বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার নামকরণ হলো যেভাবে…

আযাদ আলাউদ্দীন ।।

দেশের বিভিন্ন জেলার নামকরণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের গবেষণালব্ধ অনুসন্ধানী মতামতে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষণীয়। ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা কোথাও একমত হতে পারেনি। আমরা বিশেষ কোনো জনশ্রুতি বা মতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে শুধুই মতামতগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এর বাইরেও ভিন্নমত থাকতে পারে। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকায় প্রচলিত সব বিষয় এখানে উল্লেখ করিনি এবং আমরা নিজেরা কোন মতামত এই প্রবন্ধে উপস্থাপন করিনি। যা লেখা হয়েছে সবই তথ্যসূত্রের আলোকে আলোকপাত মাত্র।

পটুয়াখালী
১৮১২ সনে পটুয়াখালীকে নিয়ে সৃষ্টি হয় মির্জাগঞ্জ থানা। মহাকুমা হয় ১৮৭১ সনে। জেলা হয় ১৯৬৯ সনের   ১ জানুয়ারি। উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসান।

১. পটুয়াখালী নামকরণের পিছনে প্রায় সাড়ে তিনশত বছরের লুণ্ঠন, অত্যাচারের ইতিহাস জড়িত আছে বলে জানা যায়। পটুয়াখালী শহরের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত নদীটি পূর্বে ভরনী খাল নামে পরিচিত ছিলো। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা এই খালপথ দিয়ে এসে সন্নিহিত এলাকায় নির্বিচারে জুলুম, হত্যা, লুন্ঠন চালাত। স্থানীয় লোকেরা এই হানাদারদের ‘নটুয়া’ বলত এবং তখন থেকে খালটি নটুয়ার খাল নামে ডাকা হয়। নটুয়ার খাল থেকে পরবর্তীতে এ এলাকার নামকরণ হয় পটুয়াখালী।
২. পটুয়া খাল থেকে পটুয়াখালী শব্দের উদ্ভব।
৩. ভরনী খালের আকৃতি ছিলো পেট-এর মত। পেটুয়া খালী থেকে পটুয়াখালী।
৪. পটুয়ারা বাস করত। পটুয়া অর্থ চিত্রকর। তাদের স্মরণে নাম হয় পটুয়াখালী।
৫. পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুদের অত্যাচার-লুণ্ঠনযজ্ঞে জনপদটি হয় লোকশূণ্য বা পটুয়াশূণ্য। পটুয়ার সাথে আরবি শব্দ ‘খালি’ সংযুক্ত হয়ে নাম হয় পটুয়াখালী।
৬. ভরনী খাল বেয়ে পর্তুগিজরা যাতায়াত করায় ‘পর্তুয়ার খাল’ বলে চিহ্নিত হয়। পর্তুয়ার খাল থেকে পটুয়াখালী।

ভোলা
প্রাচীনকালে এই দ্বীপের নাম ছিলো চান্দিয়া। ১৫৯৯ সনে মুঘল সেনাপতি শাহবাজ খানের নামে ‘দক্ষিণ শাহবাজপুর’ ভোলার সাবেক নাম। ২৬৭ বছর প্রচলিত ছিলো এ নাম। ১৮৫০ সনে হয় ভোলা নাম। ১৯৩৫ সালে সৃষ্টি হয় ভোলা মহাকুমা। তখন প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিলো দৌলতখানের আমানিয়ায়। ১৮৭৬ সনের ৮ মে ২৫ ফুট উচ্চ জলোচ্ছ্বাস হলে বন্দরের সবাই মারা যায়। এরপর ভোলায় মহাকুমা স্থানান্তরিত হয়। পৌরসভা হয় ১৯২০ সনে, জেলা হয় ০১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪।
১. ভোলা গাজি নামে একজন ইসলাম প্রচারক, আলেম, ধর্মসাধক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। সবশ্রেণির মানুষের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধেয়। তার নাম অনুসারে ভোলা নামকরণ হয়।
২. ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতুয়া নামক খালটি এখনকার মত অপ্রশস্ত ছিলো না। একসময় এটি পরিচিত ছিলো বেতুয়া নদী নামে। খেয়া নৌকার সাহায্যে নদীতে পারাপার করা হত। ভোলা পাটনি নামে বুড়ো এক মাঝি এখানে খেয়া নৌকার সাহায্যে লোকজন পারাপার করতো। বর্তমানে যোগীরঘোলের কাছেই তাঁর মোকাম ছিলো। এই ভোলা পাটনির নামানুসারেই এক সময় স্থানটির নাম দেয়া হয় ভোলা। সেই থেকে এই জেলাটি ভোলা নামে পরিচিত।

