, ইউক্রেন, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজও জনপ্রিয়। বিভিন্ন উৎসবের শুভেচ্ছাকার্ড থেকে ব্যক্তিগত সব ধরনের চিঠি-নথিসহ প্রয়োজনীয় পার্সেল আদান-প্রদান করে থাকে। এটি শুধু একটি ডাক বিভাগ নয়, সুপ্রাচীন ঐতিহ্যও বটে।
অস্ট্রেলিয়ার পোস্টাল সার্ভিসটি গ্রাহকদের বিভিন্ন সেবা যেমন- বই কেনা, অনলাইনে কেনাকাটা, অফিস পেপারস সার্ভিস, কফি পার্সেল ইত্যাদি। কোম্পনিটির বার্ষিক আয় ২৯০ লাখ ডলার।
মার্কিনিদের হাত ধরেই ডাক বিভাগ এবং আধুনিক প্রযুক্তির উত্থান। ১৬৭৩ সালে গভর্নর ফ্রান্সিস লাভলেস প্রথম নিউইয়র্ক ও বোস্টনে পোস্ট অফিস চালু করেন। সময়ের দিকে গুরুত্ব দিয়ে যোগ্য জনবল চেয়ে ১৮৬০ সালে মার্চে ‘পিয়নার ট্রান্সপোর্টশন’ কোম্পানি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। কোম্পানিটি ট্রেনে, বাষ্পীয় জাহাজে এবং নৌজাহাজে করে বিভিন্ন দেশে চিঠি আনা-নেওয়া করত। প্রেরিত চিঠিগুলো নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর জন্য ঘোড়ার গাড়ি, ইঞ্জিনচালিত গাড়ি ব্যবহার করত। ১৮৩৫ সালে তৈরি আমেরিকান ‘পোস্ট অফিস রিফর্ম’ আধুনিক পোস্ট অফিসের আইকন। সেই থেকে প্রযুক্তির যাত্রা শুরু। ১৯৯৬ সালে ডাক বিভাগ আরও উন্নতি লাভ করে। ‘পেনি এক্সপ্রেস’ অল্প সময়ে ৩৪,৭৫০টি চিঠি পৌঁছাতে পারত। সে সময় চিঠি আদান-প্রদানে ঘোড়ার গাড়ি, ইঞ্জিনচালিত গাড়ি, ট্রেন, বাষ্প জাহাজ, নৌজাহাজ, প্যারাসুট এবং সব শেষে বিমানের ব্যবহার পুরোপুরি চালু হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে ই- মেইল প্রযুক্তি চলে আসে। এতে প্রয়োজনীয় তথ্য আরও স্বল্পসময়ে প্রেরকের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। সত্যি বলতে, ই-মেইল-এর বাস্তবায়নে ডাক বিভাগের চেহারা পাল্টে যায়।
বর্তমানে হাতে লেখা চিঠি বিলুপ্তির পথে। টেলিগ্রাম চিরতরে বিদায় নিয়েছে ২৭ জানুয়ারি ২০০৬ সালে। একদিন হয়তো ডাকযোগে আসা চিঠি মাধ্যমটি ও টেলিগ্রামের মতো হারিয়ে যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত ডাক ব্যবস্থা আজ থেকে ৮০০ বছর আগে উপমহাদেশে প্রচলিত ডাক ব্যবস্থার একটি আধুনিক রূপ। হাতে লেখা চিঠির জায়গা এখন দখল করেছে ইমেইল, মোবাইল কিংবা এসএমএস।
জিশান মাহমুদ
শ্রীবরদী, শেরপুর, পেশা: শিক্ষকতা
মোবাইল : ০১৯১৫৯২৫৭৫৬