অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, নানা সঙ্কটে জর্জড়িত বিভিন্ন দেশ। এইসব সমস্যা, জটিলতার মূলে রয়েছে মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত, সংকীর্ণ চিন্তাধারা এবং সত্যপথ বিচ্যুতি। ভুলতথ্য, মিথ্যা ইতিহাস দ্বারা চালিত হচ্ছে জাতিরাষ্ট্র। সর্বত্রই বঙ্কিমীয় ইতিহাসের ছড়াছড়ি। গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রই বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজের প্রধান উপজীব্য! অহির জ্ঞান, প্রভুর নির্দেশনা সেখানে গরহাজির, পুরোপুরি অনুপস্থিত। কল্পনার রাজ্যে অবগাহন করছে রাষ্ট্রের কর্ণধাররা। আর সত্যকে মিথ্যা বানাচ্ছে, মিথ্যা রূপান্তরিত হচ্ছে সত্যে। এজন্যই সারা বিশ^ আজ বাইবেলিয়, বুদ্ধিষ্ট, রাম-কৃষ্ণীয়, মার্কসিয় উপত্যাকায়।
মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে হযরত নুহ নবি পর্যন্ত সকল মানুষ একই ভাষায় কথা বলত। পরবর্তীতে মানববংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন ভাষার পয়দা হয়। বাইবেলে উল্লেখ আছে, প্লাবনের পরে সমস্ত পৃথিবী এক ভাষাতে কথা বলত। সমস্ত মানুষ একই শব্দগুলি ব্যবহার করত। (বাইবেল, আদিপুস্তক ১১/১) এই সেই স্থান যেখানে প্রভু সমস্ত পৃথিবীর এক ভাষাকে অনেক ভাষাতে বিভ্রান্ত করলেন। তাই এই স্থানটির নাম হলো বাবিল (বর্তমান ইরাক)। এইভাবে প্রভু তাঁদের সেই স্থান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিলেন। (বাইবেল, আদিপুস্তক-১১/৯) খ্রিস্টানদের স্বরচিত ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ভাষার ইতিহাসের ক্ষেত্রে সত্যের একটি দিক উন্মোচন করেছে। অথচ পুরো সত্য প্রকাশ করেনি। শ্লোক থেকে বুঝা যায় সেই প্রাচীনতম, সেই প্রথম ভাষার নাম বাইবেল রচয়িতরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে গেছেন।
তবে সত্যিকার ইতিহাস পর্যালোচনায়, প্রকৃত গবেষণায় এ সত্যটা বেরিয়ে এসেছে। আল্লামা জালালউদ্দিন আস সুয়ুতি বলেন, সর্বপ্রাচীন ও প্রথম ভাষা হলো আরবি। আদম আ. কে জান্নাতে পরীক্ষার জন্য সর্বপ্রথম যে শব্দজ্ঞান ও ভাষা শেখানো হয়েছিল তা ছিলো আরবি, এতে কোনো দ্বিমত নেই। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত জান্নাতে আদম আ. -এর ভাষা ছিলো আরবি। কিন্তু ভুলবশত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর তিনি আরবি ভাষা ভুলে যান এবং তিনি সুরিয়ানি ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। অত:পর যখন তার তাওবা কবুল হয় তখন তিনি পুনরায় আরবি ভাষায় কথা বলতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তিনি দুনিয়ায় আরবি ভাষায়ই কথা বলতেন। সকল আসমানি গ্রন্থ ও সহিফা আরবি ভাষায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আম্বিয়ায়ে কিরাম তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় তরজমা করে তাদেরকে সেই গ্রন্থের বাণী ও শিক্ষা পৌঁছান। আসমানি কিতাবসমূহের মধ্যে কেবল পবিত্র কুরআনই তার মূল ভাষা আরবিতে বহাল রয়েছে। (আল ইতফান ফি উলুমিল কুরআন. প্রথম খ-, পৃ ১৩৬)
আবদুল মালিক ইবনে হাবিব (মৃত্যু ২২৮ হিজরি) এর বরাতে উল্লেখ আছে যে, সর্বপ্রথম আদম আ. যে ভাষা নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন সেটি ছিলো আরবি। (আল বুলগা ফি উসুলিল লুগাহ, নওয়াব সিদ্দিক খান) মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল আযহারি র. (মৃত্যু ৩৭০ হিজরি) বলেন, মানুষ দুনিয়াতে আগমনের পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা আদম আ. কে আরবি ভাষা শিক্ষা দানের মাধ্যমে এ ভাষার সূচনা করেন। আরবি ভাষা সবভাষার চেয়ে প্রাচীন ভাষা, এর বড় প্রমাণ হলো আল কুরআনের ভাষা আরবি। (মুকাদ্দামা মুকামাতাল হারির, পৃ ১৩৭; উদ্বৃতি: ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৪, পৃ ১৭৪)
অতএব আরবিই প্রাচীনতম এবং দুনিয়ার প্রথম ভাষা। আরবি ভাষা থেকেই বর্তমান বিশে^র অপরাপর ভাষার উদ্ভব। বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান বলেন, ইউরোপের কোনো পাহাড়-পর্বত নয়; এশিয়ার আরব ভূমি-ই যে আদি আদম, আদি লিপি, আদি ভাষা ওগয়রহের পয়দা-স্থল, তা আধুনিক লিপিতত্ত্ববিদরাও কবুল করেছেন।—-কেবল ব্রাহ্মী লিপি ও বৈদিক ভাষা নয়; সংস্কৃত লিপি, বৈদিক ভাষা এবং আর্যত্ববাদী ব্রাহ্মণ জনকওমের প্রাচীন পুরুষ-মহিলারা যে, সেমিটিক (আরব) অঞ্চল এবং সেমিটিক (আরবীয়) জনকওমের-ই অন্তর্ভুক্ত- ইউরোপ আর ইউরোপীয়নদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং ছিল না- তা পষ্ট।
মোটের ওপর মানব জাতির আদি মানব-মানবী যেমন আরব ভূমিতেই আবির্ভূত হন; তেমনি আদি মানবগোষ্ঠী, ভাষা ও লিপিরও পয়দায়েশ এখানেই। সেই হেতু যে-ভাষাগোষ্ঠীকে ইন্দো-ইউরোপীয় প্যারেন্ট স্পীচ বলা হয়ে থাকে; তা আসলে সেমিটিক-প্যারেন্ট স্পীচ বা সেমিটিক মূল ভাষা বলা উচিত। নির্দিষ্ট অর্থে এই ভাষাটি আরবী, আরবীয় বা আরব্য। আর এই আরব্য শব্দটিকেই ম্যাক্সমুলার বানানোর বিকৃতি ঘটিয়ে করেছেন- আর্য্য।
অতএব, ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা বা ইন্দো ইউরোপীয় প্যারেন্ট স্পীচ- এর তরফে যত কথা, যত যুক্তি-ই দেয়া হোক না কেন; তা না- কবুল করার পক্ষে বহু যুক্তি আছে। (বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড ,পৃ ৭৬-৭৭) তিনি আরও বলেন, আর্য্য শব্দটি যে, আকাশ থেকে পড়েনি, আরব্য শব্দ থেকে তৈরী এবং তা প্রাচীন আরবীয় জনপ্রবাহের দেশান্তর, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্ব-ধ্বনিতত্ত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ- তা পষ্ট। (ওই, পৃ ৭৬) অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ইউরোপ, ইউরোপীয়ান, আর্য্য, আর্য্যান এর উৎসও আরবি, আরব্য, আরবিয় থেকে। (ওই, পৃ ৭৩-৭৬)
বিশ^ রাজনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার দেউলিয়াত্ব ভাষার ইতিহাসের উপরও ভর করেছে। ভাষাবিজ্ঞানের সঠিক ইতিহাস নির্ণয়ে ভাষাবিদরা চরমভাবে ব্যর্থ। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক, অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক আল্লাহর মনোনীত পথকে এড়িয়ে মরিচীকার পেছনে ঘুরে ফিরছেন। সত্যকে বাদ দিয়ে কল্পনার মিশেলে রচনা করছেন ভাষার ইতিহাস। তাই তাদের চিন্তা চেতনা, ভাবনা দৃষ্টিভঙ্গি ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা পরিবারে গিয়ে থেমে যায়।
লেখক: মাহমুদ ইউসুফ