ঝালকাঠি
১৮৭৫ সনের ১লা এপ্রিল ঝালকাঠি পৌরসভার গোড়াপত্তন হয়। পুলিশ থানা হয় ১৮৮২ সনে। ১৯৮৪ সনের ১লা ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা লাভ করে।

১. জেলার নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ জেলার জেলে সম্প্রদায়ের ইতিহাস। মধ্যযুগ-পরবর্তী সময়ে সন্ধ্যা, সুগন্ধা, ধানসিঁড়ি আর বিষখালী নদীর তীরবর্তী এলাকায় জেলেরা বসতি স্থাপন করে। এর প্রাচীন নাম ছিলো ‘মহারাজগঞ্জ’। মহারাজগঞ্জের ভূ-স্বামী শ্রী কৈলাশ চন্দ্র জমিদারি বৈঠক সম্পাদন করতেন এবং পরবর্তীতে তিনি এ জায়গাতে এক গঞ্জ বা বাজার নির্মাণ করেন। এ গঞ্জে জেলেরা জালের কাঠি বিক্রি করত। এ জালের কাঠি থেকে পর্যায়ক্রমে ঝালকাঠি নামকরণ করা হয় বলে ধারণা করা হয়।
২. জানা যায়, বিভিন্ন স্থান থেকে জেলেরা এখানে মাছ শিকারের জন্য আসত এবং যাযাবরের মতো সুগন্ধা নদীর তীরে বাস করত। এ অঞ্চলের জেলেদের পেশাগত পরিচিতিকে বলা হতো ‘ঝালো’। এরপর জেলেরা বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে এখানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে। এভাবেই জেলে থেকে ঝালো এবং জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে তোলার কারণে কাটি শব্দের প্রচলন হয়ে ঝালকাটি শব্দের উৎপত্তি হয়। পরবর্তীকালে ঝালকাটি রূপান্তরিত হয় ঝালকাঠিতে।

পিরোজপুর
বর্তমান পিরোজপুর, পূর্বে যা ছিলো সেলিমাবাদ [সম্রাট জাহাঙ্গীর সেলিমের নামে], তারও পূর্বে সলাইমাবাদ এবং তারও পূর্বে খলিফাতাবাদ। খলিফাবাতাবাদ রাজ্য ছিলো খান জাহান আলী প্রতিষ্ঠিত একটি সমৃদ্ধশালী জনপদ, যার রাজধানী ছিলো বাগেরহাট। পিরোজপুর থানা হয় ১৭৯০ সনে, ১৮৮৬ সনে পৌরসভা। ১৯৫৯ সনের ২৮ অক্টোবর পিরোজপুর মহকুমা এবং পরবর্তীতে ১৯৮৪ সনের ১ মার্চ জেলায় রূপান্তরিত হয়।

