বাংলাদেশের আদিবাসী

মাহমুদ ইউসুফ ।।

বাংলাদেশে মানববসতির সূচনাকালের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিক বিবরণী অস্পষ্ট নয়। বাঙলা ভূভাগে মানুষ আগমনের ধারবাহিকতা মামুলি কোনো ঘটনা নয়। এর ব্যাকগ্রাউন্ডে রয়েছে অহির নির্দেশনা। আসমানি তাগিদেই মানুষের জয়যাত্রা ঘটে গাঙ্গেয় উপত্যাকায়। বাঙালি বয়ানের চাঞ্চল্যকর কাহিনি ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। সেই তথ্য আবহমান বাঙলার সাথে সংযুক্ত করেছে এক ঐন্দ্রজালিক কাণ্ড। রূপকথাকেও হার মানিয়েছে সত্যিকার ঘটনাবলি। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস এতকাল ছিলো পর্দার অন্তরালে। একালের গবেষকরা নির্ভরযোগ্য তথ্যাবলি উপস্থাপন করেছেন পাঠক সমীপে।

নবি আদমের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষের শোভাযাত্রা। ক্রমান্বয়ে মানুষের মিছিল মহিরুহ হতে থাকে। সৃষ্টি হয় বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, দল, উপদল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, পথ, মত, আদর্শ। বাঙালি জাতিও আদম পরবর্তী প্রজন্মের একটি শাখা। মানুষ সৃষ্টির উষাকালে বাংলাদেশে মানববসতি ব্যাপক বিস্তার লাভ করেনি। যদিও কথিত আছে আদি পিতা আদম প্রথম প্রেরিত হয় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। সেটা ভিন্ন বিষয়। সূচনাকালে মানুষের জয়যাত্রা ছিলো আরব-ইরাককেন্দ্রিক। বাংলাদেশে মানুষের বসবাস শুরু হয় আদমের মৃত্যুর শত সহস্র্র বছর পর। প্রথম রসুল নুহ আলাইহিস সালামের বংশধররা বাঙলায় বসবাস শুরু করেন। গাঙ্গেয় উপত্যাকা তথা বঙ্গীয় বদ্বীপে সর্বপ্রথম যার পদচারণা ঘটে তিনি হলেন বঙ বা বং বা বঙ্গ। বঙ হলেন নুহ নবির প্রপৌত্র ও আদমের ১৪তম অধস্তন পুরুষ। আদম →শিষ →আনু →কাএন →মাহলা এল →য়্যারবু →উখনুখ →মুতাশলাখ →লামাক →নুহ →হাম →হিন্দ→বঙ। বঙ থেকেই বাঙলা, বাংলা, বাঙ্গালা, বেঙ্গল, সুবে বাঙলা, বাংলাদেশ। বঙ্গীয় উপদ্বীপ বা বঙ্গোপসাগর আজও নুহ নবির স্মৃতি বয়ে চলছে। তাই বঙ বা বঙ্গই বাঙালি জাতির আদি জনক, আদি পুরুষ, আদি পিতা, আদি ব্যক্তিত্ব। ।

ষাট গম্বুজ মসজিদ মূল ভবন

মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াও জ্ঞান অনুসন্ধিৎসুদের আবেগকে অবমূল্যায়ন করে নাই। সত্যকে চিরদিন চেপে রাখা যায় না। একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত মানুষের চোখে ধোঁয়াশা উদ্রেক করা যায়। সেই ব্যর্থ দৃষ্টির অবসান ঘটছে একবিংশ শতকে। নুহ নবির প্রপৌত্র বঙ সম্পর্কে মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার বক্তব্য, ‘বঙ্গ (কিংবা বঙ বা বং) ছিলেন একজন কিংবদন্তি বংশধর যিনি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপনকারী বলে মনে করা হয়।
বঙ্গকে হিন্দের ছেলে ও হামের (হজরত নুহের ছেলে) নাতি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম শতাব্দীর রোমানো-ইহুদি ইতিহাসবিদ ফ্ল্যাভিয়াস জোসেফাস জোর দিয়েছিলেন যে হামের বংশধরেরা এশিয়ার কিছু এলাকায় জনবহুল ছিল। গুলিয়ানার হাফিজ শামসুদ্দিন দাবি করেছিলেন যে হজরত হাম বর্তমান পাকিস্তানের ‘গরিবওয়াল’ নামক একটি শিয়া-জনবহুল গ্রামে মারা গিয়েছিলেন, যেখানে আজও একটি ৭৮ ফুট লম্বা কবর পাওয়া যায়।
অনেক নথিভুক্ত সূত্র এবং ইবরাহিমি ইতিহাসবিদদের মতে, পিতৃপুরুষ বঙ্গই প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন যা এখন দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। এতে বলা হয়েছে যে সেখানে বসতি স্থাপনের পর, তার আওলাদ হয়েছিল এবং বঙ্গ নামে পরিচিত একটি মহান জাতি কায়েম করেছিলেন। এ কথাটি ১৬ শতাব্দীর ইতিহাসবিদদ্বয় ফিরিশতা এবং আবুল-ফজল ইবনে মুবারক দ্বারাও সমর্থিত।’ এ তথ্যের আলোকে সুনিশ্চিত যে, বঙই বাঙালি জাতির আদি জনক। নুহ নবির সাথেই বাঙালি জাতির রিশতা বা মূল সম্পর্ক।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আবদুল করিম লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের কোন অংশ কোন সময়ে বাঙ্গালা ছিল না। তারা ছিল রাঢ়, সুমো। বঙ্গ নামটা এসেছে হযরত নুহ আ. এর পরে। ওই সময়ে সংঘটিত প্লাবনে হযরত নুহ আ. তাঁর কিস্তিতে তিনি নিজে ও তাঁর আত্মীয়স্বজন আশ্রয় নিলেন। প্লাবনের পরে অন্য সবকিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেলে তিনি আবার সেটলমেন্ট শুরু করেন। তিনি তাঁর ছেলেদেরকে বিভিন্ন স্থানে পাঠান সেটল করার জন্য। আর তাঁর এক ছেলের বংশধরের একজন যার নাম ছিল বঙ্গ। অর্থাৎ নুহ আ. এর নাতি বঙ্গের নামানুসারেই এই বঙ্গ জাতি বা বঙ্গ দেশের উৎপত্তি ঘটে বলে জানা যায়।’ [আবদুল হাই শিকদার, বাংলা সাহিত্যে: নক্ষত্রের নায়কেরা, পৃ ২৭২] ইতিহাসবিদ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ‘বাঙ জাতি চন্দ্রদ্বীপ আবাদ করে। তাদের নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় বাঙ্গালাবাদ।’ [বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, পৃ ১৪৮-১৪৯] প্রকৃতপক্ষে নবি নুহের উত্তরসূরীরাই বঙ বা বাঙ জাতির কর্ণধার

নুহ প্রপৌত্র বঙ উপনিবেশিত অঞ্চলে একটি সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জাতির জন্ম দেন। বিশ্বাসী ও আসমানি সংস্কৃতিই ছিলো সেই জাতির পথচলা। তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্ণীত হয় তাওহিদের আলোকে। তাওহিদি কৃষ্টিই বাঙ জাতির অবদান। অহি নির্দেশিত পথই ছিলো তাদের পথচলা। তাদের জীবন জীবিকা তাওহিদের ভিত্তিতে নির্ণীত। তাই বলা যায় ইসলামি সংস্কৃতি আর বাঙালি সংস্কৃতি মুদ্রার অভিন্ন পিঠ। বাঙালি ও সংস্কৃতিতে আদম-নুহের জীবনধারা শুধু অনুঘটক বা প্রভাবক নয়। বাস্তবিকই উভয়ের উৎস একই বিন্দুতে। বাঙালি কৃষ্টি আর ইসলামি তমদ্দুনকে পৃথক করার কোনো সুযোগ নেই। একালের আর্য-পৌত্তলিক রীতিনীতির সংমিশ্রণ কোনোক্রমেই আদি বাঙালি সত্তার সাথে মেলানো সম্ভব নয়। বঙ ছিলেন মুসলিম। উত্তরকালের বংশ পরম্পরায় তাঁরা ছিলেন ইসলামের অনুসারী। তাই মুসলমানরাই বাংলাদেশের আদিবাসী। মুসলিমরাই বাংলার আদিম অধিবাসী। মুসলিমরাই বাংলা মায়ের সন্তান। মুসলিমরাই বাঙলা পলিমাটির বীরপুরুষ। বঙের উত্তরসূরীরাই বাঙালি জাতি। এ সময়ের জনপ্রিয় কবি সায়ীদ আবুবকরের ভাষায়:

পরিচয়

আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি
বট-পাকুড়ের নিচে, হিজলছায়ায়, বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে
কত কাল মহাকাল। নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি;
আমার শরীরে হ্যামের শোণিতধারা। আমার অস্থিতে-হাড়ে

তাঁর পুত্র হিন্দের উজ্জ্বল উপস্থিতি, যাঁহার ঔরসে ছিল বঙ।
পিতা বঙ থেকে আমি এই বঙ্গে, বয়ে যাই তাঁরই উত্তরাধিকার।
আমার কোথাও যাওয়ার নেই। পাখি আর আকাশের নানা রঙ
দেখে দেখে আমার দিবস কাটে। কিভাবে হরিণ বাঘের শিকার

হয় বনেÑআমি তাও দেখি। কখনো আনন্দে হাসি, কখনো বা
কষ্টে শ্রাবণের মতো আমি কাঁদি। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে
তাজিং ডনের মতো থাকি আমি অবিচল- যেন জন্ম বোবা;
হঠাৎ দু’ঠোঁটে ফোটে খই, একতারা বেজে ওঠে বাউল এর হাতে।

কোথাও আমার যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি
বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে, সভ্যতার প্রায় সমান বয়সী,
প্রথম মানুষ এ দ্বীপের; নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি।
সকালের সূর্য আমার কুশল পুছে, জানায় শুভেচ্ছা আমাকে রাতের শশী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *