বিজ্ঞাপনের নামে নারী প্রদর্শনী !

মাহমুদ ইউসুফ ।।

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযু্িক্তর যুগে পণ্য দ্রব্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বিজ্ঞাপন ছাড়া উৎপাদিত পণ্যের প্রচার প্রসার সম্ভব নয়। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর জন্য ডিলার, এজেন্ট, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী যতটুকু ভূমিকা পালন করে, বিজ্ঞাপন তার চেয়ে আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের দরকারিতা তো আরো গুরুত্বের দাবীদার। আর এ বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হলো রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজ, পোস্টার, ব্যানার, সাইন বোর্ড, লিফলেট, বিলবোর্ড প্রভৃতি। তবে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে টেলিভিশন ও খবরের কাগজের ভূমিকাই অধিক। শুধু বিজ্ঞাপন দাতার জন্যই নয়, প্রচার মাধ্যমের জন্যও বিজ্ঞাপন দরকার। কেননা ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্টিং মিডিয়ার একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন খাত। বিজ্ঞাপন দাতা, মিডিয়া, জনগণ সবার জন্যই বিজ্ঞাপন দরকার। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিজ্ঞাপনের নামে নারীদেরকে কেন ‘পণ্য’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে?

বাংলাদেশের সকল প্রকার প্রচার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের নামে যা দেখানো হচ্ছে তাকে বিজ্ঞাপন না বলে ‘নারী প্রদর্শনী’ বলাই শ্রেয়। কেননা সেখানে আসল পণ্য দ্রব্যের চেয়ে নারী দেহ, নারী সৌন্দর্য, নারী কন্ঠ, নারীর অঙ্গ সৌষ্টবকেই অধিক প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অশ্লীল নৃত্য, নগ্ন দেহই যেন বিনিয়োগের পূূজি হয়ে ওঠছে। পর্দা তো দূরের কথা কোনো নারী মডেলের মাথায় কাপড় দিয়ে অদ্যাবধি উপস্থাপন করতে দেখা যায়নি। নারীর শরীর থেকে চাদর বা ওড়না তো অনেক আগেই খসে পড়েছে। ফিনফিনে পাতলা পোশাকেই যেন তাদের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে! ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলোতে নারী দেহ ও ও সৗন্দর্যকে পূজি করে এক শ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কোটিপতি বনে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। কমিউনিজম, বুর্জোয়া, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর এ দেশিয় দালাজীবীরা মা জাতিকে নিয়ে ব্যবসায়িক আনন্দে মেতে ওঠেছে।

নারী আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধাংশ। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পশ্চাতে রেখে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়া এবং আদর্শ সমাজ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সবাইকেই সমভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা, চাকরি, তেজারতি, সওদাগিরি  সর্বক্ষেত্রেই নারী সমানিধার প্রাপ্য। তাই বলে মহিলাদেরকে রাস্তায় নামিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করবে এটা তো হতে পারেনা। দেশের একটা অশুভ শক্তি নারীবাদী, নারী প্রগতি, নারী উন্নতির নামে তাদেরকে পণ্য দ্রব্য হিসেবে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যবহার করছে। দ্বাদশ শতকে ক্রুসেড যুদ্ধের ধ্বজাধারী ইহুদি ও খৃস্টানরা গাজি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও মুসলিম মুজাহিদের বিরুদ্ধে যেভাবে নারীদের ব্যবহার কররেছিল আজকের সাম্রাজ্যবাদীদের এদেশিয় এজন্টরাও একই ভূমিকায় অবর্তীর্ণ। আমেরিকা, ইসরাইল, ভারতের এসব সেবাদাসরা সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম জাতির ধ্বংসসাধনেই বেশি তৎপর। আর এ কাজে তারা বেছে নিয়েছে অবলা নারী জাতিকে। কিশোরী, তরুণী, যুবতীরাও তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অন্ধকার জগতে পাড়ি জমাচ্ছে। সঙ্কীর্ণ স্বার্থ ও অর্থের মোহে তারা বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমায় নগ্নভাবে পোজ দিচ্ছে। ভাববতেও লজ্জা হচ্ছে যে, একজন মুসলিম তরুণী মডেল হয়ে বিজ্ঞাপন চিত্রে নগ্নভাবে উপস্থাপন হচ্ছে, যেখানে বিক্রিত পণ্যের চেয়ে নিজের শরীরই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আমাদের বুঝে আসে না যে, এতে কি নারীদের মান সম্মান বৃদ্ধি পাচ্ছে! আমাদের তো ধারণা এতে নারীদের অধিকার, ইজ্জত আবরু আরো খর্ব হচ্ছে।

রোযার সাংস্কৃতিক স্বরূপ

সৈয়দ ওয়ালিদুর রহমান।।

বইয়ের সজ্ঞায় ধর্ম সংস্কৃতিরই একটা উপাদান। আবার অনেকের মতে ধর্মের আবার নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে। কে কাকে ধারণ করে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে। তবে ধর্ম ও সংস্কৃতির একটা পারস্পরিক সম্পর্ক অনস্বীকার্য। আর ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা ইসলাম তার বিধিবিধানের একটা ছাপ তার অনুসারীদের সামগ্রিক জীবনাচরণ ও অভ্যাসের মধ্যে দেখতে চায়। এখানে বিশ্বাস ও অভ্যাস একসূত্রে গাঁথা। শুধু কিছু স্প্রিচুয়ালের মধ্যে ধর্মকে আটকে রাখলে ইসলামের দাবি পূরন হয় না। আর এ সূত্রেই আমাদের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রোযার একটা ব্যাপক সাংস্কৃতিক প্রভাব আছে। আমাদের ব্যবহার, শিষ্টাচার, রসনা বিলাশ, পোষাক-পরিচ্ছদ, মার্কেট ইকোনমি, বিজ্ঞাপন, কর্পোরেট সংস্কৃতি, মিডিয়া, পলিটিক্স, ক্রাইম – সকল ক্ষেত্রেই রোজার ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান।

রোযার ছবি এর ছবির ফলাফল

রোযার মাসে আমাদের পদ্ধতি ও বিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অফিস আদালত বা পরিবার পাড়ায় সব জায়গাতেই মানুষ একটু বেশি বিনয়ী হয়ে ওঠে। পূণ্যের আশায় হোক বা দূর্বল দেহের কারণে হোক সামাজিক আচরনে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এমনকি রোযার মাসে কুয়েতের মতো দেশে পাবলিক প্লেসে খাওয়াটা ছোটোখাটো অপরাধ হিসেবে জরিমানা করা হলেও আমাদের দেশে বেরোযদাররা বিনা নোটিশে প্রকাশ্য কিছু খেতে এখনও ইতস্তত বোধ করে। তাছাড়া অফিস আদালতে বা আড্ডায় মিথ্যা, চাটুকারিতা বা চোগলখুরিতা কমে আসে। কারন এসব “কাউল আযযুর” বা বাজে কথা ত্যাগ না করলে যে শুধু উপবাসে কোনো কাজ হবে না-হাদিসের এ বাণী মোটামুটি সবারই জানা। অবশ্য যারা আত্মশুদ্ধির সাথে একাত্ম না হয়ে শুধু সওয়াবের আশায় বা লোকলজ্জায় রোজা রাখে তাদের ক্ষুধার্ত পেট আবার মস্তিস্ককে উত্তপ্ত করে তোলে। এছাড়া ইফতার-মাগরিব-এশা-তারাবির টাইট সিডিউলে বাজে আড্ডারও তেমন ফুসরত থাকে না। তাই সবমিলিয়ে ‘দুই ঠোটের মাঝে ‘ যা আছে তা কন্ট্রোলের ভালো চর্চা হয় এই মাসে এবং সমাজও এর একটা ইতিবাচক ফল পায়।

রোযার এক মাসে ভালো সামাজিক পরিবর্তন হয়। ইফতার মাহফিলগুলোতে পারস্পরিক অনুভুতি ও সামাজিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং মতবিনিময় হয়। পূণ্যের পাশাপাশি এর উৎসব মুখরতারও একটা সামাজিক মূল্য আছে যদি না তা উৎকট হয়ে ওঠে। কেননা অনেক সময় ইফতারের এই উৎসব মুখরতাকে কেন্দ্র করে রোযার শিক্ষা বিরোধী অনেক কাজও হয়। যেমন ভার্সিটিগুলোর ক্যাম্পাসে বা বিভিন্ন সমিতি বা এলামনাইয়ের ইফতারিতে ছেলেমেয়ে একসাথ হয়ে ‘বার্থডে পার্টি স্টাইলে’ ইফতারি করে। রোযা বা নামায এখানে মুখ্য নয়; আড্ডা আর উৎসবই মুখ্য। অবস্থা এতো ভয়াবহ যে আজকাল ঢাকার অভিজাত এলাকায় সেহরি পার্টি হচ্ছে যা নাকি অনেকটা ডিজে পার্টির ছদ্মবেশী সংস্করণ। আবার রাজনৈতিক দলগুলোরও রোযার আসল উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে অনেক সময় ইফতার মাহফিলগুলোকে নিছক অপপ্রচার হিসেবে ব্যবহার করে। আসলে ‘ধর্মের নামে ব্যবসা’ বলে যদি কিছু থেকে থাকে এগুলো তাই।

রোযার ছবি এর ছবির ফলাফল

প্রচলিত আছে বাঙালি রসনা বিলাসী। আর এ বিলাস যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে সংযমের মাসে। পুরোনো ঢাকার চকবাজার বা বেইলী রোডে ঘুরে আসলেই এর প্রমাণ মেলে। মোঘল আর নবাবি আমলের খাবারের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার এই মেলা যেন রমযান ছাড়া আর কোনো মাস খুঁজে পেল না। সারা দেশের মোটামুটি একই অবস্থা। যেখানে কম খেয়ে বেশি ইবাদাত করার কথা সেখানে তৈলাক্ত পিঁয়াজু-ছোলার ঢেকুরে তারাবিতে আর শরীর সায় দেয় না। যাহোক বাঙালির মসলাজাত গুরুপাকের সাথে রোযার উছিলায় কিছু বেশি পানীয় ও ফল খাবার অভ্যাস যোগ হয় এ মাসে। সব মিলিয়ে রমযানে কমার পরিবর্তে ভোগ্য পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়।

‘রমজানের অর্থনীতি’ নামের আলাদা চ্যাপ্টার খুলতে হচ্ছে অর্থনীতিবিদদের। এ মাসে মমিন মুসলমান মুত্তাকি মজুদদাররা মজুদদারি আর ভেজালীকরণ অন্যমাসের চেয়ে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। হিন্দুদের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু এসকল বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ীদের ভাগ্য ভালো যে তাহারা সৌদি আরব বা ইরানে জন্মে নাই। ওখানে থাকলে নিশ্চিত গলাকাটা।

কর্পোরেট কোম্পানিগুলো অধিক ভোগবাদীদার এই সুযোগে রমযানে তাদের বাহারি বিজ্ঞাপন নিয়ে এমনভাবে হাজির হয় যেন তাহাদের পণ্য না কিনলে ভোক্তারা দোজাহানের অশেষ নেকি থেকে বঞ্চিত হবে। কোকাকোলার মতো ইয়াহুদি মলিকানা ও ইজরাইলকে অর্থায়ন করা কোম্পানিও এমনভাবে বিজ্ঞাপন দেয় যেন এই অমিয়সুধা ইফতারির টেবিলে না থাকলে পুরা রোযাটাই যেন মাটি। এছাড়া দেশি বিদেশি বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের কোম্পানিগুলো রোযার মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে তাদের বিজ্ঞাপনের রমযান সংস্করণ বের করে।

অবশ্য রোযার মাসে প্রিন্ট ও টিভি চ্যানেলগুলো যেসব ইসলামি অনুষ্ঠান প্রচার করে তা প্রশংসার দাবিদার। পাড়ামহল্লার পুচকে ছেলেদর সেহরিতে চোঙা নিয়ে মধুর চেঁচামেচি অনেকটা কমে আসলেও টিভি চ্যানেলগুলো সেহরি অনুষ্ঠান নিয়ে আরও সরব হয়ে উঠছে। তাছাড়া মাসব্যাপী শিশুদের কুরআন তিলওয়াত কিংবা ইসলামি গান ও জ্ঞানের প্রতিযোগিতাগুলো ‘ক্ষুদে গানরাজ’ টাইপের প্রোগ্রামগুলোর সমান্তরালে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পুরো বছর জুড়ে এই অনুষ্ঠানগুলো থাকলে আরো ভালো হতো। তবে এসকল কুরআনের অনুষ্ঠানের ফাকে ফাকে অশ্লীল এ্যাডগুলো অস্বস্থি বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া কড়া মেকআপ করা বা চুলখোলা নারী শিল্পীর কন্ঠে হামদ নাতও কেমন যেন বেমানান লাগে। তার উপর রমজান শুরুর সাথে সাথেই আবার ঈদকেন্দ্রিক উৎকট অনুষ্ঠানগুলোর আগাম বার্তা কেমন জানি রমযানের পবিত্রতাকে মলিন করে দেয়। এটা অনেকটা ইফতারে গোগ্রাসে গেলার জন্যই যেন রোযা রাখার মতো মনে হয়।

রোযার ছবি এর ছবির ফলাফল

মোটাদাগে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির মতোই রোযার সংস্কৃতিও মিশ্র প্রকৃতির। অর্থাৎ ভালো-মন্দের মিশেলে গঠিত। কেননা অনেক ভালো দিক থাকলেও এ মাসের অনেক চর্চাই রোযার বিধান বা স্পিরিট এর সাথে যায় না-বরং তা স্ববিরোধীতা আর দ্বিমুখীতার দোষে দুষ্ট। নগ্ন পুঁজিবাদী ও বিজাতীয় সংস্কৃতি তথা শয়তানের কূটচালে পড়ে সত্য ও মিথ্যার এই চতুর্মুখী মিশেলের কারনে আমরা মুসলমানরা রোযার ধর্মীয় বিধান ও শিক্ষাকে আমাদের অভ্যাসে, আচরণে তথা সামগ্রিক লাইফ স্টাইলে এখনো ধারণ করতে পারি নি। তাই সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার জন্যই আমাদের কুরআনের কাছে যেতে হবে; কারণ রমযানে নাযিল হওয়া এ মহাগ্রন্থই হলো আমাদের কাছে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড ।

 

লেখক : সৃজনশীল লেখক, গবেষক ও ব্যাংকার

ইখতিয়ার উদ্-দ্বীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খীলজীর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড: একটি ইতিহাসভিত্তিক বিশ্লেষণ

ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী

. ভূমিকা
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সংস্কৃতি সম্পর্কিত সংগাসমূহ ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, সংযোজন ও বিয়োজন করে আমরা একটি অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছি এবং তা হলো ‘সংস্কৃতি হচ্ছে মানব সৃষ্ট কর্মকান্ডের যোগফল যা সে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে এবং যা তার বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’। অতএব সে মতে ইখতিয়ার-উদ্বীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী কতৃক সৃষ্ট সকল কর্মকান্ড যা তার বিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যে গণ্য করা যেতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধে একটি ঐতিহাসিক পটভূমির প্রেক্ষাপটে বখতিয়ার খলজীর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ; তাঁর সর্বভৌমত্বের প্রতীক-খোৎবা ও মূদ্রা; মুসলিম সমাজের ভিত্তি- মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ প্রতিষ্টা; মুসলমানদের মৌলিক কাজ- দ্বীনের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

.পটভূমি
উত্তর আফগানিস্তানের গরমশির [আধুনিক দস্ত-ই-মার্গ] এলকার বাসিন্দা ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী তুর্কি জাতির খলজ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। গজনীতে তিনি তাঁকে সৈনিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য মুহম্মদ ঘুরীর আজির-ই-মালিকের নিকট আবেদন করেন। কিন্তু খর্বাকৃতি ও বাহুদ্বয় হাটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা হওয়ার কারণে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। ভগ্নমনোরথ হয়ে বখতিয়ার অত:পর দিল্লির দিকে অগ্রসর হন এবং কুতুবউদ্দীন আইবকের অধীনে চাকরি প্রার্থী হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। এরপর তিনি বদউনে চলে যান এবং সেখানে তিনি মালিক হিজবরউদ্দীন কর্তৃক একটি নিুপদে নিযুক্ত হন। অল্পকাল পরেই তিনি বদাউন পরিত্যাগ করে অযোধ্যায় উপস্থিত হন। এখানে তিনি শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দীনের অধীনে তাঁর যোগ্যতার উপযোগী একটি চাকরি লাভ করেন। তাঁকে মির্জাপুর জেলার ভাগওয়াত ও ভিউলী নামে দুটি পরগনার জায়গির প্রদান করা হয়। শীঘ্রই প্রচুর সংখ্যক দু:সাহসী ভাগ্যান্বেষী খলজীর সাথে যোগ দেয়। বখতিয়ার তাদের সাহায্যে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন।

১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজী বিহার আক্রমণ করেন এবং সে স্থান দখল করে প্রচুর ধন-সম্পদসহ প্রত্যাবর্তন করেন। অতপর তিনি কুতুবউদ্দীন আইবকের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাঁকে বহুমূল্যবান উপহার প্রদান করেন। অত:পর বখতিয়ার খলজী বাংলার দিকে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দে শীতকালে তিনি তাঁর দু:সাহসী অভিযান শুরু করেন এবং ঝাড়খণ্ডের দুর্গম অরণ্যাঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে এত দ্রুতগতিতে নওদীয়াহর দিকে ধাবিত হন যে, তাঁর সাথে মাত্র আঠারোজন অশ্বারোহী সৈন্য তাল রেখে আসতে পেরেছিল। নগরবাসীরা তাঁকে ঘোড়া ব্যবসায়ী বলে মনে করেছিল। বখতিয়ার খলজী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে রাজপ্রাসাদ দখল করেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন নগ্নপদে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। ইতোমধ্যে বখতিয়ার খলজীর মূল বাহিনীও এসে পড়ে এবং নওদীয়াহ তাঁর অধিকারে আসে।

বখতিয়ার খলজী স্বল্পকালীন সময়ের জন্য নওদীয়াহয় অবস্থান করেন এবং পরে তিনি গৌড়ের [লখনৌতি] দিকে যাত্রা করেন। তিনি ৬০১ হিজরিতে [১২০৫ঈ.] বিনা বাধায় গৌড় জয় করেন এবং সেখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। অত:পর তিনি পূর্বদিকে অগ্রসর হন এবং উত্তর বাংলায় তাঁর অধিকার বি¯তৃত করেন।

. প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস
রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূখ্য অধ্যায় হলো প্রশাসনিক বিভাজন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. সর্বপ্রথম মুসলিম রাজ্যকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ৮টি প্রদেশে ভাগ করেন এবং প্রতিটি প্রদেশকে জেলায় বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা ওয়ালী এবং প্রতিটি জেলার জেলাপ্রশাসক বা আমিল নিয়োগ করেন। প্রাদেশিক ও জেলা প্রাশাসনের সাথে পৃথক বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উভয় স্তরে কাযী নিয়োগ করেছিলেন। বখতিয়ার খলজী হলেন হযরত উমর ইবনুল খাত্ত্বাবের রাজনীতিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। তাই তিনি তার নব বিজিত অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে কয়েকটি প্রশাসনিক এককে বিভক্ত করেন। তখন সে সময়ে শাসনতান্ত্রিক বিভাগকে ইক্তা এবং ইকতার শাসনকর্তাকে মোক্তা বলা হতো।

মীনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা গভীরভাবে নীরিক্ষা করলে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বখতিয়ার খলজীর প্রতিষ্ঠিত লক্ষনৌতি রাজ্য পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে তার পূর্ব অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বি¯তৃত ছিল। সম্ভবত: লখনৌতি রাজ্যে তিনটি মুকতা বা প্রদেশ ছিলো-
১. ‘বরসৌল’ ইকতা কে বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ঘোড়াঘাট এলাকাকে নির্দেশ করা যায়, কারণ এটি রংপুর দিনাজপুর ও বগুড়া-এ তিন জিলার মিলনস্থলে অবস্থিত। বখতিয়ার খীলজী তাঁর সেনাপতি মালিক আলী মর্দান খীলজীকে অত্র এলাকার মুকতা নিয়োগ করেন।
২. গঙ্গাতরী ইকতা- ড. আবদুল করিম মনে করেন গঙ্গাতরীর নির্দেশকরণ এখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু ড. কালিকারঞ্জন কানুনগোর মতে- গঙ্গাতরী আইন-ই-আকবরীর তান্ডা সবকারের ‘গণকরা’ মহলের সঙ্গে অভিন্ন। বখতিয়ার খীলজী তাঁর অপর সেনাপতি মালিক হুসাম উদ্দীন ইওজ খীলজীকে এ ইকতার মুকতা নিয়োগ করেন। ৩. লখনৌরে ইকতা- বীরভূম জেলার নাগর অঞ্চল বর্তমানে রাজনগর নামে পরিচিত। বখতিয়ার খলজী তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক মোহাম্মদ শিরীন খলজীকে এ ইকতার মুকতা নিয়োগ করেন।

. সার্বভৌমত্বের প্রতীক: খোৎবা এবং মুদ্রা
ইসলামী সালতানাতের সার্বভৌমত্বের প্রতীক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির মুখ্য উপাদান মূলত দুটো খুৎবা [জুমার নামাজের আগের বক্তৃতা] এবং ছিক্কা [মুদ্রা]। মীনহাজ লিখেছেন- ‘যখন মোহাম্মদ বখতিয়ার ঐ রাজ্য অধিকার করেন [তখন তিনি] নওদীয়াহ নগর ধ্বংস করেন এবং লখনৌতি নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। সিই রাজ্যের [চতুম্পাশ্বস্থান] অঞ্চল তিনি অধিকার করেন এবং সমগ্র অঞ্চলে খুৎবা ও মুদ্রার প্রচলন করেন।’ মীনহাজের বর্ণনা এতই সংক্ষিপ্ত এবং সুস্পষ্ট যে তার থেকে খোৎবা এবং মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা লাভ করলেও একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং তা হলো বখতিয়ার খীলজী কার নামে খোৎবা পাঠ করেন এবং কার নামে মুদ্রা অঙ্কন করেন?