১. জমিদার ফিরোজ শাহ মুঘল আমলে এ এলাকার শাসক ছিলেন। তার নামানুসারে ফিরোজপুর, পরবর্তীতে পিরোজপুর।
২. বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন শাসক ফিরোজ শাহ নামে দেশ পরিচালনা করেছেন। সেখান থেকে পিরোজপুর নাম হতে পারে।
৩. আওরঙজেবের পুত্র ফিরোজ মান্দ পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে টালমাটাল পয়দা হলে তিনি দিল্লি ত্যাগ করে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে সেলিমাবাদ পরাগনায় এসে আত্মগোপন করেন। তার নাম থেকে ফিরোজপুর। এতদাঞ্চলের মানুষের কথ্যভাষার উচ্চারণ বিচ্যুতিতে ফিরোজপুর থেকে পিরোজপুর।
৪. ফরাসিভাষায় ফিরোজ বা পিরোজ অর্থ পালতোলা বিশেষ এক ধরনের নৌকা। পর্তুগিজ ফিরিঙ্গি ও ফরাসি দেশীয় পাদরীদের ব্যবহৃত পিরোজ থেকে পিরোজপুর। তবে ফিরোজ শব্দটি ফার্সি, যার অর্থ নীলাভ।
৫. ‘ফিরোজ শাহের আমল থেকে ভাটির দেশের ফিরোজপুর, বেনিয়া চক্রের ছোয়াচ লেগে পাল্টে হলো পিরোজপুর উপরিউক্ত কথন থেকে পিরোজপুর নামকরণের একটা সূত্র পাওয়া যায়।
৬. বাংলার সুবেদার শাহ সুজা। সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার নিকট পরাজিত হয়ে বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে এসে আত্মগোপন করেন। এক পর্যায়ে নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর পাড়ে একটি কেল্লা তৈরি করে কিছুকাল অবস্থান করেন। মীর জুমলার বাহিনী এখানেও হানা দেয়, শাহ সুজা তাঁর দুই কন্যাসহ আরাকান রাজ্যে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বর্মী রাজার চক্রান্তে নিহত হন। পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী ও এক শিশুপুত্র রেখে যান। পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করে ধীরে ধীরে পশ্চিমে চলে আসে এবং বর্তমান পিরোজপুরের পার্শ্ববর্তী দামোদর নদীর মুখে আস্তানা তৈরি করেন। এ শিশুর নাম ছিলো ফিরোজ এবং তাঁর নামানুসারে হয় ফিরোজপুর। কালের বিবর্তনে ফিরোজপুরের নাম হয় ‘পিরোজপুর’।

বরগুনা
১৯০৪ সনের শেষদিকে বরগুনায় স্থাপিত হয় অস্থায়ী থানা। ১৯৬৯ সনে পটুয়াখালী জেলা হলে বরগুনা এই জেলার আওতায় মহাকুমায় উন্নীত হয়। জেলা হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪।

১. ইসলামি দৃষ্টিকোন থেকে পাপ দ্ইু প্রকার। একটিকে বলা হয় ছোটো গুনাহ, অপরটিকে বলা হয় বড় গুনাহ। এই বড় গুনাহ থেকে বরগুনা নামের উৎপত্তি।
২. দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাঠ ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলে কাঠ নিতে আসত। নৌকায় সওয়ার হয়ে সওদাগররা খরস্রোতা খাকদোন নদী অতিক্রম করতে গিয়ে অনুকূল প্রবাহ বা বড় গোনের জন্য এখানে অপেক্ষা করত বলে এ স্থানের নাম হয় বড় গোনা। গোন আঞ্চলিক শব্দ যার অর্থ হলো ভাটি বা অনুকূল স্রোত। এই বড় গোন বা বড় গোনা থেকে বরগুনা নামের উদ্ভব।
৩. উজানভিত্তিক এ অঞ্চলে উজান স্রোতে নৌকার দাঁড় টানার সময় ‘বড় গুনা’ (দড় বা রশি) টেনে নৌকা অতিক্রম করতে হতো বলে এ স্থানের নাম বরগুনা। গুনার এক প্রান্ত থাকত নৌকায়। অন্যপ্রান্তে এক টুকরা কাঠ বেধে বাওয়ালি বা মাঝি-মাল্লারা খাল-নদীর চর দিয়ে নৌকা টেনে নিত। সে এক মজার অভিজ্ঞতা।
৪. বরগুনা নামক কোন প্রভাবশালী বাওয়ালীর বা রাখাইন অধিবাসীর নামানুসারে বরগুনা।

বরিশাল
আগা বাকের ১৭৪০ সনে বাকেরগঞ্জ বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। মির্যা আগা মোহাম্মাদ বাকের ছিলেন বরিশালের বুজর্গ উমেদপুর পরাগনার জমিদার ও চট্টগ্রামের ফৌজদার। রাজা রাজবল্লভ ছিলেন নবাব সিরাজদৌলার ভাগ্যবিপর্যয়ের অন্যতম নায়ক। পলাশির বিশ্বাসঘাতক রাজবল্লভ, তার পুত্র রামদাস ও কৃষ্ণদাস আগা বাকেরকে নির্মমভাবে খুন করে। ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৭ সনে বাকেরগঞ্জ জেলা সৃষ্টি করে তাদের প্রশাসনিক সুবিধার্থে। স্যার জন শ্যোর ১৮০১ সনের ১লা মে সদর দপ্তর বরিশালে স্থানান্তর করেন। বরিশাল- নামটির সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় নবাব মির কাশিমের এক পত্রে। ১৭৬২ সনের ২৬ ডিসেম্বর গবর্নর ভেন্সিটারটকে বাকেরগঞ্জের ইউরোপীয় বণিকদের অত্যাচার বন্ধের নির্দেশ দিয়ে যে পত্র লিখেন সেখানে ‘বরিশাল’ শব্দটি আছে। বরিশালের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।

১. প্রাচীনকালে অত্র এলাকায় বড় বড় শাল গাছ জন্মাতো, আর এই বড় শাল গাছের কারণে (বড়+শাল) বরিশাল নামের উৎপত্তি।
২. পর্তুগিজ যুবক বেরি ও শেলির প্রেমকাহিনীর জন্য তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে বরিশাল নামকরণ।
৩. বর্তমান চকবাজার ও সদর রোড এলাকা ছিলো গিরদে বন্দরের আওতাভূক্ত। ১৭-১৮ শতকে এখানে ঢাকা নবাবদের বড় বড় লবণের গোলা ও চৌকি ছিল। ইংরেজ ও পর্তুগিজ বণিকরা বড় বড় লবণের চৌকিকে ‘বরিসল্ট’ বলতো। অথাৎ বরি+সল্ট=বরিসল্ট। বরিসল্ট থেকে বরিশাল।
৪. এখানকার লবণের দানাগুলো বড় বড় ছিলো বলে ‘বরিসল্ট’ বলা হতো। পরবর্তিতে বরিসল্ট শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নামে পরিচিতি লাভ করে।
৫. সওদাগররা গিরদে বন্দরকে গ্রেট বন্দর বলত, যার পরিবর্তিত রূপ বরিশাল।
৬. অতীতে এখানকার খাল-নদি-জলাশয়ে বড় বড় শৌল মাছ পাওয়া যেত। বড় শৌল কালক্রমে বরিশালে রূপান্তরিত।

এই লেখাটি মুক্তবুলি ম্যাগাজিন, ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র:
১. বিলু কবির: বাংলাদেশের জেলা নামকরণের ইতিহাস
২. সিরাজ উদদীন আহমদ: বরিশাল বিভাগের ইতিহাস প্রথম খন্ড
৩. আজিজুল হক বান্না: বরিশালে ইসলাম
৪. বৃহত্তর বাকেরগঞ্জের ইতিহাস, সংগ্রহ ও সম্পাদনায়: তপংকর চন্দ্রবর্তী ও সিকদার আবুল বাশার
৫. এ. এফ. এম আবদুল জলিল: সুন্দরবনের ইতিহাস
৬. ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *