মাহমুদ ইউসুফ ।।
১৭৮৯ সাল। কোনো এক রজনী। নির্জন গভীর রাত। বাতাস বইছে ঝিরঝিরে। ঝড়াপাতার শব্দের হাজিরাও পষ্ট। নয় জোছনা ঝলোমলো। নেই চাঁদের আলো। তাঁরারাও উজ্জ্বলতায় ম্রিয়মান। গাছগাছালির পর্দা ভেদ করে নক্ষত্রের সেই মৃদু আলোর পক্ষে জমিনে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বলতে গেলে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারদিকে কালো অন্ধকারাচ্ছনতার রাজত্ব। সেই তিমিরকে ডিঙিয়ে ধীরপায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধূর্ত সেনারা। অজানা অচেনা গুম-খুনের মুদ্রা প্রাকটিসে পারদর্শী বাহিনী।
আজ পোষা কুকুরগুলোও ভুলে গেছে বুলি। কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ব্রিটিশ বাহিনী অতর্কিতে ঘিরে ফেলে সিকদার বাড়ি। আইন উদ্দিন সিকদার কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধৃত হলেন। ডাণ্ডাবেরি পরিয়ে রাতের অন্ধকারেই নিয়ে গেল। বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের অসহায় চোখগুলো পথ চেয়ে রইল। দানবেরা রেখে যায় শুধুই বুকফাটা আর্তচিৎকার। পরিবার চিরদিনের জন্য হারালো তাদের অভিভাবককে।
দেশপ্রেমের আলো জালিয়েছিলেন, উড্ডীন করেছিলেন ভালোবাসার আলো, মানবতার আলো, মানবিকতার আলো, নীতি-নৈতিকতার আলো, মনুষত্ববোধের আলো, একতার আলো, একত্ববোধের আলো, ঐকতানের আলো। ইংরেজ ডাকাতরা সেই আলোকে নির্বাপিত করে। দখিনের স্বাধীনতার সাম্রাজ্য এভাবেই ভেঙে পড়ে। শিশিরস্নাত সকাল সিকদারের কাছে অধরাই থেকে যায়। নদী নিরন্তর বয়ে যায়। কিন্তু নদীর বুকে আইন উদ্দিনদের মোলাকাত আর নেই। উল্লেখ্য বাকেরগঞ্জ বাংলাদেশের সর্বাদিক নদীবেষ্টিত উপজেলা।
উপনিবেশবাদী উৎপীড়কদের উৎপীড়ন উৎখাতে জীবনদায়িনী ব্যক্তিত্ব আইন উদ্দিন শিকদার। বাকেরগঞ্জের বীর বীরসম্রাট শেখ আইন উদ্দিন শিকদার ছিলেন বিবিচিনি নিয়ামতির নাগরিক। বাকেরগঞ্জে সাম্রাজ্যবাদী শাসন শোষনকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলেন আইন উদ্দিন শিকদার। ঔপনিবেশিক যুগে যাঁরাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে শির উঁচু করে দাঁড়াবার কোশেশ করত তাদেরকেই তারা ডাকাত, দস্যু, তস্কর। রাজদ্রোহী আখ্যা দিত। আইন উদ্দিন শিকদারও তাদের সিলেবাসের বাইরে যেতে পারনেনি। ব্রিটিশ নথিপত্রে আইন উদ্দিন শিকদার একজন ডাকাত। ব্রাহ্মণ বাবুর কলমেও ব্রিটিশ বুলির সার্থক প্রয়োগ, ‘১৮০৫ খৃস্টাব্দে মহম্মদ হায়াৎ ডাকাইতগণের নেতা ছিল। তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করিয়া দীপান্তরিত করা হয়েছিল।’ [শ্রী খোসালচন্দ্র রায়, হিস্টরি অব বাকেরগঞ্জ] নন্দিতরা এভাবেই নিন্দিত ব্রিটিশ রাজানুগত পণ্ডিত, লেখক সাহিত্যিকদের জবানিতে।
শেখ আইন উদ্দিন শিকদার ছিলেন কৃষক নেতা। কৃষক আন্দোলনের অগ্রদূত। ভাটি বাংলার কিংবদন্তি নায়ক। ভাটি মুল্লুকের মুকুটহীন সম্রাট। ভাটির রাজা। বিপ্লবী যুগের বিবর্তনবাদী। বাঙালি বীর, বাঙালি সন্তান। এ মাটির মানুষ। ভূমিজপুত্র। তাইতো এদেশের জন্যেই জীবন, সম্পদ ও রক্তকে বিলিয়ে দিয়েছেন। মা, মাটি ও মানুষের প্রতি ছিলো তাঁর সীমাহীন দরদ। অপরিমেয় প্রেম ও ভালোবাসা। অপরিসীম মায়া-মমতা। জাতির দুর্দিনে যারা দেশ রক্ষা ও মানবাধিকার রক্ষায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তারাই প্রকৃত দেশসেবক, সমাজসেবক। রক্ত দিয়ে যারা স্বাধীনতা আনেন আইন উদ্দিন শিকদার তাঁদেরই দলভুক্ত। জীবনের গোটা অর্জন বিসর্জন দিয়েছেন মানবসেবায়। তাঁর জীবনালেখ্য ও জীবনেতিবৃত্ত জাতিরাষ্ট্রের প্রয়োজনেই সামনে আনা জরুরি।
