মাহমুদ ইউসুফ
বাংলার শষ্যভাণ্ডার বরিশাল। ইংরেজরা দিয়েছিল এ খেতাব। বরিশালের বালাম চাউল আজও বিশ্ববিখ্যাত। সুপারি, নারিকেল, ইলিশে এ জেলা ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাকেরগঞ্জের বাকরখনি বা সোনারখনির লোভ ইংরেজরা সামলাতে পারেনি। উদ্বৃত্ত সম্পদ সবই লুটেপুটে খেত ব্রিটিশ ও তাদের এজেন্ট জমিদাররা। তাইতো এতদাঞ্চলের কৃষক, দিনমজুররা বার বার ফুসে ওঠেছে ইংরেজ, জমিদার, জোতদারদের বিরুদ্ধে। আশু আকন্দ এই সংগ্রামী মানুষদেরই একজন।
জন্ম বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার চাঁদপুর গ্রাম। পিতা জহিরুদ্দিন আকন, দাদা শেখ মোহন, পরদাদা শেখ কুতুব উদ্দিন। চার ভাইয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হলেন আশু আকন্দ। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে প্রতিবাদী মনোভাব স্থানীয় জনগোষ্ঠী টের পেয়েছিল। সেই জিহাদি চেতনা থেকেই মহৎ কাজে শরিক হন যৌবনের প্রারম্ভে। তাই যুবক বয়সে যখনই তিনি কৃষক বিপ্লবের ডাক দেন তখনই কৃষক শ্রেণি তাঁর ডাকে সাড়া দেন। আশু আকন্দের নেতৃত্বে চাষি সমাজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে।
‘লাঙ্গল যার জমি তার’- এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন আশু আকন্দ। উনবিংশ শতাব্দীতে মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ায় কৃষকদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, লুণ্ঠনের স্টিম রোলার চলে। উলানিয়ার জালিম জমিদারের ক্রুদ্ধ রোষানলে কৃষকরা সর্বশান্ত হয়। জমিদারদের নায়েব, গোমস্তা, পেয়াদা ও লাঠিয়ালদের দৌরাত্মে কৃষকরা আত্মাহুতি দিতেও বাধ্য হয়। এই নরক জ্বালাযন্ত্রণার মধ্যে আশু আকন্দ আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হয়ে তাদের মাঝে।
উলানিয়ার ২২টি গ্রামের কৃষকদের নিয়ে আশু আকন্দ জমিদার বিরোধী সংগ্রামের ডাক দেন। চাষি মজুররা যোগ্য নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেয়। জনতার শত্রু জমিদার বিদ্রোহী প্রজাদের জমি নিলামে উঠায়। স্থানীয় জনসাধারণ একতাবদ্ধ থাকায় নিলামি জমি খরিদ করার কোনো খরিদ্দার এগিয়ে আসেনি। নিলাম বিক্রি কার্যকর করার জন্য সরকার ১০ জন শিখ সৈন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু জনপ্রতিরোধে জমিদার বাহিনী পরাজিত হয়ে শিখ সৈন্যসহ পালিয়ে এ যাত্রা রক্ষা পায়। অবশ্য তাদের গুলিতে বেশ কিছু সংখ্যক কৃষক হতাহত হয়।
দুর্জনের বন্ধুর অভাব হয় না। যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকরাই সত্যপন্থীদের হত্যা করে জনতার দৃষ্টিকে ভিন্নপথে প্রবাহিত করে। পলাশির আম্রকাননে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মিরজাফর চক্রের উল্টোরথে নবাব সিরাজদৌলা পরাজিত হয়। উলানিয়ার মাটিতেও উমিচাঁদদের উত্তরসুরী ভবতোষ তরফদার চক্রান্ত করে ধরিয়ে দেয় আশু আকন্দকে। সময়টা ১৮৭৯, বাংলা ১২৮৬ সন। আশু আকন্দের দোস্ত ভবতোষ তরফদার। ১২৮৬ বাংলা সনের ১৫ ফাল্গুন ভবতোষ আশু আকন্দের সৌজন্যে তার বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আশু আকন্দ দুই জন সঙ্গী নিয়ে অনুষ্ঠানে গমন করেন। পূর্বেই সব সাজানো ছক ছিলো। জমিদার সৈন্যরা কুকুর নিয়ে ভবতোষের বাড়ি ঘেরাও করে। ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে ধৃত হলেন আশু আকন্দ। ইতিহাসবিদ সিরাজ উদদীন আহমেদ লিখেছেন, ‘ আশু আকন্দকে বন্দী করে জমিদারের লোকেরা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে। প্রথমে তার পায়ের আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। শরীরের চামড়া উঠিয়ে লবণ দেয়। চোখ উপড়ে ফেলে। অবশেষে গরম তেলের কড়াইতে তাকে ছেড়ে দেয়। কই মাছের মতো তাঁকে ভাজা হয়। তাঁর দেহ অবশেষে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। তাঁর মৃত্যুদেহের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।‘ এভাবেই একজন সংগ্রামী ও বিপ্লবী সৈনিক নওজোয়ানের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয় শোষক চক্র। সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী সেই অত্যাচারী জমিদারের উত্তরসূরী।
তথ্যপঞ্জি:
১. সিরাজ উদদীন আহমদ: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস প্রথম খ-, ভাস্কর প্রকাশনী, বরিশাল-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ জুলাই ২০০৩
২. আজিজুল হক বান্না: বরিশালে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রকাশ ১৯৯৪
৩.মনিরুজ্জামান শাহীন: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বরিশাল ১৯২০-১৯৪৭, সুবর্ণ, বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ: জানুয়ারি ২০১৭