প্রফেসর জাহান আরা বেগম ।।
সকল প্রতিকূল পরিবেশেও যিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি সমান ভালোবাসা দিতে পারেন- তার নাম মানবতা। যুগে যুগে এক এক দেশে এমন কিছু মানুষের জন্ম হয় যাদের কর্মই বলে দেয় তিনি এই ধরায় না এলে জাতির উত্থান হোতো না।আমাদের বাংলা সাহিত্যে এমন একজন কবির আর্বিভাব হয়েছে যিনি না হলে আমাদের সাহিত্য যেমন অপূর্ণ থাকতো তেমনি আমরা আমাদেরও চিনতে পারতাম না, আমাদের সঠিক অবস্থান জানতে পারতাম না, পরাধীনতার শৃংখলে বাঁধা বাঙালি জাতি নিজেদের কি করণীয় কি বর্জনীয় কিছুই বুঝে উঠতে পারতো না। বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সংকটকালে ধূমকেতুর মতো আলো ছড়িয়ে এলেন আমাদের কবি, মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুল সাহিত্যের প্রায় প্রত্যেক শাখায়ই তার মানবতার চরম প্রকাশ দেখতে পাই। তিনি সমস্ত কিছুর উর্দ্ধে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। সমাজে যে অলিখিত শ্রেণি বৈশম্য আছে তিনি তা স্বীকার করেন নি। সকল মানুষের সমান অধিকার ও সম্ভাবনার দিকে জোর দিয়েছেন এবং সব মানষের চিরন্তন স্বাভাবিক আশা-আকাঙক্ষা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। এ জন্য তিনি সব মানুষের কবি। মানবতার কবি। আমাদের দেশের মানুষের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সামাজিক বা কূল মর্যাদার মিথ্যা অহংকার। কিন্তু কবি এই ভেদাভেদ পছন্দ করেন নি। তিনি ‘যুগবাণী’তে লিখেছেন, ‘সমাজ বা জন্ম লইয়া এই যে বিশ্রী উচুঁ-নিচু ভাব তাহা আমাদিগকে জোর করিয়া ভাঙ্গিয়া দিতে হইবে। আমরা মানুষকে বিচার করিব মনুষ্যত্বের দিক দিয়া, পুরস্কারের দিক দিয়া। এই বিশ্বমানবতার যুগে যিনি এমন করিয়া দাঁড়াইতে পারিবেন তাহাকে আমরা বুক বাড়াইয়া দিতেছি।’
নজরুল বর্তমানকে যে অবস্থায় পেয়েছেন তার চেয়ে উন্নততর নতুন বর্তমান গড়ে তুলবার প্রয়াসী মানবতার কল্যাণের রথ সর্বদা সামনের দিকে চলতে হবে, পিছনের দিকে তাকিয়ে হা-হুতাশ করে কোনো লাভ নেই। ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষ পাশ্চাত্যের জাগরণের বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। পৃথিবী ব্যাপী সমস্যা ও সংকট ভারতবর্ষে আত্ম-প্রকাশ করলো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকেই। এ দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন হতে লাগলো। এ সমস্ত পরিবর্তন এ দেশের সাংস্কৃতিক জীবনকেও গভীর ভাবে আলোড়িত করে তুললো। বিশ্বযুদ্ধের মহা ঝড়ের পরে এ দেশের মানুষ যখন আশা করেছিলো দেশবাসীর কপালে এবার মুক্তির প্রাপ্তি ঘটবে তখনই এলো ভারত সংস্কৃতির আইন। আবারও জোর জুলুম অত্যাচার। এ দেশে তথা পৃথিবীর উত্তপ্ত পরিবেশে নজরুল প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিলো, প্রথম মহাযুদ্ধের বিভিন্ন আন্দোলন তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। তিনি কতগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
যুদ্ধোত্তর কালের নৈরাজ্য বেদনা ও অস্থিরতা নজরুল সাহিত্য ও সংগীতে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়। এ দেশের মাটি ও মানুষ তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছিলো। কৃষক-শ্রমিক ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের অবক্ষয় ও ভাঙনের ছবিও তার সৃষ্টির মধ্যে ধরা পড়েছে।
মূলত নজরুল গণমানুষের কবি, মানবতার কবি। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে মানবতার সুর, মানবতার প্রতি বিশ্বাসে তিনি সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তাই তার সাহিত্যে মানব প্রত্যয় দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি পোষণ করেন। মানুষের ব্যথা-বেদনা তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করতো, তাই মানুষকে নির্যাতিত, অপমানিত হতে দেখে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নজরুল মানুষের লাঞ্ছনা অপমানে দুঃখিত ও ব্যথিত হয়েছেন আবার লাঞ্ছিত মানুষের দুঃখ বেদনা অবসানের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা তার সাহিত্যে দেখতে পাই। মানুষ সম্বদ্ধে তাঁর ধারণা অনেক উচুঁ, তিনি মানুষের আত্মিক শান্তির বিপুলতায় বিশ্বাসী। কোনো ধরণের মানুষই তার কাছে ক্ষুদ্র-তুচ্ছ নয়, হেলা-ফেলার নয়। প্রত্যেক মানুষের মাঝেই আছে বিপুল সম্ভাবনা। তাঁর মতে, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।’
নজরুল নিজের ব্যক্তি জীবনের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টকে আপন করে অন্তরের অনুভূতি দিয়ে বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের দুঃখ-কষ্টকে অনুভব করেছেন। তার কাছে মানুষই ছিলো প্রধান, তার জাত-পাত নয়। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি তার কাব্য সৃষ্টির পক্ষে কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বলেছেন, মানুষকে অবহেলিত, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত এবং অত্যাচারিত- উৎপীড়িত হতে দেখে তিনি বিদ্রোহী হয়েছেন। সমাজের ঐ সমস্ত বঞ্চিত ব্যথিতরাই তার কবিচিত্তকে নাড়িয়ে তুলেছে। সমাজের নিম্ন শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ তার হৃদয়ে একটা গভীর দরদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কবির মধ্যে যে গুনগুলো প্রধান রূপে দেখা দেয় তা হলো- সাম্যবাদী, অসাম্প্রদায়িক, নারী মুক্তির আহ্বায়ক, চির বিদ্রোহী। এ সবের মূলে রয়েছে তার মানবতাবাদী চেতনা, ধনীরা দরিদ্রকে শোষণ করে দিনের পর দিন স্ফীত হচ্চে আর দরিদ্ররা ক্রমাগত নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব হচ্ছে। এ অন্যায় তিনি সহজে মেনে নিতে পারেন নি, মানুষের প্রতি গভীর দরদের কারণেই তিনি তার সাহিত্যে বেদনাহত মানুষের ছবি আঁকতে পেরেছেন সহজেই। তাই তো তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন-
‘দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে।
চোখ ফেটে এলো জল, এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।’
– ( কুলি মজুর )
আবার ‘কৃষানের গান’ দেখি-
‘আজ চারিদিক হতে ধনিক ধনিক
শোষণ কারীর জাত ও ভাই জোকের মত
শুষছে রক্ত, কাড়ছে থালার ভাত।
শ্রমিকের গানে-
‘যত শ্রমিক শুষে নিঙরে প্রজা
রাজা উজির মারছে মজা।’
সকল মানবতার পক্ষে এ নিদারুণ লজ্জা ও অপমানের।
‘এক জনে দিলে ব্যথা
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা
সকলের বুকে হেথা।’
বিধাতা সৃষ্ট মানুষ সবই কবির কাছে সমান, সেখানে চন্ডাল সম্রাট এর মধ্যে কোনো ধরণের পার্থক্য ছিলো না।
‘ওকে? চন্ডাল? চমকাও কেন ও নহে ঘৃণ্যজীব
ওই হতে পারে হরিশ্চন্দ্র ওই শ্মশানের শিব।’
কবি নজরুল তাঁর বিপুল মানবিকতা বোধের কারণে সমাজের সব স্তরে সমতা দেখতে চেয়েছেন, তিনি চেয়েছেন ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্য সমাজকে সমৃদ্ধ করুক, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর হোক। মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ আসে ধর্মকে অবলম্বন করে অথচ ধর্মের নামে ধর্মের ধ্বজাধারীদের অত্যাচার তিনি মেনে নিতে পারেন নি।
‘খোদার ঘরে কে লাগায় কপাট
কে দেয় সেখানে তালা
সব দ্বার এর খোলা রবে,
চালা হাতুড়ি শাবল চালা।’
ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ভেদাভেদ তিনি মেনে নিতে পারেন নি, তাঁর ভাষায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ হলো স্রষ্টাকে অপমান করা, স্রষ্টা যেখানে ধর্মের সীমাবদ্ধ গন্ডিতে মানুষকে বেঁধে রাখেন নি সেখানে মানুষ কেন মানুষ নিয়ে এই হীন খেলা খেলবে?
‘জাতের চেয়ে মানুষ সত্য
অধিক সত্য প্রাণের টান
প্রাণ ঘরে সে এক সমান।’
তাঁর সত্য মন্ত্রে এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। নারী-পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত হবে এটাও তিনি সহজে মেনে নিতে পারেন নি। তাঁর মতে এই সত্য স্রষ্টার সৃষ্টি সব নর-নারী সমান। নারীর অবমাননা তো মানবতার অবমাননা।
নজরুলের সমস্ত সাহিত্য কর্মের মধ্যেই একই সুর বেজেছে- সে সুর হলো মানবতার। কবির কাব্যে তো মানবতা প্রকাশিত এমনকি তাঁর উপন্যাস, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধগুলোতেও মানুষ, মানবতা প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর উপন্যাস, ছোট গল্পের দরিদ্র চরিত্রগুলো নিপুণভাবে তুলে ধরে তিনি মানুষকেই, মানবতাকেই সম্মান জানিয়েছেননন। তাঁর অন্যান্য সাহিত্য কর্মগুলোও মানবতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ।
মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষের কর্ম দিয়ে, মন দিয়ে, আচার-আচরণ দিয়ে কবির কাছে যিনি শ্রেয় তিনিই সঠিক- তিনিই খাঁটি, তিনিই শ্রদ্ধার। উচুঁ নিচু ভেদাভেদ অর্থহীন এবং হাস্যকর। এই সত্য উপলব্ধি করতে পারার কারণেই তাঁর সমগ্র সাহিত্য কর্মেই মানবতার সুর ধ্বনিত হয়েছে। তাই তো এক কথায় বলা যায়, নজরুল মানব দরদী কবি, মানুষের কবি।
প্রফেসর জাহান আরা বেগম
সাবেক বিভাগীয় প্রধান
বাংলা বিভাগ, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল
তথ্যসূত্র: মুক্তবুলি ম্যাগাজিন, ৩২তম সংখ্যা (মার্চ-এপ্রিল ২০২৪)