ইতোমধ্যে এসকল প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসবিদদের মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে বৃটিশ মিউজিয়ামে বখতিয়ার খলজীর একটি স্বর্ণ মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। উক্ত মিউজিয়ামের মুদ্রা গবেষক এন এম লওয়ার্ক সে মুদ্রাটি প্রথম প্রকাশ করে এবং তাতে কিছু অস্পষ্টতা থেকে যায়। পরবর্তীকালে ড. পি এল গুপ্ত ১৯৭৫-৭৬ সনে সে মুদ্রাটি Journal of the Varenda Research Museum vol. 4. pp. 29-34 প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত মুদ্রা বিশেজ্ঞ ড. পি এল গুপ্ত মুদ্রাটির নিুরূপ বিবরণ প্রদান করেছেন-
প্রথম পিঠ:    একটি বৃত্তের ভিতর বল্লম হাতে একজন অশ্বারোহী এবং বৃত্তের বাইরে চারদিকে প্রথমে আরবী অক্ষরে ‘১৯শে রমজান ৬০১ হিজরী’ এবং পরে নাগরী অক্ষরে ‘গৌড় বিজয়ে’ লিখা।
অন্যপিঠে:    আরবী অক্ষরে ‘সুলতান উল-মুয়াজ্জম মুঈজ উদ্-দ্বীন মোহাম্মদ বিন সাম’ লিখা।
মুদ্রায় সুলতান মুঈজ উদ-দীন মোহাম্মদ বিন সাম অর্থাৎ মোহাম্মদ ঘুরীর নামাঙ্কিত কিন্তু ‘গৌড় বিজয়ে’ কথাগুলি লিখিত আছে সেহেতু ড. পি এল গুপ্ত মনে করেন যে মুদ্রাটি মুহাম্মদ বখতিয়ার খীলজী গৌড় বিজয়ের পরে তার প্রভুর নামে গৌড় বা লৌখনতি হতে জারি করেন; মুঈজ উদ্দীন মোহাম্মদ বিন সাম কখনও গৌড়ে আসেননি। অতএব মীনহাজের বর্ণিত মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কিত জটিলতার অবসান হল।

এখন প্রশ্ন হলো মোহাম্মদ বখতিয়ার কার নামে খোৎবা পাঠ করতেন? খুব সহজ সরল উত্তর হচ্ছে সর্বভৌমত্বের সংস্কৃতিতে যার নামে মুদ্রা অঙ্কন করা হয়েছে তার নামেই খোৎবা পাঠ করা স্বাভাবিক সমীকরণ। কিন্তু মুসলিম জগতের খলিফা আব্বাসীয় খলিফার নামে, সুলতান কুতুব উদ্দিনের আইবকের নামে অথবা বখতিয়ার খীলজী নিজের নামে খোৎবা পাঠ করার সম্ভাব্যতা ইতিহাসবিদেরা তাদের ধারনা থেকে সম্পূর্ন বাদ দেননি।

দিল্লীর সুলতানদের শাসননীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। কারণ মুসলিম আইন বিশারদের মতে সারা মুসলিম জাহান এক এবং অবিভাজ্য এবং একজন খলিফা দ্বারা শাসিত হবে। খলিফা মুসলিম জগতের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রধান হিসেবে পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণের উৎস। খলিফার অনুমতি ছাড়া মুসলিম জগতের কোথায়ও কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং অবস্থান সম্পূর্ণ অবৈধ। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্বলতার সুযোগে খিলাফতের ভৌগোলিক সীমানায় যে সকল মুসলিম রাজবংশের উৎপত্তি হয়েছিলো তারা সকলে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতো। এ সকল প্রান্তিক স্বাধীন মুসলিম সুলতানগণ খলিফার দরবারে উপঢৌকনসহ দূত প্রেরণ; তাদের মুদ্রিত মুদ্রায় তাদের নামের সাথে খলিফার নাম অঙ্কিতকরণ এবং জুমার নামাজের খোৎবায় খলিফার নামের সাথে তাদে নাম পাঠ করে খলিফার প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করতেন। আব্বাসীয় খলিফাগণ ও এসকল স্বাধীন সুলতানদের আনুগত্য প্রদর্শনে মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে বৈধ সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন। তাদের জন্য সনদ ও খিলাৎ প্রেরণ করতেন। এমনিভাবে আইনত; দিল্লীর সালতানাত আব্বাসীয় খিলাফতের অংশ ছিল। গজনভীর সুলতান, এমন কি সুলতান মুঈজউদ্দীন মোহাম্মদ ঘুরী এবং তার বংশধরগণ আব্বাসীয় খলিফার আনুগত্য স্বীকার করতেন।

সে যুগে প্রচলিত মুসলিম জাহানের রীতি অনুসারে দিল্লীর সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কতুবউদ্দিন আইবক তাঁর প্রভু মঈজউদ-দীন মুহাম্মদ ঘুরীর মৃত্যুর ৩মাস পর ১২০৬ ঈ. দিল্লীর সালতানাতে অধিষ্ঠত হয়ে বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। তবে সরাসরি স্বীকৃত লাভ করতে সক্ষম হননি। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর মনসুর আল মুনতাসির বিল্লার দূত ১২২৯ ঈ. সুলতান ইলতুৎমিরের জন্য খলিফার সনদ অর্থাৎ স্বীকৃতিপত্র এবং খিলাৎ [সম্মানসূচক পোষাক] নিয়ে দিল্লীতে আসেন। ফলে দিল্লীর সালতানাত দার-উল-ইসলামের অংশ এবং সুলতান খলিফার বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে পরিগণিত হয়।

গজনভীর সুলতান মুঈজ-উদ-দীন মোহাম্মদ বিন সাম খুৎবায় নিজের নামের সাথে আব্বাসীয় খলিফার নাম উল্লেখ করতেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন দিল্লীর সুলতান কতুবউদ্দিন আইবেক তাঁর নামে খোৎবা পাঠ করেন। তার মৃত্যুর পর কতুবউদ্দিন আইবেক নিজের নামে খোৎবা পাঠ করেন। বখতিয়ার খীলজী বেঁচে থাকতে যেহেতু আইবেক নিজের নামে খোৎবা পাঠ করেননি সেহেতু বখতিয়ার খীলজী আইবেকের নামে খোৎবা পাঠের প্রশ্ন আসে না। দ্বিতীয়ত: বখতিয়ার খিলজী বেঁচে থাকতে ভারত দার-উল-ইসলামের অংশ হিসেবে আব্বাসীয় খলিফাদের নিকট থেকে স্বীকৃতির প্রচেষ্টাও করা হয় নাই। তাই বখতিয়ার খলজী আব্বাসীয় খলিফাদের নামে খোৎবা পাঠের সম্ভাবনা থাকে না। তৃতীয়ত: বখতিয়ার খলজীর তিব্বত অভিযান ব্যর্থ হলে দেওকোট পৌঁছে অত্যাধিক মানসিক যন্ত্রনায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। সে মৃত্যুর শয্যা সম্পর্কে মীনহাজ লিখেছেন- ‘সেই বিপদের সময়ে তার মুখ থেকে অধিকাংশ সময়ে উচ্চারিত হতো সুলতানে-ই-গাযী মঈয-উদ-দুনিয়া-ওয়াদ-দীন মোহাম্মদ সাম এর কী এমন কোন বিপদ ঘটেছে যে আমার ভাগ্য আমাকে পরিত্যাগ করেছে। তখন এমন কি ঘটেছিল যে, সে সময়েই সুলতান-ই-গাযী [তার সারাহ] শাহাদৎ বরণ করেন’। এ বক্তব্য থেকে এ কথা প্রমানিত হয় যে বখতিয়ারখীলজী সুলতান-ই-গাজী মুঈজ-উদ্দিন মোহাম্মদ বিন সামের প্রতি পূর্ণ অনুগত ছিলেন। মোহাম্মদ বখতিয়ার খীলজী তার এ চরম দু:সময়ে মোহাম্মদ ঘুরীর কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন অথবা সাহায্যের আশা করেছিলেন, না সুলতানের শুভেচ্ছাই তার বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার পক্ষে যথেষ্ট তা সুস্পষ্ট নয়। বারবার এ উক্তির উচ্চারণ এ কথা প্রমান করে যে মোহাম্মদ বখতিয়ার খীলজী সুলতান মোহাম্মদ ঘুরীর অনুগত এবং øেহপুষ্ঠ ছিলেন। সুতারাং তার নামেই খোৎবা পাঠ করাই খুব স্বাভাবিক ছিল। চতুর্থত: উপরে আলোচিত বখতিয়ার খীলজীর অঙ্কিত মুদ্রায় নিজের নাম বাদ দিয়ে মুহাম্মদ ঘুরীর নাম প্রকাশ এবং গৌড় বিজয় কথা দ্বারা অনুমিত হয় যে বিজিত অঞ্চল মোহাম্মদ ঘুরীর রাজ্যে ছিল। তাই বখতিয়ারের বিজিত অঞ্চলে পাঠিত খোৎবা মুঈজ-উদ-দীন মুহাম্মদ বিন সামের নামে পাঠ করা হতো বলে ইতিহাসতাÍিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ায় যায়।

. মুসলিম সমাজের ভিত্তি: মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ প্রতিষ্ঠা

মীনহাজ-ই- সিরাজ অত্যান্ত সুষ্পষ্ট করে লিখেছেন ‘ঐ অঞ্চল সমুহে [অসংখ্য] মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ তার এবং তার আমিরদের প্রচেষ্টায় দ্রুত ও সুন্দরভাবে নির্মিত হয়।’  বখতিয়ার খীলজী লৌখনতী রাজ্যের রাজধানীতে, তার আমীরগন ইকতার [প্রদেশের] সদর দপ্তরে এবং অন্যান্য খলজী মালিকগন গুরুত্বপূর্ন স্থানে মুসলমানদের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ, মুসলমানদের সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য মাদ্রাসা এবং সূফীদের দ্বারা নওমুসলিমদের ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। শাসনতান্ত্রিক পুন:বিন্যাসের পর তিনি মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেন। মুসলিম সমাজের নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মসজিদ। মুসলমানেরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই প্রথমে মসজিদ প্রতিষ্টা করেছে। যে সকল মুসলমান অভিযান পরিচালনার সময়ে অথবা তার পরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য লখনৌতে আগমন করে তাদের সুবিধার জন্য তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রসঙ্গে ড. আবদুল করিম লিখেছেন, একজন সৈনিক হইয়াও বখতিয়ার খীলজী বুঝিতে পারেন যে, মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠা ব্যতিত লখনৌতির মুসলমান রাজ্য শুধু সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করিতে পারে না। সামরিক শক্তির প্রয়োজন একদিন শেষ হইবেই, কিন্ত অতপর, অর্থাৎ শান্তির সময়ে মুসলমান সমাজ- মুসলমান রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধান করিবে’ আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং আমাদের ইতিহাস অসচেতনতা ঐতিহাসিক নির্দশন দ্রুত নষ্ট অথবা ধ্বংস হয়ে যায়। যার কারণে বখতিয়ার খীলজির আমলের কোন স্থাপত্য নির্দশন আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

. দ্বীন প্রচার: মুসলমানদের মৌলিক কাজ
বখতিয়ার খলজী যখন লখনৌতিতে আসেন তখন আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। খিলাফতের প্রান্তিক রাজ্যসমূহের সম্প্রসারনে তখনও মূল কারণ দ্বীন- ই- ইসলাম প্রচার করা।  হিন্দু ও ইউরোপীয়রা যতই একে মাল-ই-গনীমতের লোভে পরিচালিত অভিযান বলে আখ্যায়িত করুক না কেন; মুসলিম সেনাপতিরা জিজিয়া দিতে সম্মত হয়েছে অথবা দ্বীন গ্রহণ করেছে এমন কোন রাজা বাদশাহর সাথে যুদ্ধ করেছে এমন প্রমাণ তারা দিতে পারবে না। সে জন্য প্রান্তিক রাজ্য বিজয়কে আব্বাসীয় খলিফা স্বীকৃতি প্রদান করতো; বিজয়ী সেনাপতিকে সনদ ও খিলাত দান করতো; সর্বোপরি বিজিত অঞ্চলকে দ্বার-উল-ইসলামের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতো। তাছাড়া বিজয়ী সেনাপতি মাল-ই-গনীমত সংগ্রহ ও বন্টন করতো; জিজিয়া সংগ্রহ করতো; বখতিয়ার খিলজীর ক্ষেত্রে এ নীতির লংঘিত হয়নি।

উল্লেখিত প্রসঙ্গে মীনহাজ-ই-সীরাজ তিনটি তথ্য প্রদান করেছেন- ‘কোচ ও মেচ জাতির প্রধানদের মধ্যে একজন-যিনি আলী মেচ নামে পরিচিত হন- মোহাম্মদ বখতিয়ারের হস্তে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং [তিনি মোহাম্মদ বখতিয়ারকে] পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে যেতে এবং পদ প্রর্দশক হতে সম্মত হন’।

‘মোহাম্মদ বখতিয়ার ঐ নদীর তীরে উপস্থিত হলেন এবং আলী মেচ মুসলিম সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন। তিনি দশ দিন ধরে নদীর উর্ধ্ব মুখে সৈন্যদের চালিয়ে নিয়ে গেলেন।’’ [পৃ.-২৭]

‘মোহাম্মদ বখতিয়ার পানি থেকে বের হয়ে আসলে কোচ এবং মেচদের একদলের নিকট সংবাদ পৌছে গেল। পথ প্রর্দশক আলী মেচ তার আতœীয় স্বজনদের রেখে গিয়েছিলেন। তারা উপস্থিত হয়ে অনেক সাহায্য ও সেবা করলেন।’

কোচ এবং মেচ জাতির পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে মীনহাজের অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া লিখেছেন’ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত [উত্তর] অঞ্চলে বিশেষ করে, বৃহত্তর ও অবিভক্ত দিনাজপুর ও রংপুর জেলা সমুহে, বিহারের পুর্নিয়া জেলার কিয়দংশে ও অবিভক্ত আসামের পশ্চিমাঞ্চলে একটি পৃথক নবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব দেখা যায়। চ্যাপটা নাক, উন্নত গন্ডাস্থি, বঙ্কিম চক্ষু, উদ্দন্ড কেশ এবং কেশ বিহীন দেহ, কেশ বিরল মুখমন্ডল এর অধিকারী এ নরগোষ্ঠী যে আদিতে মোঙ্গলীয় রক্তধারা থেকে উৎপন্ন তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার উত্তরাংশে এদের নিবাস অধিক পরিমাণে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং এখনও আছে। রংপুর জেলার উত্তর-উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আজও এদের ঘনবসতি দেখা যায়।’ মীনহাজের বর্ণনা  থেকে এটা সহজে ধারণা করা যায় যে- মেচ জাতির প্রধান আলী মেচকে বখতিয়ার খীলজী স্বয়ং দ্বীনের দাওয়াত দেন। সে দাওয়াত গ্রহন করে আলীমেচ এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, এমনকি তার মেচ জাতির বহু লোক বখতিয়ারের হাতে ইসলাম গ্রহন করেন। আলী মেচকে জোর করে বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে ধর্মান্তরিত করা হয়নি এবং আলী মেচ ও তার লোকেরা যে মোহাম্মদ বখতিয়ারের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে অনুগত ছিলেন তা সহজে বোঝা যায় বখতিয়ার খীলজীর চরম দুর্দিনে তাদের সাহায্যে ও সেবার দৃষ্টান্ত দেখে। বখতিয়ার খীলজীর প্রতি যদি তারা বিরূপ থাকতেন তবে তার সেই চরম অসহায় মুহূর্তে [অবস্থায়] ইচ্ছা করলে অতি সহজেই তার এবং তার সঙ্গীদের প্রাণনাশ করতে পারতেন; প্রতিশোধ নিতে পারতেন এবং তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে আলী মেচ ও তার দলবলের সঙ্গে বখতিয়ার খীলজির একটা আন্তরিকতাপূর্ন দ্বীনি সম্পর্ক ছিল।

উপর্যুক্ত উদাহরণ যথেষ্ট যে বখতিয়ার খীলজী এবং তাঁর সঙ্গী সাথীরা লৌখনতি রাজ্যের রাজধানী ও প্রশাসনিক সদর দপ্তরে সাধারন মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করেছিলেন যার ফলে মেচ কোচসহ বহুজাতির দেশ আজ মুসলিম প্রধান দেশে পরিণত হয়েছে।

.উপসংহার
বখতিয়ারের ঘোড়া, ঢাল, তরবারী, বল্লম, তীর-ধনুসহ সকল অস্ত্র-সস্ত্রের সঠিক নমুনা না থাকলেও মীনহাজ সে সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারনা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন।তাছাড়া ইতোমধ্যে আবিস্কৃত মুদ্রার একপীঠে বৃত্তের মধ্যে বল্লমধারী ঘোড়সওয়ারী সৈন্যর অঙ্কন তার সংস্কৃতিতে উন্নত সৈনিক জীবনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তিব্বত অভিযান ব্যর্থতার পেছনে সমর নেতা হিসেবে তার কোন অযোগ্যতা প্রকাশ পায়নি বরং পাশ্ববর্তী রাজন্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতাই মূখ্য কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়েছে। এদেশীয় সামরিক কুটকৌশলের নিকট বখতিয়ার পরাজিত হয়ে দেবকোট ফিরে আসেন। এ দেবকোট হচ্ছে প্রাচীন ভারতের বরেন্দ্র অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও জাকজমকপূর্ণ নগরী। দেবীকোট্ট, দেওকোট, দেবীকোট, উমাবন, উষাবন, কোটীবর্ষ, শোনিতপুর, বানপুর প্রভৃতি নামে এ নগরীর বর্ণনা যাদব প্রকাশের বৈজয়ন্তী, কল্পসূত্র, বিষ্ণুপুরান, শ্রীমৎ ভগবত, বায়ুপুরান এবং বৃহৎ সংহিতার মতো প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। এমন একটি নগরীকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন বখতিয়ারের উচ্চ ঐতিহ্যমন্ডিত সাংস্কৃতিক রুচিবোধ ও জ্ঞানের বহি:প্রকাশ। এখানেই বখতিয়ার ইনতেকাল করেন এবং এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। এখনও তার সমাধিস্থলে দর্শনার্থীদের ভীড় লক্ষনীয়। এ দেবকোটে মাওলানা শাহ আতার সমাধি সৌধ রয়েছে যার দেয়ালে সংযুক্ত ৬৯৭ হিজরী [১২৯৭ঈ.] শিলালিপি বাংলার সুলতানী শাসনের প্রাথমিক যুগের গুরত্ব বহন করে। তাছাড়া সুলতান কায়কাউসের রাজত্বকালে [৬৯১-৭০২ হিজরী] প্রাদেশিক গর্ভনর জাফর খান বাহরাম আইতগীনের সময়ে মুলতানর সালাহউদ্দিন জিওয়ান্দের তত্বাবধানে একটি সমজিদ নির্মিত হয়। এসব তথ্য একথা প্রমাণ করে যে বখতিয়ারের প্রতিষ্ঠিত রাজধানী এবং সমাধিস্থল প্রাথমিক সুলতানী যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে বর্তমান ছিল।

বখতিয়ার খলজী নওদীয়াহ ও লৌখনতি বিজয় করে বাংলার উত্তর প্রান্তে একটি মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। সে রাজ্যে তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম সমাজের ভিত মজবুত করেছিলন; সে রাজ্যে তিনি মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক খোৎবা এবং মুদ্রার প্রচলন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে রাজ্যে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করে ওয়ালী, আমীল ও কাযী নিয়োগ দিয়ে একটি উন্নত প্রশাসন প্রবর্তন করেছিলেন। সে রাজ্যে দ্বীন ইসলাম প্রচার করে কোচ- মেচ সহ হাজার ধরণের অমুসলিমকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুসলিম করেছিলন। এসবের সুফল আজ আমরা শতভাগ ভোগ করছি। অথচ বখতিয়ার খলজী এ প্রজন্মের কাছে অপরিচিত। তাই শুধু সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নয়; বরং সর্বক্ষেত্রে বখতিয়ার খলজীর চর্চা প্রয়োজন; অতি প্রয়োজন। আগামী প্রজন্ম যেন বখতিয়ার খলজীকে সহজে চিনতে পারে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করার জন্য সচেতন সুধী সমাজকে আহবান জানাই।

উৎস:
সাময়িকী, ০৩ এপ্রিল ২০১৬

লোকশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের বর্ণাঢ্য জীবনের কয়েকটি বিচিত্র ঘটনা

 

মাহমুদ ইউসুফ

 

সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সমৃদ্ধশালী জনপদ। প্রাগৈতিহাসিককালে নুহ নবির প্রপৌত্র বং এ জাতির গোড়াপত্তন করেন। সেই থেকে আমাদের পথচলা। তাই বঙই বাঙালি জাতির আদি জনক। বাংলাদেশের অধিবাসীরা বঙের ওয়ারিশ-উত্তরসূরী। বঙের রক্ত বহন করে চলছে নিরবধি। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এই বর্ণালী অতীতের ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে তাওহিদবাদী অর্থাৎ মুসলিমরাই সোনার বাংলা গড়ে তোলে। শুধু অর্থবিত্তে উন্নত নয়; সংগীত, শিল্পকলা, সংস্কৃতি চর্চায়ও এ জাতি শীর্ষে। গানে ভরা, সুরে ভরা এদেশ আমার। মাঠে গান, ঘাটে গান, নদীতে গান। গান আর গান, সুর আর সুর। সেই সুরের সুুরলহরীতে সুকুমার বৃত্তির বিকাশে অঙ্গীকারাবদ্ধ জাতি। এই গান জীবনের, প্রেমের, বিরহের, নবিদের, রসুলদের, দীনের, ইসলামের, ইমানের, তাওহিদের। আবহমানকাল থেকেই বাঙালির বিনোদন সংগীতকলার সাথে রিশতাযুক্ত। ব্রিটিশ আমলে ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ প্রবঞ্চনা ও জুয়াচুরিতে বাঙালি মুসলমানরা হয় কোনঠাসা। তাহযিব-তমদ্দুন থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়। হয় তারা গৃহবন্দি। এই বন্দিদশা থেকে বিশ শতকে তাদের উদ্ধার করেন নজরুল-আব্বাস। নজরুল বাঁধার প্রাচীর উপড়ে ফেলেন আর আব্বাস অচলায়তন ভেঙে সুরের জগতে টেনে আনেন স্বগোত্রকে। নজরুল-আব্বাস যুগল প্রতিভায় বাঙালি সংস্কৃতি ঝলমলিয়ে ওঠে। বর্তমানের কথিত সেকুলার বা পৌত্তলিক সংস্কৃতি নয়; একত্ববাদের কালচারই বাঙালি কালচার। বাঙালি সংস্কৃতি কোনোকালেই মুশরিকি প্রভাবাধীন ছিলো না। বাঙালিরাই মুসলমান মুসলমানরাই বাঙালি। মূল বাঙালি, আসল বাঙালি, আদি বাঙালি, ঐতিহাসিক বাঙালি। (অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস ১ম খণ্ড, পৃ ২৮৯) আধুনিক যুগে নজরুল-আব্বাস ছিলেন সেই বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের প্রধান সেনাপতি। আব্বাসউদ্দীনের সুকণ্ঠী গলার মাদকতায় মাতোয়ারা হয়ে উঠল বাংলার আপামর জনতা। সে এক ঐন্দ্রজালিক কাণ্ড। সেই ঝড়ো হাওয়ায় পাল তুলে জাতি এগিয়ে চলল লক্ষ্যপানে। এই মহানায়কের মহাজীবনের কয়েকটি টুকরো খবর নিয়ে আজকের আয়োজন।

ফুলচোর
গান আর ফুল ছিলো তাঁর প্রিয়। কবি বলেছেন, জোটে যদি মোটে একটি পয়সা/খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/দুটি যদি জোটে তবে/একটিতে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী। এই কবিতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি তাঁর জীবনকাহিনি। বাড়ির কাছেই পিডব্লিউডি’র ডাকবাংলো। সেখানে গোলাপ, বেলি, গন্ধরাজ ও আরও নানান ফুলের সুন্দর এক বাগান। সেই বাগান থেকে রোজ অতি ভোরে ফুল চুরি করতেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। একদিন মালির কাছে ধরা পড়ে যায়। মালি বললেন, ‘না বলে ফুল নাও কেন? বরং ফুলের ডাল নিয়ে যাও। বাড়িতে পুঁতে দিও, ফুল হবে’। এমনি করে গড়ে ওঠে তাঁর বাড়িতে ফুলবাগান। তবুও রোজ সকালে ডাকবাংলো থেকে ফুল চুরি করে আনতেন। মালির কাছে আবার ধরা পড়লেন। মালি বললেন: দুষ্ট ছেলে, তোমাদের বাগানে তো এখন খুব ফুল ফোটে। আমার এখান থেকে ফুল নিয়ে যাও কেন? আব্বাস সরলভাবে বললো: মালি, আমার নিজের বাগানের ফুল ছিড়তে বড় মায়া লাগে’। মালি রাগ না করে জবাব দিল: ঠিক কথা খোকা, নিজের বাগানের ফুল ছিড়তে বড্ড মায়া লাগে। তবে আমার বাগান থেকে না বলে নিলে সেটা তো চুরি করা হয়। আর ওতে আমারও তো ফুল কমে যায়। আমি দুঃখ পাই।’ আব্বাসউদ্দীন লিখেছেন, ‘… ফুলের দিকে তাকালেই সৃষ্টির রহস্য জাল বুনতে থাকে মনের কোনে। বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি এই ফুল।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৫)

নামের আগে শ্রী
বিশ্ববিখ্যাত এই সংগীত তারকার ছেলেবেলার নাম ছিল ‘শ্রী শেখ আব্বাসউদ্দীন আহমদ’। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ২০) আবার তাঁর ছাত্রজীবনের তাকালে দেখি তাঁকে ধুতি পড়ে স্কুলে যেতে হত। আশ্চর্য ! ভাবতে অবাক লাগে! একটা ধর্মের অনুসঙ্গ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা তখন কত জোরালো ছিলো তা এখান থেকেই অনুমেয়।

কাব্য রত্নাকর: নামের শেষে লেজ
একসময় বিশেষ দাওয়াত উপলক্ষে কবি নজরুল ইসলাম আসেন কুচবিহারে। স্কুল-কলেজের দাওয়াতে অংশগ্রহণের জন্যেই তাঁর এখানে আসা। আব্বাস প্রথম জীবনে কবিতা লিখতেন। কবিতা লেখার জন্য উস্তাদ ও ইয়াররা তাঁকে ‘কাব্য রত্নাকর’ খেতাব দেয়। আব্বাস নামের শেষে এই উপাধি ব্যবহার করেছেন দেখে নজরুল তাঁকে বললেন, ‘কি ব্যাপার নামের শেষে লেজ লাগিয়েছো কেন? আব্বাস শরমে নত হয়ে গেলেন। লেজ ছাড়াও খ্যাতি অর্জন করা যায়। নামজাদা হবার জন্য লেজের কোনো দরকার নেই। তিনি আর কখনও নামের শেষে কাব্য রত্নাকর খেতাব যোগ করেননি। পরবর্তীকালে লেখাই ছেড়ে দিলেন। (এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১১)

বিয়ের মধুর স্মৃতি
১৯২৯ সনে রংপুরের চিকনমাটি গ্রামের ফজিলউদ্দিন সরকারের কন্যা লুৎফুন্নেছার সঙ্গে বিয়ে হয় আব্বাসউদ্দীনের। মেয়ে দেখার সময় লুৎফুন্নেছা গান গেয়ে শোনান আব্বাসউদ্দীনকে। আর আব্বাসউদ্দীনও অনেক গান শোনালেন ভাবী স্ত্রী আর উপস্থিত সবাইকে। আব্বাসউদ্দীন তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়েছিলেন ‘আলেয়া’। আলেয়া নামেই তিনি তাকে ডাকতেন। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ১৯)

আব্বাসউদ্দীন ও জসীম উদ্দীন
মাটি ও মানুষের কবি জসীম উদ্দীন। তিনি গত শতাব্দির নামজাদা কবিশিল্পী। তিনি খ্যাতিমান হয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীনের সহযোগিতায়। ইহা অনেকেরই অজানা। উভয়ের মোলাকাত করার সুযোগটা বড়ই মধুর। এমএ পরীক্ষার পর অবসর সময় কাটাচ্ছেন কবি। আব্বাসউদ্দীনের কাছে যেতে চাইলেন। কিন্তু পকেটে যে পয়সা নেই। আব্বাসের কাছে চিঠি লিখতে চাইলেন। কিন্তু চিঠি লেখার ঠিকানা যে জানা নেই। ভীষণ ভাবনায় পড়লেন, কীভাবে লিখবেন তাঁকে। হঠাৎ করে মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। খামের ওপর লিখলেন: কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, পার্কসার্কাসের যে বাড়িতে তিনি থাকেন, পো: কলকাতা, জেলা: কলকাতা। এই আজব চিঠি পেয়ে হয়ত রানারও মুচকি হাসছিলেন। আব্বাসউদ্দীন সবারই পরিচিত শিল্পী। ডাকপিওন যথাভাবেই চিঠি পৌঁছে দিলেন। আব্বাসউদ্দীন জসীম উদ্দীনকে কলকাতা সেটেলড করার বন্দোবস্ত করলেন। (এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, পৃ ২৪-২৫)

চলচ্চিত্র অভিনেতা
গণমনে তিনি সুরশিল্পী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। তিনি যে চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন তা অধিকাংশ মানুষই অনবহিত। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মোট চারটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এগুলো হলো বিষ্ণুমায়া (১৯৩২), মহানিশা (১৯৩৬), একটি কথা ও ঠিকাদার (১৯৪০)। ঠিকাদার সিনেমাতে আব্বাসউদ্দীন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এসব সিনেমাতে তিনি গানও পরিবেশন করেন।

স্বাধীনতার কাণ্ডারি
জীবনীকর, সুসাহিত্যিক এম রুহুল আমিন লিখেছেন, ‘আব্বাসউদ্দীন গ্রামবাংলার অসংখ্য সভায় গান-গজল গেয়ে দেশকে জাগিয়েছেন, দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার বারো বছর পর তাঁর মৃত্যু হয় ঢাকায়। মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্তও তিনি বলতেন, ‘গোলাম হয়ে জন্মেছিলাম। আযাদ হয়ে মরতে পারছি, এই আমার আনন্দ।’ (এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১৮) আব্বাসউদ্দীন সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আব্বাস উদ্দিন কেবল গায়ক ছিলেন না, এই প্রজন্মের গায়করা যদি ভাবেন আব্বাস উদ্দিন শুধু গান গেয়ে এদেশের মানুষের মন জয় করেছেন তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে। আব্বাস তাঁর সময়কালের আকাঙ্খা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল এবং আরো অনেকে।” তাঁর সন্তান ফেরদৌসী রহমান এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসীও গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন।

মঞ্চে আব্বাসউদ্দীন
১৯৫৪ সনে পুরান ঢাকায় বার লাইব্রেরিতে একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়। এই ঘরোয়া প্রোগ্রামে আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকসহ বহু বোদ্ধা শ্রোতা-দর্শকের হাজিরা ঈর্ষণীয়। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন যখন সঙ্গে এলেন তখন তিনি হলের সব লাইট নিভিয়ে দিতে এবং কোনরূপ শব্দ না করতে অনুরোধ জানান। তাঁর হুকুমমতোই সব ব্যবস্থা হলো। শিল্পী গান ধরলেন ‘নদীর কূল নাই কিনার নাইরে’। সুরের ইন্দ্রজালে মোহমুগ্ধ জনতা। গান শেষ হলে কোনো শব্দ নেই শুধু মনে হয়েছিল সুর তখনও অনুরণিত হচ্ছে। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম মোস্তাফা কামাল লিখেছেন, ‘তিনি যখন গান গাইতেন- কি বাসায়, কি বাইরে- মনে হত তাঁর শরীরটাকে মর্তে রেখে তিনি তাঁর কণ্ঠকে তুলে দিয়েছেন মহাকালের হাতে। গানের এই বিমূর্ত প্রকাশ ঘটে থাকে কিছুটা বিধিদত্ত প্রতিভা, কিছুটা সাধনা এবং অনেকটা আরাধনার ভেতর দিয়ে। তাঁর গানে বিশেষ করে ইসলামী গানে মরমী হৃদয়ের যে নিবেদিতচিত্ততা লক্ষ্য করি তা কোন আকস্মিক কণ্ঠগত কৌশল নয়। জন্মগত প্রতিভার সাথে ব্যাপক চর্চার মিশ্রণ ঘটিয়ে এসব গানে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির প্রয়াস নেই। এ-গানগুলো যাঁরা শুনেছেন তাঁদের হৃদয়ের গভীর অর্ন্তলোকে স্পন্দন এসেছে। তার কারণ, ভক্ত হৃদয়ের আকুতি ও উচ্ছ্বাস এইসব গানে ধরা পড়ে আছে।’ (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১৪৪ ও ৬৬-৬৭)

ফুলবাগানের মালি
সুন্দর, সৌন্দর্য, মনোহর, লাবণ্যময়তার প্রতি ইনসানের আকর্ষণ স্বাভাবিক সহজাত। আব্বাসউদ্দীনের এক্ষেত্রে এ সত্য আরও বেশি প্রযোজ্য। তাঁর জিন্দেগির সকল কাজেই সুরুচির পরিচয়বাহী। আগেই উক্ত হয়েছে: শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন ফুলপ্রেমিক, ফুলের অনুরাগী। পুরানা পল্টনস্থ তার বাসভবন ‘হীরামন মঞ্জিলে’ নিজ হাতে গড়া ফুলবাগান ছিলো তাঁর হৃদয়ের অবিচ্ছেদ অংশ। এই বাগানকে ঘিরে একটি স্মরণীয় ঘটনা: একদিন এক ইংরেজ ভদ্রলোক আসেন শিল্পীর সঙ্গে দেখা করতে। ভদ্রলোক গাড়িতে করে এসেছিলেন। আব্বাসউদ্দীন তখন বাগানের কাজে মশগুল। ভদ্রলোক বাড়িতে প্রবেশ করে বাগানের মালিকে বললেন, সাহেবকে খবর দাও। খানিকক্ষণ পর ধোপদূরস্ত হয়ে শিল্পকার হাজির। ইংরেজ নাগরিক অসহিষ্ণু হয়ে আবার গৃহকর্তার খোঁজ করলেন। আব্বাসউদ্দীন বিনীত গলায় জানালেন, আমার নামই আব্বাসউদ্দীন। শুনে ভদ্রলোক তাজ্জব। (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ৯৪)

গানে গানে বৃষ্টি
আব্বাসউদ্দীনের গায়ক জীবন নানা স্মৃতিতে ভরপুর। সুখ-দুঃখের স্মৃতি নিয়ে রচিত জীবনালেখ্য ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে। বইটি অসাধারণ সুখপাঠ্য ও শিক্ষণীয়। আব্বাসউদ্দীন লিখেছেন, ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে- গানখানা বহুবার গেয়েছি। যতদিনই গেয়েছি। গানের শেষে ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে’ উপখ্যান বা প্রবাদ বাক্য কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
চীনের প্রধানমন্ত্রী মি. চৌ এন্ লাই ঢাকায় এলেন। আমরা এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গুলিস্তান সিনেমা হলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাই। সন্ধ্যা সাতটায় নাচ-গান আরম্ভ হল। রাত নটায় অনুষ্ঠান শেষ হয়। এই অনুষ্ঠানে আমি ‘‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’’ গানখানি পরিবেশন করেছিলাম।
অনুষ্ঠান শেষে প্রতিটি শ্রোতা হলের বাইরে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বাইরে আরম্ভ হয়েছে ঝমঝমাঝম বৃষ্টি। অথচ প্রেক্ষাগৃহে যখন সবাই ঢুকেছিলাম তখন ছিলো তারকাখচিত নির্মল আকাশ।
মিঃ চৌ এন্ লাই ঢাকা পরিত্যাগের পূর্বমুহূর্তে বিমানঘাঁটিতে বলে গিয়েছিলেন, এদেশের অনেক কিছুই হয়ত ভুলে যাব কিন্তু স্মৃতির মনিকোঠায় একটি চিত্র বহুদিন দাগ কেটে থাকবে। সেটা হচ্ছে- তোমাদের দেশের শিল্পী গান দিয়ে আকাশের পানি আনতে পারে।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৩৯-১৪০) ইসলামি গান দিয়েই তিনি সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছেন। সুনীল কুমার মখোপাধ্যায় বলেন, ‘ইসলামী গান গেয়েই আব্বাসউদ্দীন বাঙালী মুসলমানের প্রাণের তারে ঘা দিতে পেরেছিলেন সবচেয়ে বেশি।’ (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১১৯)

মৃত্যুশয্যায়
১৯৫৯ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি রোজনামচায় লিখেন, ‘… সারাদিনরাত শুয়ে শুয়ে আর ভাল লাগে না। কি সুন্দর আস্তে আস্তে অজানা দেশে চলেছি। কারো ক্ষমতা নেই সে দেশ যাওয়া থেকে প্রতিনিবৃত্ত করা; … চলমান দুনিয়ায় কোনো শক্তি নেই সেই মহা আকর্ষণ থেকে কোনো উপায়ে ঠেকিয়ে রাখে।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৪০) এর দুমাস পর ১৯৫৯ সনের ৩০ শে ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৮ বছর ২ মাস ৪ দিন। অথচ তাঁর আব্বা জাফর আলী আহমদের আয়ুষ্কাল ছিলো ১০৫ বছর।