আইন উদ্দিন শিকদার কৃষক আন্দোলনকে বেগবান ও সজীবতা প্রয়াসকে রাখেন উজ্জীবিত। রক্ত পিচ্ছিল পথের যাত্রীদের আশার প্রতীক শেখ সিকদার। তাঁর বীরত্বগাঁথা, ত্যাগ, যুদ্ধ, জিহাদ, সংগ্রাম, প্রতিরক্ষা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা। বৈরি বাতাসে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে সিকদারের মুখে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল, আমি বাঙালি, আমি প্রতিবাদী, আমি সংগ্রামী বীর, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ। আমি ব্রিটিশ রাজত্ব মানি না, আমি স্বাধীন, স্বাধীনতার জন্য যা যা করা দরকার সবই আমি করব!’ তাইতো আইনউদ্দিন আমাদের জাতীয় বীর। জাতীয় চেতনার প্রতিচ্ছবি। জাতীয় নায়ক। জাতীয় মন ও মননের স্রষ্টা। আমরা ভুলিতে পারি না এই মহানায়ককে।
বরিশালের নিপীড়িত কৃষকরা আইন উদ্দিন সিকদারের নেতৃত্বে ইউরোপীয় ও তাদের আমলাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাকেরগঞ্জে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধেই বরিশালে পাকাপোক্ত হয় ব্রিটিশ থাবা। ইংরেজ বণিকদের অত্যাচার নিপীড়নে বাঙালি কৃষক ও লবণচাষীদের যাপিত জীবনে নেমে আসে লোমহর্ষক অধ্যায়। কোম্পানি এজেন্ট দেশীয় কৃষকদের বিনা অনুমতিতে লবণ তৈরি বন্ধ করে দেয়। কোম্পানি কর্মচারীরা শুরু করে বিনা শুল্কে লবণ ব্যবসা। এজেন্ট ও ইজারাদারদের দাদন ফাঁদে সর্বশান্ত হয় মোলঙ্গিরা। এছাড়া কোম্পানি বণিকরা চাষীদের সুন্দরবনে ধরে নিয়ে লবণ চাষে বাধ্য করত বিনা পারিশ্রমিকে।
এভাবে চলতে থাকে কোম্পানির অত্যাচার অবিচার, জুলুম নির্যাতন। কৃষকরা হয় সর্বশান্ত। এই দুঃসহ রজনীতে ১৭৮৭ সালে ঘটে ভয়াবহ প্লাবন। ফলে কৃষকদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ব্যহত হয় লবণ উৎপাদন। সংঘটিত হয় ভীষণ দুর্ভিক্ষ। এই দুর্যোগেও ব্রিটিশ অত্যাচার ও খাজনা আদায় হ্রাস পায়নি। বরং বাড়তে থাকে। ফলে বাকেরগঞ্জের কৃষকরা অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য হয়। গর্জে ওঠে তারা। রুখে দাঁড়ায় জমিদার ও রাজস্ব কর্মচারীদের অনাচারের বিরুদ্ধে। বুজুর্গ উমেদপুর পরাগণার তালুকদার আইন উদ্দিন সিকদার বিদ্রোহী কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন।
সরকার ডাকাত আখ্যা দিয়ে ১৭৮৯ সালের এক গভীর রাতে তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে বন্দি করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের পর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেউ বলেন, তাঁকে খুন করে বিষখালি নদীতে ফেলে দেয় ইংরেজ সৈন্যরা। আবার কেউ বলেন তাঁকে নির্বাসনে দেওয়া হয় সাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। স্বাধীনতাকামীদের শেষ পরিণতি কী এটাই? দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা তাঁদের স্মরণে রাখি নাই। দেশপ্রেমের কাছে হেরে যায়নি সিকদার। হেরে গিয়েছে সময়ের কাছে। বিষয়টি অনুধাবন করা জরুরি।