মাহমুদ ইউসুফ
বাংলাদেশের সাহিত্য ভুবনে ভাবনার বিস্ময় সৃষ্টিকারী কথাসাহিত্যিক শফীউদ্দীন সরদার। তাঁর উপন্যাসের ভাব-ভাষা-ভঙ্গি ও সুষমার সমন্বিত রূপ ক্লাসিক্যাল মর্যাদায় অভিষিক্ত। ধ্রুপদী মানে উত্তীর্ণ এসব উপন্যাস সব সময়ের, সব যুগের, সব মানুষের উপযোগী। মানুষের আত্মার সাথে সম্পৃক্ত এ ধরনের শিল্প-সাহিত্য বাংলা ভাষায় খুব কমসংখ্যক লক্ষ্যণীয়। শফীউদ্দীন সরদার এক্ষেত্রে অতুলনীয়। তাঁর নির্মাণ-কলা ও শিল্পোৎকর্ষের চমৎকার নিদর্শন বখতিয়ারের তলোয়ার, গৌড় থেকে সোনারগাঁ, যায় বেলা অবেলায়, বিদ্রোহী জাতক, বার পাইকার দুর্গ, রাজ বিহঙ্গ, শেষ প্রহরী, প্রেম ও পূর্ণিমা, সূর্যাস্ত, বিপন্ন প্রহর, পথহারা পাখী, বৈরী বসতি, অন্তরে প্রান্তরে, দাবানল, ঠিকানা, ঝড়মুখী ঘর, অবৈধ অরণ্য প্রভৃতি উপখ্যান; যা পাঠক-গবেষক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন।
পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে রাখা ইতিহাসের নির্যাস ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া দেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিকদের নৈতিক দায়িত্ব। ভারতীয় বুদ্ধিজীবী গোলাম আহমাদ মোর্তজা যাকে বলেছেন, ইতিহাসের ইতিহাস বা চেপে রাখা ইতিহাস। জাতীয় প্রয়োজনেই এসব লুপ্ত ইতিহাসের মনিমাণিক্য ও গুপ্তধনভা-ার উদ্ধার হওয়া দরকার। আর এ কাজটিই করেছেন শফীউদ্দীন সরদার তাঁর কথারাশির ছত্রে ছত্রে। সরদারের উপন্যাস মানেই ভাংচুর ও নতুনত্ব। ভাংচুর বলতে বুঝাচ্ছে, উপন্যাসে বিগত দুশতাব্দীর গতানুগতিক ধারা বদলে নতুন সমীকরণের জন্ম দিয়েছেন লেখক। নতুনত্ব মানে, অহির বিশ^াসের আলোকে জাতির সম্মুখে এক নতুন থিম হাজির করেছেন। তাঁর কীর্তি তাঁকে অদূরভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যে মহানায়কের মর্যাদায় সিক্ত করবে। হয়ত তিনি তখন থাকবেন ইহজগতের আলো-বাতাসের বাইরে। পাশ্চাত্যের নামজাদা কবি, নাট্যকার, সনেট রচিয়তা সেকসপিয়র দুনিয়া জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁর মৃত্যুর দুশো বছর পর।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে অজ্ঞাত, অজানা, অচেনা, অচর্চিত, অকর্ষিত বিষয়ের উপস্থাপন তাঁর উপন্যাসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই দিকটা বরাবরই উপেক্ষিত ছিলো বাংলা সাহিত্যে। তিনি এই অভাব পূরণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে বিশ^াসী কথাকারদের মধ্যে ইতিহাসের আলোকে উপন্যাসে প্রথম হাতেখড়ি মীর মশাররফ হোসেনের। অত:পর সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর। কারও কারও মতে, সিরাজীর গ্রন্থগুলো ছিলো বঙ্কিমচন্দ্রের বিদ্রুপাত্মক রচনাবলির বিপক্ষে জবাবি উপন্যাস। বিগত শতাব্দীর শেষ দশক ও চলতি শতাব্দীর শূন্য দশকে শফীউদ্দীন সরদার ইতিহাস-ঐতিহ্য আশ্রয়ী উপন্যাস লিখে আলোড়ন পয়দা করেছেন বাংলা কথাসাহিত্যে। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের পাশাপাশি উপন্যাসে লোকজ উপকরণ, গ্রামীণ পটভূমি, পুঁথিসাহিত্যের ভাষা প্রয়োগে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। একই সাথে প্রতিষ্ঠিত সেকুলার চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে সত্য ও ন্যায়ের সৌধের ওপর গণমুখী সমাজ নির্মাণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন পাঠকদের। গতানুগতিক সাহিত্যকর্মের বিপরীতে এমন একটি বিষয় উপস্থাপন করেছেন যেখানে বোদ্ধা পাঠকম-লী জীবনের দিকনির্দেশনা লাভ করতে পারবেন। তাইতো তাঁর উপন্যাস মানেই নতুন চমক, নতুন আকর্ষণ, নতুন বিষয়বস্তু।
সাহিত্যে শব্দ প্রয়োগ ও ব্যবহারে তিনি এক নতুন রীতি প্রয়োগ করেছেন। হারিয়ে যাওয়া হাজারো শব্দের সফল প্রয়োগে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। এছাড়া গ্রামের সাধারণ খেঁটে খাওয়া চাষি, মজুর, মাঝি-মাল্লাদের ব্যবহৃত চিরন্তন শব্দ বা লফজকে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখনীতে। আর বাংলা ভাষার মূলধারা এর মধ্যেই নিহিত। এ বুলি বা জবানই আমাদের বাংলা ভাষা, মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। সংগীত স¤্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ যথার্থই বলেছেন, মহিষাচরক মৈষালদের ভাষাই আমার মাতৃভাষা।’ অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে এই ভাষাই ছিলো সরকারি ভাষা, সাহিত্যের ভাষা, জনগণের ভাষা। পুঁথি সাহিত্যে লুকিয়ে আছে সেই ভাষার মাহাত্ম্য। কথিত ভদ্র বা শহুরে সমাজ যাকে ‘বটতলার সাহিত্য’ নামে ব্যাঙ্গাত্মক উপাধি দিয়েছে। এ নিবন্ধে সরদারের বিভিন্ন উপন্যাস থেকে কিছু শব্দ হাজির করা হলো। যেমন: আওলাদ, আহলাদ, আজব, তেজ, তাজী, শানদার, দিমাগ, বেয়াকুফ, খামুশ, চোপরও, মামুলি, না-লায়েক, না-পছন্দ, নাদান, মিল-মহব্বত, মোলাকাত, হররোজ, হপ্তাহ, হপ্তাকাল, হাজির, হুকুমবরদার, আওয়ারা, আওয়াজ, শাদি, ওয়াক্ত, হককথা, সাচ্চা, হুঁশ, হুঁশিয়ার, নিদ, বেগানা, আউরত, তলব, রিস্তেদার, হল্লা, আদমী, বেগম, খোয়াব, ঈমানদারী, সওদা, ফাই-ফরমায়েশ, খানাপিনা, গরজ, খোশ আমদেদ, আক্কেল, কয়েদ, লেবাস, বদল, গোস্বা, তওবা, কব্জা, মাফ, খবরদার, বাহানা, মোকতাছার, তামাম, খুবসুরত, আলবত, খোশনসিব, খাস, তারিফ, তোয়াজ, ওস্তাদ, মুসিবত, নওজোয়ান, নওজোয়ানী, ফৌজ, মাতবর, কসুর, গোস্তাকি, হুজুরাইন, সালার, খাদেম, তাকিদ, বরদাস্ত, কিসমত, আম্মা, ঘোড়সওয়ার, মজাক, ঈসায়ী, হকদার, খতম, জান, গজব, জমিন, মুনিবগিরি, সাফদিল, নফর, নকরি, খেয়াল, মালিকা, জিঞ্জির, তাজ্জব, নজর, খোলাসা, জবাব, হাজেরান, হাজেরান মজলিস, জোর প্রয়াস, কামিয়াব, ইনাম, জিয়াদা, লহমা, লহমা খানেক, আলাদা, যুদা, ওয়ালেদ, খোশদিল, মজলিসে কুতুব, মোহতারাম, মজবুত, নারাজ, দানাদার, আসমানি, জরুর, ফুরসত, কোশেশ, জলদি, মারহাবা, মাশয়াল্লাহ, জবরদস্ত, মোবারকবাদ, মেজাজ, আনযাম, খাতির, খিলাত, খিতাব, খামাখা, ইনসান, পলক, উতলা, সহি-সালামতে, হাওলা, বাহাদুরী, জানবাজ, নেকবান্দ, মালিকানা, বিলকুল, সাহিবাত, না-ফরমান, মোনাফেক, নওকর, ওরফে, আফসোস, খতম, হা-হুতাশ, দিউয়ানা, নাদান, নালায়েক, স্বগরজ, কুরসি, বাদি, শিগগির, গোস্বাভরে, ইরাদা, ইসাদি, হুজুর, বান্দা, লেশমাত্র, সালার, মুসিবত, তালাশ, তালিম, জিন্দেগী, তকলিফ, সাফ, মারহাবা, মেহেরবান, রওনা, বিলকুল, আন্দাজ, মকান, দরাজদিল, খাসমহল, কাহাকার, গর্দান, হলফ, মোলাকাত, মশগুল, বিরাম, লেবাস, নাশতাপানি, সালুন, জিন্দালাশ, খাশা নসিব, ইল্লত, ফায়সালা, গজর গজর, দহলিজ, জরুর, এযাজত, নাস্তানুবুদ, সামাল, জমায়েত, বেজায়, মস্তবড়, তলোয়ার, তরফ, হুঁশিয়ারে, মুলুক, লেকিন, ফৌজ, মৌজ, জোয়ান, দোস্তী, দুশমন, একিন, খেলাপ, বর্তন, কসুরমন্দ, সাচ, দৌলতদার, ফাটক, বেঈমান, দাগা, চোট, বিবাগী, হা-পিত্তেশ, মুনিব, বানু, বেগম, দিলের খদ্দের, দুনিয়া উজালা, পয়গাম, কাতারে কাতার, তামাম খেদ, তামাশা, বহিন, আবদার, মউত, নাখোশ, ফাও, তাবোড়-তাবোড়, কাবু, উন্মাদ, মানে, রাজী, দেরী, বেগার, লা-ওয়ারিশ, কদর, ফুরসত, খোশকণ্ঠে, কায়েমী পছন্দ, সেরেফ, মুরুব্বী, জোশ, ফায়দা, বুলন্দ, বেত্তমিজ, নেমকহারাম, ফায়দা, বুলন্দ আওয়াজ, বেত্তমিজ, কলব, ফালতু, অন্দরমহল, হাওলা, অদনা, খাশা, লহমাখানেক, আসমানী সুরত, দজ্জাল, তসবির, লেড়কী, উমদা, ঝরোকা, খছম, আহাম্মকী, মুহব্বত, মিসমার, মঞ্জুর, নামঞ্জুর, ওস্তাদ, নাজানা, মার্জনা, তোফা, গোস্তাকী, মরদ, হয়রান, পেরেশান, বানায়্যা, বেখেয়াল, হাকিম, হাকিমী, হুকুমজারী, খামখেয়ালী, মালপত্তর, জিগির, খাল্লাস, বেহুদা, হায়াত-মউত-রেজেক, আপছে আপ, হালত, বরাত, আস্তানা, ফকিন্নী, গোছলখানা, দুস্তী, দুশমন প্রভৃতি হৃদয় উদগত শব্দ আমাদেরকে শেকড়ের দিকে ফিরতে উদ্বুদ্ধ করে।
জাতীয় মন ও মননের কথাশিল্পী, শেকড়সন্ধানী নিরলস সাহিত্যকর্মী শফীউদ্দীন সরদার। মানুষের মৌখিক বচন আর সাহিত্যের ভাষা এক ও অভিন্ন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। নামজাদা সাহিত্যিক শ্রী প্রমথ চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন, ‘মানুষের মুখের ভাষাই কলমের ভাষা উচিত।’ কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এই সিলসিলা কায়েম হয় নাই কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামি চক্রান্তে। সাম্প্রদায়িক ইংরেজ গোষ্ঠী ও ফোর্ট উইলিয়াম সৃষ্ট কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবি ও কলম সৈনিকরা বাঙালির মুখের ভাষা আর লেখ্যভাষার মধ্যে ফারাক পয়দা করে। উনিশ শতকের সেই ষড়যন্ত্র আজও বহাল। শফীউদ্দীন সরদার সেই ভ্রান্তির কবল ছিন্ন করে আম জনতার মুখের জবান ও বুলিকে লেখ্যরূপে প্রতিষ্ঠার কোশেশ করেছেন মাত্র। এই প্রচেষ্টাই তাঁকে অমর করে রাখবে চিরকাল। বইয়ের ভাষা আর মৌখিক ভাষার তফাত কমিয়ে না আনলে ভাষা তার গতিশীলতা হারিয়ে ফেলে। কথ্যরূপ ও লেখ্যরূপের ফারাক জিরো পর্যায়ে নিয়ে আসার মাধ্যমেই ভাষাকে সমৃদ্ধশালী করা সম্ভব। এ মিশন বাস্তবায়নে শফীউদ্দীন সরদার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় তিনি দীপ্তিময়তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। গল্প, কবিতা, নাটক, রম্য, রূপকথা, শিশু সাহিত্যে তাঁর কলম এখনও ঘূর্ণায়মান। নীরবে, নিভৃতে, তিনি লিখে চলছেন প্রায় চার দশক। অথচ বাংলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে কম আলোচিত। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা শয়ের কাছাকাছি। চলনবিলের পদাবলী, রোহিনী নদীর তীরে, বখতিয়ারের তিন ইয়ার, দখল, ঈমানদার, শাহ্জাদী, আওয়ারা, লা-ওয়ারিশ, খিজির ও কাফুর, শের খান, সোনার হরিণ, থার্ড প-িত, অমরত্বের সন্ধানে, মুসাফির, অপূর্ব অপেরা, শীত বসন্তের গীত, পাষানী, গুনাহগার, রাজ নন্দিনী, চাঁদনী ইসলাম, দ্বীপান্তরের বৃত্তান্ত, প্রিয়তম বা মরুদ্যান, দুপুরের পর, দেশপ্রেম, খোঁজ, সর্বজনীন কাব্য, সুদূর মক্কা মদীনার পথে, সুলতানের দেহরক্ষী, ভূতের মেয়ে লীলাবতী, পরিরাজ্যের রাজকন্যা, রাজার ছেলে কবিরাজ, যাদুর বাঁশি, বুড়ির ঘুড়ি, বারো ভূইয়ার উপাখ্যান প্রভৃতি তাঁর কীর্তিরাজি। সংখ্যায়, গুণে, মানে অনন্য হলেও তিনি সকল প্রকার জাতীয় পুরস্কার, এনাম, খেতাব, পদক, সম্মাননা থেকে বঞ্চিত। এর কারণ কী? রহস্য কোথায়? এত বড় একজন গুণীশিল্পী ও কীর্তিমানের কদর নেই কেন? রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে না কেন? বাংলা একাডেমি তাঁর ব্যাপারে উদাসীন কেন? মিডিয়া কভারেজ নেই কেন? সবগুলো সওয়ালের জওয়াব একটাই। আর তাহলো- তিনি ইমানদার সাহিত্যশিল্পী।