সারাদেশে কুখ্যাত, অখ্যাত, অপরিচিত, অজানা, অচেনা লোকের নামেও হয়েছে নানাবিধ স্থাপনা। অথচ ইতিহাসের মহান শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের নামে নেই কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম। সড়ক, এভিনিউ, সংগীত একাডেমি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ তাঁর নামে হতে পারত। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে চরম উদাসীন। এই অবিমৃশ্যকারিতার অবসান হোক।

হদিস:
১। সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, বাংলা একাডেমি ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮
২। আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, হাসি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ৩৪ নর্থব্রুক হল রোড, ঢাকা-১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২
৩। শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, রেড ক্রিসেন্ট হাউস, মতিঝিল ঢাকা ১০০০, প্রথম সুলভ সংস্করণ সেপ্টেম্বর ২০১৪
৪। এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ২০০০
৫। অতীত দিনের স্মৃতি; আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড, মোহাম্মদ মাহ্ফুজ উল্লাহ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯৪
৬। আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, সেগুনবাগিচা ঢাকা ২, প্রকাশ: জুন ১৯৭৯
৭। অধ্যাপক ড. এস.এম. লুৎফর রহমান: বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস ১ম খণ্ড, ধারণী সাহিত্য সংসদ, ঢাকা, প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৪

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ : পর্ব ৭

 

বেদে  গুম  জঙ্গি  সন্ত্রাস

আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ। চার বেদের মধ্যে ঋগবেদ প্রাচীন। ঋগবেদখানা পড়লে বুঝা যায় যে আর্যরা ছিলো একটা হাঘরে জাত। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদের উৎপত্তি হলেও সমগ্র বেদখানাতে উলঙ্গভাবে প্রকটিত হয়েছে দেবতাদের কাছে, তাদের বৈষয়িক প্রার্থনা- ঋগবেদের ১০ হাজার মন্ত্রের মধ্যে হাজার খানেকেতে শুধু একই কথা বলা হয়েছে- দাও আমাদের শত্রুর ধন দাও, দাও আমাদের শত্রুর সম্পদ, দাও আমাদের শত্রুর গাভী, দাও আমাদের শত্রুর মেয়েছেলে ইত্যাদি। সর্বত্রই বলা হয়েছে- ‘আমার শত্রুকে ধ্বংস কর, তাদের সকল সম্পদ আমাদের দাও, অন্য কাউকে দিও না। কেবল আমাদের মঙ্গল কর।১ বিপরীত সম্প্রদায়ের ধ্বংসই ওদের কাম্য।

ইন্দ্র হলো হিন্দুপুরাণের স্বর্গের দেবতাদের রাজা। আর্যসভ্যতার ইতিহাসবেত্তাদের মতে ইন্দ্র সম্ভবত ভারতে আগত আর্যদের মধ্যে কোন এক রাজা বা পরাক্রান্ত নেতার নাম, যা কালক্রমে দেবতাদের রাজা আখ্যান পেয়েছে হিন্দুধর্মে। ঋকবেদে ইন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইন্দ্র ঋগেবেদের দেবতাদের মধ্যে প্রধান। দুর্দমনীয় যোদ্ধারূপেই তিনি পরিকল্পিত। অগ্নি এবং পূষা তার ভ্রাতা। তিনি আর্য জাতির রক্ষক, তার জন্য তিনি দস্যুদের বধ করতেও কুণ্ঠিত নন।(ঋগবেদ ৩/৩৪/৯)।২ বহু শত্রুর দমনকারী, বহু বরণীয় ধনের স্বামী ইন্দ্রকে লক্ষ করে গাও। তিনি আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করুন, তিনি ধন প্রদান করুন, তিনি স্ত্রী প্রদান করুন, তিনি অন্ন নিয়ে আমাদের নিকটে আগমন করুন।৩ লোভ লালসা, পরধন গ্রাস আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চিরন্তন রীতি।

হে ইন্দ্র! আমাদের রক্ষণার্থে সম্ভোগযোগ্য, জয়শীল, সদা শত্রুবিজয়ী ও প্রভূত ধন দাও। যে ধনদ্বারা (নিযুক্তি সৈন্যদিগের) নিরন্তর মুষ্টিপ্রহার দ্বারা আমরা শত্রুকে নিবারণ করব অথবা তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে অশ্ব দ্বারা শত্রুকে নিবারণ করব। হে ইন্দ্র! তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে আমরা কঠিন অস্ত্র ধারণ করি, যুদ্ধে স্পর্ধাযুক্ত শত্রুকে জয় করব। হে ইন্দ্র! তোমার সহায়তায় আমরা বীর অস্ত্রধারীদের সাথে সৈন্যসজ্জাযুক্ত শত্রুকেও পরাভব করতে পার। ইন্দ্র মহৎ এবং সর্বোৎকৃষ্ট, বজ্রধারী ইন্দ্রে মহত্ত্ব অবস্থিতি করুক; তাঁর সৈন্য আকাশের ন্যায় প্রভূত। যে পুরুষেরা সংগ্রামে লিপ্ত হন অথবা পুত্র লাভ ইচ্ছা করেন অথবা যে বিজ্ঞ লোকেরা জ্ঞানাকাক্সক্ষায় থাকেন (তাঁরা সকলেই ইন্দ্রের স্তুতি দ্বারা সিদ্ধি লাভ করেন)।৪ আজও তাদের দানবীয় প্রবৃত্তি আগের মতই আছে।

Image result for সম্রাট অশোকের ছবি

ঘোড়াই আর্যদের সম্বল ছিলো, তারা সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের কাছ থেকে গাভী চুরি করে এনেছিল। দূতী সরমাকে পাঠিয়ে তারা এর সন্ধান করেছিল। তারপর তারা গুহার মধ্যে রক্ষিত গাভীসমূহ অপহরণ করেছিল। (ঋগবেদ- ১/৬/৫)। তারা প্রার্থনা করত, হে ইন্দ্র! শত্রু বধকালে এ উভয় জগৎ তোমাকে ধারণ করতে পারে না, তুমি স্বর্গীয় জল জয় কর, আমাদের সম্যকরূপী গাভী প্রেরণ কর। (ঋগবেদ- ১/১০/৮)। গাভী লাভার্থে ইন্দ্র সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের নগরসমূহ বিদীর্ণ করেছিল। (ঋগবেদ- ১/৫৩/৭, ৪/২৬/৩)। সেজন্য ইন্দ্রের নাম হয়েছিল ‘পুরন্দর’। একমাত্র সিন্ধু সভ্যতার বাহকরাই নগরে বাস করত। আর্যরা বাস করত গ্রামে; কেননা, তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি ছিলো গ্রামীণ।৫ সোমরসে তুষ্ট ইন্দ্রের সাহায্যে আমরা দস্যুকে ধ্বংস করব এবং শত্রু হতে মুক্তি লাভ করে সম্যকরূপে অন্ন ভোগ করব। (ঋগবেদ- ১/৫৩/৪)। ৬ এখানে দস্যু ও শত্রু বলতে ভারতবর্ষের আদিবাসীদের বুঝানো হয়েছে।

হে ইন্দ্র! তুমি শত্রুবর্ষণকারীরূপে যুদ্ধ হতে যুদ্ধান্তরে গমন কর, বলদ্বারা নগরের পর নগর ধ্বংস কর। হে ইন্দ্র! তুমি নথী ঋষির সহায়ে দূরদেশে মনুচি নামক মায়াবীকে বধু করেছিলে। তুমি অতিথিগ¦ নামক রাজার জন্য করঞ্জ ও পর্ণর নামক শত্রুদ্বয়কে তেজস্বী বর্তনী দ্বারা বধ করেছে; তারপর তুমি অনুচর রহিত হয়ে ঋজিশ্বান নামক রাজার দ্বারা চারদিকে বেষ্টিত বঙ্গৃদ নামক শত্রুর শত নগর ভেদ করেছিলে। সহায় রহিত সুশ্রবা নামক রাজার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য যে বিংশ নরপতি ও ৬০,০৯৯ অনুচর এসেছিল, হে প্রসিদ্ধ ইন্দ্র! তুমি শত্রুদের অলঙ্ঘ্য রথচক্র দ্বারা তাদের পরাজিত করেছিলে। (ঋগবেদ- ১/৫৩/৭-৯)। ৭

Image result for সম্রাট অশোকের ছবি

আর্যরা মনে করে এ পৃথিবী তাদের। কারণ ‘আমি আর্যকে পৃথিবী দান করেছি (ঋগবেদ- ৪/২৬/২)। ৮ অন্য কারও এ ধরাতে বসবাসের অধিকার নেই। অতএব অন্য সকল অধিবাসীকে নির্মুল করতে হবে। অপর জাতি ও সম্প্রদায়ের শক্তি খর্ব করতে হবে, তাদের ধনসম্পদ আত্মসাৎ করতে হবে। এই হলো হিন্দু মনমানসিকতা।

হে মনুষ্যগণ! যিনি দ্যোতমান, যিনি জন্ম গ্রহণ মাত্রেই দেবগণের প্রধান—যুদ্ধকালে শত্রুগণকে বিনাশ করেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদ- ২/১২/১-৩)।৯ হে মনুষ্যগণ! যিনি এ সমস্ত নশ^র বিশ^ নির্মাণ করেছেন, যিনি দাসবর্ণকে নিকৃষ্ট এবং গুঢ়স্থানে অবস্থাপিত করেছেন, যিনি লক্ষ্য জয় করে ব্যাধের ন্যায় শত্রুর সমস্ত ধন গ্রহণ করেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদ- ২/১২/৪)।১০ হে মনুষ্যগণ! যিনি বজ্রদ্বারা বহুসংখ্যক মহাপাপী অপূজককে বিনাশ করেছেন, যিনি গর্বকারী মনুষ্যকে সিদ্ধি প্রদান করেন না, যিনি দস্যুগণের হন্তা, তিনিই ইন্দ্র। —যিনি বল প্রকাশকারী অহিনামক শয়ান দানবকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র।— যিনি বজ্রবাহু হয়ে স্বর্গারোহণ্যেদ্যত রৌহিণকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র (ঋগবেদ- ২/১২/১০-১২)।১১ এদেশের প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর পরাজয়ে ওরা ইন্দ্রের জয়গান করছে। মিথ্যার জয়গানই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কীর্তি।

Source :

১. ড. অতুল সুর: হিন্দু সভ্যতার বনিয়াদ, কলিকাতা ৯, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯১, পৃ ৩৬
২. উইকিপিডিয়া/ ঋগে¦দ-সংহিতা[ প্রথম খ-], পৃ ৪৩, ৩২৮
৩. ঋগবেদ- ১/৫/২-৩, ঋগে¦দ-সংহিতা [ প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পৃ ৬২
৪. ঋগবেদ- ১/৮/১-৬, ঋগে¦দ-সংহিতা [ প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পৃ ৬৪-৬৫
৫. ড. অতুল সুর: হিন্দু সভ্যতার বুনিয়াদ, পৃ ৩৭; = ঋগে¦দ-সংহিতা [প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০৪, পৃ ৬৩, ৬৬, ১১২, ৩৮২, ৪৭
৬. ঋগে¦দ-সংহিতা [ প্রথম খ-], হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলকাতা ৭, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০৪, পৃ ১১২
৭. ওই, পৃ ১১২
৮. ওই, পৃ ৩৮২
৯. ওই, পৃ ২৬৫
১১. ওই, পৃ ২৬৫
১১. ওই, পৃ ২৬৫

সংস্কৃতির দৈন্যতা ও আত্মবিস্মৃত জাতি

আমাদের আবাসস্থল শিক্ষিতজন , অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মিলনভূমি। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই আমাদের কায়কারবার। তাই বিভিন্ন শ্রেণি, আদর্শ এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক মানুষের সাথে গভীর রিশতা গড়ে ওঠে। নানা ব্যস্ততার মাঝেও পরস্পরে মেতে উঠি আড্ডায়। সে আড্ডায় উঠে আসে আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, জাতীয় রাজনীতি, প্রতিরক্ষা নীতি, জননিরাপত্তা, ভায়োলেন্স, সংস্কৃতি, গণমাধ্যমসহ নানা অনুষঙ্গ। কাজের একঘেয়েমী ভাব দূর করতে এসব আলোচনা একেবারে মন্দ নয়। বিনোদন, পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রতি তো আছেই। এমনি এক আড্ডাস্থলে বিনোদন সংস্কৃতি প্রসঙ্গ ওঠলে এক শিক্ষক হলিউড, বলিউডের হালহকিকত, বর্তমান ক্রেজ, বিখ্যাত চিত্র তারকাদের জীবন কাহিনির বিবরণ দিয়ে পান্ডিত্য জাহির করলেন। সাম্প্রতিককালের হিন্দি এবং ইংরেজি ফিল্ম-সংগীত অঙ্গনের সকল শিল্পী সম্পর্কেই তার রয়েছে কমবেশি ধারণা। আমি নিজে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাস এবং শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁকটা একটু বেশি। যদিও এসব বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। তাই তার কাছ থেকে কিছু জ্ঞান হাসিলের চেষ্টা করলাম। দেশজ সংস্কৃতি, ইসলামি সংস্কৃতি এবং আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি কী এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘নাচ গানই আমাদের সংস্কৃতি’। হলিউড বলিউডের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি কমবেশি জানেন, অথচ বাংলাদেশের মানবসংস্কৃতি সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অপ্রতুল। সর্বশেষে বললাম, ‘বিশ্বের খ্যাতিমান ফিল্ম স্টার, নায়ক নায়িকা, শিল্পী, খেলোয়াড়দের সম্পর্কে ভাল জানাশোনা আছে আপনার। এখন কয়েকজন নবি রসুল, সাহাবি এবং মুসলিম মনীষীদের সম্পর্কে ধারণা দেন’। তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হলেন। দুনিয়ার মানুষকে কারা সঠিক পথ দেখাল, কারা জ্ঞান বিজ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতি শিক্ষা দিল, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষ ও ইউরোপে কারা জ্ঞানের মশাল নিয়ে প্রবেশ করল- কিছুই তিনি বলতে পারলেন না। জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি কী হতে পারে, কী হওয়া উচিত তা তিনি আমাদের জানাতে পারলেন না। অথচ তার একটি সুন্দর আরবি নাম এবং ইসলামি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। আদমশুমারি হিসেবে তিনি মুসলিম!

এই সমস্যা শুধু একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নয়, জাতির শিক্ষিত জনগোষ্ঠির প্রধান অংশেরই একই অবস্থা। সচেতন নাগরিকদের এই অসচেতন চিন্তাভাবনা কর্মকান্ডের জন্যই জাতিরাষ্ট্রের বর্তমান দূরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জাতির কান্ডারিরাই দেশকে ধ্বংস তথা পরাশক্তির অনুগত স্টেটে পরিণত করছে। বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাঁদের মনমস্তিস্ক, লেখালেখি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্রাজ্যবাদ তথা ইহুদিবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও খ্রিস্টবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। দেশের সাধারণ নাগরিকরাও সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা দূতাবাসগুলোর নির্দেশিকা বাস্তবায়নে তৎপর। ক্ষমতাসীনরা প্রতিবেশী দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী। নিজেদের ইতিহাস, সত্যিকারের ইতিহাস ভুলে পরকীয়াকে ধারণ, হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নেয়ার ফলেই রাষ্ট্রের এই অবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিষ্ঠাতা, লেনিনের সহকর্মী, সোভিয়েত রাশিয়ার তদানীন্তন পলিটব্যুরোর সদস্য, বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক শ্রী মানবেন্দ্র নাথ রায় বলেছেন, ‘(ভারতবর্ষে) মুসলিম বিজয়ের দ্বারা সমাজদেহে যে আঘাত লাগলো তাতেই হলো কবীর, নানক, তুকারাম ও চৈতন্য প্রমুখ সমাজ-সংস্কারকের আবির্ভাব সম্ভব। আর অনেকটা তারই জন্য তারা ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বহু জনসমর্থিত একটা বিপ্লবও দাঁড় করিয়ে দিয়ে যান। রঙিন চশমা না চড়িয়ে এই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস পড়লে মুসলমান ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি হিন্দুদের উদ্ধত আচরণ উপহাস্য বলে মনে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই ইতিহাসকে অপ্রমাণিত করেছে আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেও ব্যহত করেছে। মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার অধিনায়ক হয়ে রইল। এমনকি আজও তার শ্রেষ্ঠ মনীষীরা অতীত ঋণের বোঝা স্বীকার করতে সঙ্কুচিত হন না। দুর্ভাগ্য আমাদের, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামের সংস্কৃতি সম্পদ থেকে ভারতবর্ষ উপকৃত হতে পারেনি, কেননা অনুরূপ সম্মানের অধিকারী হবার যোগ্যতা তার ছিলো না। এখনও এই অবিস্মরণীয় অধ্যায় থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে ভারতবাসীরা প্রভূত লাভবান হতে পারে। মানব সংস্কৃতিতে ইসলামের দান সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ আর উক্ত দানের ঐতিহাসিক মূল্যের যথার্থ অনুধাবন তাদের উদ্ধত আত্মপ্রসাদের প্রাসাদ থেকে বাইরে টেনে নিয়ে এসে হিন্দুদের চকিত বিস্ময়ে অভিভূত করে দেবে আর আমাদের এ যুগের মুসলমানদের সঙ্কীর্ণতা মুক্ত করে তারা যে ধর্মে বিশ্বাসী, তার মর্মবাণীর সঙ্গে তাদের মুখোমুখি পরিচয় করিয়ে দেবে’। (পৃ-৮৮, ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান, মল্লিক ব্রাদার্স, কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা, ১৯৯৪)

বাংলা পাক ভারতবর্ষে ইসলাম এসেছিল মানবতার মুক্তির মহাসনদ নিয়ে। মুসলমানরা এ উপমহাদেশে আগমনের পরই এখানকার শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি, পোশাক, আহার বিহার, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়। তুর্কিদের আসার আগে এদেশে তৈরি পোশাকের প্রচলন ছিলোনা। ধূতি, চাদর, শাড়িই ছিল নারীপুরুষের একমাত্র পোশাক। তাইতো দর্জির বিকল্প কোনো শব্দ বাংলা কিংবা সংস্কৃত ভাষায় লক্ষ্য করা যায় না। ভূবন বিজয়ী ‘মসলিন’ মুসলিম কারিগরদেই অবদান। আটশ’ বছর ধরে রাজকীয় যেসব খাবার উপকরণের লক্ষ্য করা যায় তা সবই মুসলমানদের সৃষ্টি। কোরমা, কাবাব, কোপ্তা, পোলাও, হালিম, মোগলাই পরোটা, শরবত, পনির, মাখন, ছানা, বিরিয়ানী, বাকরখানি ইত্যাদি মুসলমানদেরই সৃষ্টি। মুঘল আমলের অর্থনীতি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশই হত বাংলাদেশে। বখতিয়ার খিলজীর হাতে সেনদের পরাজয়ের সাথে সাথেই ‘সোনারবাংলা’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। স্বাধীন সুলতানী আমলে ইহা পূর্ণ বিকশিত হয়। সুবাদারী আমলেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর উন্নয়নের অগ্রযাত্রার দ্রুত অবনতি ঘটে। মুসলিম আমলে তদানীন্তন বিশ্বের বিনোদনের সব উপাদানই প্রচলিত ছিল। কবিতা, মেলা, সুর সংগীত. নৃত্য. যাত্রা কোনোটাই অপ্রচলিত ছিলো না। ইংরেজ আমলে সেই সোনালী যুগের সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। কলকাতাকেন্দ্রিক এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদদে। এরা সবাই ছিল বর্ণহিন্দু, যাদেরকে ইতিহাস ‘বাবুশ্রেণী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এই দুই শক্তি মিলে মুসলমানদের স্মৃতিচিহ্ন সব মুছে ফেলে। মুসলমানদের নামিয়ে দেয়া হয় তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। মুসলমানদের গণ্য করা হতো হিন্দু জমিদারদের লাইভ স্টক বা গৃহপালিত পশু হিসেবে। শুধু তখনই নয় আজও ভারতের অধিপতিরা বাংলাদেশীদের ‘মানুষ’ হিসেবে গণ্য করেননা। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সার্বিক কর্মকান্ড এ কথারই সাক্ষ্য দেয়।

শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে ভারত এদেশের ওপর একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে। এ প্রভাবের পিছনে ভারতীয়দের যত না বেশি অবদান, তারচেয়ে বেশি অবদান আমাদের ধর্মনিরপেক্ষবাদী বুদ্ধিজীবীদের। ওপারের খুঁত কুড়ো খেয়ে তারা বেঁচে আছেন তো? তাই ওপারের ওকালতী করতেই বেশি অভ্যস্ত। তারা বেদ, পুরাণ, রামায়ন ও মহাভারতের গুনগানে বেশি তৎপর। কিন্তু কুরআন হাদিসের জ্ঞানের প্রসারের বিরুদ্ধে তাদের একরোখা অবস্থান। তাদের জন্যই আমাদের পাঠ্যপুস্তক, টিভি চ্যানেল, পত্রপত্রিকায় মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতির চিহ্নমাত্র লক্ষ্য করা যায় না।

ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষার অধ্যাপক আলফ্রেড গিলম বলেছেন, ‘ইবনে সিনা, আল ফারাবী ও গায্যালীর রচনার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টান পাশ্চাত্য অ্যারিস্টটলের সঙ্গে পরিচিত হন’ (পাশ্চাত্য সভ্যতায় ইসলাম- টমাস আরনল্ড ও আলফ্রেড গিলম সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃ-২৬৪)। ম্যাক্স মেয়ারহফ বলেছেন, ‘ইবনে হায়সাম ও জনৈক কামাল উদ্দিনের গাণিতিক দক্ষতা ইউক্লিড ও টলেমীর দক্ষতাকে ম্লান করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের এই বিভাগে তাঁরা বাস্তব ও স্থায়ী অবদান রেখে গেছেন’ (প্রাগুক্ত- পৃ ৩৫২)। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। এখানকার পাঠ্যপুস্তকে ইবনে সিনা, গাযযালী, ফারাবী, রুশদ, খালদুন, আল বেরুনী, শেখ সাদী, কামাল উদ্দিনদের পরিচয় নেই। কিন্তু এ্যারিস্টটল, প্লেটো, আর্কিমিডিসদের অবস্থান রাজকীয় পর্যায়ে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য পশ্চিমা মনীষীদের দ্বার্থহীন ঘোষণা, আরব মনীষীরা এ্যারিস্টটল, প্লেটো তথা গ্রিক দর্শন উদ্ধার না করলে বর্তমান বিশ্ব তাদের সম্পর্কে কোনো ধারণা পেতনা। প্রকাশিত পুস্তকাবলি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় চেগুয়েভার, লেনিন, মাওসেতুঙ, এম এ গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনদের প্রতিষ্ঠিত করছে। অথচ সালাহউদ্দিন, তারিক, মুসা, মুহাম্মদ বিন কাসেম, বখতিয়ার, ঘুরী, আওরঙজেবদ, শামসুদ্দিন ইলিয়াশ শাহ, মহাবীর ঈশা খাঁ, শায়েস্তা খানদের মহান জীবন সম্পর্কে তরুণ সমাজ কিছুই জানেনা। তারা শুধু ভারতীয় সোপ অপেরা, ইন্ডিয়ান আইডল ও বলিউডের নর্তন কুর্দন সম্পর্কেই অবহিত। ভারতীয় সিরিয়াল না দেখলে আমাদের গৃহিণীদের চোখে ঘুম আসেনা, হিন্দী গান না শুনলে ছাত্র-ছাত্রীর স্মার্ট হতে পারেনা, মোবাইলের রিং টোনে হিন্দী গান না বাজলে প্রগতিবাদীতায় আঘাত লাগে। এর সমালোচনা করতে গেলে সম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গালি শুনতে হয়। এই কী আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাখ শহীদের রক্তে গড়া এই কী আমাদের সবুজের বাংলাদেশ। সিরাজ, মোহনলাল, মীর মদন, দৌলত আলী, মজনু শাহ, টিপু সুলতান, তিতুমীর, বাল্কী শাহ, আহমাদুল্লাহ, রজব আলীরা কী এজন্যই জীবন দিয়ে গেছেন। নবাব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী, আকরম খাঁ, নজরুল, আব্বাসউদ্দিন, শেরে বাংলার স্বপ্নের দেশ কী এই বাংলাদেশ।

সংগীত

নতুন লেখা সংগীত

মোশাররফ হোসেন

১.
এ জীবন বড় অসহায় প্রভু সুদিনের অপেক্ষায়
দাও ফিরিয়ে তুমি সেইদিন
যেদিন হবে সুখময় রঙিণ।

চারিদিকে হতাশা আর হাহাকার
যেনো মৃত্যু নগরী
মায়েরি কান্না বোনেরি অসহায়
বাঁজে কষ্টের বাসরী।
সুখের প্রদ্বীপ জ্বেলে শান্ত করে দাও
বিলাও রহম অনাবিল।

আর কত মুজাহিদ করেই যাবে জান কোরবান
আর কত গুম হবে দুঃখি মা’র প্রিয় সন্তান।

সংগ্রামী বাবার প্রিয় সেই ছেলেটা
আছে কেমন জানা নেই
অশ্রুসজল বোনের প্রিয়তম স্বামিটা
খুন হলো  বিচার নেই
সুদিনের স্বপ্ন করে নাও কবুল
ধ্বংস করো আজাজিল।

কথা ও সুর: মোশাররফ হোসেন

বহুমুখি প্রতিভার তোরণ আব্বাসউদ্দীন আহমদ

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদ মাহমুদ ইউসুফ

Mahmud Eusuf

বাংলা গানের ইতিহাসে এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের জন্মদাতা আব্বাসউদ্দীন আহমদ। বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি, তাহযিব, তমদ্দুনিক ইতিহাসে আব্বাসউদ্দীন এক অপরিহার্য নাম। যাঁর কণ্ঠনি:সৃত গানে একদা বাংলার মানুষ নেচে উঠেছিল, মুক্তির মূলমন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। জনগণ-রাজনীতিক এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল আযাদি হাসিলের লক্ষ্যে; সেই মহান মহানায়ক হলেন আব্বাসউদ্দীন। বাংলার ইতিহাসের রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক বোদ্ধাদের মধ্যে যাঁর প্রতি জনগণ সবচেয়ে বেশ আকর্ষিত হয়েছিলেন তিনি হলেন সবার প্রিয় সংগীত তারকা আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তিনি রাজা বাদশাহ ছিলেন না বটে, কিন্তু নামজাদা রাষ্ট্রনায়কদের চেয়েও ছিলেন খ্যাতিমান এবং খ্যাতির চেয়ারে তিনিই চেয়ারম্যান। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে গ্রহ-নক্ষত্রের মতোই সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারকায়িত অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি আব্বাসউদ্দীন।

সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় স্থানিক, কালিক ও মানুষিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন সবার ঊর্ধ্বে। বাংলার জানা ইতিহাসে জনসমর্থন, জনপ্রিয়তা, লোকপ্রিয়তায় তিনিই শীর্ষে । শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বলেছেন, ‘আমি যদি কাজি আর আব্বাসকে নিয়ে বাংলাদেশে বের হই তাহলে সারা বাংলা আমি জয় করতে পারি কদিনের ভেতরেই।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ৬৯)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে তাঁর ছিল নাড়ির সম্বন্ধ। … নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটি দিক অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গান গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।’ (শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ১১১) সকলের মুখে মুখে ছিলো শুধু তাঁর নাম, আর ছিলো তাঁর গান। তাঁর চিত্ত, অন্ত:করণ আর অন্তরিন্দ্রিয়ে ছিলো শুধুই গান আর গান। গানের গিরিঝর্ণায় তারঁ সমতুল্য তিনি নিজেই।

উদাস হাওয়ার মতোই ভাওয়াইয়ার সুরের গতি

তখন আজকের মতো প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটেনি। দূরদর্শন, ইউটিউব, ইন্টারনেট ছিলো গরহাজির। গ্রামোফোন রেকর্ড, মঞ্চ বা উন্মুক্ত মাঠই ছিলো গান পরিবেশনের একমাত্র মাধ্যম। আব্বাসউদ্দীন প্রায় পাঁচ হাজার সভায় যোগদান করে সংগীত পরিবেশন করেন। মিটিং-মাহফিলে লাখ লাখ লোক হাজির হতো শুধুই তার গান শোনার জন্যে। স্কুল-কলেজের চ্যারিটি শো, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠান, সরস্বতীপূজার জলসা, মিলাদ মাহফিল, পুরস্কার বিতরণী সভা, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সমাবেশ এরকম হাজারো রকমের জনসমাগমে প্রধান আকর্ষণ থাকত আব্বাসউদ্দীন। বিশেষত: গ্রামোফোন রেকর্ডের কল্যাণে দেশের আনাচে কানাচে তাঁর সুনাম পৌঁছে যায়। অজস্র মানুষের কোলাহল, হৈ চৈ, কলরব, হট্টগোল, উচ্চবাচ্য, চিৎকার, চেঁচামেচি নিমিষেই উবে যেত তাঁর সুরের যাদুতে। তাঁর গানের সুরলহরীতে নীরব, নির্বাক, মৌনী হয়ে যেত জনতা। কলকোলাহলময় জনতাকে মুহূর্তে নিঝুমদ্বীপের বাসিন্দায় রূপান্তরিত করতে পারতেন তাঁর কণ্ঠসুধা দিয়ে। তাঁর গলার আওয়াজ থেকে দর্শক শ্রোতারা খুঁজে পেয়েছিল জীবনের দিশা, দেশাত্ববোধ, আত্মসচেতনা, বাঁচার অধিকার। তাদের অবচেতন মনে জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, প্রেরণা, নির্দেশনা জাগিয়ে দেন আব্বাসউদ্দীন। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে অসংখ্য সভায় পাকিস্তানের আযাদি আন্দোলনের সমর্থনে গান গেয়েছেন আব্বাসউদ্দীন। আযাদি উত্তরকালেও হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে অগণতি সভায় গান পরিবেশন করেছেন তিনি। গেয়েছেন সাহিত্য সভায় গান। এইভাবে সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রবেশ করেছেন আব্বাসউদ্দীন। তাইতো সমকালীন সমাজ তাঁকে লুফে নিয়েছিল অপরিমেয় কলহাস্যে।

আব্বাসউদ্দীন মুলত সংগীত শিল্পী হলেও তিনি এক অসাধারণ সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন। ইহা তাঁর আত্মজৈবনিক কাহিনি। ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ নামে এই জীবনালেখ্য প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে। কিতাবটিতে যথাক্রমে আমার গানের প্রেরণা, কলেজ জীবন, শিল্পীর আসনে, নব জাগরণে বাংলার মুসলমান, উত্তরকাল, বিদেশ ভ্রমণ, জীবন সায়াহ্নের স্মৃতি, আমার রেকর্ডের গানের তালিকা শীর্ষক মোট আটটি অধ্যায় রয়েছে। বইটি সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, ‘আব্বাসউদ্দীন সাহেবের আত্মজীবনী আমাদের নবগঠিত জাতির উত্থান-পর্যায়ের সনদ।’ কোলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার ১১ ডিসেম্বর ১৯৬০ তারিখে লিখে, ‘আত্মজীবনী পাঠের একটি বিশেষ আনন্দ আছে। বিশেষত: সে-জীবন যদি কোনও শিল্পীর হয়। এ যেন সেই প্রদীপ জলবার পিছনের সলতে পাকানোর ইতিহাস। কুড়ি থেকে ফুল হয়ে ওঠার কাহিনী … আলোচ্য গ্রন্থটি সেদিক থেকে অত্যন্তই আকর্ষণ সন্দেহ নেই।
প্রখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দীনের নামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ শোভা ও শ্রীর এক অনুপম অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে … সংগ্রামমুখর তাঁর আশ্চর্য জীবন কথা যেমন জন্দীপ্ত করে, তেমনি ব্যক্তি জীবনের অনেক টুকরো মনোরম ঘটনা- যা গল্পের চেয়েও সুন্দর- তাঁর শিল্পী সত্তাকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করে। আব্বাসউদ্দীনের সরল অনাড়ম্বর ভাষার একটি দুর্বার আকর্ষণ পাঠকমাত্রেই অনুভব করবেন।’ (সূত্র: আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৫৯-১৬০)

Image result for মাহমুদ ইউসুফ আব্বাসউদ্দীন আহমদ

মহুয়া সুন্দরী আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড করা একটি নাটক। নাটকটি রচনা করেন আবদুল করিম, অভিনয়ে আব্বাসউদ্দীন আহমদ অ্যান্ড পার্টি। হিজ মাস্টার্স ভয়েস ইহা রেকর্ড করে। চট্টগ্রামের অতি পুরাতন একটি সত্য ঘটনাকে এই নাটিকায় রূপ দিয়ে রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলার অধিকাংশ স্থানে আজো এই মহুয়ার কাহিনি লোকের মুখে মুখে। ছেলে-মেয়ে-মুরব্বিরা রূপকথার মত আজো এই মহুয়াকে নিয়ে গল্প করে। আজো তাদের অন্তরে মহুয়া করুণ সুরজাল টেনে এনে হাসি-কান্না-ব্যথায় তাদের বুকখানি ভরে দিয়ে যায়। তাঁর রচিত কয়েকটি গান হলো: কোথা গেল হৃদয়ের প্রেম/কোথায় লুকানো আজি আঁখির মদিরা, সকল স্বপ্ন সফল করিয়া/কুটিল যেদিন ফল, কী যে মন চেয়েছিল একদিন/চাহিয়া কী যেন, মন পায়নি। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ৪৬-৫৩) জীবনের কোনো এক সময়ে গল্প ও কবিতাও লিখতেন। কিন্তু সংগীতকেই জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ করায় ওদিকে আর অগ্রসর হননি।

আব্বাসউদ্দীন ছিলেন সুরজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ, সুরশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, গণশিল্পী, সুরের দুলাল, সুরের যাদুকর, সুরের রাজা, গানের রাজা। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল (মহরহুমের জ্যেষ্ঠপুত্র) লিখেছেন, ‘তিনি যখন গান গাইতেন- কি বাসায়, কি বাইরে- মনে হত তাঁর শরীরটাকে মর্তে রেখে তিনি তাঁর কণ্ঠকে তুলে দিয়েছেন মহাকালের হাতে। গানের এই বিমূর্ত প্রকাশ ঘটে থাকে কিছুটা বিধিদত্ত প্রতিভা, কিছুটা সাধনা এবং অনেকটা আরাধনার ভেতর দিয়ে। তাঁর গানে বিশেষ করে ইসলামী গানে মরমী হৃদয়ের যে নিবেদিতচিত্ততা লক্ষ্য করি তা কোন আকস্মিক কণ্ঠগত কৌশল নয়। জন্মগত প্রতিভার সাথে ব্যাপক চর্চার মিশ্রণ ঘটিয়ে এসব গানে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির প্রয়াস নেই। এ-গানগুলো যাঁরা শুনেছেন তাঁদের হৃদয়ের গভীর অর্ন্তলোকে স্পন্দন এসেছে। তার কারণ, ভক্ত হৃদয়ের আকুতি ও উচ্ছ্বাস এইসব গানে ধরা পড়ে আছে।’ (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ৬৬-৬৭) আব্বাসউদ্দীনের সংগীত সাধনার বৈশিষ্ট্য ও তার কণ্ঠে গীত অজস্র গানের বিষয় ও পরিমাণ সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ নির্ভরযোগ্য কিতাব হচ্ছে মোস্তাফা কামাল ও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সংকলিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ ‘আব্বাসউদ্দনের গান।’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত কিতাবটিতে আব্বাসউদ্দীন গীত ২০৪টি গান স্থান পেয়েছে। তবে বাস্তবে গানের সংখ্যা বহু। বইটিতে তাঁর গানের বর্ণবৈভব ও ভাবৈশ্বর্যের ছটা আমরা দেখতে পাই। সঙ্কলিত গানগুলো ইসলামি, ভাওয়াইয়া, লোকসংগীত ও পল্লীগীতি এবং কাব্যগীতি- এ চারটি শ্রেণিতে বিন্যাস্ত। তন্মধ্যে ইসলামি গান ৮৪টি, ভাওয়াইয়া ৩১টি, লোকগান ৫৮টি ও কাব্যগীতি ৩১টি। (আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, পৃ ১১৪-১১৫)

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদের ফটো

তাঁর কণ্ঠে ঝঙ্কৃত ইসলামি ও কওমি গানগুলো জাতির চেতনাহীন মনে নব চেতনার উন্মেষ জাগায়। তাঁর কণ্ঠ:নিসৃত দীনি গানের মধ্যে রয়েছে: ও মন রমযানের ঐ রোজার, আল্লাহ আমার প্রভু, মোদের নাবি কমলিওয়ালা, যাবার বেলা ছালাম লহ, ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ, মোহাম্মদ নয়ন-মনি, ইয়া নবী সালাম আলায়কা, ওরে ও দরিয়ার মাাঝি, খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে, হে নামাজী আমার ঘরে, গুন গরিমায় আমাদের নারী, নৈরাশা হয়ো না, ফোরাতের পানিতে নেমে, খাতুনে জিন্নাত ফাতেমা জননী, ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর, সেই রবিয়ল আউয়ালেরি, ত্রান কর মওলা মদিনার, মোহররমের চাঁদ এল ঐ, ভেসে যায় হৃদয় আমার, খয়বর জয়ী আলী হাইদার, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, ওয়াজ মাহফিল, চলবে কাবার জেয়ারতে, নাই হল মা বসন-ভূষণ, মোহাম্মদের নাম জপেছিলি, আল্লাহতে যার পূর্ণ ইমান, আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি, তুমি কোথায়, আমার যখন পথ ফুরাবে, জাগ মুসাফির রাত পোহাল, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের, তৌহিদেরি বান ডেকেছে, খোদা এই গরিবের শোনো, রোজ হাশরে আল্লা আমার, ঈদ মোবারক, নামাজের এই পাঁচ পিয়ালা, কারো মনে তুমি দিওনা আঘাত, দুঃখের দিনের দরদি মোর, দিকে দিকে পুন:জ্বলিয়া উঠিছে দীন ইসলামি লাল মশাল প্রভৃতি।


হারিয়ে যাওয়া পল্লীর কথা, পল্লীর গাঁথা, পল্লীর সুর, পল্লীর গান, পল্লীর কিংবদন্তী কাহিনিকাব্য গানে গানে তুলে ধরেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। তাঁর গাওয়া লোকগানসমূহের মধ্যে রয়েছে নদীর নাম সই অঞ্জনা, ও কি গাড়ীয়াল ভাই, তোরষা নদীর ধারে ধারে, ঐ যে ভরা নদীর বাঁকে, আমার গহীন গাঙের নাইয়া, ঠগ্ মিনসে মুখপোড়া, কী মোর জঞ্জাল হইল রে, আগে জানলে তোর ভাঙা, তোরা কে কে যাবি লো জল, আমার হাড় কালা করলাম রে, আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি, আজি নদী না যাইও যে, পতিধন প্রাণ বাঁচে না, আমায় ভাসাইলি রে, মনই যদি নিবিরে বন্ধু, থাকতে পারঘাটাতে তুমি, প্রেম জানে না রসিক, তুমি মোরে নিদয়ার কালিমা, আগা নাওয়ে ডুবুডুব, সোনা বন্ধুরে কোন দোষেতে, ও কন্যা হস্তে কদমের ফুল, নদীর কূল নাই কিনার নাই, বন্ধু আজো মনে রে পড়ে, যামো যামো যামো কন্যা হে, ও মোর চান্দরে মোর সোনা, আল্লা মেঘ দে পানি দে, নাও ছাড়িয়া দে, দিনার দিন দিন ফুরাইল, হাত ধরিয়া কঁও যে কথা, আরে ও ভাটিয়াল গাঙের, আগো না দাড়ীটা মরিয়া, নাও ছাড়িয়া দে, বাজান চল যাই চল, পরের অধীন কইর‌্যাছে আমায়, হারে আমার আকুল প্রাণের আশা, আমার কার জন্য প্রাণ এমন করে, ও সুখের ময়না রে, ও শহরবানু কান্দে, তোমার লাগিয়া রে কালা, ওই না মাধবী বনেতে বন্ধু ছিল, ঐ না রূপে নয়ন দিয়ে, গুরুর পদে প্রেমভক্তি, দাওয়ায় করছে মেঘ মেঘালি, ওরে ও পরানের মাঝি, শোন নলিতে ও বিশাখে, কি ওরে বাবার দেশের ওড়ে কুড়ুয়া, মুখ কোনা তোর জিবা ডিবোও, কোন বনে ডাকিলু কোকিল, ছাড়বে মন ভবের খেলা, আমায় দাগের মত দাগ, সে যেন কি করল রে আমায়, বাওকুমটা বাতাস যেমন, ও ভাই মোর গাঁওয়ালিয়া রে, গাও তোলো গাও তোলো কন্যাহে, কাগাতুয়া বলোং মুই ঠোঁটকরি প্রভৃতি।
পালাগান: রূপধন কন্যা, মরুচমতি কন্যা, হলদি-শানাই, দেশের গান: সকল দেশের চেয়ে পিয়ারা, উড়াও উড়াও আজি, আল্লা আল্লা বলরে ভাই প্রভৃতি। উর্দু গান: য়্যায় চাদে স্যবা গুজরেযো, ইয়া মোহাম্মাদ আপসা মহবুবে, যবসে দেখি হ্যায় কালামউল্লাহ, আল্লাহ ভি হ্যায় খুদ শেকত্যয়ে, মোহাম্মদকে কদমো পর কোরবান প্রভৃতি। স্বদেশি গান: ভারতের দুই নয়ন তারা, নম নম নম বাংলা দেশ মন। আধুনিক গান: বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধূর, ফিরে চাও বারেক ফিরে চাও, আর কিগো ফিরে আসিবে না, বরষ বরষ দিবস যামিনী, সাধ জাগে মনে পরজীবনে, বসিয়া নদীকূলে এলোচুলে।

Related image
বিবিধ: বিরহের গুলবাগ মোর ভুল করে, অনেক ছিলো বলার, আসিছেন হাবিবে খোদা, আজি কোথায় তখতে তাউস, দিকে দিকে পুনঃজ¦লিয়া উঠিছে, এই সুন্দর ফল সুন্দর ফুল, জরীন হরফে লেখা রূপালী হরফে, জাগে না সে জোশ লয়ে, তওফিক দাও খোদা ইসলামে, লীগ বিজয় না দিগ্বিজয়, মসজিদে ঐ শোন্রে আজান, হে নামাজি আমার ঘরে, উত্তল হল শান্ত আকাশ, আসিবে জানি তুমি প্রিয়, হারে পাগল দিলে মুষে, মিলন-পাত্র পূর্ণ করিয়া, ফুল পুছিনু বল কোথা পেলি, কোন বিরহীর নয়ন জলে, স্মরণ পারের ওগো প্রিয়, তোমার মাঝেই আপন হারা, উঠরে চাষি জগতবাসী ধর কষে লাঙ্গল, বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা শির উঁচু কর মুসলমান, আজি ক্যানে কাঁন্দেন তোমরা চন্দন বৃক্ষের ডালে, কুল মখলুকে আঝ ধ্বনি উঠে, কে এল ঐ- কালেমা শাহাদাতের বাণী, প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কে, আজ শরতের রূপ দিপালী, হিন্দু আর মুসলমান মোরা দুই সহোদর ভাই, ওরে ভাই আমরা ছিলাম পরম সুখী, আজ জাগরে কৃষাণ সবতো গেছে, ঘোর-ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর, স্নিগ্ধ শ্যামবাণী বর্ণা প্রভৃতিসব কালজয়ী গান। (সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃ ৬৫-৭৫)

এই বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ তারিখে তিনি তাঁর জীবনেতিবৃত্তে লিখেন,

দুদিন পর আমি যখন এ-ধরার আনন্দ কোলাহল থেকে চিরদিনের মতো চলে যাব তখন তো দুনিয়াই আমাকে ভুলে যাবে। চিরকাল জেগে আছে এবং থাকবে শুধু আকাশের ঐ চন্দ্রসূর্য অগণিত তারকা সজাগ প্রহরীর মত। চলমান হয়ে থাকবে আলো-বাতাস, দখিনা হাওয়া, পাখীর কলতান, কুলুকুলুনাদিনী স্রোতস্বতী- আমার, এর, তার বাগানের হাসনাহেনা, যুঁই, চামেলী। এরা ফুটবে-ঝরবে-আর ফুটবে। আমি ফুটেছিলাম- দিন কয়েক হেসেছিলাম- এবার ঝরার পথে- ঝরব। কিন্তু আর ফুটব না।’ (আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, পৃ ১৪০-১৪১)

আব্বাসউদ্দীনকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল
আব্বাসউদ্দীন তখন কলকাতা ডিপিআই অফিসে চাকরিরত। একদিন এক অফিস কলিগ তাঁকে ধরলেন গান গাইতে যেতে হবে তাদের গ্রামে। নতুন চাকরি, বন্ধুটিও নতুন, আব্বাসউদ্দীন আর না করতে পারলেন না। খঞ্জনপুর গ্রামে জমিদারের একটি খাসমহল আছে। একদিন এই জমিদার অফিসের কয়েকজন মুসলিম কর্মচারী এসে আব্বাসউদ্দীনকে একরকম জোর করেই নিয়ে গেলেন। সাথে অফিসের সেই বন্ধুটি।

সন্ধ্যার দিকে আব্বাসউদ্দীন সেখানে পৌঁছে দেখলেন মহাবিপদ। যাত্রাগানের আসরের মতো চারদিকে লোক বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝখানে গায়কের আসন। আব্বাসউদ্দীন জমিদারের ম্যানেজারের খোঁজ করলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আসলেন বাবুসাব। কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, আপনি আব্বাসউদ্দীন সাহেব তো? কোলকাতা থেকে এসছেন? তা গান আরম্ভ করুন গিয়ে!
– কিভাবে গান গাইব? এতো লোক হাজির হবে জেনেও মাইকের ব্যবস্থা করেন নি কেন?
– প্রতিবার এখানে যাত্রা গান হয়। এতো লোক তো কখনো হয় না। আপনি আসবেন বলে হয়তো বা ছোটলোক প্রজা মুসলমানরা এসেছে গান শুনতে, আপনাকে দেখতে।

‘ছোট লোক প্রজা মুসলমান’ কথাটা মনে বেশ লাগলো। ম্যানেজার বাবুর সাথে কথা না বাড়িয়ে তিনি সোজা স্টেজে উঠলেন। ১০-১২ হাজার জনতা একেবারে শান্তরূপ ধারণ করল। পিনপতন নীরবতা। কাজী নজরুল ইসলামের গান দিয়েই আব্বাসউদ্দীন শুরু করলেন, ‘ও ভাই হিন্দু মুসলমান, ভুল পথে চলি দোঁহারে দুজন কোরো নাকো অপমান।’ গানের মধ্যেই কতিপয় যুবক হট্টগোল শুরু করলো। ওরা ম্যানেজার বাবুর নিয়োগকৃত হিন্দু সন্ত্রাসী!

খাসমহলে বরাবর যাত্রা, কীর্তন ও বাইজি নৃত্যের আসর জমে। এখানকার অধিবাসীরা বেশিরভাগ মুসলমান। হিন্দুধর্মীয় এসব অনুষ্ঠানে মুসলিমরা অংশগ্রহণ করে না। তাই তারা আব্বাসউদ্দীনের গান শোনার দাবি জানায়। হিন্দু জমিদারের ম্যানেজার সাহেব এতে নাখোশ হয়ে আব্বাসউদ্দীনকে হত্যার চক্রান্ত করে। আব্বাসউদ্দীনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার এ খুনের কুটকৌশল সম্পর্কে জানতে পারে স্থানীয় কিছু মুসলিম তরুণ। তারা পরিকল্পিতভাবে আব্বাসউদ্দীনকে ম থেকে বাইরে এনে কাঁধে করে রাতের আঁধারে দ্রুত ট্রেন স্টেশনে নিয়ে যান। কলকাতাগামী রেলে তিনি বাসায় ফিরেন গভীর রাতে। (জহুরুল আলম সিদ্দিকী: ছোটদের সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন, পৃ ৫১-৫৩) এছাড়া ১৯৪৬ সনের কলকাতা দাঙ্গার সময় তাঁকে খুন করার চক্রান্ত করে বর্ণহিন্দু সন্ত্রাসীরা।  কী জঘন্য কর্ম! একজন নামিদামি বিশ্ববরেণ্য সংগীতশিল্পীকে হত্যার ষড়যন্ত্র! এটাই আব্বাসউদ্দীনের মহাজীবনের ট্রাজেডি, একটি বিয়োগান্তক অধ্যায়।

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদের ফটো

উপেক্ষিত আব্বাসউদ্দীন আহমদ
আব্বাসউদ্দীন একসময় জাতীয় জীবনে ঝড় তুলেছিলেন। গানের বিচিত্র ভাবপ্রবাহের তুফান প্লাবনে গণজাগরণ পয়দা হয়েছিল উপমহাদেশে। দেশকে, দেশের মানুষকে জাগিয়েছেন, আযাদি আন্দোলনের সৈনিক গড়েছেন। কিন্তু ইদানিংকালে স্থানীয় ও জাতীয় ক্ষেত্রে চরমভাবে উপেক্ষিত আব্বাসউদ্দীন। জন্ম-মৃত্যু তারিখ নীরবে আসে নিভৃতে চলে যায়। বেতার-টেলিভিশন-খবরের কাগজ চেপে যায় এই বহুমুখি প্রতিভার তোরণকে। অবহেলা, অনাদর, অবজ্ঞাই যেন নিয়তি! পাঠ্যপুস্তকে নেই, সভা-সেমিনারে নেই, আলোচনা-পর্যালোচনায় নেই। একসময় প্রাথমিক পাঠ্যসূচিতে আব্বাসউদ্দীন ও আবদুল আলিমের জীবনী অন্তর্ভুক্ত ছিলো। শিশু বয়সেই শিক্ষার্থীদের মনে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করত সেই সিলেবাস। অথচ সাম্প্রতিককালে পাঠ্যপুস্তক থেকে তাদের জীবনী তুলে নেয়া হয়েছে। এতে বিশেষ কারও স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশ ও দশের জন্য অমঙ্গলজনক।

Image result for আব্বাসউদ্দীন আহমদের ফটো

দেশের বিভিন্ন নগর, শহর, বন্দর, গ্রামে অপরিচিত, অজানা, অচেনা, অখ্যাত, কুখ্যাত লোকের নামেও রয়েছে নানাবিধ স্থাপনা। অথচ ইতিহাসের মহান শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের নামে নেই কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম। সড়ক, এভিনিউ, সংগীত একাডেমি, স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের নামকরণ তাঁর নামে হতে পারত। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে চরম উদাসীন। এই অবিমৃষ্যকারিতা, অকৃতজ্ঞতা, অনুদারতা, বিবেচনাহীনতার অবসান হোক।

হদিস :
১। সেলিনা বাহার জামান: আব্বাসউদ্দীন আহমদ, বাংলা একাডেমি ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮
২। আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, হাসি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ৩৪ নর্থব্রুক হল রোড, ঢাকা-১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২
৩। শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, রেড ক্রিসেন্ট হাউস, মতিঝিল ঢাকা ১০০০, প্রথম সুলভ সংস্করণ সেপ্টেম্বর ২০১৪
৪। এম রুহুল আমিন: ছোটদের আব্বাসউদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ২০০০
৫। অতীত দিনের স্মৃতি; আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচনাবলী দ্বিতীয় খ-, মোহাম্মদ মাহ্ফুজ উল্লাহ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী ঢাকা ১০০০, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯৪
৬।। জহুরুল আলম সিদ্দিকী: ছোটদের সংগীতশিশল্পী আব্বাসউদ্দীন, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি, মতিঝিল ঢাকা-১০০০, প্রথম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০১

৭। আল মাহমুদ সম্পাদিত আব্বাসউদ্দীন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, সেগুনবাগিচা ঢাকা ২, প্রকাশ: জুন ১৯৭৯

৮। ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

 

সংস্কৃতি আন্দোলনের অগ্রনায়ক ড. আসকার ইবনে শাইখ

মাহমুদ ইউসুফ


(জন্ম ৩০ মার্চ ১৯২৫, ইন্তেকাল ১৮ মে ২০০৯)

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ড. আসকার ইবনে শাইখ বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের মহীরুহ। পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের নাটক ও নাট্য আন্দোলনের জনক আসকার ইবনে শাইখ ছিলেন একাধারে ভাষা সৈনিক, সংগঠক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রবন্ধকার এবং অনুবাদক। নাটকের প্রয়োজনে তিনি অনেক গানও রচনা করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক। তাঁর প্রকৃত নাম এম. ওবায়দুল্লাহ, আর সাহিত্যিক নাম আসকার ইবনে শাইখ। তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রতই ছিলো বাংলার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করা। ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুনের পুনর্জাগরণ ও সংরক্ষণেই তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয়। ইসলামের রূপ-সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যকর্মে। ইসলামের সোনালী অতীত পুনরুদ্ধার এবং বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বিনির্মাণে তাঁর নাট্যকর্ম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে প্রথম স্বার্থক মুসলিম নাট্যকার ড. আসকার ইবনে শাইখ। অর্ধশতাব্দিকাল ধরে তিনি নাটকের সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। নাট্যগুরু, নাট্যকর্ম, নাট্যব্যক্তিত্ব আসকার ইবনে শাইখ নাটক রচনার পাশাপাশি অভিনয়-নির্দেশনাও সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন মঞ্চ-রেডিও-টেলিভিশনের একজন খ্যাতিমান অভিনেতা-নির্দেশক। জীবিতকালে তিনি রেডিও-টেলিভিশনের জন্য নিয়মিত নাটক লিখতেন। এই জনপদের পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র নিয়ে তাঁর পূর্বে কোনো নাট্যকার নাটক লিখতে এগিয়ে আসেননি। মুসলিম সমাজ জীবন বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যায়। তোফা হোসেন লিখেছেন, ‘এদেশের মানুষের মন ও মানস, তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও চেতনা, তাদের জীবন-সংগ্রাম ও আশা-বাসনার প্রতিফলন তাঁর নাট্যকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি অনলস নাট্যকর্মী। বাংলা নাটকের উন্নয়নে তাঁর অবদান অসামান্য। চারদিকে আজ নাট্য প্রয়াসের যে শুভ কর্মচাঞ্চল্য বিদ্যমান, তার সূচনাকারীদের প্রধান পুরুষ শাইখ। পঞ্চাশ দশকের আরম্ভ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাইরে এবং ৭০ সাল থেকে ৮০ সাল সাল পর্যন্ত স্বগৃহে ‘নাট্য একাডেমী’ স্থাপন করে তিনি বহু উৎসাহীকে হাতে-কলমে নাট্য বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন।’ ১

পরাধীন আমলে ব্রিটিশ ও প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের ইসলাম বিদ্বেষের কারণে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিলো খুবই শোচনীয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাতারে ছিলো সামগ্রিক মুসলিম সম্প্রদায়। আসকারের ভাষায়, ‘নতুন দিনে গড়ে ওঠা নগরে-বন্দরে, অফিস-আদালতে নব্য শিক্ষিত হিন্দু ভাগ্যবানেরা, আর বনে-জঙ্গলে, মাঠে-ময়দানে বেশির ভাগ মুসলিম ভাগ্যহতরা।’ ২ সেই দুর্যোগের দিনে মুসলমানরা শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। তারপরও বেশ কয়েকজন মুসলিম সাহিত্যিক নাটক রচনায় এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন, শাহাদাৎ হোসেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, আবুল ফজল, আকবর উদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, মোহাম্মদ আবদুর রহমান, মোঃ ইসহাক রেজা চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। সাতচল্লিশের পট পরিবর্তনের পর বাংলা নাট্যমঞ্চে ধূমকেতুর মতো আগমন ঘটে আসকার ইবনে শাইখের। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে বাংলা নাটকে একচেটিয়া আধিপত্য ছিলো হিন্দুদের। আসকার সেই আধিপত্যকে ধূলোয় মিশিয়ে বাংলা নাটকে মুসলমানের রাজত্ব কায়েম করেন। বিশিষ্ট টিভি ও নাট্য অভিনেতা মরহুম ওবায়দুল হক সরকার লিখেছেন, ‘এতকাল নাট্যমঞ্চ ছিলো হিন্দুদের দখলে। মঞ্চে প্রবেশ করতে হলে হিন্দু সেজে প্রবেশ করতে হতো। আসকার ইবনে শাইখই প্রথম সুযোগ করে দিলেন মুসলমান হয়ে নাট্যমঞ্চে প্রবেশ করার। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কোনো ঠাঁই ছিলো না সেদিনের দেশিয় নাটকে- মুসলমান ছিলো অপাঙক্তেয়। আসকার ইবনে শাইখ, নূরুল মোমেন প্রমুখ প্রথম মুসলমান চরিত্রকে বরণ করে নিলেন মঞ্চে।’ ৩

১৯৪৭ সালে ‘বিরোধ’ নাটক প্রকাশের মধ্য দিয়ে শাইখের নাট্যজীবনের আরম্ভ। ওই সময়ে ‘বিরোধ’ রচনা, প্রকাশনা ও মঞ্চায়ন বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে অবশ্যই ছিলো এক অপূর্ব ঘটনা। ১৯৪৯ সালে ফজলুল হক মুসলিম হলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাট্যাভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উক্ত অনুষ্ঠানে মঞ্চায়নের জন্য ‘বিরোধ’ নাটক নির্বাচন করেন। যথাসময়ে ‘বিরোধ’ মঞ্চস্থ হয়। এ বিষয়ে আসকার ইবনে শাইখ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন,

‘বিরোধ মঞ্চায়ন প্রসঙ্গে কিছু স্মৃতি আজও আমাকে নাড়া দিয়ে যায়। এর পরিচালনার ভার ন্যাস্ত হয়েছিলো পরলোকগত দুই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সর্বজনাব মুহম্মদ আবদুল হাই (বাংলা বিভাগ) ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার (ইংরেজি বিভাগ) উপর। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই সাহেব একাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। কার্জন হলে স্টেজ বেঁধে মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘বিরোধ’। নাট্যারম্ভে হলের প্রভোস্ট ডক্টর আবদুল হালিম মঞ্চে এসে হাতজোড় করে (আক্ষরিক অর্থেই) দর্শকবৃন্দের কাছে অনুরোধ জানালেন: এই প্রথম মুসলমান সমাজের উপর একজন মুসলমান নাট্যকারের পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে। তাতে দর্শকদের চোখ-কানের অভ্যাসে হয়তো বিসদৃশ নাড়া লাগবে। তারা যেন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি নিয়ে নাট্যাভিনয়ের পুরোটাই দেখে যান। অর্থাৎ বিরক্ত হয়ে চলে না যান।’ ৪

ড. আসকার ইবনে শাইখ নিজস্ব মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা নিয়োগের মধ্য দিয়ে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী ধারাটিকে করেছেন সমৃদ্ধ ও বেগবান। তাঁর দ্বিতীয় নাটক ‘পদক্ষেপ’ রচিত হয় ১৯৪৭ সালে এবং প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। সামাজিক দোষত্র“টি, উদ্ধত বংশগৌরব, সমাজের অন্যায়, শাসন ও শোষন এ নাটকের বিষয়বস্তু। সমাজের কুসংস্কার দূর করে প্রেম, ভালোবাসা ও ন্যায়ের সমাজ স্থাপন করবার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় এ নাটকে। ৫ পদ্মার পাড়ের জনপদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে তিনি রচনা করেন বিদ্রোহী পদ্মা। এটি ১৯৫২ সালে রচিত ও ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে এটি চলচ্চিত্রে রূপদান করেন প্রখ্যাত পরিচালক বাদল খন্দকার। হিন্দু জেলেদের সমাজজীবন নিয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে রচনা করেন বিল বাওড়ের ঢেউ। ১৯৫৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়।

মেঘলা রাতের তারা ড. আসকার ইবনে শাইখের একটি অসাধারণ নাট্যকর্ম। ১৯৮১ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়। এটি মূলত: দেশাত্মবোধক টেলিনাট্য সিরিজ। পলাশীর আম্রকাননে পরাধীনতার বীজ বপন, ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বদেশপ্রেম, ব্রিটিশ ফিরিঙিদের অত্যাচার, শোষন, নির্যাতন আলোচ্য নাটকগুলোর বিষয়বস্তু। ড. শাইখ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমাদের ঐতিহ্য আছে, গৌরবদীপ্ত পরিচয় আছে। আমাদের অতীত স্বদেশপ্রেমের অতীত, একদিন যারা ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের নিয়ে আমাদের স্মরণীয় অতীত নয়; ঐতিহ্য তো নয়ই। আমাদের ঐতিহ্য দৌলত আলী, মজনু শাহ্, রানী ভবানী, নূরুদ্দীন, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক, দয়ারাম শীল, দুনিরাম পাল, সোবাহান শাহ্, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া এবং এমনি আরও অনেকে। আমাদের অতীত ফকির সন্নাসীরা, বিদেশী শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে উচ্চকিত ও সক্রিয় ছিল যাঁদের প্রতিরোধ সংগ্রাম। দুর্যোগভরা মেঘলা রাতে এঁরাই জ্বালিয়ে রেখেছিলেন স্বদেশপ্রেমের অম্লান শিখা। ভোগ করেছেন তাঁরা লাঞ্ছনা আর অত্যাচর, ত্যাগ করেছেন জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। তাঁদের নিয়ে ঘটেছে অনেক কিছু ঘটনা। সেই সব ঘটনাকে সেই সব মানুষকে আমাদের চিনতে হবে, জানতে হবে নিজেদেরই প্রয়োজনে। মুলত জাতীয় পরিচয়কে চিহ্নিত করার জন্যই আমার এ প্রয়াস।’ ৬

আলোচ্য গ্রন্থটি ১১টি টিভি নাটকের সঙ্কলন। নাটকগুলো হলো পলাশীর পথে, পলাশী, পলাশীর কান্না, অন্ধ রাতের ডাক, মন্বন্তর, বিদ্রোহ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রেনেসাঁ, বাঁশের কেল্লা, ঝড়ের ডাক এবং ঝড়ের রাতে। পলাশীর পথে নাটকে ইংরেজ বণিকদের দিল্লীর শাহী দরবার থেকে সুবে বাঙ্গালায় বাণিজ্য করার ফরমান লাভ, নবাব মুর্শিদকুলী খানের দক্ষ শাসনকার্য, হিন্দু জমিদারদের উৎপত্তি, আলিবর্দীর শাসন ক্ষমতা লাভ, বর্গী দস্যুদের দমন, বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন, কোম্পানির কাউন্সিলর ও কর্মচারীদের গোপন লিপ্সা প্রভৃতি বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। আলীবর্দীর ইন্তেকাল এবং সিরাজউদ্দৌলার মসনদে আরোহনের মধ্য দিয়ে আলোচ্য নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, জগৎশেঠ, মীরজাফর, উমিচাঁদ, রাজাবল্লভ, রায়দুর্লভ, নন্দকুমারদের বিশ্বাসঘাতকতা, পলাশীতে স্বাধীনতাকামীদের পরাজয়, ইংরেজদের লুটপাটের চিত্র নিয়ে ‘পলাশী’ নাটকের কাহিনী আবর্তিত। পলাশি ট্রাজেডির পরবর্তী পরিস্থিতিতে মীরজাফরদের নামমাত্র নবাবী নিয়ে ‘পলাশীর কান্না’ নাটক রচিত। ‘অন্ধ রাতের ডাক’ নাটকে আমরা দেখতে পাই মীর কাসিমের নবাবী লাভ, ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া অধিকার, দেশিয় বণিকদের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থা, মীর কাসিম কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকদের ফাঁসি প্রদান, স্বাধীনতার জন্য মীর কাসিমের জীবনপণ প্রয়াস। ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষ নিয়ে রচিত হয় ‘মন্বন্তর’ নাটকটি। কোম্পানি আমলের কুখ্যাত ইজারাদার দেবী সিংহের অত্যাচার নির্যাতন এবং ফকির সন্যাসীদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ‘বিদ্রোহ’ নাটক রচিত। অর্থনৈতিক শোষণের লক্ষ্যে লর্ড কর্নওয়ালিসের জমি বণ্টনের নীল নকশা নিয়ে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নাটকটি রচিত। একই সাথে মুসা শাহ, পরাগল শাহ, বাল্কী শাহ, ভবানী পাঠক, চেরাগ আলী, মজনু শাহ প্রমুখ ফকির সন্যাসীদের আন্দোলন সংগ্রামের কাহিনী স্বার্থকভাবে ফুটে ওঠেছে আলোচ্য নাটকে। ‘রেনেসাঁ’ নাটক কোলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত নবজাগরণ ও আধুনিকতা, ইংরেজদের সহচর উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণি তথা বর্ণহিন্দুদের আবির্ভাব, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রত্যক্ষ মদদে খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং টিপু পাগলা, সোবাহান শাহ্ প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চেতনা নিয়ে আবর্তিত। সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের সংস্কার আন্দোলন এবং জমিদার কৃষ্ণদেব ও তার সহচর রামচন্দ্রের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নাট্যকার রচনা করেছেন ‘বাঁশের কেল্লা’। নীলকরদের অত্যাচার অবিচার, জমিদারদের দৌরাত্ম্য এবং ফরায়েজি নেতা দুদু মিয়ার প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রাম নিয়ে ‘ঝড়ের ডাক’ নাটক রচনা করেছেন নাট্যকার। ১৮৫৭ সালের জোয়ান-জনতার বিপ্লবে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ঈশ্বরী পাঁড়ে ও মঙ্গল পাঁড়ে এবং চট্টগ্রামে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মহাবীর হাবিলদার রজব আলী। এঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়েই লেখক রচনা করেন ‘ঝড়ের রাতে’ নাটকটি। মেঘলা রাতের তারা গ্রন্থটির শেষে লেখক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ সংযোজন করেন। ‘ইতিহাস কথা বলে’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে ১৮৫৭ সালের মহাঅভ্যুত্থানের প্রাণপুরুষ বাহাদুর শাহ জাফর, মৌলবী আহমাদুল্লাহ্ শাহ্, প্রিন্স আজিমুল্লাহ্ খান, ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আলী, অযোদ্ধার বেগম হাসরত মহল, লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া তোপী, বখত খান, শাহজাদা ফিরোজ শাহ্, রায়বেরেলীর খান বাহাদুর খান, বিহারের অমর সিং, কুমার সিং, মৌলবী ফজলে হক খায়রাবাদী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন। মেঘলা রাতের তারা গ্রন্থ সম্পর্কে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আশরাফ আলী মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘এ নাট্যগ্রন্থে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক বিস্তৃতকালের ঐতিহাসিক ঘটনা-পরিক্রমা বিধৃত হয়েছে। পলাশী বিপর্যয়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে এ মহাবিপর্যয়ের কারণ যেমন এ গ্রন্থে উঠে এসেছে, তেমনি এ বিপর্যয়ের পর সুদীর্ঘ এক’শ বছরব্যাপী সংঘটিত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোগ্রাহী ভাষায় বিবৃত হয়েছে।’ ৭

জমাদার দৌলত আলী এই দেশে এই জাতির জন্য জীবন দিয়েছেন পলাশির প্রান্তরে। দৌলত আলী একজন অখ্যাত সৈনিক। কিন্তু দেশমাতৃকার জন্য জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, দেশপ্রেমিকরা কখনও ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা’ দেয় না। পলাশিতে একটি তিন্তিড়ী ও বওলা বৃক্ষের ছায়াতলে তাঁর সমাধি। শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘… তাহা একজন মুসলমান জমাদারের সমাধিস্তুপ। মুসলমান বীর সম্মুখ-সংগ্রামে সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন রক্ষার জন্য প্রাণপণে অস্ত্র চালনা করিয়া অবশেষে চিরনিদ্রায় অভিভূত হইয়াছেন। প্রতি বৃহস্পতিবারে বাঙ্গালী কৃষান-কৃষানরা তাহার উপর ভক্তি ভরে ফুল ফল তন্ডুলকনা ‘সিন্নী’ প্রসাদ করিয়া এখনও সেই পুরাকাহিনী সঞ্জীবিত রাখিয়াছে।’ ৮ মরহুম আসকার ইবনে শাইখ তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে রচনা করেছেন নাটক ‘দৌলত আলীর সন্তানেরা’। এছাড়া ‘পলাশী ও পলাশীর কান্না’ নাটকেও তাঁর চরিত্র স্বার্থকভাবে ফুটে ওঠেছে।

উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও স্বাধীনতার ইতিহাসে মুসলিম মহিলাদের অবদান অনেক। স্বাধীনতার প্রত্যাশায় নিজেদের অর্থ সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন এবং বুকের ধন ছেলে মেয়েদেরকে জিহাদের ময়দানে পাঠিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছেন দেশ ও স্বজাতির মুক্তির জন্য। ইতিহাসের পাতায় সেইসব মহান নারীদের অনেকেরই নাম নেই। অথচ তাঁদের মহাত্যাগের কাহিনি সত্যি। সেই সব জানা অজানা ১২ জন মহিয়সী নারীকে নিয়ে ড. শাইখ রচনা করেছেন ঐতিহাসিক নাটক কন্যা জায়া জননী। শিরোনামগুলো হলো – নাম না জানা মা, কবি রহিমুন্নেসা, নবাব নন্দিনী যীনাতুন্নেসা, গদীনশীন বেগম, সিরাজ বেগম লুৎফুন্নিসা, সিরাজ দুহিতা, ফরহাদ বানু, মন্নুজান, সুলতানা রাজিয়া, চাঁদ সুলতানা, মহিলা নবাব এবং বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। শিরোনামই বলে দেয় নাটকের বিষয়বস্তু।

আসকার ইবনে শাইখের একটি বিখ্যাত মঞ্চনাটক ‘অগ্নিগিরি’। এই নাটকের মাধ্যমে লেখক দেশের জনগণকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফকির বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী মজনু শাহ। বিদেশি শক্তির অত্যাচারের মোকাবেলা করতে দেশপ্রেমিক সংগ্রামী কর্মীদের উদ্ভব ঘটে। তাঁরা ইংরেজ শোষকের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বিদ্রোহী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। এইসব মু্িক্তযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফকির মজনু শাহ। অতীতের সেই মহামানুষটির কৃতিত্ব নাটক আকারে তুলে ধরে ড. শাইখ একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৮৫৭ সালের মুক্তিসংগ্রামে গর্জে ওঠেছিলো এদেশের আমির, বণিক, কৃষক, সিপাহি, দিনমজুরসহ সকল শ্রেণি পেশার নাগরিক। সেই মহাঅভ্যুত্থানের চেতনাকে উদ্বেলিত হয়ে ড. শাইখ রচনা করেন মঞ্চ নাটক রক্তপদ্ম, অনেক তারার হাতছানি এবং গল্পগ্রন্থ কালো রাত তারার ফুল। প্রিন্স আজিমুল্লাহ খান, শাহ আহমাদুল্লাহ সুফী, মুহাম্মদ আলী খান, হযরত মেহরাব আলী শাহ, হাবিলদার রজব আলী, পীর আলী, মৌলবী এলাহি বকস, বেগম হাসরত মহল, ওয়াজেদ আলী শাহ, শাহজাদী কুলসুম যমানী, সফর আলী খানসহ অসংখ্য জানা অজানা মুসলিম বীরদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে রচিত এসব নাটক ও গল্প। ১৮৫৭ সালের ১ লা আগস্ট ঈদ-উল-আজহার দিনে উজনালয় ২৩৫ জন নিরস্ত্র মুসলিম সিপাহীকে হত্যা করে ইংরেজ পিশাচ ফ্রেডারিক কুপার ও তাঁর এদেশিয় দোসররা। উল্লেখ্য ২৮২ জন সিপাহীকে উজনালার পুলিশ স্টেশনে একটি ছ্ট্টো কুঠুরিতে বন্দী করা হয়। এঁদের মধ্যে ৪৭ জন জন প্রচন্ড গরমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আর বাকিদের প্রতিবারে ১০ জন সিপাহিকে দঁড়িতে বেঁধে কুপারের আদেশে গুলি করে হত্যা করে শিখ সৈন্যরা। এইসব হতভাগ্য শহিদদের স্মরণে রচিত হয় বেতার নাটক ‘এমনি এক বকরীদে’।

ইসলামি চেতনায় অভিসিক্ত, মহানবি (সঃ) এর আদর্শ সংগ্রামের প্রতি অনুরক্ত নাট্যকার ড. আসকার ইবনে শাইখ তাঁর কর্মময় জীবনে ইসলাম থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাইতো আমরা দেখতে পাই, ঐতিহাসিক বদরযুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ, মক্কা বিজয়, ইমাম হোসাইনের শাহাদাত, সালাহউদ্দিন আইয়ুবির স্বাধীনতা সংগ্রাম এর ঘটনার নাট্যরূপ দিয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে এর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই।

৬২২ সালে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাজিত কুরায়েশ বাহিনীর ৭০ জন সদস্য বন্দী হয়। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মহানবি (সঃ) এর মহানুভবতা নিয়ে রচিত হয় ‘মুক্তি অভিনব’ নাটক। মহানবি (সঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ও আবু সুফিয়ানের মুশরিক বাহিনীর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬২৬ সালে। এ যুদ্ধে কাফের, মুশরিক, ইহুদি ও বেদুইনদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। আর মুসলিম মুজাহিদদের সংখ্যা ছিলো মাত্র আড়াই হাজার। যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের বাহিনী পরাজিত হয়ে মক্কায় ফিরে যায়। এই খন্দকের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ড. শাইখ রচনা করেন ‘প্রতিধ্বনি’ নাটক। এ প্রসঙ্গে নাট্যকার লিখেছেন, ‘কিন্তু খন্দকের যুদ্ধকে তুলে ধরাই এ রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের জন্য, পতিত অবদমিত দিশাহারা মানুষের জন্য, রহমাতুল্লিল আলামীন নবীজী মুহাম্মদ (সঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত পুর্ণাঙ্গ দ্বীন বা জীবন বিধান যে ইসলাম, তারই চিরশ্বাশ্বত আহ্বানকে তুলে ধরা।’ ৯ ইসলামী বিপ্লবের কাহিনি নিয়ে রচিত লেখকের আরেকটি নাটক ‘মহাবিজয়’। নবি করিম (সঃ) এর মক্কা বিজয়কে কেন্দ্র করে এটি রচিত। মুসলিম মিল্লাতের মহামিলনমেলা হজ্জ ও কুরবানি নিয়ে লেখক সৃষ্টি করেন ‘বান্দা হাজির আল্লাহ’ নাটকটি।

কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের শাহাদাত এবং ইয়াজিদ বাহিনীর নৃশংসতা ও উল্লাস নিয়ে রচিত হয় ‘দান্তে কারবালা’ নাটকটি। ক্রুসেডের দ্বিতীয় পর্যায়ে চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন গাজি সালাহউদ্দিন ইউসুফ আইয়ুুবি। ১১৮৭ সালে সুলতান তাঁর মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে ক্রুসেডারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয় হিত্তিনের প্রান্তরে। হিত্তিনের প্রচন্ড যুদ্ধে বিজয়ী মুজাহিদরাই পুনর্দখল করে নেয় জেরুযালেম। এই ঘটনা নিয়ে ড. শাইখ রচনা করেন বেতার নাট্য ‘এক সিংহের জাগরণ’।

অষ্টম শতকের শুরুতে রাজা রডারিক স্পেনকে নরক রাজ্যে পরিণত করেছিলো। মানুষের জীবন ও নারীদের মান সম্ভ্রম নিয়ে সে হোলিখেলায় মেতে ওঠে। ইহুদিদের ওপর চালিয়েছিলো নির্যাতনের স্টিমরোলার। মানবতা সেখানে লুন্ঠিত হচ্ছিল চরমভাবে। সেই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে তারিক বিন যিয়াদ ৭১২ সালে রাজা রডারিককে পরাজিত করে স্পেনের মাটিতে শান্তির পতাকা উড্ডীন করেন। আন্দালুসিয়ায় ইসলামের ইতিহাসের এই গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা এবং রডারিক-ফ্লোরিণ্ডা-ফোনিস-জুলিয়ান ও অত্যাচারিত ইহুদিদের বিদ্রোহ নিয়ে ড. শাইখ রচনা করেন ঐতিহাসিক নাটক ‘কর্ডোভার আগে’। আন্দালুসিয়ায় প্রায় ৮০০ বছর মুসলমানরা রাজত্ব করে। স্পেনের মাটি থেকে মুসলিমদের শেষ অধিকার খ্রিস্টানরা মুছে দেয় ১৫০২ সালে। রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা মুর মুসলমান নিধনের শেষ ‘কর্তব্য’টুক পালন করে। স্পেনের মুসলমানদের রক্ষায় খ্রিস্ট অপশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের অবতীর্ণ হয় মহাবীর মুসা। মুসার বীরত্ব ও মুসলিমদের বিষাদময় কাহিনি নিয়ে রচিত হয় ঐতিহাসিক নাটক ‘রাজপুত্র’।

আসকার ইবনে শাইখের আরেকটি বিখ্যাত নাটক রাজ্য রাজা রাজধানী। ইসলাম এদেশিয় জনসমাজের ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করে। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ন্যায়, উদারতা, মৈত্রির বানী ছড়িয়ে হিন্দু লাঞ্ছিত-প্রপীড়িত সমাজে মুক্তির সোনালী আশ্বাস এনেছিলো ইসলাম। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা হয়েছিলো ব্যাপক। বস্তুত ইসলামের মানবিক আবেদনে এদেশিয় জনসমাজের আলোকময় রূপান্তর ঘটে। ড. শাইখ সেই বিস্মৃত, চাপাপড়া সময় ও মানুষকে নাটকের মুখের আঙিনায় টেনে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারই স্বার্থক ফলশ্র“তি রাজ্য-রাজা-রাজধানী। মোট ১৪ টি নাটকের পরিসরে তিনি সেই বিশেষ সময়কালটির যে রূপরেখা প্রস্ফুটিত করেছেন একালে তার গুরুত্ব ও মূল্য অপরিসীম। এসব নাটকে লেখকের ইতিহাসনিষ্ঠা, স্বজাতিপ্রেমের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের উজ্জ্বল প্রকাশ মূর্ত হয়ে ওঠেছে। ১০

