মোঃ রিসালাত মীরবহর ।।
আমরা সকলেই জানি মানুষ হচ্ছে জগতের শ্রেষ্ঠ জীব। অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন সভ্যতা পেরিয়ে নানা প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে আধুনিক যুগে পা দিয়েছে। কালের এই বিবর্তনের ধারায় হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। আবার মানব সভ্যতা ফিরে পেয়েছে আধুনিক সব চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা আর নতুনত্ব। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে কালের ধারায় হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মনুষত্ববোধ। বর্তমান আধুনিক যুগে আমরা দেখতে পাই কোন কোন ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় যা আমাদের জীবন ধারাকে বদলে দিয়েছে। বিশেষ করে পরিবার যেখানে সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কথা, সেখানে পরিবার কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
সন্তান তার পরিবারের অবাধ্য হচ্ছে এবং সে আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদক, অপরাধ কিংবা সোস্যাল মিডিয়ার মতো অবাস্তব জগতে। যা আমাদের জানান দেয় পরবর্তী প্রজন্মের অনুর্বর মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার। আমরা এখানে বলতে পারি পারিবারিক কলহ, শিশু নির্যাতন, দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা, সোস্যাল মিডিয়ার অত্যাধিক ব্যবহার ইত্যাদির কারনে শিশু কিশোরদের সুস্থ্য মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেকটা বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। এখানেই শেষ নয়, বেকারত্বের মতো অভিশাপের কবলে পড়ে অনেক মেধাবীরাও জড়াচ্ছে অনৈতিক কার্যকলাপে। এখানে কেবলমাত্র পারিবারিক শিক্ষাকে দায়ী করেই আমরা দায় সারা দিতে পারিনা। বিদ্যার্জন হচ্ছে শিক্ষিত মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের এই অবক্ষয়ের জন্য কম দায়ী নয়। বিশেষ করে আদর্শবান শিক্ষকের অভাবে নৈতিক শিক্ষার মানদন্ড আজ হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন খুব কম থাকায় নীতি নৈতিকতা সম্পর্কে জানার জায়গাটা আমাদের জন্য অনেক ছোট হয়ে আসছে। আমরা অধিকাংশ মানুষ এখন আর আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য বিদ্যার্জন করতে রাজি নই। বরং বিদ্যার্জন শেষে একটি ভালো চাকুরি পাওয়ার আশায় পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকি।
এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিক চাহিদাটা আমাদের পেয়ে বসে। তবে সবাই কে দায়ী করা যাবেনা। বিবেক বর্জিত মানুষের পাশাপাশি বিবেকবান মানুষও রয়েছে আমাদের মাঝে। সীতানাথ বসাকের লেখা আদর্শলিপি বইটি ভালো করে পড়ে বোঝার আগেই আমরা পরের ক্লাসের বই পড়তে উঠে পড়ে লেগে যাই। মনে হয় যত তারাতারি করে বইগুলো পড়া শেষ করা যায় তত তারাতারিই চাকরির দরজাটা খুলে যাবে। কিন্তু আসল সত্য হল নীতি-নৈতিকতা আর আদর্শ না থাকলে একটি জাতি কখনো উন্নত হতে পারে না। উন্নত জাতি গঠনে চাই উন্নত চিন্তা, চেতনা, নীতি-নৈতিকতা আর আদর্শ। সামাজিক মূল্যবোধের এই জায়গাটায় সমাজকেও আমরা কিছুটা দায়ী করতে পারি। দেখুন একটি মানুষের বিবেক কে বিকাশিত করার জন্য সামাজিক ভাবে বেড়ে ওঠাও আমাদের সন্তানদের জন্য খুব জরুরি। সমাজ থেকে যদি আমরা সামাজিকতা না শিখতে পারি তবে তা ব্যক্তির উত্তম বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়ায়।
যা বর্তমানে সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার জায়গাটাকে বেশ নড়বড়ে করে তোলে। আর তাই এখানেও আমরা দেখতে পাই সামাজিক এই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পেছনে নীতিহীন সমাজ ব্যবস্থার চর্চা। সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে ধর্মীয় চর্চা। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কে ঠেকানোর জন্য। আধুনিক যুগের এই 4জি 5জির দুনিয়ায় ধর্মীয় চর্চার বিষয়টি মানুষের মন থেকে আস্তে আস্তে করে মুছে যাচ্ছে। যা আধুনিকতার ফল হিসাবে আমরা ধরে নিতে পারি। আসলে আমরা আমাদের সন্তানদের নীতি নৈতিকতা কোথায় শেখাব? আমরা পরিবার হিসেবে ব্যর্থ, কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ব্যর্থ, সমাজ এ বিষয়ে দায়িত্ব নিচ্ছে না। দেখুন এমনও হয় সন্তান অনেক বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা অনেক টাকার মালিক। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন এই বৃদ্ধ বয়সে কেন আপনি একাকীত্ব অনুভব করছেন, কেনইবা আপনাকে দুবেলা ভাতের জন্য মানুষের দুয়ারে ঘুরতে হয়।
কেনইবা আপনাকে থাকতে হয় বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালের মাঝে, কেনেইবা অভাবের তাড়নায় বৃদ্ধ বয়সে রিকশার প্যাডেলে পা লাগাতে হয়? এখানেই আমরা নীরব। কারণ আমরা আমাদের এতগুলো প্রতিষ্ঠান দিয়েও সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। কারণ আমরা শিশুকে ভর্তি করেছি ইংরেজি মিডিয়ামে কিংবা পড়িয়েছি কোন নামিদামী স্কুল, কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক কারণে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের আগেই ঝড়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। আমরা শিখিয়েছি বাবা তুমি অনেক পড়াশুনা কর। কারণ তোমাকে অনেক ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তোমাকে অনেক বড় হতে হবে। এখন অনেকেই বলতে পারেন আমি কি তাহলে উচ্চ শিক্ষার বিপক্ষে? মোটেই না, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড একটি মানুষ যেমন মেরুদন্ড ছাড়া সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি শিক্ষা ছাড়াও একটি জাতি কখনো মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না, আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা অর্জনের পক্ষে গুরুত্বারোপ করছি। একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে, অন্যদিকে নৈতিক শিক্ষা মানুষকে আদর্শ মানুষ হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে যেখানে মানুষ নৈতিকতা, আদর্শ হৃদয়ে লালন করে তার সত্যিকারের বিবেক কে জাগ্রত করতে সক্ষম হবে। মানুষের মতো মানুষ হবে।
মানবতাকে এগিয়ে নিতে সে তার সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। আমার মনে হয় নৈতিক শিক্ষাই পারে আমাদের সন্তনদের বিবেক, বুদ্ধি ও মনুষত্ব কে জাগ্রত করতে। কেননা নৈতিক শিক্ষা মানুষের বিবেক কে সঠিকভাবে পরিচালিত করে। দেখুন পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ জীবনের কথা বলে। আমরা যদি আমাদের সন্তানকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি তাহলে সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধের এই অবক্ষয় থেকে হয়তো রেহাই পাওয়া যেতে পারে। সবশেষ আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি- ‘আসুন আমরা নিজেকে বদলে ফেলি এবং সমাজকে বদলাই’। জয় হোক বিবেকের জয় হোক মনুষত্বের। আলোকিত হোক আগামীর পৃথিবী।
ভাল লেখা