মাহমুদ ইউসুফ
পাঠ্যপুস্তকে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেয়া হয়, ব্রিটিশ আমলে মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেনি। সরকারের প্রতি মুসলমানদের এতই বিদ্বেষ ছিলো যে, তারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাফের ফতুয়া দিতেও দ্বিধা করেনি। আধুনিক শিক্ষাকে মুসলমানরা কুফরি ও ইসলাম বিরোধী শিক্ষা মনে করত। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ না করার জন্যই মুসলমানরা আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রিক দিক থেকে দুর্দশার শিকার হয়’। এইসব তথ্য মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। প্রকৃত তথ্য হল: প্রধানত দু’টি কারনে মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি।
প্রথমত: পলাশি ট্রাজেডির পরপরই কোম্পানি এবং কোম্পানির আশির্বাদপুষ্ট হিন্দু জমিদাররা মুসলমানদের অর্থনৈতিক শক্তিকে পঙ্গু করে দেয়। মুসলমানদের জমি জিরাত, সহায় সম্পদ সব কেড়ে নেয়া হয়। সরকারি হস্তক্ষেপেই মুসলমানদের স্থাবর অস্থাবর সম্পদ প্রতিবেশি সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়াকে চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা হয়। প্রশাসন, সৈন্য বিভাগ, অর্থ বিভাগ থেকে মুসলমানদের চাকরিচ্যুত করে নেটিভদের বসানো হয়। উইলিয়াম হান্টারের দি ইন্ডিয়ান মুসলিম শীর্ষক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তখন সরকারি বিজ্ঞাপনেই উল্লেখ থাকত ‘চাকরিতে শুধু হিন্দুদেরই নিয়োগ দেয়া হবে। মুসলমানদের দরখাস্ত করার প্রয়োজন নেই’। স্বাভাবিকভাবেই ওই সময় মুসলমানরা কপর্দকশূণ্য হয়ে পড়ে। এককালের অভিজাত মুসলমানরাও একমুঠো অন্নের জন্য বাবুদের দুয়ারে দুয়ারে ফিরত। এই আর্থিক দূরাবস্থায় মুসলমানদের পক্ষে ব্যয়বহুল ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করার কোনো উপায়ই ছিলো না। আজকে যদি একজন দিনমজুরের সন্তানকে প্রশ্ন করি, ‘তুমি ঢাকার কোনো ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ স্কুল কিংবা কোনো প্রাইভেট ইউনিবার্সিটিতে অধ্যয়ন করছ না কেন?’ তাহলে সেটা হবে খুবই হাস্যকর প্রশ্ন। কোম্পানি আমলে আর্থিক অবস্থা আজকের দিনমজুরের চেয়ে কোনোক্রমেই স্বচ্ছল ছিলো না। বরং তার চেয়েও খারাপ ছিলো।
দ্বিতীয়তঃ প্রথম দিকে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় সেসব শিক্ষায়তনে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। শুধু হিন্দুরাই সেখানে লেখাপড়ার সুযোগ পেত। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজে মুসলমানদের ভর্তির কোনো সুযোগ দেয়া হতোনা। তাছাড়া নিম্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা দেয়া হত রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, গীতা অর্থাৎ হিন্দুদের ধর্মীয় শিক্ষা। সেখানেও মুসলমানদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত ছিলো। তাই ‘মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে নাই’। এই তত্ত্ব থেকে অবিলম্বে বেরিয়ে আসা উচিত। তবে আর একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। একটা বিশেষ শ্রেণি ছিলো যারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণকে অধর্মের কাজ মনে করত। শুধু তখনই নয় তাদের উত্তরসূরীরা বর্তমানেও পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণকে নিন্দনীয় মনে করে। এদের একটা অংশ দ্বারাই বর্তমান ফোরকানিয়া বা কওমি শিক্ষা পরিচালিত হয়। এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি কর্তৃক সৃষ্ট অপবাদ উপমহাদেশের সকল মুসলমানদের ওপর চাপানো ন্যায়সঙ্গত নয়।
thanks to yousuf vai