স্বাধীনতা সংগ্রামে সৈয়দ ইমামউদ্দিন চৌধুরী

মাহমুদ ইউসুফ

পলাশির আম্র কাননে স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যগগনে। হানাদার ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষের ভাগ্য বিধাতার আসনে অবতীর্ণ হয়। ব্রিটিশ সরকার বিজয়ের স্মারক হিসেবে ১৮৮৩ সালে পলাশিতে নির্মাণ করে মনুমেন্ট। এই স্তম্ভ ইংরেজদের নির্মিত বিজয়স্তম্ভ। তাদের বিজয়গৌরবকীর্তির পাশেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাকীর্তি রক্ষণ সংক্রান্ত নির্দেশনামা বা সাবধানবাণী। যেখানে লেখা ‘এই মনুমেন্ট আমাদের জাতীয় সম্পত্তি। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার, আমার সকলের।’ [আবদুল হাই সিকদার: সিরাজদৌলা: মুর্শিদাবাদ, পৃষ্ঠা ১৮] জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জন্য বড়ই আনন্দের! ভারত সরকারের উচিত ছিলো ওই মনুমেন্ট গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে শোক স্মারক স্থাপন। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। ঐতিহাসিক তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন। তাঁর বয়ান: ‘ক্লাইভ এটাকে পাকা ক’রে তুললেও ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র। পশ্চিমবঙ্গে তখন বীরভূম ছাড়া আর সব বড়-বড় পরাগনায় হিন্দু জমিদার।… প্রকাশ্যে না হ’লেও, ভিতরে-ভিতরে প্রায় সব জমিদারই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।’ [তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়: পলাশির যুদ্ধ, পৃ ১৫৯] ইতিহাসকার বিমলানন্দ শাসমল বলেছেন: ‘ভারতবর্ষে হিন্দুরা বহুদিন থেকেই মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নিজেদের পারস্পরিক অনৈক্য ও সামাজিক দুর্বলতার জন্য মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা কার্যকরী কিছু করে উঠতে পারেন নি। কিন্তু ইংরেজদের আগমনে ভারতের হিন্দুদের বহুদিনের অবদমিত আকাক্সক্ষা সম্পূর্ণ হবার অবকাশ পেল। ভারতবর্ষের সিংহাসন থেকে মুসলমানদের সরিয়ে হিন্দুরাই বসিয়েছিল ইংরেজকে। পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে বিখ্যাত মারাঠা নায়ক বালাজী বাজিরাও ক্লাইভকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে তিনি বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য ইংরেজদের নিজের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন। ক্লাইভ সেই চিঠিখানা সিরাজের কাছে পাঠিয়ে দেন সিরাজকে ভয় দেখাবার জন্য।
পলাশী যুদ্ধে মিরজাফর শিখ-ি ছিলেন মাত্র। সিরাজের প্রায় সমস্ত হিন্দু সেনাপতি মিরজাফরকে সামনে খাড়া করে গোপনে ইংরেজ পক্ষের সুবিধা করে দিয়েছিলেন। একমাত্র মোহনলাল সিরাজের পক্ষে লড়াই করেছিলেন (!) বটে কিন্তু তিনি খুব উচ্চপদের সেনাপতি ছিলেন না।
ইংরেজদের হাতে ভারতের শাসনভার অর্পিত হলে হিন্দুরা যেরকম প্রীত হয়েছিলেন মুসলমানরা তা হতে পারেন নি। ইংরেজরা এদেশের শাসনভার গ্রহণ করতে না করতেই আমরা হিন্দুরা ইংরেজদের শিক্ষা সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানে নিজেদের রপ্ত করতে আরম্ভ করলাম। এ থেকেই বোঝা যাবে ইংরেজ-শাসনকে আমরা হিন্দুরা আন্তরিকভাবে চেয়েওছিলাম।
মুসলমানরা বহুদিন পর্যন্ত ইংরেজী সভ্যতার নানান প্রতীকের প্রতি রীতিমত বিরূপ ছিল। এমন কি, বহুদিন পর্যন্ত মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করাও অধর্মের কাজ (!) বলে মনে করে এসেছে। মুসলমানেরা চিরদিন ইংরেজদের তাদের রাজ্য অপহরণকারী বলে মনে করতেন। কিন্তু হিন্দুদের কাছে ইংরেজ রাজত্ব যেন ভগবানের আশীর্বাদ স্বরূপ এসে উপস্থিত হয়েছিল।’ [বিমলানন্দ শাসমল: স্বাধীনতার ফাাঁকি, পৃ ৭৮-৭৯]

পলাশি যুদ্ধের পর স্বাধীনতার প্রতীক নবাব সিরাজউদ্দৌলার একদল সৈন্য বরিশালের নাজিরপুর পরাগনায় আশ্রয় নেয় আজাদি পুনরুদ্ধারের প্রত্যাশায়। সুযোগ বুঝে তাঁরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন- এই ভরসায় তাঁরা ভাটির দেশে আশ্রয় নেয়। তাঁদেরকে সেই সুযোগ করে দিলেন সৈয়দ ইমামউদ্দিন মুহাম্মাদ। তিনি ছিলেন নাজিরপুর পরাগনার জমিদার। সৈয়দ ইমামউদ্দিন চৌধুরীর প্রেরণায় পলাশি ফেরত মুজাহিদরা গৌরনদীর শরিকলে দুর্গ নির্মাণ করেন। হয়ত এই অপরাধে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। গভর্নরের হুকুমে ঢাকার এটর্নি পিট ১৭৭৭ সালে ইমামউদ্দিনকে গ্রেফতার করে। হাতকড়া পরিয়ে ইমামউদ্দিনকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। [আজিজুল হক বান্না: বরিশালে ইসলাম, পৃ ১৫৩]

ইতোমধ্যে ইমামউদ্দিনকে কারাগার থেকে ছাড়াবার ব্যবস্থাও করা হয়। এ প্রসঙ্গে হেনরি বেভারেজ লিখেছেন: ইমামুদ্দিনের নামে এক ব্যক্তি ঢাকায় বসবাসরত অ্যাটর্নি পিটের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ঢাকার প্রাদেশিক কাউন্সিলে অভিযোগ করেন। পিট জমিদারদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেন। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর, মি. রাউস এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ গভর্নর জেনারেলকে (ওয়ারেন হেস্টিংস) এ কথা লেখেন, ‘‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নাজিরপুরের জমিদার যিনি বছরে প্রায় ৪০,০০০ রুপি রাজস্ব পরিশোধ করেন। কলকাতায় নেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি রাজস্ব পরিশোধের লক্ষ্যে তার ভূখ-ের উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছেন। কেননা আইনত তিনি তা করতে বাধ্য। এ কারণে তিনি অনেক মাস অনুপস্থিত থাকতে পারেন। কেননা প্রভুর অনুপস্থিতির জন্য খাজনা আদায় ভালোভাবে হয় না। এর ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় ঘাটতি দেখা দেবে। আর শেষ পর্যন্ত পরাগনাটি বিক্রি করে ওই ঘাটতি পূরণ করা হবে। এটা হবে জমিদারের প্রতি খুব খারাপ ক্ষতিপূরণ প্রদান। পরিশেষে জানানো যাচ্ছে যে তাকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ [এইচ বেভারেজ: দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ, পৃ ১২৫]

বিভিন্ন পক্ষের তদবিরে অবশেষে মুক্তি পেলেন ইমামউদ্দিন চৌধুরী। মুক্তি পেয়ে তাঁর স্বাধীনতার স্পৃহা আরও বেড়ে গেল। ঔপনিবেশিক শক্তি এই মহান নেতার কাছ থেকে কোনো স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ হয়। সা¤্রাজ্যবাদের বন্দীশালা থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরিঙিদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন বিপ্লবী ইমামউদ্দিন। তিনি বাড়ির চারদিকে পরীখা খনন করেন এবং কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন। এ খবর পেয়ে ইংরেজ সরকার একদল সৈন্য প্রেরণ করে। তারা শরিকল দুর্গ আক্রমণ করে। তীব্র সংঘর্ষের পর সরিকল দুর্গের পতন হয়। চাষি, মজুর ও পলাশি ফেরত সৈনিকদের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙ্গে যায়। নবাব সিরাজের স্বপ্নসাধও মিলিয়ে যায় অসীমের পানে। সিরাজের অনেক মুসলিম নওজোয়ান শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর শে^তাঙ্গ সৈন্যরা নলচিড়া খান বাড়ি আক্রমণ করে। হানাদার ইংরেজদের কামানের আঘাতে ইমামউদ্দিনের বাড়ি ধ্বংস হয়। এভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামী মুসলিম মুজাহিদদের জীবন প্রদীপ নিভে যায়।

দোহাই:
১. এইচ বেভারেজ বি.সি.এস: দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ [তরজমা: সিকদার আবুল বাশার], গতিধারা, ৩২/ক বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০, সেপ্টেম্বর ২০০৮। ২. আজিজুল হক বান্না: বরিশালে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রকাশ ১৯৯৪। ৩. আবদুল হাই সিকদার: সিরাজদৌলা: মুর্শিদাবাদ, জ্ঞান বিতরণী বাংলাবাজার ঢাকা, একুশে বইমেলা ২০০১। ৪. তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়: পলাশির যুদ্ধ, নাভানা, ৪৭ গণেশচন্দ্র এভিনিউ, কলকাতা ১৩, দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ১৯৫৬। ৫. বিমলানন্দ শাসমল: স্বাধীনতার ফাাঁকি, হিন্দুস্তান বুক সার্ভিস, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৫ই আগস্ট ১৯৯১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *