মো. আহসান উল্লাহ ।।
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান মোবাইল ফোন, যা মুহূর্তেই পৃথিবীকে এনে দেয় হাতের মুঠোয়। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খবর পৌঁছানোর জন্য যেখানে কয়েক দিন লেগে যেতো; সেখানে আজ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খবর পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তেই, যা সম্ভব হয়েছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। কিছুদিন আগেও প্রবাসে বা দূরে থাকলে তাকে দেখার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতো, যা আজ অতি সহজেই মুহূর্তের মধ্যে ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখা সম্ভব। কেননা শুধু খবর পৌঁছানো বা কথোপকথনের মধ্যেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার এখন আর সীমাবদ্ধ নেই।
কিছুদিন আগেও কোনো স্থান থেকে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ডাকঘর আর পিয়নের উপর নির্ভর করে অপেক্ষা করতে হতো কিন্তু আজ তা মোবাইলে ই-মেইলের মাধ্যমে চোখের নিমিষেই আদান-প্রদান হচ্ছে। ইউটিউবের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো স্থানের, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বক্তব্য শোনা ও দেখা খুবই সহজসাধ্য বিষয় হয়ে গেছে। বিভিন্ন অ্যাপস এর মাধ্যমে বহুবিদ কর্মসম্পাদন আমাদের জীবনকে করেছে জটিলতা ও কষ্টমুক্ত। তার মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে Al Quran অ্যাপ এর কথা। যার মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের আরবি ইবারত, উচ্চারণ, অর্থ ও অডিও শুনতে পাওয়া যায়, সহীহ হাদিসসমূহ, বিভিন্ন দোয়াসমূহ, নামাজের সময়সূচি, দিক নির্ণয়ের কম্পাসসহ অসংখ্যা বিষয়ের সুযোগ ভোগ করা যায়। এরূপ অসংখ্য অ্যাপ আছে যার মাধ্যমে আমাদের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এর বিপরীত একটা দিকও আছে সেটাই এখন বড়ই ভাবনার বিষয়।
বর্তমানে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানো বিষয়টি হচ্ছে ফেসবুক। যার মাধ্যমে মুহূর্তেই খবরাখবর নেয়া সম্ভব হচ্ছে। ২০ বছর আগের বন্ধুর নামে সার্চ করলে অনায়াসেই তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। শুধু তাই নয়, আজ বন্ধুত্ব দেশের সীমানা ভেঙ্গে বিশ্বগ্রামে বন্ধুত্ব হচ্ছে অহরহ ফেসবুকের কল্যাণে। এরূপ ট্ইুটার, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, ইমোসহ অসংখ্যা যোগাযোগের অ্যাপ পাওয়া যাচ্ছে নাগালের মধ্যেই বিনামূল্যে।
এতো কিছু মঙ্গলকর বিষয়, সত্যিই কি সকলের জন্য মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসছে? তা আজ সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। বাবা-মা তার সন্তান ও সংসারের কথা ভুলে মোবাইল নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। যার কারণে সংসারের কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন হচ্ছে না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংসার ভাঙার জন্যও মোবাইল ফোন বা ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সন্তানদের। বিশেষ করে ছাত্রসমাজকে বেশি বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোনের অপব্যবহার। একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন ২ ঘন্টা পড়তে বসতে না পারলেও ঘন্টার পর ঘন্টা ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। এসময় হিসাব করে দেখা গেছে কোনো কোনো শিক্ষার্থী গড়ে ৮-১০ ঘন্টা ফেসবুক ব্যবহার করে। রাতে দরজা বন্ধ করে পড়ার নাম করে পড়ার টেবিলে বসে মোবাইল ব্যবহার করে। ঘুমানোর কথা বলে রুমের বিছানায় শুয়ে শুয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ফেসবুকে চ্যাটিং করে।
গবেষকরা এটাকে ‘ফেসবুক আসক্তি’ রোগ বলে চিহ্নিত করেন। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী তার পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারে না। পরের দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলেও ক্লাসের পড়ায় অমনোযোগী থাকে। আর এভাবেই দিনে পর দিন পড়াশোনা থেকে বিছিন্ন থেকে এক একজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এরা প্রতিমাসে ৫০০ টাকা ওয়াইফাই বিল দিলেও ১০০ টাকার বই কেনায় আপত্তি দেখায়। জাতি আজ মেধাশূন্য হচ্ছে, জনবহুল এ দেশ তার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হারাতে বসেছে। ফেসবুক পড়াশোনার ক্ষতির পাশাপাশি শারীরিক, স্বাস্থ্য ও চোখের ক্ষতি করছে। গবেষণায় দেখা গেছে- এন্ড্রয়েড মোবাইলের নীল আলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঘাটতির কারণ যা চোখের পাশাপাশি মরণব্যাধি ভয়ঙ্কর ব্রেস্ট ও প্রস্টেট ক্যান্সার সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও এই নীল আলো মেলাটনিন হরমোন কমানোর সঙ্গে সঙ্গে রেটিনার কর্মক্ষমতাও কমিয়ে দেয়, ফলে কমে যায় দৃৃষ্টিশক্তি। এতে শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যন্ত্রকে তাদের কাজে লাগিয়ে উন্নতির চূড়ায় পৌচ্ছে যাচ্ছে, আর আমাদের দেশে এই যন্ত্রই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে কালের অতল গহ্বরে আমাদের নিক্ষেপ করছে।
ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নারীরা ডিজিটাল ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে, হচ্ছে লাঞ্চিত, অপমানিত এমনকি কখনও প্রতারণার ফাঁদে পরে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সামাজিক বন্ধুদের দূরে রেখে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সাইবার দুনিয়ার বন্ধুদের। ভুয়া তথ্য দিয়ে আইডি খুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দিচ্ছে কেউ কেউ। ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপন ও ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে অহরহ কিন্তু মাঝে মাঝেই এ ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় করে প্রতারিত হন অনেকে।
মোবাইল ফোন বা ফেসবুক আমাদের জন্য সম্ভাবনা না হয়ে সমস্যা হওয়ার পিছনে রয়েছে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ। মোবাইল ফোন বা ফেসবুক ব্যবহারে নেই কোনো দিকনির্দেশনা বা ন্যূনতম তদারকি। এদেশে মোবাইল সংযোগের সহজলভ্যতাও অনেকাংশে দায়ী। বিটিআরসি বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৭-২০১৮ তে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন ‘বর্তমানে মোবাইল ফোন সক্রিয় গ্রাহক সংখ্যা ১৫ কোটি ৯ লক্ষ’ যেখানে মোট জনগণ ১৬ কোটি।
বরিশাল নগরীর কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কিছু কিছু শিক্ষার্থীর কাছে ১০-১২ টি সিমও রয়েছে। এ খাতে সরকারের দিক নির্দেশনা থাকলেও তা যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় কেউ কেউ চাঁদাবাজি, হত্যার হুমকি, অপপ্রচার, গুজব, রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকান্ডসহ সাইবার ক্রাইমের মতো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ##
মো. আহসান উল্লাহ
প্রাক্তন বাংলা প্রভাষক, বরিশাল মেট্রোপলিটন কলেজ
[email protected]