আসকার ইবনে শাইখ ঐতিহাসিক ছিলেন না বটে। তবে তাঁর প্রবন্ধরাজি ইতিহাসের নানা উপাদান এবং অজানা অনেক তথ্য উপাত্তে সমৃদ্ধ। ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া অজানা অনেক বিষয়কে হাজির করে অনুসন্ধিৎসুদের দৃষ্টিকে খুলে দিয়েছেন তিনি। কবি আবিদ আজাদ লিখেছেন, ‘আসকার ইবনে শাইখকে প্রশ্ন করেছিলাম- আজকের দিনে সামাজিক নাটক থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে আপনি ইতিহাসের প্রতি এত মনোযোগী হয়ে উঠলেন কেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ ইতিহাসের একটা অর্থ যদি ‘প্রাচীন বা অতীতের কথা’ হয়, তাহলে আজকের কথার সঙ্গে অতীতের কথার একটা যোগসূত্রকে অস্বীকার করা যায় না। আজকের সমাজের নানা সমস্যার কথা, বিশেষ করে আমাদের দেশে বিরাজমান সম্প্রদায়গত সম্পর্কের কথা, ভাবতে গিয়েই আমাকে অতীতের পানে তাকাতে হল। আমার জীবনের প্রথম অনেকটা অংশই কেটেছে হিন্দু সমাজের নিবিড় সাহচর্যে। তখনই হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন আমার মনে জাগে, বৃদ্ধি পায় এদেশের সামাজিক ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে স্বনামখ্যাত ভারতীয় চিন্তাবিদ মানবেন্দ্র নাথ রায়- এর ‘ The Historical Role Of Islam ’ পুস্তিকাটি এবং আরও কয়েকজন প্রগতিশীল লেখকের বইপত্র আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
তারপর কেটেছে বেশ কিছু সময়। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পরিণত বয়সে পা’ রেখেছি। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের ব্যাপারে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তাকে যতটা সম্ভব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেছি। তার সঙ্গে আরও জানার প্রয়োজন অনুভব করেছি। এর থেকেই প্রধানত আমার এই ইতিহাস মনস্কতা।’ ১১ ইতিহাসের অন্ধগলি হাতড়িয়ে তিনি মনিমুক্তাকে টেনে তুলেছেন অকুতোভয়ে। সত্য ও বাস্তবতাকে নিশঙ্কচিত্তে পাঠকের সামনে পেশ করেছেন। মাটি ও মানুষের কথা, সহসা নতুন ভোর, রঙধনুকের দেশে, স্বদেশ সমাচার, নামাকরণ সমাচার, বাঙালী জাতি, সংস্কৃতি সভ্যতার অভিযাত্রা ও ঈদুল ফিতর, চৈতন্য থেকে চেতনা, স্বাধীন স্বপ্নভূমি ও স্বীয় সাংস্কৃতিক কথা, স্বাধীন স্বপ্নভূমি ও সাম্প্রদায়িকতা, বাংলাদেশের বহমান সংস্কৃতি ধারা, স্বাধীন সুলতানী আমলে বাঙ্গালার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা, কতিপয় পর্যটক ও লেখকের দৃষ্টিতে সুলতানী আমলের বাঙ্গালা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশী বিপর্যয়, মীর জাফরী নবাবী এবং, স্বাধীনতাকামী নবাব মীর কাসিম শীর্ষক নিবন্ধসমূহ তাঁর ইতিহাস সচেতনতার পরিচয় বহন করে।

ইতিহাসখ্যাত দুর্দমনীয় তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি ১২০৫ সালের ১০ মে (১৯ রমযান ৬০১ হিজরি) নদিয়া অর্থাৎ লক্ষ্মণাবতী অধিকার করেন। ১২ একই সাথে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মুসলিম যুগের সূচনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে ড. শাইখ লিখেছেন, ‘বাঙলায় মুসলিম রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ইখতিয়ার-উদ-দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই রাজ্যটি প্রতিষ্ঠার পরই বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন উপায়ে মুসলমানরা স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে এ রাজ্যে আসেন। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, নব প্রতিষ্ঠিত এ রাজ্যটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি মুসলমান সমাজের প্রয়োজন। এমনি একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ অবশ্যি ত্রয়োদশ শতকের বহু আগেই আরম্ভ করেছিলেন এদেশে আগত সুফি-দরবেশগণ। তাঁদেরই মাধ্যমে ইসলামের বাণী বাঙ্গলার সজল মাটি স্পর্শ করেছিল সপ্তম শতকেই। পরবর্তীতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ত্বরান্বিত হয়ে ওঠেছিল মাত্র।’ ১৩

‘মুসলিম আমল বাংলার শাসনকর্তা’ ড. শাইখের অসাধারণ গবেষণাকর্ম। ১২০৫ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত সাড়ে পাঁচশ’ বছরের মুসলিম শাসনের ওপর সংক্ষিপ্ত অথচ একটি প্রামাণ্যগ্রন্থ। বখতিয়ার খিলজী থেকে সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ের ৯৪ জন শাসনকর্তার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত দুশ বছর ছিলো স্বাধীন বাঙ্গালা। সুলতান ফখর-উদ-দীন মুবারক শাহ্ (১৩৩৮-১৩৪৯) ছিলেন স্বাধীন বাঙ্গালার প্রতিষ্ঠাতা। শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন গিয়াস-উদ-দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮)। ১৫৩৮ সালে পাঠান বীর শের খান বাঙ্গালা জয় করেন। শুরু হয় বাঙ্গালায় আফগান শাসন। ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত আফগানরা স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করেন। ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে আফগান নেতা দাউদ খান কররানি মুঘল সেনাপতি খান ই জাহানের কাছে পরাজিত হয়। শুরু হয় মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে সুবে বাঙ্গালা। এ ঘটনার ১৮১ বছর পর পলাশিতে চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা হারায় বাংলাদেশ। ১৭৫৭ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ১০ জন নবাব নাজিম নামমাত্র দায়িত্ব পালন করেন। এরা মুলত ছিলেন রাজনৈতিক যাত্রামঞ্চের ভার। মূল ক্ষমতা ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ইতিহাসে এ সময়টা ‘মুর্শিদাবাদ নাজিমি’ আমল নামে পরিচিত। আসকার ইবনে শাইখ সংক্ষেপে উক্ত ১০ জন কথিত নবাবের দায়িত্ব ও ক্ষমতার ওপর আলোচনা করেছেন। মধ্যযুগের বাঙ্গালার সুফী সাধকদের জীবনী ও কর্মের ওপরও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে আলোচ্য ইতিহাসগ্রন্থে।

আসকার ইবনে শাইখের ইতিহাসের ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো গবেষণাধর্মী ‘ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত’। বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ দ্বিতীয় কোনো বই রচিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। পুস্তকখানা ক্রুসেডের হাজার বছরের ইতিহাসের একটি অমূল্য এ্যালবাম। ১০৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর পোপ দ্বিতীয় আরবান প্রাচ্য মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেন। খ্রিস্টান ইউরোপের ‘অর্বাচীন, বর্বর ও মূর্খ’ লোকেরা মুসলিম রাজশক্তিকে খতম এবং মুসলিমদের নিধনের লক্ষ্যেই ক্রুসেড যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১০৯৮ সালে ওরা এন্টিয়ক দখলে নিয়ে সেখানে ১০ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। ১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখল করে ভয়ঙ্কর এক রক্ত স্নানের মধ্য দিয়ে। ক্রুসেডাররা ফালি ফালি করে কেটে ফেলে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে। তলোয়ারের নাগালের মধ্যে কেউ রেহাই পায়নি। মুসলিমদের লাশে আবৃত রাস্তা দিয়ে পায়ের গোড়ালি সমান রক্তধারা পেরিয়ে অতিকষ্টে হেঁটে যেত ক্রুসেডাররা। মুসলিম নিধনের সেই বর্বর দৃষ্টান্ত আজও ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, চেচেন, কসোভা, ভারত, কাশ্মীর, মায়ানমার ফিলিপাইন, আলবেনিয়ায় লক্ষ্যণীয়। ১১৮৭ সালের ২ জুলাই গাজি সালাহউদ্দিন আইয়ুবি খ্রিস্টান ক্রুসেড জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আস্তানা গুড়িয়ে দিয়ে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন।

খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা আরব দুনিয়ায় পরাজিত হলেও তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পরে রক্তের নেশায়। কলম্বাস, ভাস্কো দা গামা, উইলিয়াম হকিন্স, লর্ড ক্লাইভ, রাজা ফার্দিনান্দ, রানী ইসাবেলা, নেহেরু, বাল গঙ্গাধর তিলক, প্যাটেল, বল থ্যাকার, গান্ধি, মাওসেতুঙ, জন মেজর, বুশ, ব্লেয়ার, বারাক ওবামা, ফাত্তাহ সিসি, নরেন্দ্র মোদি, অংসান সূচি, নেতানিয়াহু সকল সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রই ক্রসেডারদের প্রতিচ্ছবি। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়- তখন ক্রুসেডের অন্তর্ভুক্ত ছিলো শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায়। বর্তমানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী এ ত্রিশক্তি মিলে ক্রুসেডের পতাকা বহন করছে। ড. শাইখের চোখে বিষয়টা ধরা পরেছে এভাবে, ‘১০৯৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জারি ছিলো খ্রিস্টশক্তির আরম্ভ করা এই ক্রুসেড এবং তারই জবাব হিসেবে মুসলিম শক্তির জেহাদ। প্রথম পর্যায়ে খ্রিস্টানরা বিজয়ী হলেও পরবর্তী দুটি পর্যায়ে জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিজয়ী হয় মুসলিম শক্তি।
১২৯১ খ্রিস্টাব্দের পরেও জারি ছিলো এই ক্রুসেড, যদিও তার উত্তেজনা তখন নিঃশেষ প্রায়। ইতিহাসে সেসব ক্রুসেড ‘পরবর্তী ক্রুসেড’ নামে অভিহিত; আর তাতেও পরাজিত হয় খ্রিস্টশক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম শক্তি এই বিজয়ের ফসল ঘরে তুলে সমৃদ্ধশালী হতে পারেনি; বরং বিজিত খ্রিস্টানরাই রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূর্যালোকে স্নাত হয়ে বিভূষিত হল নবযুগ স্রষ্টার গৌরবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, খ্রিস্টানদের করায়ত্ব এই নবযুগে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-কৌশলে-শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তারা মুসলিম প্রতিপক্ষকে ধ্বংসের নবতর উপায় উদ্ভাবনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যংশের এই ভারতবর্ষেও তারা ছুটে আসে নিজ স্বার্থ উদ্ধার ও বহুকালপোষিত মুসলিম বিদ্বেষ চরিতার্থের লক্ষ্যে। মুসলিম শক্তির অযোগ্যতা ও চরিত্রহীনতার সুযোগে তারা সে লক্ষ্য অর্জনে সফলও হয়। ভারতবর্ষে মুসলিম মুঘল শক্তিকে ধ্বংস করে তারা ভারতবর্ষের অধিশ্বর হয়ে বসে। ইউরোপিয় খ্রিস্টশক্তির এসব কর্মকাণ্ডকেই আমরা চিহ্নিত করেছি ‘আরও পরবর্তী ক্রুসেড’ রূপে।
একেবারেই হালে আমরা পৃথিবীময় কি দেখতে পাচ্ছি? বসনিয়ায়, ফিলিস্তিনে, কাশ্মীর ও ভারতের নানাস্থানে এবং পৃথিবীর অন্যান্য ভূভাগে? মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান-ইহুদি-ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির এসব কর্মকাণ্ড কি সেই ক্রুসেডকেই স্মরণ করিয়ে দেয় না?’ ১৪

হদিস :
১. আসকার ইবনে শাইখ, বাংলা মঞ্চ নাট্যের পশ্চাতভূমি, সাত রং প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ১৪৮ (কভার পেজ, লেখক পরিচিতি প্রসঙ্গে)
২. আসকার ইবনে শাইখ, বাংলা মঞ্চ নাট্যের পশ্চাতভূমি, সাত রং প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, একুশে ফেব্র“য়ারি, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ৮০
৩. উদ্বৃতি- মুহাম্মদ মতিউর রহমান, নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ, মাসিক অগ্রপথিক, জুলাই ২০০৯, ২৪ বর্ষ, সংখ্যা ৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃ ৩৮
৪. আসকার রচনাবলী ২, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯২, পৃ ১৩৫
৫. আসকার রচনাবলী ১, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯২, পৃ ৭৫
৬. আসকার ইবনে শাইখ, মেঘলা রাতের তারা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০০৩, পৃ ৭
৭. আসকার ইবনে শাইখ, মেঘলা রাতের তারা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০০৩, পৃ ৫
৮. শ্রী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সিরাজদ্দৌলা, দিব্য প্রকাশ, একুশে ফেব্র“য়ারি ২০০৩, পৃষ্ঠা ২১২
৯. আসকার রচনাবলী ৮, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পৃ ১০
১০. আসকার ইবনে শাইখ, রাজা রাজ্য রাজধানী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০০৫, পৃ ৬
১১. আসকার রচনাবলী ৪, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, পৃ ৪
১২. সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস (১২০৪-১৫৭৬), খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, এপ্রিল ২০০০, পৃ ১১, ২৪
১৩. আসকার রচনাবলী ৭, আবিদ আজাদ ও মাহবুব হাসান সম্পাদিত, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পৃ ২৬০
১৪. ড. আসকার ইবনে শাইখ, ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত, মদীনা পাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২, পৃ ৬-৭

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : কোন পথে আমরা?

সাবরিনা শুভ্রা ।।

প্রশ্ন হচ্ছে সংস্কৃতি কী? বলা যায়, কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষা-দীক্ষাÑ এ সবই সংস্কৃতি। তাই বলা হয়ে থাকে, কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে জানতে হলে তার সংস্কৃতির দিকে তাকালেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হচ্ছে, একটি জাতি বা রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি অন্য একটি জাতি বা রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেয়া। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আধুনিক সভ্যতার একটি বড় অভিশাপ। আজকাল সংস্কৃতি শব্দটির পাশে যোগ হচ্ছে আকাশ সংস্কৃতি। মূলত কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে টিভি চ্যানেলগুলোর বিশ্বব্যাপী প্রচারকেই আকাশ সংস্কৃতি বলা চলে।

আমাদেরও আছে গর্ব করার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। কিন্তু ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে আজ সুকৌশলে কোণঠাসা করছে। এককথায়, দিনে দিনে বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষায় দায়িত্বশীলরা যে উদাসীন। তারা কি এমনটি ভাবেন না যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে না পারলে একদিকে যেমন হারিয়ে যাবে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি, তেমনি আমরা পিছিয়েও পড়ব।

আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে যেভাবে বিদেশি, বিশেষ করে ভারতীয় সংস্কৃতির মোড়কে বাস্তবতাবিবর্জিত কাল্পনিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টিকারী সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। তাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে খুব বেশি দেরি আছে বলে মনে হয় না। বলতে চাচ্ছি, ভারতের ফেনসিডিল আগ্রাসনে আমাদের যুব সমাজ শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার পর এবার দেশটির একাধিক টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে রীতিমতো মগজ ধোলাই হতে চলেছে এই জাতির। জন্মপরিচয় আর নামে মুসলমান হলেও আচার-আচরণে, ভাবনা-চিন্তায় আমরা কেন ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হয়ে পড়ছি? তাহলে কি ‘স্বকীয়তা’ বলতে আমাদের কিছু থাকবে না? আমরা কি ভারতীয় সিরিয়াল নির্মাতাদের টার্গেট হয়েই বাঁচব? না, তা হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়।

বলতে দ্বিধা নেই, ভারতীয় এসব চ্যানেলের কারণে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো আজ হুমকির মুখে। বলা যায়, ভারতীয় চ্যানেলের চাপে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো যেন নিজেদের হারিয়ে খোঁজার উপক্রম। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় সংস্কৃতি। আমাদের বাচ্চারা এখন মায়ের ভাষা বাংলা শেখার আগেই হিন্দিতে কথা বলা রপ্ত করে ফেলছে! আর এটি হচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কারণে। তাদের সিরিয়ালগুলোয় এমন কিছু শিশু চরিত্র দেখা যায়, যেগুলো শিশু চরিত্র হলেও তাদের সংলাপ, আচরণ ও মুখভঙ্গির মধ্যে সামান্য হলেও শিশুসুলভ কিছু থাকে না। উদ্বিগ্ন হতেই হয় যখন দেখি, শিশুদের দিয়ে হিংসা, ঈর্ষার প্রতিযোগিতামূলক আচরণের অভিনয় করানো হচ্ছে। এতে কি শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না? এসব সিরিয়াল দেখে আমাদের শিশুরা কী শিখছে? তাদের ওপর কি এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না? আমরা কি ভুলতে বসেছি যে, শিশুরা সুষ্ঠু সংস্কৃতির চর্চা করলে সেটা তার সঠিক মেধাবিকাশে কাজে লাগবে। আর সঠিক মেধাবিকাশের মাধ্যমেই একটা শিশু নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে? তাহলে আমাদের সমাজে দিন দিন সুষ্ঠু সংস্কৃতিচর্চা কমে যাচ্ছে কেন? এ নিয়ে কি রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মুক্তবাজারের কল্যাণে আমাদের দেশে ভারতীয় স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা, জিটিভি, স্টার ওয়ান, সনি, জি স্মাইল, ইটিভিসহ ভারতের ডজন তিনেক চ্যানেল দেখানো হচ্ছে। যদিও বিটিভিসহ আমাদের দেশের ৩০টির বেশি টিভি চ্যানেল রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ এর একটিও কি ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যে সম্প্রচারিত হয়? ভারতে আমাদের চ্যানেল প্রচারিত না হওয়ার জন্য কি আমাদের টিভি অনুষ্ঠানের নিম্নমান দায়ী? আমি অন্তত তা মনে করি না। কেননা আমাদের দেশের টিভিতে যেসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, তা শুধু গতানুগতিক সংস্কৃতির চর্চাই নয়, বরং শিক্ষামূলকও। তাহলে কি বলা যায় না, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অগাধ ও প্রবল শ্রদ্ধাবোধই ভারতে আমাদের চ্যানেলগুলো প্রচার না হওয়ার প্রধান কারণ? তাহলে আমরা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি উদাসীনÑ এমন মন্তব্য করা যায় না?

এবার আসছি সূত্র ঠিক রেখে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে। ঈদের সময়ের কথা বলি। মাসখানেক আগে থেকেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঈদ কেনাকাটায়। দেখা যায় রাজধানীর সব স্তরের মার্কেট থেকে শুরু করে বিভাগ-জেলা-উপজেলা পর্যায়ের মার্কেটগুলো ছেয়ে যায় বাহারি নামের ভারতীয় পোশাকে। এসব পোশাক বিক্রি হয় দেদার। নিঃসন্দেহে গভীর উদ্বেগের বিষয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের ঈদের কেনাকাটায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো। সেটা কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝা যায় যখন শুনি, কোনো মেয়ে আত্মহত্যা করেছে তাকে পছন্দের ‘পাখি’ কিংবা ‘কিরণমালা’ পোশাক কিনে না দেয়ার কারণে। আরও শুনেছি, স্বামী তার স্ত্রীকে ভারতীয় সিরিয়ালের পছন্দের পোশাক কিনে না দেয়ায় স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেয়ার ঘটনা। তাহলে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালগুলোর কুপ্রভাব মহামারী আকার ধারণ করার আগেই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন নয়? কিন্তু কথা থেকে যায়Ñ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তবে সাহস করে কেউ বাঁধতে পারলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে নিশ্চয়ই। আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা যা কিছু নিজেদের সংস্কৃতি বলে ঘোষণা করব বা মেনে চলব, তা হওয়া চাই রুচিপূর্ণ, নান্দনিক ও সুন্দর। অন্যদের অনুকরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের সংস্কৃতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সেই সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিমনাও হতে হবে। কেননা সংস্কৃতি জাতির প্রাণ। জাতির প্রাণ রক্ষার দায়ও যে আমাদেরই।

সাবরিনা শুভ্রা
গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক